কলকাতার দিনগুলি
পঞ্চম পর্ব
পরবর্তী আকর্ষণ ছিল নন্দন। বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসি কলকাতার এই সাংস্কৃতিক পাড়ায়। নন্দনে দেখলাম প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিপ্রদর্শনী—তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্বে তোলা বিভিন্ন রকম ছবি। আগে থেকেই জানতাম, তাঁকে ভক্তরা মোহরদি বলে ডাকে; রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং মোহরদির ছোটবেলায় তাঁকে গান শিখিয়েছিলেন। তাই একটু উৎসাহী হয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগলাম।
তিন বছর আগে প্রয়াত এ শিল্পী যৌবনে রূপে-গুণে ওই সময়কার বাঙালি যুবকের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিলেন; অনেকে তখন শান্তিনিকেতনে যেতেন শুধু মোহরদির কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনবেন বলে—এসব জানতে পেরেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীতে। সেই ষাটের দশকের এ নামী শিল্পীর ছবিপ্রদর্শনী বেশ উপভোগ করলাম।
বাইরে পোস্টার দেখে একটি তেলেগু ছবি দেখার জন্য প্রবেশ করতে যাব, হঠাৎ চোখে পড়ে বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর লাইব্রেরিয়ান স্বপনদার কাছে, যাঁর সঙ্গে বন্ধু সুশানের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল, শুনেছিলাম তসলিমা তখন স্থায়ীভাবে থাকেন কলকাতায়। তাই ততটা অবাক হইনি। উপযাজক হয়ে কথা বলতে যাব, তৎক্ষণাৎ তিনি দলবল নিয়ে উঠে পড়লেন লিফটে। আমরা গেলাম পরের লিফটে।
ওপরে উঠে দেখি তসলিমা হাওয়া। ভেবেছিলাম দেখা হলে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করব। তিনিও হয়তো জানতে চাইবেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির কথা। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। কোথায় খুঁজব আর!
অগত্যা চলে এলাম আমাদের নির্ধারিত অডিটরিয়ামে। খুব সুন্দর একটি তেলেগু ছবি দেখলাম। তেলেগু ছবি দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু এই ছবিটি আমাকে বিস্মিত করে। এককথায় অসাধারণ! একটা ভালো ছবির যেসব বিষয় থাকা প্রয়োজন, তার সবই ছিল ছবিটিতে।
নন্দনের একপাশে শিশিরমঞ্চ এবং অন্যপাশে রবীন্দ্রসদন। এই এলাকাটিকে বলা যায় কলকাতার সাংস্কৃতিক বলয়। রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথের বিশাল এক স্ট্যাচু। সেই স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে ছবি তুললাম।
প্রবেশপথে যেতেই জানা গেল, রবীন্দ্রসদনে পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কাব্যের নাট্যরূপ দেয়া একটি নাটক মঞ্চস্থ হবে এখানে। নাটকটি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু টিকিট পেলাম না। সুযোগ না পেয়ে খুব হতাশ হলাম। মনে হলো, আজ পদে পদে ব্যর্থতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
একই চৌহদ্দির মধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। বইমেলা চলছে আকাদেমির প্রাঙ্গণজুড়ে। হাজার বছরের বাংলা কবিতা এবং বাংলা ছোটগল্পের কথা নামক দুটি বই মেলা থেকে খুব অল্প দামে কিনে নিলাম। সেখানে দেখা পেলাম বিশিষ্ট কয়েকজন বাঙালি লেখকের। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ, মহাশে^তা দেবী, নবনীতা দেবসেন ও আরো অনেকে। আরো ছিলেন বিখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ ও জয় গোস্বামী। তাঁরা সবাই ছিলেন মঞ্চে উপবিষ্ট। কিছুক্ষণ তাঁদের মুখের অমিয়বাণী শ্রবণ করলাম।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নয়টা পর্যন্ত থেকে আমরা চলে এলাম দেবাশীষদার দোকানে। গল্পে-আড্ডায় আরো কিছুক্ষণ সময় কাটাই। পেট ভরে খাই কলকাতার বিখ্যাত ‘চাউমিন’। তারপর দেশপ্রিয় পার্কে চারজন মিলে আরো অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা দিই। আড্ডা যেন কিছুতে শেষ হয় না। সঙ্গে চলেছে ভাঁড়ের চা আর সিগারেট। এদিকে রাত বাড়ছে। হোটেলে তো ফিরতে হবে। পাশেই বালিগঞ্জে আমাদের হোটেলে। পদব্রজে ফিরতে ফিরতে বাজল রাত ১১টা।
ট্রামে বা বাসে চড়ার সময় একটি ব্যাপার আমাকে ভীষণ অভিভূত করত। সেটা হলো প্রতিটি রাস্তার নামকরণ। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে রাস্তাগুলোর নাম। যেমন রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, গুরুসদয় স্ট্রিট, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (এপিসি) রোড, সূর্য সেন স্ট্রিট, রবীন্দ্র সরণি, বিবেকানন্দ রোড, বিধান সরণি, মহাত্মা গান্ধী রোড, বাঘা যতীন, বিবাদী বাগ (বিনয়-বাদল-দীনেশ), যতীন দাস পার্ক।
ভাবি, এই মানুষগুলো তো আমাদের ইতিহাসেরও অংশ। বেশির ভাগই ব্রিটিশ যুগের বাঙালি বিপ্লবী, যাঁরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। আজকের বাংলাদেশ তো সেই ভারতবর্ষেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সে হিসেবে এঁরাও তো আমাদের বীর। সূর্য সেন চট্টগ্রামের সন্তান বলে তাঁকে আমরা যতটা গুরুত্ব দিই, অন্যদের বিষয়ে আমাদের মনোভাব অনেকটাই ভিন্ন রকম। এমনকি সুভাষচন্দ্র বসু কিংবা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নামে পর্যন্ত আমরা কোনো জাতীয় স্থাপনার নাম করিনি।
ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি বলেই হয়তো আমাদের এই পরিণতি। আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সেই সব বীরপুরুষের কি কোনো অবদান নেই? আমরা কি অস্বীকার করতে পারব ইতিহাসের ধারাবাহিকতা? ’৪৭-এর গা বেয়েই তো এসেছে ’৭১। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত আমাদের অভিন্ন ইতিহাসকে মনে মনে কুর্নিশ জানাই।
নামগুলো দেখলে আমার বুকের মধ্যে স্পন্দন শুরু হতো এজন্য যে, বড় মাপের মানুষের প্রতি তাঁরা, মানে রাজ্যের আইনপ্রণেতারা কতটুকু শ্রদ্ধাশীল। এখানকার শিশুরা পথ চলতে চলতে দেশের বীরপুরুষদের নাম জেনে যায়। কারো কারো মধ্যে হয়তো জেগে ওঠে তেমন বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্ন আর অভিলাষ।
এসব দেখে কলকাতাকে আমার মনে হচ্ছিল দ্বিতীয় প্যারিস। কারণ শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান প্যারিস সম্পর্কে অন্নদাশংকর রায়ের লেখা পড়ে এরকমই একটা ধারণা পেয়েছিলাম। দুঃখ হচ্ছিল এ জন্য যে, আমরা ঢাকাতে আজও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে সব রাস্তার নামকরণ করতে পারিনি। কী দুর্ভাগ্য আমাদের!
সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। খোকনকে ঘুমে রেখেই আমি একা নেমে পড়ি রাস্তায়। উদ্দেশ্য, অদূরে সার্কুলার রোডে সেই ঐতিহাসিক বাড়িতে যাওয়া, যেখানে ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় ছিল।
ফুটপাতের দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে একটি আদম রিকশা (মানুষে টানা রিকশা, আমাদের ঠেলাগাড়ির মতো) ঠিক করার জন্য রিকশাওয়ালাকে ডাকলাম। তার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারণ সে বলছিল হিন্দিতে। আমার হিন্দি-জ্ঞান নেই বললেই চলে। অনেক চেষ্টা করেও ভাষাটা রপ্ত করতে পারিনি।
চা-দোকানদার সাহায্যে এগিয়ে এলেন। বাংলায় জেনে নিলেন আমার গন্তব্য। তিনি রিকশায় যেতে বারণ করে বললেন—দাদা, ট্রামে করে গেলে আপনার সুবিধে হবে।
ট্রামের জন্য কে অপেক্ষা করে! পথের কথা জেনে নিলাম। তার কথামতো চললাম হেঁটে। পথ চলতে চলতে হঠাৎ আবিস্কার করলাম আমার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট। নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
২০০০ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন ঢাকায় এসেছিলেন, আমি তখন টিএসসির আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলনে বিশিষ্ট রবীন্দ্র-গবেষক ওয়াহিদুল হকের ছাত্র। ওয়াহিদুল হকের আমন্ত্রণে ওই সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কণ্ঠশীলনে এসেছিলেন এবং উপস্থিত সব শিক্ষার্থীকে ওনার কলকাতার বাসার ঠিকানা দিয়েছিলেন।
স্পষ্টভাবে বাড়ির গেটে লেখা—‘ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্স’, পারিজাত। ঠিকানাটা দেখামাত্র অন্য রকম অনুভূতি টের পেলাম মনের মধ্যে। এত প্রিয় মানুষের কাছাকাছি আমি! লালনের সেই বিখ্যাত গানটি মনে পড়ে—‘বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে…।’
একবার ভাবছি ভেতরে ঢুকব—দারোয়ানের কাছে পরিচয় দিয়ে লেখকের সঙ্গে দেখা করার কথা বলব। আবার সংকোচবোধ করে ঢুকলাম না। যদি তিনি আমাকে চিনতে না পারেন কিংবা প্রত্যাখ্যান করেন, তখন তো বিশ্রী ব্যাপার হবে। শুধু শুধু কষ্ট পাব। এমনিতে কলকাতার মানুষ সম্পর্কে ধারণা এরকম যে, তাঁরা যখন কলকাতার বাইরে যান তখন আন্তরিকতার কমতি থাকে না, খুব আপন করে নেন মানুষকে, কিন্তু কলকাতায় পাঁচ মিনিট সময় দিতেও নারাজ।
এমন মনে হওয়ার কারণও আছে। শান্তিনিকেতনে আনিস নামে জামালপুরের একটি ছেলের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। সে কলকাতা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ফোন নম্বর দিয়ে খুব করে বলেছিল, কলকাতায় এসে তাকে যেন ফোন করি; সে সময় দেবে আমাদের; ঘুরবে আমাদের সঙ্গে। কিন্তু কতবার তাকে ফোন করেছি, অথচ তার টিকির দেখাও পেলাম না।
(চলবে…)
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব