কলকাতার দিনগুলি ০৮


কলকাতার দিনগুলি


অষ্টম পর্ব


গড়ের মাঠে, যেখানে আগে রেসকোর্স হতো, হেঁটে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ রাস্তার পাশে বিশাল এক স্ট্যাচু দেখে থমকে দাঁড়াই। কাছাকাছি গিয়ে দেখি, স্ট্যাচুটি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। ফলকে বড় অক্ষরে লেখা নেতাজির বিখ্যাত উক্তি—‘Give me blood, I will give you freedom.’ আমার মনের মধ্যে দোলা দিল নেতাজির এই অতি প্রসিদ্ধ বাক্যটি। মাথা নত হয়ে এলো শ্রদ্ধায়।

এ বাঙালি বীরপুরুষ ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন রক্তের বিনিময়ে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতো স্বাধীনতা ভিক্ষা করে নয়। হিন্দু-মুসলমান সকলের সমর্থনে গঠিত আজাদ-হিন্দ ফৌজের এ শ্রদ্ধেয় নেতা হঠাৎ নিখোঁজ হন ভারতের স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো।

হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক নেতাদের (তথাকথিত নেতা যাঁদের কাছে ব্যক্তিগত স্বার্থই বড় ছিল) হাত থেকে ভারতকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁকে বিপ্লবের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। তিনি পেয়েছিলেন দল-মতনির্বিশেষে সব ভারতবাসীর সমর্থন। মনের মধ্যে তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা এ জন্য ছিল যে, এরকম নিঃস্বার্থ, অসাম্প্রদায়িক ও দেশপ্রেমিক নেতা বাঙালি তথা ভারতবাসীর মাঝে সত্যিই বিরল। কিছুক্ষণ নীরবে স্ট্যাচুটির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলাম।

শহরের মাঝখানে এত বিশাল মাঠ দেখে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ালাম। মনে পড়ে গেল বিখ্যাত দুটি কথা—‘আজ আমার পকেট গড়ের মাঠ’ এবং ‘গড়ের মাঠে ঘোড়ার গাড়ি গড়গড়াইয়া চলে’। জনশ্রুতি আছে, ভারতীয় কোনো রাজনৈতিক নেতা তাঁর জনসভায় এই মাঠ পরিপূর্ণ করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম রাজীব গান্ধী। গড়ের মাঠে কিছুক্ষণ হাওয়া খেয়ে নিউমার্কেটে চলে এলাম কিছু কেনাকাটা করব বলে।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সদর স্ট্রিটের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম টের পাইনি। রবীন্দ্রনাথের একটি ছোট ভাস্কর্য দেখে খোকনকে দাঁড়াতে বললাম। ফলকের ওপরে বড় বড় করে লেখা—সদর স্ট্রিটের ১০নং বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি। সঙ্গে সঙ্গে পাঠ শুরু করি— ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশিল প্রাণের পর/ কেমনে পশিল গুহার আধারে/ প্রভাত পাখির গান/ না জানি কেন রে এতদিন পরে/ জাগিয়া উঠিল প্রাণ।’

রবীন্দ্রভক্ত এই আমি জানতাম, তাঁর সব কবিতার প্রাণ এ বিখ্যাত কবিতাটি সদর স্ট্রিটেরই একটি বাড়িতে বসে লেখা। তখন তাঁর বয়স ২১ কি ২২! সেই দিন তাঁর ওপর বাংলার কাব্যদেবী দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বাংলা কবিতাকে পূর্ণতা দেয়ার। সেই যে শুরু আর থামেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাড়িটি পাইনি। অগত্যা ভাস্কর্যটির সামনে ছবি তুলে চলে এলাম নিউমার্কেটে।

সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটেছিল কালীঘাটে, যা মনে পড়লে আজও হাসি পায় আমার। মহীয়সী নারী মাদার তেরেসা প্রতিষ্ঠিত ‘নির্মল হৃদয়’ দেখার জন্য হেঁটে কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।

হঠাৎ একটি ছেলে আমাদের পথরোধ করে বলল—দাদা, বিশ টাকা দিলেই হবে; মাকে দর্শন করিয়ে পুজো দিয়ে দেব। চলুন, আমার দোকান থেকে প্রসাদ নেবেন। আমি যতবারই বলছি যে, আমি নির্মল হৃদয়ে যাচ্ছি এবং আমি হিন্দু নই, সে তত অনুরোধ করে চলছে। তাঁর ধারণা, আমরা হিন্দু হয়েও মিথ্যা বলছি। কীভাবে তাকে বোঝাই!

অগত্যা সে বিশ টাকা থেকে নেমে এলো দশ টাকায়। তবু আমার সম্মতি না পেয়ে পাঁচ টাকা চাইল। তাতেও রাজি না হওয়াতে দু’টাকা চাইল। আমি বিস্মিত হলাম ব্রাহ্মণের এ অবস্থা দেখে। এখানে ব্রাহ্মণ এত সস্তা! শুনেছি, এখানে অনেক নকল ব্রাহ্মণ আছে। যাহোক, পেটের দায়ে মানুষ তাঁর ধর্ম ও মূল্যবোধকে যে বিকিয়ে দিতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করে অবাক হই। খুব কষ্ট লাগে মনে। আমার দৃঢ়তা দেখে অবশেষে ছেলেটি পথ ছেড়ে দেয়।

পৌঁছে গেলাম মাদার তেরেসার অনেক ত্যাগ আর শ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠান ‘নির্মল হৃদয়ে’। ভেতরে ঢুকেই আমার চোখে জল এসে গেল আবেগে। রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় মানুষদের তুলে এনে সিস্টার ও ব্রাদাররা সেবা করে চলেছেন। কোনো দিকে তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই ব্যস্ত। আমার সঙ্গে কথা বলার কারো সময় নেই। অনেকক্ষণ পরে অনুমতি পেলাম প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার।

প্রশ্ন করে করে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করলাম। সেই ইংরেজ নারীর শান্ত-সৌম্য চেহারা এবং নম্র ব্যবহার দেখে আমার মাথা নত হয়ে এলো শ্রদ্ধায়। ত্যাগের এত বড় দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে! সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে মানুষের সেবা করার জন্য এঁরা ঘর-সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে এসেছেন এখানে। অনুভব করলাম, পৃথিবীতে যে এখনো মহৎ মানুষ আছে এঁরা তার দৃষ্টান্ত।

সন্ধ্যায় গেলাম টিটু ভাইয়ের কলকাতার বান্ধবী রঞ্জিতা বসু পিউর বাসায়। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, কলকাতা শহরের কোনো স্থানীয় লোকের বাড়িতে যাওয়ার, তাদের অভ্যন্তরীণ গার্হস্থ্য জীবন কাছাকাছি থেকে দেখার। পিউদি সেই সুযোগটি করে দেয়। অগত্যা তার আমন্ত্রণের প্রস্তাবে অসম্মতি জানাতে ব্যর্থ হই।

পিউদিকে বিকেলে ফোন করেছিলাম দেবাশীষদার দোকান থেকে। তখন তিনি বারবার তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ভাবলাম, যাই আর দেখে আসি কলকাতার মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাড়িটি পেলাম। একটি ত্রিতল বাড়ির দোতলায় তারা থাকেন। বাড়িটির মালিক তারাই। তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান।

জানতে পারি, তাদের আদি নিবাস ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। তার ঠাকুরদা ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন সাতচল্লিশের দেশভাগের পরপর। তার মা গল্পের ডালি খুলে দিলেন। আমাদের পেয়ে যে মাসিমা খুব খুশি হয়েছেন, তা প্রকাশ পাচ্ছিল অভিব্যক্তিতে; তিনি আবার বরিশালের মানুষ বলে জানালেন।

পিউদির বাবা অবিনাশ বসুকে খুব আমুদে মানুষ বলে মনে হলো; তিনি কখনো বাংলাদেশে আসেননি, তবে তাঁর বাবা পরমেশ বসুর মুখে ঢাকার বাড়িটি নিয়ে যা শুনেছিলেন তা আমাদের কাছে গভীর আবেগে প্রকাশ করলেন। সেই আবেগ স্পর্শ করে আমাকে। মনে মনে বলি, দেশভাগ কত মানুষকে যে বাস্তুচ্যুত করেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

কলকাতার মানুষ সম্পর্কে মিতব্যয়িতার যে উপমাটি স্বতসিদ্ধ, এনারাও তার ব্যতিক্রম নন। তা টের পেলাম অতিথি আপ্যায়নের নমুনা দেখে। আমাদের একটি করে মিষ্টি, অল্প কিছু চানাচুর এবং এক গ্লাস করে শরবত দিলেন। এমনকি রাতের খাবারের জন্য একবারও অনুরোধ করলেন না।

পিউদির সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। তিনি বারবার টিটু ভাইয়ের গল্প করতে চাচ্ছিলেন। বুঝতে পারলাম, তিনি টিটু ভাইকে অনেক ভালোবাসেন। ঢাকার মেসে টিটু ভাই থাকতেন আমার পাশের রুমে। তার কাছে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি জেনেছিলাম। সে এক রোমান্টিক গল্প।

তাদের দুজনের পরিচয় হয়েছিল চেন্নাইতে। টিটু ভাই গিয়েছিলেন তার বাবার চিকিৎসার জন্য। একই হাসপাতালে পিউদি তার বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই পারের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দুই বাঙালির পরিচয় চেন্নাইতে, অবাঙালির ভূমিতে। তারপর থেকে তাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। পরিণতির কথা না ভেবে তারা এগিয়ে গেছেন। পিউদির কাছে জেনেছি, টিটু ভাই কলকাতায় গেলে তাদের বাড়িতেই ওঠেন। বিষয়টা আমাকে অবাক করেছে বৈকি।

রাত দশটায় দেবাশীষদা আর বাদলদা আমাদের হোটেলে রেখে বিদায় নিলেন।

পরদিন ভোর পাঁচটায় সোহাগ পরিবহনে ঢাকার উদ্দেশে আমরা রওনা হলাম।

(সমাপ্ত)


প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব


বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

আপনার প্রেমিকা হতে চাই ও অন্যান্য কবিতা

মাহবুবা করিম-এর তিনটি কবিতা আপনার প্রেমিকা হতে চাই শুনেছি– পিথাগোরাসের মারপ্যাঁচ বোঝেন; ক্যামিস্ট্রি মোটেও বোঝেন না। অথচ কী না পিওর

গল্প

বিসর্জন

– হ্যাঁ, এটাই। বামে নামিয়ে দিন। রিকশাটা থামার আগে তার থেকে যেনো লাফিয়ে নামলো অল্পবয়স্ক একটি মেয়ে। চোখে ঝড়ের কবলে

গল্প

দুর্ঘটনা

দেলদ্বারভাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছে গিয়ে সোনার ঘড়িতে সময় দেখে নীরব। আরো তেরো মিনিট সময় আছে ট্রেনটি ছেড়ে দিতে। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে

গল্প

কংক্রিট

সিমেন্ট ঘাঁটতে এমন ভালো লাগে রঘুর। দশটা আঙুল সে ঢুকিয়ে দেয় সিমেন্টের স্কুপে, দু-হাতে ভরতি করে তোলে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে