কাগজের বউ: বোহেমিয়ান জীবনের গল্প


উপন্যাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত পাঠককে টেনে নেবার ক্ষমতা। পাঠক যত পড়বে ততই সে উপন্যাসটি শেষ করতে চাইবে। এই ক্ষমতা থাকলে সেটি একটি সফল উপন্যাস। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় গল্পের শুরুতে যতটা আকর্ষনীয় ক্রমেই সেই আকর্ষণ কমতে থাকে। সেক্ষেত্রে পাঠকের আকর্ষণ কমতে থাকে। বিপরীতে দেখা যায়, কোনো কোনো উপন্যাস পাঠককে ক্রমাগত ভেতরের দিকে টানতে থাকে। এমনও হয় পাঠক উপন্যাসটির শেষটা জানতে এতই আগ্রহী হয় যে সে দ্রুত পড়ে শেষ করে এবং পুনরায় খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে থাকে। এবং যতবারই বইটি পড়ে ততবারই পূর্বের মতোই পাঠের আকর্ষণ বজায় থাকে। আমার পড়া এরকম একটি উপন্যাস হলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘কাগজের বউ’ উপন্যাসটি। বইটি আমি কম করে হলেও পাঁচ-ছয় বার পড়েছি এবং প্রতিবারই একরকম টান অনুভব করেছি। প্রতিটি চরিত্র আমার কাছে নতুন মনে হয়েছে।

এরকম অনুভূতি আরও একটি উপন্যাস পাঠের ক্ষেত্রে হয়েছে বলে আমি মনে করতে পারি, সেটি হলো বিভূতিভূষণের  ‘আরণ্যক’। যাই হোক আমার আজকের লেখা ‘কাগজের বউ’ উপন্যাস নিয়ে। উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনায় লেখকের চরিত্র ‘উপল’ চরিত্রটি প্রাধান্য পেয়েছে। একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনের সাথে উপলের নানা ঘাত-প্রতিঘাত বর্ণিত হয়েছে। বাকি চরিত্রগুলোর মধ্যে বেশি প্রাসঙ্গিক হিসেবে রয়েছে লেখকের বন্ধু সুবিনয়, সুবিনয়ের বউ ক্ষণা, লেখকের মাসী, প্রীতি, মানিক সাহা এবং সামান্যভাবে লেখকের একসময়ের ছিনতাইকারী বন্ধু গোবিন্দ। এছাড়াও আরও বেশকিছু চরিত্র রয়েছে যা লেখকের জীবনে বিভিন্নভাবে এসেছে। উপন্যাসের মূলবোধ হলো ‘ক্ষুধা’। উপন্যাসের গল্পের শুরু থেকেই লেখক পরাশ্রিত ব্যক্তি। অবশ্য সে পরাশ্রিত হয়ে কোনোরকমে বেঁচে থেকে জীবন ধারণ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। লেখক অর্থাৎ উপলের মূল উদ্দেশ্যই হলো ক্ষুধা নিবারণ করা। আমাদের জীবন ধারায় এই ক্ষুধার গুরুত্ব কতখানি এবং একজন কী কী করতে পারে তাও দেখানো হয়েছে সুচারুরূপে।

উপল কেবল পরাশ্রিত জীবনধারণেই অভ্যস্ত নয় সেই সাথে সে একজন অলস এবং ভাবলেশহীন ব্যক্তি। জীবনের প্রয়োজনে সে এমন কোনো কাজ নেই যে করেনি। জীবনের প্রয়োজন অর্থ হলো টাকার প্রয়োজন। ছিনতাকারীদের দলে ভিড়েছে, অন্যের ফাইফরমাশ খেটেছে, প্রেমের অভিনয় করেছে আবার কারো প্রেমের অভিনয়ের ফাঁদে পড়েছে। এক আশ্চর্যরকম সহ্যশক্তি ছিল উপলের মধ্যে। কারও ছোটখাটো অপমান তাকে কখনো আঘাত করতে পারেনি। উপন্যাসের শুরু হয়েছে তার সহপাঠী বন্ধু সুবিনয় যে একজন মস্ত বিজ্ঞানী, পয়সাওয়ালা তার বাড়িতে আশ্রিত জীবনযাপন থেকে। সেখানে তাকে আড়ালে আবডালে সুবিনয়ের বউ ক্ষণা চুরির অপবাদ দেয়া হয়েছে এবং এটা লেখকের কানেও গেছে। এ বাড়িতে সে বাজার করার মতো ছোটখাটো কাজকর্ম করে মন যোগানোর চেষ্টা করতো।

লেখকের জীবন শুরু হয়েছিল তার পিতৃভিটেয়। সেখানে তার মাসীর সাথে থাকতো। সেই মাসী যে লেখককে প্রচন্ড ভালোবাসতো। লেখকের বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়িওয়ালা বকেয়া ভাড়ার জন্য তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এরপরেই লেখকের এই পরাশ্রিত জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। লেখক কখোনই জীবনে ঝুট ঝামেলা পছন্দ করেনি। জীবনটা পরিশ্রমেই শুরু করেছিল। বাসে প্রাইভেট বাসে কন্টাকটরি করে। বাস অ্যাকসিডেন্ট করলে পাবলিকের পিটুনি খেয়ে তারই সহযোগী গোবিন্দের সাথে তার গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সেখানেই ফাইফরমাশ খেটে তার দিব্বি বেশ কিছুদিন চলে যায়। তারপর একদিন রাতে সেখান থেকে হাতে একটি লাঠি আর হারিকেন নিয়ে চলে আসতে হয় তাকে। এরপরেই তার সাথে তিন ছ্যাঁচোড়ের পরিচয় হয়। ভিড়ে যায় তাদের দলে। তাদের সাথে একদিন ট্রেনে ডাকাতির সময় লেখক বাদে সবাই ধরা পড়লে কৌশলে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়। সেই সাথে ট্রেনের সেই বগিতে থাকা মানিক সাহা নামে একজনের সাথে তার গ্রামে চলে যায়। সেখানেও একরাতে হাতে হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পরে উপল। অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হলেও সবসময় তার কোনো একটা আশ্রয় ঠিক জুটে যেতো। উপন্যাসে উপল বরাবরই নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছে। তাই যখন যে তাকে ডেকেছে একটু নিশ্চিন্ত এবং নির্ভেজাল জীবনের জন্য তার সাথে ভিড়েছে। কোনো বাছবিচার করেনি। পেটের খিদে তাকে সবসময় তাড়া করতো। সেই খিদে মেটাতেই এতকিছু করতে হয়েছে তাকে। অথবা সারা জীবনে সে কিছুই করেনি। কারণ অনেকে এসব কাজকে কোনো কাজের ভেতরেই ধরবেন না।

উপন্যাসটির কাহিনী পাঠককে টানার আরও একটি কারণ হলো এর গল্প কখোনো একঘেঁয়েমি লাগে না। একটি উপন্যাসের মধ্যেই লেখকের আলাদা আলাদা কয়েকটি কাহিনীর জন্ম হয়েছে। যা পড়তে গিয়ে একেবারে নতুন মনে হবে। যেমন– শুরুটা সুবিনয়ের বাড়িতে হলেও তারপর তার কন্ডাকটারি জীবনের ঘটনা, সহকারী বন্ধু গোবিন্দের গ্রামের ঘটনা, চোরদের সাথে মেলার ঘটনা, মানিক সাহার গ্রামের ঘটনা তারপর আবার সুবিনয়ের বউয়ের সাথে প্রেমের অভিনয়ের ঘটনা এবং সবশেষে সুবিনয়ের শ্যালিকা প্রীতির সাথে একটি সম্পর্কের ঘটনা এবং ইতি। প্রতিটি ঘটনাই আলাদা আলাদাভাবে রস যোগাতে সক্ষম। সুবিনয় যখন তার বউকে একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে ডিভোর্স দিতে চায় তখন সে কাজে লাগায় উপলকে। তার বউয়ের সাথে প্রেমের অভিনয় করতে বলে। এর বিনিময়ে লেখক তার সুবিনয়ের কাছ থেকে প্রচুর টাকা পায়। কাজটি ভালো না হলেও আগেই বলেছি টাকার জন্য লেখক তা করেছে। অসাধারণ দক্ষতায় এতবড় একজন বিজ্ঞানীর বউকে তারই ভাষায় নিষ্কর্ম উপলের প্রেমে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

কাহিনী বর্ণনায় বহুবার লেখকের সাথে তার বিবেকের কথোপকথন রয়েছে। তার বিবেক তাকে বিভিন্ন সময় পথ দেখাতেও চেয়েছে। কিন্তু বিবেকের সে যুক্তি গ্রাহ্য হয়নি। ক্ষণার সাথে প্রেমের আগে বিবেক হাজির হয়ে তাকে বোঝাতে চেয়েছিল। সেসময় তার বিবেক সামনে এসে বলেছিল, ‘উপলচন্দ্র, টাকাটা তোমাকে বড় কাহিল করে ফেলেছে হে। শোনো বলি টাকা না থাকলেই যে মানুষ গরীব হয় তা কিন্তু না। দুনিয়ায় দেখবে যার যত টাকা সে তত গরীব।’ এই মহাকালের মহাসত্য উক্তিটি লেখকের সামনে বিবেকের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছে। ঠিক যে অভিনয়টি লেখক ক্ষণার সাথে করে প্রায় একই রকম অভিনয় করেই এবং নিজেকে সুবিনয়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য টোপ হিসেবে লেখককে ব্যবহার করে প্রীতি। কারণ সুবিনয় প্রীতিকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসতো। ওর কারণেই ক্ষণাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল। শেষপর্যন্ত তা আর হয়নি। লোকদেখানো প্রীতি উপলকে বিয়ে করে কাগজে সই করে। কিন্তু কোনোদিন একমুহূর্তের জন্যও কাছে যাওয়া হয়নি বউয়ের। ঐ যে কাগজের বউ। তা কাগজেই থেকে যায়। এজন্যও সে প্রচুর টাকা পায়। সেই টাকা রাস্তায় ছড়িয়ে দিতে গিয়ে জেল খাটতে হয়। জেল থেকে যখন বেরোয় তখন ঠিক একজন জুটে যায় বরাবরের মতো। আবার তার পিছনে লেখকের যাত্রা শুরু হয়। পথ কখনো উপলকে একা করেনি। কাউকে না কাউকে ঠিক সঙ্গী করেছে।


 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
প্রবন্ধ

সাহিত্যের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধ

আলী রেজার প্রবন্ধ সাহিত্যের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমেই বাঙালি

গল্প

চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ

আমাদের ক্লাসটা ছিল একটি নৃতত্বের ল্যাবরেটরির মতো। এমন বিচিত্র মানবতার নমুনা আর কোন্ স্কুলে কোন্‌  ক্লাসে আছে জানি না। তিনটি

কবিতা

মন খারাপের রাত

সীমা শামীমার তিনটি কবিতা মন খারাপের রাত কোনো কোনো মন খারাপ খুব একা হয় সিটকে পড়া ট্রেনের বগির মতো আনএটেন্ডেট,

কবিতা

ইউটোপিয়া

শিশির আজমের দুটি কবিতা জবাগাছ বিকেলের দেয়ালের পাশে ব্লু ইউনিফর্ম আর জবাগাছ জবাগাছের বিষয়ে আমরা তেমন কিছু জানি না আসলে