কলকাতার দিনগুলি ০১


কলকাতার দিনগুলি


প্রথম পর্ব


কলকাতা আমার কাছে কেবল একটা শহর নয়; এটা একটা ইতিহাস, যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে বাংলা ও বাঙালি। কেবল বাংলা ও বাঙালি বললে কম বলা হবে, শহরটির ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভাগ-পূর্ব ভারতবর্ষের (বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) প্রতিটি মানুষ।

ভারত উপমহাদেশের নবজাগরণে কলকাতার ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। বলা বাহুল্য, রাজ-চক্রান্তের শিকার হয়ে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার নির্মম পরাজয়ের পর ইংরেজরা কলকাতাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘাঁটি গাড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই পরবর্তী সময়ে পুরো ভারতবর্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

বন্দর সুবিধা পেতে কলকাতাকে তারা বেছে নেয়। ইংরেজরা বণিকের জাত; ব্যবসা ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। লাভ-লোকসানের হিসাবটা তারা আগে করে। তারপর পা ফেলে বুঝেশুনে। এই কলকাতা শহরে বসেই ইংরেজরা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের সব অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ। প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজ-সাম্রাজ্য; ঘোষণা করে, ব্রিটিশ রাজত্বে কখনো সূর্য অস্তমিত হয় না।

পরাধীনতার সেই অন্ধকার যুগে যে মানুষটি প্রথম আলোক-প্রদীপের খোঁজ পেয়েছিলেন, তিনি একজন বাঙালি। ক্রমান্বয়ে সেই আলো তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অনুসারীদের মাঝে। কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে তিনি জ্বেলেছিলেন আলোর মশাল। এই মহান মানুষটি হলেন আধুনিক ভারতের অগ্নিপুরুষ রাজা রামমোহন রায়। প্রকৃতপক্ষে তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলায় তখন সূচনা হয়েছিল নতুন যুগের। ব্রিটিশদের সহায়তায় ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদের মাধ্যমে তিনি এদেশের মানুষকে মুক্ত করেন হাজার বছরের কুসংস্কার থেকে।

শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন—‘১৮২৫ হইতে ১৮৪৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বিংশতি বর্ষকে বঙ্গের নবযুগের জন্মকাল বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে। এই কালের মধ্যে কি রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি শিক্ষা বিভাগ, সকল দিকেই নবযুগের প্রবর্তন হইয়াছিল।’ শাস্ত্রী মহাশয় যাকে নবযুগ বলেছেন, পরে তারই নাম হয় ‘বেঙ্গল রেনেসাঁস’ বা বাংলার নবজাগরণ।

সেই নবযুগ প্রবর্তনের মধ্যমণি ছিলেন মনীষীশ্রেষ্ঠ রাজা রামমোহন রায়। তরুণ বিদ্যাসাগর তার অনতিকাল পর এ কলকাতা শহরে বসেই রাত জেগে রেড়ির-তেলের আলোয় রচনা করেছেন বাংলা গদ্য। সৃষ্টি করেছেন নতুন ভাষা। বাঙালির জন্য উন্মুক্ত করেছেন নতুন দিগন্ত। তখন হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যেন জেগে ওঠে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

ওই সময় এই শহরে উঠতি জমিদার বাঙালি বাবুরা ছিলেন কেবল মদ আর রমণীবিলাসে ব্যস্ত; আর মত্ত ছিলেন নিজেদের শখ মেটাত দুহাতে টাকা ওড়ানোয়; নব্য শিক্ষিত বাঙালি যুবকরা নিজেদের ব্যাপৃত রাখেন ইংরেজ-অনুকরণে। তখন প্রজা-শোষণের অর্থে চলছিল সংস্কৃতিচর্চা, সমাজ ও ধর্মসংস্কার। এসব ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী উত্তর কলকাতার আড়াই শ বছরের জীর্ণ অট্টালিকাগুলো, যা আজও বিলীন হয়ে যায়নি।

এ কলকাতা মহানগরীর বুকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে রচিত হয়েছিল আধুনিক বাংলা মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’; টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে প্যারীচাঁদ মিত্রের হাতে প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’; প্রথম সার্থক বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচিত হয়েছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে।

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা তো বলাই বাহুল্য। তাঁর শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য—এককথায় গোটা জীবন কেটেছে এখানে। তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফসল বেশির ভাগ শিল্পসৃষ্টি ভূমিষ্ঠ হয়েছে এই কলকাতা শহরে, যা কিনা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ববাসীর দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বাঙালির জন্য এনেছে অতুল গৌরব—স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মর্যাদা।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, ১৮৮৬ সালে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ও ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ-রদ, ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ—সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই কলকাতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও কলকাতার ভূমিকা অবিস্মরণীয়, যা উঠে এসেছে দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ আর গবেষকদের বিভিন্ন রচনায়।

ছবি: সিপাহী বিদ্রোহের চিত্র

কলকাতার এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস পড়েছি বই-পুস্তকে। সেগুলো মনের ভেতর সদাজাগ্রত। সেসব বুকে ধারণ করে, কলকাতাকে একবার দু’চোখ ভরে দেখতে যাই সেখানে। পৃথিবীর অন্য সব শহরের প্রতি আমার তেমন আকর্ষণ নেই। সেটা হয়তো এ জন্য যে, আমি সেসব শহরের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানি না। তবে প্যারিসের কথা আলাদা, সে আমার স্বপ্ননগরী। শিল্প-সাহিত্যের পীঠস্থান এই নগরটির প্রতি আমার সীমাহীন দুর্বলতা।

কেবল প্যারিস নয়, ফরাসিদেশও আমার স্বপ্নভূমি। একটি কথা আমার মনে সবসময় ভাসে—ফরাসি দেশের প্রতি শিল্পী-সাহিত্যিকদের রয়েছে আলাদা টান। বলতে শোনা যায়, প্রত্যেক শিল্পীর দুইটা মাতৃভূমি; একটি—যেখানে সে জন্মেছে আর অন্যটি ফ্রান্স। হয়তো সে জন্য চার বছর ব্যয় করে ফরাসি ভাষাটি শিখেছি। যাক, সে অন্য কথা।

বাঙালি হিসেবে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ প্রেমিক হিসেবে কলকাতার প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ। এই আকর্ষণ হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি; শৈশব পেরোনোর পর থেকে এই অনুভূতি আমি টের পেয়েছি। এজন্য অনেকের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে অনেক কটূক্তি। তবে তাতে পাত্তা দিইনি কখনো।

১৯৪৫ সালের কলকাতা

স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘আমার ছেলেবেলা’ পড়ার সূত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর উত্তর কলকাতা আর জোড়াসাঁকোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন কল্পনায় দেখতাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল ও বহির্মহল, যেখানে কেটেছে বিশ্বকবির ছেলেবেলার নানা রঙের দিনগুলি।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে জানাশোনার পরিধি। জেনেছি বাংলা সাহিত্যের অনেক স্বনামধন্য লেখক ও তাঁদের সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে কলকাতা মহানগরীর জড়িয়ে থাকার প্রসঙ্গ। বিষয়টি আমাকে আকৃষ্ট করে। মনের ভেতর শহরটির প্রতি জন্ম নেয় নিবিড় প্রেম। গভীর ভালোবাসা।

সুযোগটাও এসেছিল হঠাৎ করে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম তিন বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের আয়োজন করা হলেও চতুর্থ বছরে নেয়া হয় বৃহৎ পরিকল্পনা। সার্ক ট্যুর। ভারত-নেপাল-ভুটান। দলনেতার কাছ থেকে ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা বেড়ে যায় সবার। তড়িঘড়ি করে ব্যাচের সবাই বানিয়ে নেয় পাসপোর্ট।

নিজেকে এই আয়োজন থেকে দূরে রাখতে পারিনি। ভ্রমণের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে বেজে ওঠে বীণার ঝংকার। যেতে যে আমাকে হবেই। কোনোভাবে এই সুযোগ মিস করা যাবে না। যথারীতি বন্ধুদের কাছে ঘোষণা দিয়ে দিলাম—কেউ যাক বা না যাক, আমি যাবই। আবার শঙ্কা জাগে টাকা পাব কই! উত্তর দেয় অবচেতন মন— টাকা দেবে গৌরীসেন।

অজানা কারণে হঠাৎ স্থগিত হয়ে যায় ট্যুরের সিদ্ধান্ত। একেকজনের কাছে একেক কথা শুনি। কোনোটাই আমার বিশ্বাস হয় না। মেনে নিতে পারি না এমন নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত। স্থগিত হয়েছে বলে কি বসে থাকা যায়। ভ্রমণে বের হব বলে যখন পাসপোর্ট বানিয়েছি, তবে যেতে হবেই আমাকে। জেগে ওঠে আমার পর্যটক-সত্তা। মানসচোখে আমি দেখতে থাকি সম্ভাব্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলোকে।

মানচিত্র নিয়ে বসে পড়ি। সঙ্গে যোগ হয় সেই বছর বইমেলা থেকে কেনা আমার ভ্রমণ-গাইড। এমনিতে স্কুলজীবন থেকে ভ্রমণ, ইতিহাস ও ভূগোলে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ, পাসপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মাত্রা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সঙ্গে যুক্ত হয় আমার সাহিত্যানুরাগ।

মনে পড়ে, সেই বছর আমি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে এক বছর মেয়াদি রবীন্দ্র পাঠচক্রের শিক্ষার্থী হিসেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলাম। তিনি আমার রবীন্দ্রপ্রেমকে আরো উসকে দিয়েছিলেন। শয়নে স্বপনে নিদ্রায় জাগরণে তখন আমার সমগ্র সত্তাজুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কেবল রবীন্দ্রনাথ। সারাক্ষণ আওড়াই রবীন্দ্রনাথের কবিতা। রবীন্দ্রনাথের গল্পে-উপন্যাসে-গানে মগ্ন থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিশাল ভারতবর্ষের অন্য কোনো পর্যটন স্থান নয়, আমাকে তখন চুম্বকের মতো টানছিল কলকাতা আর শান্তিনিকেতন।

ঝটপট ভিসা লাগিয়ে একাই কলকাতা ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ‘এখানে ভারতের ভিসা করা হয়’ লেখা সংবলিত মতিঝিলস্থ একটি ট্রাভেল এজেন্টের কাছে যাই; জেনে নিই পুরো প্রক্রিয়া। তাদের কাছে বিস্তারিত শুনে আশ্বস্ত হই। ওই সময় ভারতের ভিসা করার ক্ষেত্রে এখনকার মতো এত জটিলতা ছিল না। ডলার এনডোর্সসহ মাত্র ১০০ টাকায় ভিসা করা যেত। ট্রাভেল এজেন্ট সব ব্যবস্থা করে আমাকে দুই দিন পর ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত দিলেন।

আমার ভিসা হওয়ার পর বন্ধু খোকনকে এই ভ্রমণের কথা জানাতেই সে-ও লাফিয়ে ওঠে। জানায়, সে আমার কলকাতা ভ্রমণের সঙ্গী হতে চায়। তাহলে আর কী করা! ভ্রমণ দুই দিন পেছাতে হবে। আমি রাজি হয়ে যাই তৎক্ষণাৎ। তাকে জানাই, কোনো সমস্যা নেই; তুমি গেলে কেবল দুই দিন কেন, এক সপ্তাহ পরেও যেতে পারি।

ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে খোকনকে পছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে। সে-ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সমঝদার। ক্লাসে আমাদের দুজনের মধ্যে এসব বিষয়ে প্রায়ই কথা হতো। মনে আছে, বাংলা বিভাগের তার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে আমরা দুজন একবার কলাভবনে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ স্যারের ক্লাস করেছিলাম। এমনই ছিল আমাদের দুজনের সাহিত্যপ্রীতি।

১২ এপ্রিল। আমরা দুজন সোহাগ পরিবহনে রাত ১০টায় কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করি। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ভোর পাঁচটা নাগাদ পৌঁছাই বেনাপোল স্থলবন্দরে। ভ্রমণ-করের কথা জানা ছিল না। দেখলাম সবাই ২০০ টাকা করে সোনালী ব্যাংকে ভ্রমণ-কর জমা দিচ্ছে। আমরাও দিলাম। তারপর সেরে নিলাম সকালের নাশতার পর্বও।

কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে আমার আগে কোনো ধারণাই ছিল না। এমনকি যাত্রার আগে ভারতভ্রমণ করেছে এমন কারো সঙ্গে এই ব্যাপারে কোনো আলাপ করিনি। সহযাত্রীদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে তাদের অনুসরণ করতে লাগলাম। কাস্টমসে চেকিং আর ইমিগ্রেশন পর্ব শেষ করে ওপারে যেতে বেজে গেল সকাল ৭টা।

তারপর পেট্রাপোল সীমান্তে ৫০ ডলার ভারতীয় রুপিতে রূপান্তর করি। ভারতীয় মুদ্রাকে (রুপি) ওপারের বাঙালিরা টাকাই বলে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা রাখার পেছনে হয়তো এই কারণ ছিল যে, বাঙালিরা অনেক আগে থেকেই মুদ্রাকে টাকা বলে। যাহোক, মাথাপিছু ১০ টাকা করে শেয়ারের ট্যাক্সিযোগে পৌঁছে যাই বনগাঁ রেলস্টেশনে। দেরি না করে কাউন্টার থেকে শিয়ালদহগামী বনগাঁ লোকালের টিকিট কেটে নিই। তখন বনগাঁ থেকে শিয়ালদহের টিকিটের দাম ছিল মাত্র ১১ টাকা; দাম দেখে বেশ অবাক হই আমরা।

সকাল সাড়ে আটটা। উত্তর চব্বিশপরগনার বনগাঁ স্টেশনের ইলেকট্রিক ট্রেনের কামরায় আমি ও খোকন মুখোমুখি বেঞ্চে বসে আছি। পুরো কামরা তখনো খালি। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে সাড়ে আটটার ট্রেন চলে গেল। জানতে পারি, প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর শিয়ালদহগামী ট্রেন বনগাঁ থেকে ছেড়ে যায়। সাড়ে আটটার ট্রেনে উপস্থিত যাত্রীরা চলে যাওয়ায় স্টেশন তখন একদম সুনসান। চারদিক প্রায় নিস্তব্ধ।

ট্রেন ছাড়বে ৯টায়। দু’টাকা দিয়ে হকার থেকে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকাটি কিনে নিলাম। ‘আনন্দবাজার’ যে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা, তা আগে থেকে জানতাম। ‘আনন্দবাজার’ কর্তৃক প্রবর্তিত আনন্দ পুরস্কার ১৯৯২ সালে পান বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘নির্বাচিত কলাম’ নামক বইয়ের জন্য।

মনে আছে, সেই সময় অনুসন্ধিৎসু হয়ে তসলিমার প্রকাশিত প্রায় সব বই সংগ্রহ করে পড়েছিলাম। সেই সুবাদে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকাটিকে খুব চেনা মনে হলো– যেন তা আমাদের ‘প্রথম আলো’। আনন্দ করে পড়ছিলাম দুজনে। হঠাৎ দুটি ছেলে আমাদের কামরায় উঠে এলো; দুজন দুপাশে বসে টেনে নিল আমাদের হাতে থাকা পত্রিকা। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন রসিদ বই বের করে কলম নিয়ে বলল, বাসন্তী পুজোর চাঁদা দে।

অবাক কাণ্ড তো! এদের আচার-ব্যবহার দেখে ও কথাবার্তা শুনে সদ্য বাংলাদেশ থেকে আসা আমরা দুই তরুণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ি। ভয় আর আতঙ্ক একসঙ্গে কাজ করতে লাগল মনে। খানিক পর আরো চারজন উঠে এলো। একজন বেশ জোর দিয়ে বলল, ‘আমাদেরকে দু’হাজার টাকা দিতে হবে, নইলে তোদেরকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেব। বেশি দেরি করবি না। তাড়াতাড়ি বের কর।’

এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমরা ছিনতাইকারীদের পাল্লায় পড়েছি। কী করব বুঝতে পারছি না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়! সব টাকা এবং ডলার খোকনের পকেটে। ওরা যদি সব নিয়ে যায় জোর খাটিয়ে, তবে আমাদের কলকাতা বেড়ানো তো দূরের কথা, দেশে ফেরাটাও মুশকিল হয়ে পড়বে। এটা ভাবতেই কুঁকড়ে যেতে থাকে মন।

একবার ভাবছি লোক ডাকব, আবার ভাবছি দৌড়ে পালাই। এদিকে তারা এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, বাইরের কেউ আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। বুঝতে পারলাম, এটা তাদের কৌশল। অনেক হিসেবনিকেশ করেই তারা খালি কামরায় আমাদের ধরেছে। অথচ আমাদের ধারণার মধ্যে ছিনতাইয়ের বিষয়টি ছিল না।

ঘাম দিতে লাগল গায়ে। হাত-পা যেন কাঁপছে। তাদের মধ্যে নেতা-গোছের ছেলেটিকে একটু সরল মনে হলো। কানে কানে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে খোকন। ৩০০ টাকায় রাজি করায়। যাক বাবা বাঁচা গেল! টাকা নিয়ে তারা মুহূর্তে উধাও। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন থেকে নেমে সিদ্ধান্ত নিলাম, না, ট্রেনে নয়, বাসে আমরা কলকাতায় যাব।

কিন্তু ফুটওভারব্রিজ পার হতে গিয়ে দেখি, ওরা আমাদের বাধা দিয়ে পথ আটকাচ্ছে। বুঝতে পারলাম ভয় পেয়েছে। ওদের ধারণা, আমরা বুঝি থানায় যাচ্ছি। বিষয়টি টের পেলাম ওদের বিভিন্ন প্রশ্ন থেকে। ওরা বারবার জানতে চাচ্ছিল যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি। আমাদের উত্তরে ওরা সন্তুষ্ট ছিল না; বারবার বলছে, তোদের এই ট্রেনে করেই কলকাতায় যেতে হবে। অন্য কোথাও যেতে পারবি না।

ওদের বাধা পেয়ে ফুটওভারব্রিজ থেকে নেমে ট্রেনটির একটি জনবহুল কামরায় গিয়ে বসলাম। দেখি, সেখানে আমাদের সঙ্গে আসা চারজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক; তাঁরা গতরাতে সোহাগ পরিবহনে ঢাকা থেকে এসেছেন। তাঁদের পেয়ে একটু ভরসা পেলাম। সব ঘটনা খুলে বলি। তাঁরা পরামর্শ দিলেন, ডলার ও টাকাগুলো কয়েক জায়গায় রাখতে। সেভাবে রাখলাম। তারপরও আতঙ্ক কাটে না।

অবশেষে ট্রেন ছাড়ল। পার হচ্ছি একটি একটি করে স্টেশন। ঠাকুরপুকুর। মসলন্দপুর। উল্টোডাঙা। দমদম। দমদম ক্যান্টনমেন্ট। ক্রমশ বাড়তে থাকে যাত্রীর ভিড়। প্রতি স্টেশনে যত জন নামে তার চেয়ে বেশি যাত্রী ওঠে। অফিস টাইম বলে যাত্রীর ভিড় একটু বেশি।

একটু একটু করে কলকাতা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে। উত্তেজনায় শিহরিত হচ্ছি আমি! কোন কলকাতায় পা রাখতে যাচ্ছি? বাংলার সব শ্রেষ্ঠ মানুষের পদভারে ধন্য কলকাতার গর্বিত মাটিতে কিছুক্ষণের মধ্যে পা রাখব আমি—এই ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছি।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বেগম রোকেয়া, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় বাঙালি একসময় এ শহরের বুকে হেঁটে বেড়াতেন; যাঁদের বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আমার হৃদয়ে স্থান দিয়েছি। আমরা তো এসব মহান বাঙালিরই উত্তরাধিকারী।

এ কলকাতা শহরে বাস করেন আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (যিনি সেই সময়, প্রথম আলো, একা এবং কয়েকজন ও পূর্ব-পশ্চিম-এর মতো উপন্যাসের জন্য আমার স্বপ্নের লেখক), সমরেশ মজুমদার (যিনি সাতকাহন, উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ ও কলকাতা-এর মতো উপন্যাসের জন্য আমার মনে স্থান করে নিয়েছেন প্রথম যৌবনে), সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (যাঁর লোটা কম্বল উপন্যাসটি পরিচয় দেয়ার জন্য যথেষ্ট) এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর তাঁর বিশাল আয়তনের উপন্যাস মানবজমিন, দূরবীন এবং পার্থিব খুলে দিয়েছিল আমার অন্তর্দৃষ্টি)। রয়েছেন বিখ্যাত বাঙালি লেখক বুদ্ধদেব গুহ, শংকর, মহাশেতা দেবী, সূচিত্রা ভট্টাচার্য, আশাপূর্ণা দেবী, কবি শঙ্খ ঘোষ, বিনয় মজুমদার, জয় গোস্বামীসহ আরো অনেকে।

এ শহরকে কেন্দ্র করেই তো রচিত হয়েছে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস। সেই হিসেবে শহরটি আমাদের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু। সাহিত্যানুরাগী হিসেবে বাংলা সাহিত্যের সূতিকাগার কলকাতার প্রতি রয়েছে আমার সহজাত অনুরাগ।

সমরেশ মজুমদারের ‘কলকাতা’ নামক উপন্যাসটি পড়ে জানতে পেরেছি যে কলকাতা ভারতবর্ষের এক খণ্ড নমুনা; যেখানে একসঙ্গে বাস করছে ভারতের সব রাজ্যের মানুষ; যেমন বাঙালি, পাঞ্জাবি, বিহারি, ওড়িয়া, মারাঠি, অসমিয়া, তামিল, কাশ্মিরী ও মাড়োয়ারি। এমনকি বাস করে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং চায়নিজও। যাদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও ভাষাভাষী মানুষ। বিচিত্র রকমের মানুষের জন্যও এই শহরটির প্রতি আমার কৌতূহল ছিল। তা হয়তো এই জন্য যে, ঢাকা শহরে আমরা প্রায় সবাই বাংলা ভাষাভাষী। তাছাড়া আমি বরাবরই বৈচিত্র্য ভালোবাসি। বিশ্বাসের বৈচিত্র্য। ভাষার বৈচিত্র্য। বর্ণের বৈচিত্র্য।

(চলবে…)


প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব


 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

যদি

— শোনো মৌনাকী, তোমাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তবে একটা কথা, আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে তুমি কিন্তু সকাল দশটার

কবিতা

অক্সিজেন ও বাঘের রক্ষিতা

অক্সিজেন আমাদের ফুসফুস যখন ভর্তি ছিল বিশুদ্ধ অক্সিজেনে, তখন আমাদের মগজজুড়ে ছিলো ঘৃণার চাষাবাদ। প্রতিহিংসার আগুনে আমরা পুড়িয়েছি ঘর, দেবালয়,

হাসির গল্প

শেয়ালসা পীরের দরগা

রহিম এক ঝাঁকা সুপারি নিয়ে হাটে যাচ্ছিল। মাঠের মধ্যে যেখানে তিন পথ একত্র হয়েছে সেখানে শেয়ালে পায়খানা করে রেখেছে। এইখানে

কবিতা

আত্মহনন না মৃত্যুদণ্ড?

কান্ত রায়ের কবিতা আত্মহনন না মৃত্যুদণ্ড? সেনোরিটার সাথে অনুষঙ্গের অপরাধে– এ মর্ত আমাকে মৃত্যু না হওয়া অবধি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার