কলকাতার দিনগুলি
সপ্তম পর্ব
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে মান্নাদের সেই কফি হাউসে, যাকে নিয়ে তিনি ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি গেয়েছিলেন– সেখানে প্রবেশ করি। কফি হাউস কলেজ স্ট্রিটে; ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সি কলেজের ঠিক বিপরীতে। এই কফি-বাড়ির এক পাশে রয়েছে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট। এ দুটি স্ট্রিট পুরান ঢাকার বাংলাবাজার কিংবা নীলক্ষেতের মতো। বইয়ের বাজার। সারি সারি বইয়ের দোকান এখানে। চারদিকে নতুন পুরোনো সব রকম বইয়ের বিশাল সমারোহ।
সিঁড়ি ভেঙে দ্বিতীয় তলায় উঠে এলাম। ঢুকেই চোখ ছানাবড়া। এত বিশাল কফি হাউস! হলঘরের মতো। চারপাশে কেবল শোঁ শোঁ, চেঁচামেচি, চিৎকার আর হট্টগোলের শব্দ। কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা না বললে পাশের জনও ঠিক শুনতে পায় না।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একটি টেবিল খালি পেয়ে দখল করে বসলাম চারজন। সাপ্তাহিক ছুটির সুবাদে সেদিন আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন দেবাশীষদার মামাতো ভাই বাদলদা। কফির চুমুকে চুমুকে তুমুল আড্ডা দিলাম। অনেকক্ষণ ধরে। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, অন্যান্য টেবিলে বসে যারা আড্ডা দিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগ কবি-সাহিত্যিক।
এক কাপ কফি খেয়ে সারা দিন বসে আড্ডা দিলেও কেউ এসে বলবে না যে এবার উঠে যান। এই সুযোগটাই লুফে নিচ্ছেন কলকাতার কবি-সাহিত্যিকেরা। ফেসবুকের কল্যাণে এখন যেমন কলকাতায় অনেক লেখকবন্ধু পেয়ে গেছি, ওই সময় তো সেই সুযোগ ছিল না। তাই কারো সঙ্গে সাহিত্য-আড্ডা দেয়া হয়নি তখন।
আধা ঘণ্টা পর কফি হাউস থেকে বের হলাম। রাস্তা পার হয়ে ঢুকলাম প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রাঙ্গণে। এখন অবশ্য আর কলেজ নেই। এখন এর নাম প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।
কলেজ প্রাঙ্গণে ঢুকতেই মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ভারতবর্ষে বাঙালি ছেলেদের স্বপ্ন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসত ছেলেরা কলকাতায়। উদ্দেশ্য প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়া। তখন সব ভালো ছাত্রের স্বপ্ন থাকত প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার। আর যারা এখানে চান্স পেত ধন্য হয়ে যেত তাদের জীবন।
প্রতিষ্ঠালগ্নে, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই কলেজের নাম ছিল হিন্দু কলেজ। ভারতে শিক্ষা বিস্তারের মহান উদ্যোগ নিয়ে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮১৭ সালে। বলা যায়, এটি ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কলেজ। তখন শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দু-ছাত্ররাই পড়াশোনার সুযোগ পেত এখানে। অন্যদের জন্য কলেজটি ছিল নিষিদ্ধ।
পরবর্তী সময়ে কয়েকজন মুসলমান-নেতার প্রচেষ্টায় কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়। রাখা হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলেজটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয় হিন্দু-মুসলমান সব ছাত্র-ছাত্রীর জন্য। ২০১০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে।
প্রেসিডেন্সি কলেজ যে প্রাচীন, তা এর স্থাপত্যশৈলী থেকে বোঝা যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী এ কলেজটির বিভিন্ন ভবন দেখলাম ঘুরে ঘুরে। কলেজ চত্বরে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলাম কিছুক্ষণ।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যাওয়া। উদ্দেশ্য—সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ইটিভির (ইন্ডিয়ান) উদ্যোগে ঠাকুরবাড়ি প্রাঙ্গণে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’ উপভোগ করা। সকালে সেখানে ঘোরার সময় নোটিশ বোর্ডে এ রকম একটি বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়েছিল। ভেবেছিলাম, বিশাল একটা কিছু হবে—তাই আবার ছুটে আসা।
ঠাকুরবাড়ি পৌঁছে দেখি আমরা চারজন ছাড়া দর্শক আর কেউ নেই। ইটিভির চার কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার মধ্যে একজন নারী; তিনি আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করলেন। কোথা থেকে এলাম, কেন এলাম, এমন আরো অনেক প্রশ্ন।
কর্মকর্তাটি জানালেন যে, আমাদের সঙ্গে এ সাক্ষাৎকারটি ইটিভিতে দেখানো হবে। ভারি আশ্চর্যের ব্যাপার তো! কী সৌভাগ্য আমাদের! হয়তো দেখানো হয়েছিল, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে কিংবা হাতের কাছে টিভি ছিল না বলে তা দেখা হয়নি।
ওই শোতে ঊনবিংশ শতাব্দীর ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য ও বাড়ির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে পুরুষানুক্রমে ধারাভাষ্যের মাধ্যমে লাইট ও সাউন্ড দিয়ে বোঝানো হয়েছিল।
দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠাকুরবাড়ির সূর্য সন্তানদের কীর্তিকলাপের কাহিনি এবং এ বাড়ির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহান ব্যক্তিদের, মানে যাঁদের আনাগোনা ছিল ওই বাড়িতে, যেমন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্দীন, সব শ্রেষ্ঠ মানুষদের কীর্তি সেখানে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
ইতিহাস অনুসন্ধানী বলে আমার কাছে শোটি মনে হয়েছিল বেশ আকর্ষণীয়। অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরে বেশ ভালো লেগেছিল।
(চলবে…)
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব