ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে আশাবাদী হওয়া অনেক কঠিন: সালমান রুশদি


আহমেদ সালমান রুশদি (জন্ম: ১৯শে জুন, ১৯৪৭) একজন ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তার দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেন ১৯৮১ সালে বুকার প্রাইজ অর্জন করেছিল। তার লেখার অনেকটা অংশ জুড়েই থাকে ভারতীয় উপমহাদেশ। বলা হয়ে থাকে যে তিনি জাদু বাস্তবতার সাথে ঐতিহাসিক কল্পকাহিনী একত্রিত করে লিখেন। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে অসংখ্য সংযোগ, বিচ্ছিন্নতা ও অভিপ্রয়াণ তার লেখার অন্যতম বিষয়বস্তু।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার চতুর্থ উপন্যাস দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বিশ্বব্যাপী একটি বড় আকারের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। বইটি প্রকাশের পর বেশ কয়েকটি দেশের মুসলিমরা প্রতিবাদ জানায় যা অনেক সময় সহিংস রূপ ধারণ করে। তাঁকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়। ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি এই বই রচনার জন্য ১৯৮৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেছিল।

দর্পণে প্রকাশিত হলো সালমান রুশদির একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারের অনুবাদ।  


প্রশ্নকর্তা:

মিস্টার রুশদি, পৃথিবী সম্পর্কে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এক শব্দে কিছু বলতে বললে আপনি কী বলবেন?

সালমান রুশদি:

আশাবাদী নই। আর এক শব্দ! আমার মনে হয় একজন লেখকের পক্ষে ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে আশাবাদী হওয়া অনেক কঠিন। সে যাই হোক, আরেকটা কথা মনে রেখো, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশই এখন প্রতিনিয়ত হাস্যরসাত্মক মূহুর্ত সৃষ্টি করে।

প্রশ্নকর্তা:

আপনার লেখালিখির করার কারণ কী?

সালমান রুশদি:

আমার তো আর কোনো কিছুই করার নেই! আমি আমার জীবনে সবসময় লিখতেই চাইতাম। এটা ছাড়া আমি একজন অভিনেতা হতে চাইতাম। কিন্তু সেটা আর হলাম কই! আমি সবসময় ভাবতাম, মিডনাইটস চিলড্রেন নিয়ে যদি কোনো সিনেমা হয় তাহলে আমি সেই সিনেমায় অভিনয় করবো, আমার চরিত্রটি হবে জ্যোতিষী বা ফরচুনটেলার।

প্রশ্নকর্তা:

বেশ তো, সিনেমাটি তো হয়ে গেছে। আপনি কী এতে ছিলেন?

সালমান রুশদি:

পরিচালক আমাকে ডেকেছিল, কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে ওই কাজ থেকে বরখাস্ত করেছি। কারণ আমি যদি অভিনয় করি তাহলে দর্শকরা আমাকে দেখে ভাবতো, ওটা সালমান রুশদি না? এই জিনিসটা দর্শকদের মনোযোগ বিঘ্নিত করত। তাই শেষপর্যন্ত আমার অভিনয়ের অংশটুকু কাট করতে হয়েছিল।

প্রশ্নকর্তা:

অতিশয় দুঃখের বিষয়।

সালমান রুশদি:

তবে আমি আরেকটি চরিত্রে অভিনয় না করতে পারায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম। সেটা ছিল উইল ফেরেলের সাথে তালাদেগা নাইটস-এ অভিনয় করতে না পারা।

প্রশ্নকর্তা:

তালাদেগা নাইটস-এ সালমান রুশদির কী ধরনের চরিত্র থাকার কথা ছিল?

সালমান রুশদি:

তাদের পরিকল্পনা ছিল শুধুমাত্র একটা শটের জন্য। সেখানে নাস্কার ড্রাইভার হিসেবে তিনজন লোকের প্রয়োজন ছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে তারা জুলিয়ান স্নাবেল, লু রিড এবং আমাকে সিলেক্ট করেছিল। (হাসতে হাসতে) এবং আমাদের সবারই ইউনিফর্ম আর হেলমেট পড়ে স্লো মোশনে হাটার কথা ছিল। এটা হলে চমৎকার হতো, কিন্তু আমরা কেউই সময় করতে পারিনি। আমি একটা বই প্রদর্শনীর মাঝপথে ছিলাম, লু’য়ের ছিল মিউজিক ট্যুর, জুলিয়ান অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল। এসকল কারণে তারা তাদের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে, তাই আর সেটা করা হয়নি। সত্যি কথা বলতে আমি এটা করতে পারলে খুব উপভোগ করতাম।

প্রশ্নকর্তা:

আপনি সাম্প্রতিক সময়ে আপনার ১০ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ আত্মজৈবনিক উপন্যাস দ্যা সাটানিক ভার্সেস লেখার জন্য আয়াতুল্লাহ খোমেনি আপনাকে হত্যার ফতোয়া দেয়। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

সালমান রুশদি:

আমি আসলে এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছি কারণ আমি এমন একটা জায়গায় যেতে চেয়েছি যেখান থেকে আমার লেখার উপাদানের দূরত্ব যথেষ্ট হয়। এটার কারণ আমি জিনিসটা নিরপেক্ষভাবে লিখতে চেয়েছি। আমি চাইনি যে এটা আবেগী কোনো জিনিস হয়ে উঠুক। আমি চাইনি যে এটা অপেরাহ এপিসোডের মতো কিছু হয়ে উঠুক। তাই আমি ২৩ বছর অপেক্ষা করেছি। আমি শুধু ফতোয়ার সময়কার কথা বলতে চাইনি, আমি আমার শৈশবের কথাও বলেছি। সত্যি কথা বলতে আমি কখনো ভাবিনি যে আমি একটা আত্মজৈবনিক গ্রন্থ লেখবো।

প্রশ্নকর্তা:

কেন নয়?

সালমান রুশদি:

একসময় যখন লোকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, আমি বলতাম, “এ বিষয়ে আমি আগ্রহী নই। আমাকে কেন আত্মজীবনী লিখতে হবে?” আমি আমার সম্পর্কে লিখতে একদমই আগ্রহী না৷ আমি লেখক হয়েছি অন্য মানুষদের নিয়ে লিখে, আমি সেই কাজটাই করে যেতে চাই।

প্রশ্নকর্তা:

আপনি তো স্বদেশ ফিরতে আকুল হবার মতো মানুষ না?

সালমান রুশদি:

এটা ঠিক। দুর্ভাগ্যবশত আমি একটা মজার জীবনের অভিশাপ অর্জন করেছি।

প্রশ্নকর্তা:

আপনি ইতোপূর্বে বলেছেন, “আমি মনে করি বইয়ের একটা নিজস্ব গতি আছে এবং তারা নিজেরাই ভ্রমণ করে।”, আপনার কি মনে হয় আপনাকে হুমকি না দেওয়া হলে আপনি অন্য ধরনের লেখক হতেন?

সালমান রুশদি:

না। তুমি আমার জীবন সম্পর্কে কিছুই জানো না, কারণ তুমি আমার সম্পর্কে একটা জিনিসও পড়নি, তুমি শুধু আমার বইগুলোই পড়েছো। আমার বইগুলো পড়লেই দেখতে পারবে ১৯৮৯ সালে যা ঘটেছিল তা অবাক করার মতো বিষয় ছিল না। আমার মনে হয় না সেসময়ে একজন লেখকের বিদীর্ণ জীবন সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে। সেই ঘটনার পর বইগুলো সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যেতে থাকে। এজন্যই আমি বলেছিলাম, বইয়ের একটা নিজস্ব গতি আছে এবং তারা নিজেরাই ভ্রমণ করে।

প্রশ্নকর্তা:

আপনি কী এখনো ভয়ার্ত জীবনযাপন করেন?

সালমান রুশদি:

সত্যি বলতে না৷ আসলে হুমকির পর সাড়ে দশ বছর পার হয়ে গেছে। এটা দীর্ঘ সময়। আমি গত দশ বছর ধরে নিউইয়র্ক-লন্ডনে ভয়হীনভাবে বসবাস করছি।

প্রশ্নকর্তা:

শোনা যায় মিডনাইটস চিলড্রেন সিনেমা হবার সময় এটার নাম পাল্টানো হয়েছিল। এটা কি উগ্র মুসলমানদের প্রতিরোধের ভয়ে করা হয়েছিল?

সালমান রুশদি:

আসলে সেটা না। ইন্ডিয়াতে যখন একটা সিনেমা হয় তখন সেটা শুধু ইন্ডিয়ার সিনেমা থাকে না, সেটা হয়ে যায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ার। একারণে তারা যখন কোনো বই থেকে সিনেমা বানায় তাদের অনেক কিছুই বাদ দিতে হয়। এটা আসলে খুব কঠিন বিষয়।

প্রশ্নকর্তা:

আপনি তো ভারতে বেশ বিখ্যাত, তাই না?

সালমান রুশদি:

(মুচকি হাসি) হ্যা। সামান্য কিছুটা। তবে আমি ওখানে ম্যাডোনা কিংবা ইউটু -এর মতো বিখ্যাত নই। ওখানে আমি ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারি। মোটের ওপর বলতে গেলে, বেশিরভাগ লেখকই তাদের জীবনটা নীরবে-নিভৃতে নির্জনতার মধ্যে পার করে দেয়।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

বটতলার মধ্যাহ্নভোজ

মনজুরুল ইসলামের গল্প বটতলার মধ্যাহ্নভোজ ঢাকা থেকে ফিরেছেন শফিক। সিলেকশন গ্রেড পাননি বলে মন খারাপ। কোনো এক মনীষীর বাণীতে পড়েছেন,

শিল্প ও সংস্কৃতি

জয়নুল আবেদিনের ২০ চিত্রকর্ম

এদেশে চিত্রশিল্পীদের মধ্যে যে কয়েকজন তাদের চিত্রকর্ম দিয়ে দেশ-বিদেশের মানুষদের কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন অন্যতম।

সাক্ষাৎকার

গল্প লেখা অনেকটা জীববিজ্ঞানের মতো, বীজ থেকে ফসল উৎপাদনের মতো: জর্জ সন্ডারস

জর্জ সন্ডারস আমেরিকান একজন কথাসাহিত্যিক। ইংরেজি সাহিত্যে বর্তমানে যারা ছোটগল্প লেখেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ২০১৭ সালে তিনি ‘লিংকন ইন

গল্প

মৃতদেহ

পরিতোষ বারান্দা থেকে দেখল রাস্তায় এখানে ওখানে দু’একটা জটলা। পরিতোষ বুঝতে পারে ওরা অলোকেশকে নিয়ে কথা বলছে। আরও কয়েক ঘন্টা