অণুগল্প পাঠকের মন ও মননে রাজত্ব করবে: মোহাম্মদ জসিম


মোহাম্মদ জসিম বরিশালের বাকেরগঞ্জে ৩ এপ্রিল, ১৯৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। ইতোপূর্বে তার প্রকাশিত গ্রন্থ ত্রয়োদশ দুঃস্বপ্ন, অসম্পাদিত মানুষের মিথ ও মিথ্যেরা সাতবোন। ২০২০ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তার প্রথম অণুগল্পের বই “তামাশামণ্ডপ”। গ্রন্থটির গুরুত্ব বিবেচনায় দর্পণের সাথে লেখকের অণুগল্পবিষয়ক আলাপচারিতা হয়। সেটিই তুলে ধরা হলো দর্পণের ওয়েব পাতায়।


দর্পণ:

লেখালিখি কেন করেন?

মোহাম্মদ জসিম:

বড্ড কঠিন প্রশ্ন। সত্যি বলতে, অন্যকিছু করার যোগ্যতা নেই বলেই হয়তো লেখালেখি করি। সময় ও সমাজভাবনা, ব্যক্তিগত জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া ক্লেদ ও কুসুম, এইসব প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই বোধহয় লেখালেখিতে আসা। শৈশব থেকেই একটু একলা থাকার অভ্যাস। চারদিকের হৈ চৈ থেকে নিজেকে আড়াল করে নিজের সাথে নিজের কথা বলার একটা বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই অক্ষরযাপন। এইসব লেখালেখি রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবীকে আমূল বদলে দেবে, এমন গালভরা যুক্তি আমার নেই। তবে দায় আছে। সেই দায় থেকেই নিজেকে খুঁড়তে ভাল লাগে…

দর্পণ:

লেখালেখির ক্ষেত্র হিসেবে অণুগল্প আধুনিকতম ধারা, এই ধারায় লেখার চিন্তা কী কারণে?

মোহাম্মদ জসিম:

অতিসম্প্রতি অণুগল্প বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি ধারা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে এবং ক্রমে নিজেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। অণুগল্প এবং কবিতার মধ্যে অনেক সাহিত্যবোদ্ধা বিস্তর ফারাক মানেন। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। মনে হয়, গদ্যকবিতা এবং অণুগল্প খুব কাছাকাছি বয়সের ভাই-বোন। পাঠক হিসেবে সব ধরণের লেখাই পড়ি। লেখক হিসেবে নতুনত্ব ও নীরিক্ষার প্রতি প্রবল ঝোঁক থেকেই অণুগল্প লিখতে আসা। তবে এখন পর্যন্ত অণুগল্পে আমি নিজেকে ব্যর্থ লেখক হিসেবেই বলবো।

দর্পণ:

অণুগল্প ও ছোটগল্প এর মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলো কী কী?

মোহাম্মদ জসিম:

ছোটগল্পের চেয়ে অণুগল্পের ব্যপ্তি কম, তবে গভীরতা বেশি। শরীরের দিক দিয়ে ক্ষুদ্রায়তন। সাধারনত ৫০০ শব্দের মধ্যে অণুগল্পকে ধরার চেষ্টা করেন বেশিরভাগ অণুগল্পকার। কারো কারো মতে হাজার শব্দ। কেউ আবার এর বেশি হলেও আপত্তি করেন না। অণুগল্পের শুরুতে একটা চমক থাকে। ফিনশিংটাও হতে হয় সেরকম আশাপ্রদ। যেহেতু ক্ষুদ্রায়তন গল্প, তাই মেদহীন ঝরঝরে শব্দে অল্প কথায় বুনতে হয় শরীরটাকে। এখানে অতিকথনের সুযোগ নেই। খুব একটা সহজ না কাজটা। ছোটগল্পকাররা এক্ষেত্রে স্বাধীন। গল্প যতটা ডিমান্ড করে একজন ছোটগল্পকার ততটাই স্পেস ব্যবহার করতে পারেন নির্ভাবনায়।

দর্পণ:

গঠনগত দিক দিয়ে অণুগল্প কী কোনো সূত্র মেনে চলে?

মোহাম্মদ জসিম:

শুরুতে চমক, মেদহীন ঝরঝরে শরীর, শব্দের লিমিটেশন, পাঠককে ধাক্কা দেয়ার মতো একটা এন্ডিং এমন আরও কিছু গঠনগত সূত্রের কথা বলাবলি হয়। সূত্র মেনে গণিত হয়, সাহিত্য হয় না আসলে। একজন সাহিত্যিক কখনোই গণ্ডিতে আটকে থাকতে, আটকে রাখতে চাইবেন না। আমি চাই প্রচুর নীরিক্ষা হোক। নীরিক্ষা থেকে নতুন নতুন কনসেপ্ট আসুক সাহিত্যে। আমি নীরিক্ষা করতে পছন্দ করি। তাই আমার অণুগল্পকে আপাতত সুনির্দিষ্ট কোন সূত্রে আবদ্ধ করতে চাচ্ছি না।

দর্পণ:

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্পগুলো সম্পর্কে আপনার মন্তব্য…

মোহাম্মদ জসিম:

হাহাহা। প্রশ্নের মধ্যে আপনি নিজেই কিন্তু বললেন বলাইচাদ মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্প….। অর্থাৎ আপনি তার ক্ষুদ্রায়তন গল্পগুলোকে অণুগল্প বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এখনকার অনেক অণুগল্পকারই তার গল্পগুলোকে অণুগল্প বলতে নারাজ। কিন্তু তার গল্পগুলোকে ছাড়িয়ে যাবার মতো কিছু কি লিখতে পারছি আমরা? কিংবা ওই যে গঠনসূত্রের কথা বলা হলো সেই অনুযায়ী তার গল্প কী ভিন্ন কোন সূত্রাসূত্র বহন করে? একটু গভীরে গেলে এখনকার অণুগল্প আর বলাইবাবুর গল্পের পার্থক্য খুব সামান্যই মনে হবে। যদিও বহু লেখকের হাতেই অণুগল্পের সোনা ফলছে এখন। এইসব তর্ক তাত্ত্বিকরা করুন। আমি পাঠক হিসেবে সাহিত্যের রসটা নিচ্ছি, লেখক হিসেবে বনফুলের গল্পকে অণুগল্প বলতে আমার কোন আপত্তি নেই।

দর্পণ:

অণুগল্পের প্রতি পাঠকের আগ্রহ কেমন?

মোহাম্মদ জসিম:

আমার সাম্প্রতিক অবজারভেশনে মনে হচ্ছে পাঠক অণুগল্প নিয়ে দ্বিধান্বিত। কিছু কিছু পাঠকের আগ্রহ চরমে। কেউ কেউ তাচ্ছিল্যও করছেন। তবে পাঠকের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। এটুকু বলতে পারি অদূর ভবিষ্যতে অণুগল্প পাঠকের মন ও মননে রাজত্ব করবে।

দর্পণ:

আগামী গ্রন্থমেলায় “তামাশামণ্ডপ” নামে একটি অণুগল্পের বই আপনার আসছে, বইটি সম্পর্কে কিছু বলুন, কী মনে করে অণুগল্পময় একটি গ্রন্থ লিখলেন?

মোহাম্মদ জসিম:

আসলে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে “তামাশামণ্ডপ” লেখা নয়। বিভিন্ন সময়ে লেখা টুকরো টুকরো অণুগল্পকে একত্রে মলাটবন্দী করার চিন্তা থেকেই তামাশামণ্ডপের জন্ম। বইয়ে ছোট-বড় ৮০টির মতো গল্প আছে। বিচিত্র বিষয় ভাবনা, আঙ্গিক ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে লেখা গল্পগুলো। কয়েকটি রাজনৈতিক গল্প রয়েছে। আছে পরাবাস্তব বিষয়াদি নিয়ে কিছু লেখা। কোনো কোনো গল্প আদতে গল্পই না, আখ্যানমাত্র। বলা যায় কয়েকটি সার্থক অণুগল্পের সাথে অনেকগুলো ব্যর্থ গল্প, টুকরো ঘটনা ও অভিজ্ঞতার শব্দরূপ। বইয়ে অণুগল্প, মাইক্রো ফিকশন, ফ্লাশ ফিকশন ইত্যাদি বিভিন্ন আঙ্গিকের গল্প আছে। যারা অণুগল্প ভালবাসেন তাদের কাছে বইটি সমাদৃত হবে বলে আশা রাখি।

দর্পণ:

পাঠক কেন আপনার বইটি কিনবে?

মোহাম্মদ জসিম:

প্রথমত যারা ইতিমধ্যেই অণুগল্পের প্রেমে মজেছেন তারা বইটি ছুঁয়ে দেখতে পারেন। তাছাড়াও যারা বিচিত্র বিষয়, ভাবনা, উত্তেজনা পছন্দ করেন তারাও চেখে দেখতে পারেন। ব্যক্তি-মানসের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ, হতাশা, স্বপ্ন ও আশার সাথে সময় ও সমাজচিন্তার বহুমুখী প্রকাশে ভরপুর গল্পগুলো। এখানে কবিরা কবিতার স্বাদও পেতে পারেন যেহেতু গল্পগুলোর ভাষাটি কাব্যিক। এতসব কারণ প্রকরণ বাদ দিলে, আমি মনে করি, বইটি অণুগল্পের— এই একটা কারনেই অণুগল্পপ্রেমীরা বইটি কিনবে। অণুগল্প নিজেই সেই যাদুকরী শক্তিটি ধারণ করে।

দর্পণ:

তামাশামণ্ডপে দেখা গেছে আপনি অল্পকথায় ছোট ছোট ঘটনা বলেছেন, যেগুলোর একেকটির তাৎপর্য বিশাল, এখন কথা হচ্ছে অণুগল্পের মাহাত্ম্য কী শুধু এই তাৎপর্যে নিহিত? কাহিনির গুরুত্ব কতটুকু?

মোহাম্মদ জসিম:

না। অণুগল্পের মাহাত্ম্য শুধু এই তাৎপর্যের মধ্যে নিহিত না। তবে এই ছোট ছোট তাৎপর্যের গল্পগুলো এক ধরনের অণুগল্প হতে পারে, যেটা মাইক্রোফিকশন বা ফ্লাশ ফিকশনের সমগোত্রীয়। আবার কাহিনিসমৃদ্ধ অণুগল্পগুলো অন্য এক ধরনের অণুগল্প বা মূলধারার বাংলা অণুগল্প। আমি নীরিক্ষা ও বৈচিত্র্যের কথা বলতে চাইছি। নীরিক্ষাপ্রবণতা থেকেই এই ধরনের অণুগল্প লেখা। অনেক সমালোচকই এই ধরনের অণুগল্পকে নস্যাৎ করে দেন, ব্যর্থ বলে মনে করেন। বইয়ে কাহিনিনির্ভর ও কাঠামোবদ্ধ অণুগল্পও রয়েছে অনেকগুলো।

দর্পণ:

অণুগল্পে শব্দ নির্বাচনে বা একেকটি বাক্য গঠনে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হয়, এ বিষয়টাকে কীভাবে পরিচালনা করেন? একেকটি অণুগল্প লিখতে আপনার কত সময় লাগে?

মোহাম্মদ জসিম:

যেহেতু আমি মূলত কবিতার মানুষ, তাই কবিতা লেখার অভিজ্ঞতাটাই এ বিষয়ে যথেষ্ট সহায়তা করে। কবিতায় যেহেতু শব্দের বাহুল্য বা মেদ এড়িয়ে চলতে হয়। অণুগল্পের ক্ষেত্রেও আমি নিজস্ব কাব্যভাষাই ব্যবহার করে থাকি। কখনও দশ-পনের মিনিটে একটি অণুগল্প দাঁড়িয়ে যায়। কখনও ঘন্টাও চলে যায়। তবে অধিকাংশ গল্পের বিষয় ও প্লট দিনের পর দিন মাথায় ঘুরতে থাকে। লিখতে বসলে কয়েক মিনিটেই হয়ে যায়।

দর্পণ:

আপনি কবিতা লেখেন, ছোটগল্প লেখেন এবং অণুগল্পও লিখেছেন, এ তিনটির মধ্যে কোনটি লেখা বেশি পরিশ্রমসাধ্য বলে আপনার মনে হয়?

মোহাম্মদ জসিম:

আসলে প্রতিটি লেখাই শ্রমসাধ্য। তবে যে লেখাটি স্বঃতস্ফূর্তভাবে আসে সেটি মেধা, শ্রম, সময় সবই কম নেয়।

দর্পণ:

বর্তমান সময়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মোহাম্মদ জসিম:

এ এক নষ্ট সময়। চারদিকে হৈ—হল্লা। স্বার্থপর মুখ ও মুখোশের ছড়াছড়ি। নেপথ্যের মানুষটাকে ধরা খুব কঠিন। সামাজিক-রাজনৈতিক বাক ও ইচ্ছের স্বাধীনতা নেই। চিন্তাশীল মেধাবী মানুষগুলো বিকিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে পুরো পৃথিবীটাই একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আশার কথা— মানুষ সচেতন হচ্ছে। অনেকেই স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটার সাহস সঞ্চার করছেন, পথ দেখাচ্ছেন। ভরসা রাখি— সামনে আলোকিত একটি সময় অপেক্ষা করছে।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
ব্যক্তিত্ব

সরলাদেবী: সাহিত্য-সঙ্গীত-স্বদেশিকতার এক মূর্ত প্রতীক

মনোজিৎকুমার দাসের প্রবন্ধ সরলাদেবী: সাহিত্য-সঙ্গীত-স্বদেশিকতার এক মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রবলয়ে যে সব মহিলা সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে বাংলাসাহিত্যাঙ্গনে সমহিমায় ভাস্বর তাদের মধ্যে

গল্প

রাসের মেলা

আজ রাস পূর্ণিমা। রাসের মেলা বসেছে শহরতলির খালধারের এই রাস্তা আর দু-পাশে যেখানে যেটুকু ফাঁকা ঠাঁই আছে তাই জুড়ে। নামকরা

গল্প

যাইফুনিয়াম– ২৬৭

সকালবেলা ড্রাইভওয়ে থেকে গাড়ি বের করার সময় মুন দেখলো বাসার ভেতর থেকে সাইফ বের হয়ে এসে তাকে ডাকছে।  মুন গাড়িটা

গল্প

হারাণের নাতজামাই

মাঝরাতে পুলিশ গাঁয়ে হানা দিল। সঙ্গে জোতদার চণ্ডী ঘোষের লোক কানাই ও শ্রীপতি। কয়েকজন লেঠেল। কনকনে শীতের রাত বিরাম বিশ্রাম