কবিতাই আমাকে ‘হেলাল হাফিজ’ বানিয়েছে


হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। অল্প লিখলেও তিনি গল্প হয়েছেন অনেক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত কবির ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দেয়। জনপ্রিয় এই কবির একটি সাক্ষাৎকার দর্পণের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। সম্প্রতি সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন লেখক ও সাংবাদিক হাসান সাইদুল


এই অবস্থানে থেকে শৈশব কিংবা যৌবনকে কীভাবে অনুভব করেন?

খুব দুঃখ হয়। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে! এরপর শুরু হয় অবহেলা, অনাদর আর অভিমান। অভিমানের ভেতর লেখাপড়া, এরপর মুন্সিগঞ্জে এক স্কুলে চাকরি, আবার লেখাপড়ায় ফিরে আসা। তারপর কবিতার সঙ্গে ঘর-সংসার করতে গিয়ে কেটে গেল জীবন। এখন সব ছেড়ে চলে যাবার সময় হয়েছে।

হেলাল হাফিজ মানেই প্রেমের কবি, এই বিষয়ে আপনার কী মত?

আসলে আমি তরুণ- তরুণীদের কাছ বেশি জনপ্রিয় এ কারণেই। আমি শুনেছিও অনেকে বলে হেলাল হাফিজ একটি নেশার নাম। কিন্তু তা নয়, আমি বলি হেলাল হাফিজ একটি দিশার নাম। কিছু বিরহের কবিতা বেশি জনপ্রিয় হওয়ায় এ ধরণের একটা তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

‘যে জলে আগুন জলে’ গ্রন্থের একটি কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ সমকালে বেশ জনপ্রিয়। কবিতাটি লেখার পিছনের গল্পটা যদি বলতেন?

পাঠক এ কবিতাটির কথা বেশি উচ্চারণ করে বা মনে রেখেছে। অথচ এর চেয়ে আরও ভালো কবিতা আছে এই গ্রন্থটিতে। আসলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে কবিতাটি লেখা হয়েছিলো। কবিতাটি পত্রিকাতে প্রকাশ হওয়ার পর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেয়ালিকাও হয়েছিলো। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আমার জনপ্রিয়তা হয়ে যায় আকাশচুম্বী। এরপর আসে একাত্তর।এই দুঃসময়ে দেখা গেছে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি অনেকের মুখে মুখে ছিলো। আমি মনে করি, এক জীবনে এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। এখন এসে দেখছি সেই একাত্তরের মতোই কবিতাটি স্লোগানে পরিণত হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এর উচ্চারণও বাড়ছে। কবিতার নবীন পাঠকও কবিতাটিকে গ্রহণ করছেন।

আপনার কবি হওয়ার পেছনে কিসের প্রভাব ছিলো?

মাতৃহীনতা! যখন আমার তিন বছর বয়স, আমার মা মারা যান। ছোটবেলায় মা হারানোর বেদনাটা আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে। ধীরে ধীরে মাতৃহীনতার বেদনা আমাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরলো যে আমি আর এটা থেকে বের হতে পারলাম না। আমি নিজেকে কবিতায় নিয়ে আসলাম।

‘একজীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,/ এক মানবী কতোটাই বা কষ্ট দেবে!’ আপনার ‘প্রস্থান’ কবিতায় উল্লেখিত এই মানবী কে?

কবিতার সবটাই বলা ঠিক হবে না। বনলতা সেন কে ছিল আমরা কি জানি? জীবনানন্দ কী তা বলে গেছেন? প্রস্থান কবিতাটাও ঠিক এমনই।

একটা লেখা অথবা দু’চারটা বাক্য লিখলেই কি সেটা কখনো কবিতা হয়ে ওঠে?

কবিতা মানুষের মতো। তাকে খুব সুন্দরভাবে সাজাতে হয়। কবিতা লিখতে গেলে ছন্দ জানা বাধ্যতামূলক। কারণ ছন্দ জানা থাকলেই একটা একটা ঢঙ ছেড়ে আরেকটা ঢঙে দাঁড় করানো যায়। কবিতা হলো বুঝার বিষয়। তবে কোন কবিতা পাঠক গ্রহণ করবে এটা বুঝতে পারা বেশ কষ্টকর। আমার বিশ্বাস এই বিষয়টি কোনো কবিই বুঝতে পারেন না।

আপনাদের শুরুর সময় কবিদের মধ্যে কার সাথে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিলো?

আবুল হাসানের সঙ্গে। আমাদের মধ্যে সেই তখন সবচেয়ে ভালো লিখত। তার অস্বাভাবিক শক্তিশালী কবিতার লাইন ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’ তার লেখা কাব্যগ্রন্থের নামগুলোও ছিলো চমৎকার– ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করো’।

আচ্ছা, কবিতা আসলে আপনাকে কী দিয়েছে?

কবিতা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমাকে ‘হেলাল হাফিজ’ বানিয়েছে। একটা পরিচিতি পেয়েছি। কিন্তু আমার সব সময়ই মনে হয়, সে তুলনায় আমি কিছুই দিতে পারিনি।

আমাদের দেশে একটা দুঃখজনক রীতি আছে, কে বড় কবি কে ছোট কবি– এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

বড়-ছোট কবি নিয়ে তর্ক করার পক্ষে আমি নাই, আগেও ছিলাম না। এক সময় অপঠিত জীবনানন্দ এখন সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত কবি। এমনকি তিনি আমারও প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক, নজরুল বিপ্লবী, জীবনানন্দ নিসর্গ কবি, শামসুর রাহমান আধুনিক ও শহুরে কবি আবার আল মাহমুদ তো কৃষকের কাছে চলে গেছেন– তাই বড়-ছোট বলা কঠিন। কে বড় কবি, কে ছোট কবি সময় তা নির্ধারণ করবে। এ নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই। আর বড় ছোট নিয়ে তর্ক করা ঠিক নয়।

আপনি খুব কম লিখেছেন, মাত্র তিনটা কবিতার বই বের করেছেন। আপনার কি মনে হয়নি আপনি পাঠকদের ঠকিয়েছেন?

ভিতরে ভিতরে অপরাধবোধ কাজ করে। অনেক সময় নষ্ট করেছি। পাঠককে আমার আরো অনেক কিছু দেওয়ার ছিল, যা আমি করিনি। অনেক সময় অপচয় করেছি। এ জন্য আমি লজ্জিত, দুঃখিত। আসলে আমার কমপক্ষে ১৫টি বই থাকার কথা ছিল। অন্তত ১০টি বই থাকা উচিত ছিল। আমি এখন লিখতে বসলে হাত কাঁপে। পান্ডুলিপি করতে গেলে ভয় আসে। আমি ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব তো?

মৃত্যুকে নিয়ে আপনার দর্শন কেমন?

মাথার ভেতরে প্রায়ই মৃত্যুর কথা আসে। অনেক জুনিয়রও চলে গেছে। রুদ্র, আবিদ আজাদ তারা আমার কত ছোট বয়সে। অথচ তারা কত আগে চলে গেছে। আবার অনেকে পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। যেমন, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী। আমার মৃত্যু নিয়ে কোনো ভয় নাই। মরতে তো হবেই। এ নিয়ে আলাদা কোনো দর্শন নেই। মরতে হবে, তবে জানি না কবে!

মন খারাপ থাকলে কী করেন?

মানুষের আনন্দ বেদনা কারো সাথে ভাগ করতে পারলেই তার ভালো লাগা। যেহেতু আমি একেবারেই একা তাই কখনও বইয়ের আশ্রয় নে’ই কখনও ফেসবুকের আশ্রয় নে’ই।

আপনি কার কবিতা দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন?

আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি পড়তাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জীবনানন্দ দাসের কবিতা আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছিলো। আর আমার সমকালে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছি আবুল হাসান দ্বারা। আমি আমার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে একজনকেই ঈর্ষা করতাম। জীবদ্দশায় আমি আবুল হাসানকে বলেছিও, সে যদিও আমার দুই বছরের বড় কিন্তু আমাদের মধ্যে তুমি তুমি সম্পর্ক ছিল। দোস্ত, এক জীবনে যদি কোনো কবিকে ঈর্ষা করি সেটা তোমাকে। আবার যদি ভয় পাই সেটাও তোমাকে।

যদি কবি না হতেন…?

খেলোয়াড় হতাম। কবি হবো এমন ভাবনা কখনোই ছিলো না। সেই ছোটবেলায় নেত্রকোনার মতো মহকুমা শহরে বসে আমি লন টেনিস খেলা শিখেছিলাম। ফুটবল, টেবিল টেনিস, লন টেনিস এসব ভালো লাগতো।

ভক্তদের যা বলতে চান…

তারা যেন দোয়া করেন আমার জন্য যাতে আমার শরীরটা সুস্থ থাকে। একটু সুস্থ থেকে অল্প কিছু লেখালেখির যে ইচ্ছে আছে সেটি যেন সম্পন্ন করে যেতে পারি এই দোয়াটুকু চাই।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

বিবেক

শেষ রাত্রে একবার মণিমালার নাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার উপক্রম হইল। শিয়রে ঘনশ্যাম অত্যন্ত সজাগ হইয়াই বসিয়াছিল। স্ত্রীর মুখে একটু মকরধ্বজ দিয়া

গল্প

কর্নেলের প্রিয় পোষাপ্রাণী

নির্মল এবং নিরেট গ্রামীণ জনপদ থেকে জনাকীর্ণ শহরে আগমন। শিক্ষার প্রয়োজনই পদাপর্ণের পথ প্রসারিত করে। আর এতে অগ্রজই অগ্রণী ভূমিকা

মহিলা

এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো; এইখানে এসে প’ড়ে- থেমে গেলে- একটি নারীকে কোথাও

গল্প

কানা ও কালা কাহিনি

প্রতিদিনের মতো বিকেলে নদীর পাড়ের আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল। হঠাৎ মাইকে বাঁশির সুর ভেসে এলে ওরা সকলে চুপ হয়ে গেল।