রিগ্যান এসকান্দার-এর জন্ম ১২ জুন, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুষ্টিয়ায়। বর্তমান আবাসস্থল চুয়াডাঙ্গা জেলায়। তিনি চুয়াডাঙ্গার শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশে চিন্তা ও চর্চার দর্শন ‘চর্চায়ন’ নিয়ে কাজ করছেন। এসকান্দারের প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: দ্রোহশাস্ত্রবুলি (২০২০, আনন্দম প্রকাশনী), প্রেম কবলিত প্রসব (২০১৪), নারীগদ্য (২০০৭)।
দর্পণ:
মানুষ কেন কবি হয়ে ওঠে?
রিগ্যান এসকান্দার:
কবি নাজিম হিকমতের কবিতা মনে পড়ে, ‘যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর তা আজও আমরা দেখিনি।/ সব থেকে সুন্দর শিশু আজও বেড়ে ওঠে নি/ আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো আজও আমরা পাই নি।/ মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই, সে কথা আজও আমি বলি নি।’ এই যে না দেখা, না শোনা, না বলা কথাগুলোর পর্যবেক্ষণের চোখ, ভালোকে শ্রবণ করার সমৃদ্ধ কান ও কথার স্পষ্ট প্রকাশসমৃদ্ধ মুখের সঠিক ব্যবহার করতেই একজন মানুষ কবি হয়ে ওঠে।
দর্পণ:
মানুষের মনের সাথে কবিতার সম্পর্ক কী?
রিগ্যান এসকান্দার:
কবিতা আর মনকে পৃথক করতে পারি না আমি। কবিতা মানে মনপ্রকাশ। একজন কবির কবিতা পড়ে আপনি তাঁর মনকে পড়ে নিতে পারেন অনায়াসে। জীবনানন্দের কবিতা পড়ে তাঁর ব্যক্তি জীবনকে ধরা যায়, ওদিকে পাবলো নেরুদার কবিতা পড়েও বোঝা যায় ব্যক্তিজীবনে তিনি কতটা দ্রোহী। ঠিক একই ভাবে পড়ুন রুশ ফিউচারিজমের প্রতিনিধি কবি মায়াকোভস্কিকে। দেখবেন কীভাবে এ আগুন আত্মহত্যার মাধ্যমে শেষ হয়। কোনো ভাবেই মনকে লুকিয়ে আপনি ভং ধরতে পারবেন না। তা আমরা নজরুল-রবীন্দ্রনাথের বেলাও দেখেছি। একজনের নিয়ন্ত্রিত জীবন ও কবিতা, আরেক জনের ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এমন যা।’
দর্পণ:
দ্রোহের সাথে কবিতার সম্পর্ক বহুদিনের, ২০২০ গ্রন্থমেলায় আপনার প্রকাশিত গ্রন্থ “দ্রোহশাস্ত্রবুলি”– কী কী ধরনের দ্রোহের কথা বলছে?
রিগ্যান এসকান্দার:
প্রশ্নটি যদিও আমাকে ও আমার দ্রোহশাস্ত্রবুলি সম্পর্কে করা হয়েছে,
তবে নিরপেক্ষতার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি কবি অর্ক অপুর বয়ান কোট করছি-‘ রিগ্যান এসকান্দার রাষ্ট্রের বিজ্ঞাপনি অলংকারের মোড়ক উলঙ্গ করে আক্রান্ত শরীরের আকুতিকে নিয়ে আসেন সামনে। সে আকুতি নগর জীবনের যন্ত্রণার, প্রেমের, সাম্যের, উপনিবেশ ফাঁদের, পারিবারিক কৃষি জীবনের। কবিতার মূর্ত এবং বিমূর্তার আড়ালের গল্প বলা তার স্বভাব।’ আমি শুধু বলব, এ কাব্যগ্রন্থে অগ্নিফুল ফোটানোর কৌশল আছে। আমি নতুন করে কোনো দ্রোহ আনি নাই। আমি ফুলকে গ্রেনেড বানিয়েছি এখানে। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের বেদনাকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। এটাই এ কাব্যগ্রন্থের ম্যাজিক। আলাদা করে রাষ্ট্র নিয়ে কিছু বলিনি, সাম্যবাদের বুলি অওড়াইনি। দ্রোহের কবিতাগুলোতে সাধারণত আলাদা করে সুর তুলতে হয়। আমি ওপথে না হেঁটে, হেঁটেছি চেনা পথে, পরিবারের গল্প বলেছি। আর আমার পরিবারের একতলা ঘরেই এসে ভিড় করেছে রাষ্ট্র, ঔপনিবেশিক চাতুর্য, অমানবিক দেবতা। আর নিজ ঘরের মধ্যে এদেরকে আমি একা পেয়ে দরজা বন্ধ করে গালিগালাজসহ আচ্ছা মতো পাছার ছাল তুলে নিয়েছি। এই জাগায়ই দ্রোহশাস্ত্রবুলি স্বতন্ত্র। আর রাষ্ট্র, ঔপনিবেশিক চাতুর্য, অমানবিক দেবতাকে দেওয়া আমার বুলিই হলো ‘দ্রোহশাস্ত্রবুলি’।
দর্পণ:
দ্রোহশাস্ত্রবুলি কী বিপ্লবের নতুন স্বর হতে পারবে?
রিগ্যান এসকান্দার:
বিপ্লবের কোনো নতুন সুর হয় না। এসুর আদি ও অনন্ত। বিষয় হলো আপনি কতখানি বিপ্লব ঘটাতে পারলেন। ধরুন আপনি ৭০ ভাগ বিপ্লব ঘটালেন, আর একজন ১০০ ভাগ বিপ্লব ঘটালো, তখন মনে হবে ১০০ ভাগ বিপ্লব ঘটানো ব্যক্তি নতুন সুর তুলেছেন। কেউ গালিগালাজ দেয়, কেউ আবার কথা দিয়েই খ্যান্ত না হয়ে চাকুও বসিয়ে দেয়। আমি তাই কোনো সুর আনার চেষ্টাই করিনি। জাস্ট এ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ‘গুষ্টিমারি’ বলে গালিগালাজ দেওয়ার পর এদের বুক বরাবর চাকুটা বসিয়ে দিয়েছি। তবে কৌশলে ভিন্নতা আছে, ওই যে বললাম, রাষ্ট্র ও সমাজকে নিজ ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ইচ্ছা মতো ঠাপানো।
দর্পণ:
বিষয়বস্তু নির্বাচনে বর্তমান সময়ের কবিরা কতটুকু সচেতন?
রিগ্যান এসকান্দার:
বর্তমান সময়ের কবিরা ভালো লিখছেন। সচেতন হয়েই লিখছেন। আমি বর্তমানদের দেখেই শিখি। এঁরা আমার মূল পাঠ্যপুস্তক। পুরোনোরা আমার মূল পাঠ্যপুস্তক নয়, পুরোনোরা হলো আমার গাইড বই। আমি গাইড বই পড়ি জাস্ট মূল পাঠ্যবইকে বোঝার জন্য।
দর্পণ:
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কবিমানসে কেমন প্রভাব ফেলে?
রিগ্যান এসকান্দার:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভেতরে আমি শুধু ফেসবুক ইউজ করি। তাই এ সম্পর্কে বলতে পারি। বাকিগুলো সম্পর্কে আমার ধারনা নেই। ফেসবুক কবিমানসে সঠিক ভূমিকা রাখছে। এখনকার কবিরা ফেসবুকে নিজেদের একটা কাব্য জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। একজন আরেক জনের কবিতা পড়ার সাথে সাথে তাকেও পড়তে পারছেন, এতে করে কবিতার বিষয়বস্তু নির্ণয়ে দারুণ উপকার হচ্ছে। কারণ, এখানে কবিতার সাথে সাথে কবির যাপন সম্পর্কেও জানা যায়। আমার কাছে কবি যত না লেখার বিষয়, তার চেয়ে বেশি যাপনের। কবিতা লেখা সহজ হলেও কবি জীবনযাপন করা খুব কঠিন। প্রভাবশালী কবিদের দিকে তাকালে দেখবেন, তাদের আকর্ষণীয় কবিতার পাশাপাশি একটা আকর্ষণীয় জীবনও আছে। ফেসবুক বর্তমানে যেন এ কাজটা করার ইজারা নিয়েছে ।
দর্পণ:
অনেকে বলে থাকেন, কোনো সাহিত্যকর্ম মুদ্রণ হবার পর সেটি একটি পণ্যে পরিণত হয়ে থাকে, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
রিগ্যান এসকান্দার:
আপনার প্রশ্নের ভেতরই উত্তরটা আছে। ওই যে বললেন মুদ্রণ হওয়ার পর। হ্যাঁ, মুদ্রণ হওয়ার পর এটার বাজার মূল্য থাকতে হয়। মুদ্রণের সাথে সাথে এ শিল্প বা শিল্পীর সাথে আরো অনেক কিছু জড়িয়ে যায়, কাগজ, প্রেসের মেশিন, ছাপাখানার শ্রমিক, সর্বপরি প্রকাশক। তার মানে ছাপাখানায় যাওয়ার সাথে সাথে এর বাণিজ্যিক ব্যয় শুরু হয়ে যাচ্ছে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য। আর যার বাণিজ্যিক ব্যয় আছে, তাকে বাণিজ্যিক আয়েও আসতে হবে। আর যার আয়-ব্যয়ের সমীকরণ আছে, সে তো অবশ্যই পণ্য, একথা অস্বীকার করা হলো নিজেকে মহান হিসেবে প্রকাশ করা, মহানের ভং ধরা। হ্যাঁ। তবে ছাপাখানায় যাওয়ার আগের গল্পটা ভিন্ন। ছাপাখানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটাকে পণ্য ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এসময় একটি লেখা হলো একশো পারসেন্ট শিল্প, আর একজন লেখক হলেন শিল্পী। এখানে বাণিজ্যের সূত্র মনে না রেখেই একজন শিল্পী তার শিল্পকে রূপদান করেন। এই যে মস্তিষ্ক থেকে ছাপাখানা পর্যন্ত শিল্পের যে জার্নি, এ সময় আপনাকে বাণিজ্যের সূত্র ভুলতেই হবে। যে লেখক এটা পারেন, তিনি মহান লেখক হয়ে ওঠেন। আর যারা পারেন না, মানে ছাপাখানায় যাওয়ার আগেই বাজার বা বাণিজ্যের সূত্রে তাঁর সৃষ্টি বা শিল্পকে ফেলে বিচার শুরু করেন, তিনি তখন হয়ে ওঠেন ‘বাজারি’ লেখক।
দর্পণ:
এসময়ে কবিদের সবচেয়ে হীনমন্যতার দিক কোনটি?
রিগ্যান এসকান্দার:
নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় হীনমন্যতা। এতে করে লাভও হয়। কিছু মুরিদান, চাটুকার মেলে, পরবর্তীতে মেলে একাডেমিক পুরস্কার। এ রকম দেখেছি আমরা। বিশ্বাস না হলে ফেসবুকে দেখবেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া প্রবীণ কবিও নতুন লিখতে আসা এক কবিকে গালিগালাজ করছেন নিয়মিত, এটা এখন অপেন সিক্রেট। সকলেই জানে। অথচ একাডেমি দেখবেন তার সাথে বসে চা খায়, তাঁর জন্মদিন পালন করে। এতে করে নতুন ছেলেটার জন্মদিন তো দূরের কথা, তাঁর জন্মটাই স্তম্ভিত হতে পারে। মসজিদের বড় আলেমটা বোঝে না, ফুটপাতে চট-ছালা গায়ে দেওয়া পাগলাটাও তাঁর চেয়ে বেশি এলেম থাকতে পারে। বুঝবে কি করে, এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কবিতার ইহজাগতিক খোঁজ রাখে, কবিতার মারিফত জ্ঞান এদের নাই। তাই কবিতা জগতের মারিফতের পাগলকে চেনার ক্ষমতাও এদের নাই।
দর্পণ:
আপনি সাহিত্যের একটি সংগঠনের সাথে সংযুক্ত, এজন্য প্রশ্নটা আসছে, সাহিত্যিকের সাহিত্যিক হয়ে পিছনে একটি সংগঠন কী কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?
রিগ্যান এসকান্দার:
হ্যাঁ, আমি একটি সাহিত্য সংগঠনের যুক্ত। তবে আমি মনে করি সংগঠন কোনো সাহিত্যিক তৈরি করার ক্ষমতা রাখে না। তাহলে প্রশ্ন আসে আমি কেন সংগঠন করি। বলছি। ধর্ম-কর্ম পালন করার জন্য মানুষ যেমন মসজিদ তৈরি করে। মনে প্রশান্তি আসে। চর্চা হয়। ঠিক তেমনি সাহিত্যিকরা সাহিত্য সংগঠন করে। এতে প্রশান্তি আসে। চর্চাটা হয়। তবে সাহিত্যিক মূলত নিজেকেই হয়ে উঠতে হয়। আপনি সংগঠনমুখী না হয়েও এ প্রশান্তি পেতে পারেন। লেখালেখি করতে পারেন। এখানে গীর্জায় যাওয়া আর না- যাওয়াটা মুখ্য নয়, মুখ্য হলো আপনাকে ধার্মিক হয়ে ওঠা। ঠিক একই রূপ সংগঠন এখানে মুখ্য বা অবশ্য কর্তব্য নয়, মুখ্য হলো নিজেকে তৈরি করা, সাহিত্যিক হয়ে ওঠা।
দর্পণ:
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ঘিরে যে উৎসব এটা আপনাকে কতটুকু স্পর্শ করে?
রিগ্যান এসকান্দার:
একবার বলেছিলাম, বাংলা একাডেমি যদি একটা ভালো কাজ করে থাকে, তবে সেটা হলো বইমেলার আয়োজন করা।