পলাশ মজুমদারের ভ্রমণকাহিনি
‘যখন রব না আমি মর্ত্য কায়ায়
তখন স্মরিতে যদি হয় মন,
তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়
যেথা এই চৈত্রের শালবন।’
বিশ্ববরেণ্য বাঙালি প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর কীর্তি ‘শান্তিনিকেতন’। প্রাচ্যের অন্যতম বিদ্যাপীঠ। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষের পদচারণে ধন্য পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরের এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গন।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন পৃথিবীর সৃজনশীল মানুষেরা আসুক শান্তিনিকেতনে, জ্ঞানচর্চায় নিরত হোক, বিশ্ববাসীর কাছে এ স্থানকে পরিচিত করে তুলুক। তিনি জানতেন, একদিন তাঁকে ছেড়ে যেতে হবে মধুময় ধূলির এই মায়ার পৃথিবী, তাঁর প্রাণের শান্তিনিকেতন।
চরম সত্যটি সব সময় উপলব্ধি করতেন বলে সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থের ‘স্মরণ’ কবিতায় অনাগত-কালের ভক্তদের রবীন্দ্রনাথ আহ্বান করেছেন এই বলে যে, চৈত্রদিনে যেন তারা তাঁকে খুঁজে বেড়ান শান্তিনিকেতনের এই নিবিড় শালবনে। তিনি গেয়েছেন—
‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি— আহা,
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’
আমরা (আমি ও বন্ধু খোকন) যখন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে বোলপুর স্টেশনে পা রাখি, তখন দুপুর ১টা। সেদিন ৩০ চৈত্র ১৪০৯ বাংলা। স্টেশন থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে ঢুকলাম শান্তিনিকেতনের সুনিবিড় ছায়াতলে। মনে হচ্ছে যেন নিজের বাড়িতে এসেছি। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে শান্তির পরশ। ছায়াঢাকা পাখিডাকা শালবন আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে অপার শান্তির দেশে।
শহরের কোলাহল নেই এখানে। নেই দূষিত বাতাস। রাস্তার দুধারে সাজানো সুন্দর সুন্দর বাড়ি। রিকশা পৌঁছাল রতনপল্লির কাছাকাছি একটি হোটেলের সামনে। সেখানে কথা বলে ভাড়া একটু বেশি মনে হলো। বের হয়ে রিকশাওয়ালাকে বললাম, ক্যাম্পাসের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার হোটেলে নিয়ে যেতে।
রিকশাওয়ালা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছাকাছি আরেকটি হোটেলে নিয়ে গেল। ম্যানেজারের অভ্যর্থনা ভালো লাগে আমাদের। পরিচয় দেওয়ার পর তিনি নিজের নাম সুমন পাল বলে জানালেন। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে খুব প্রীত মনে হলো তাকে। জানালেন, তার পূর্বপুরুষের বাড়ি খুলনার বাগেরহাট। খাতির হতে বেশি সময় লাগেনি। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ সুমনদা। বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। তার কথাবার্তা পছন্দ হওয়াতে আমরা ওই হোটেলে উঠলাম।
হোটেলের নিচের এক অংশ রেস্টুরেন্ট। সেখানে দুপুরের আহার সেরে বেশ কিছুক্ষণ ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, শান্তিনিকেতনে এসেছি আমি। বাংলা সাহিত্য যেদিন আমার মনে প্রথম আলোড়ন তুলেছিল, রবীন্দ্রনাথকে যেদিন প্রথম বুঝতে শিখেছি, তখন থেকে এ দিনটির জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম। মনের কল্পনায় কতবার ভ্রমণ করেছি এই তীর্থস্থান। কেবল স্বপ্নেই দেখেছি; কখনো বাস্তবে রূপ নেবে, তা ভাবিনি। আজ যেন আমার জীবন পূর্ণতার অভিমুখে এগিয়ে যাবে।
বিকেলে বের হই আমরা। হাঁটতে থাকি। এগিয়ে যাই বুনো পথ ধরে। পাখির কলকাকলিতে মুখর চারদিক—যেন কোনো একটি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলছি আমরা। সবই অচেনা। কোনো গন্তব্য নেই। পরিচিত কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই যে তার কাছ থেকে সহযোগিতা নেব। তাই এগোতে থাকি উদ্দেশ্যহীনভাবে।
বিশাল মাঠ, ছোট ছোট প্রাঙ্গণ, বন-বনানী, হরেক কিসিমের ভবন, মাঝে মাঝে পিচঢালা রাস্তা, পাশে সুন্দর সুন্দর সাজানো বাড়ি, অপরিচিত মুখ—এ সবের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম একেবারে রবীন্দ্র-ভবনের সামনে। থমকে দাঁড়াই। ভবনটির চারদিক দেয়ালঘেরা। গেটের সামনে সাইনবোর্ডে বিস্তারিত পরিচিতি দেয়া আছে। সব পড়ি খুঁটে খুঁটে আর জানার চেষ্টা করি।
এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি বাড়ি—উত্তরায়ণ, উদয়ন, শ্যামলী, কোনার্ক ও উদীচী। কাউন্টারে টিকিট কাটার জন্য যেতে দারোয়ান বাধা দিয়ে বলল—‘আজকের মতো পরিদর্শন একটু আগে বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের সময়। দেখতে চাইলে আপনারা বৃহস্পতিবার সকালে আসবেন।’
দারোয়ানের কথা শুনে আমরা বেকুব বনে গেলাম। বলে কি লোকটা! সেদিন রবিবার, সোম-মঙ্গল নববর্ষের বন্ধ, বুধবার সাপ্তাহিক ছুটি—ব্রাহ্মদের প্রার্থনার দিন। দারুণ হতাশ হয়ে পড়লাম। ফিরে যাচ্ছিলাম এ ভেবে যে, তিন দিন না থাকলে রবীন্দ্র-ভবন দেখা হবে না। হঠাৎ গেটের একপাশে দেয়ালে খোদাই করা একটি কবিতার চরণে আমার চোখ আটকে যায়—
এখনো অংকুর যাহা
তারি পথ পানে
প্রত্যহ প্রভাতে রবি
আশীর্বাদ আনে।
ভাবি—এই চরণ কি আমার উদ্দেশে লেখা? তিনি কি জানতেন যে আমি একদিন এখানে আসব? তাই এমন কবিতা লিখে রেখে গেছেন। আমার মধ্যে আমি আমার মতো হাজার হাজার রবীন্দ্রানুরাগীকে দেখতে পাই। তিনি আমাদের উদ্দেশে বুঝি এ পঙক্তি লিখেছিলেন। তাঁর আশীর্বাণী পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দিল আমার মন-প্রাণ। মনে মনে প্রণাম জানিয়ে বলি—আপনি যথার্থই গুরুদেব; আপনি নমস্য।
এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। সাঁঝের ম্লান আলোয় আবিস্কার করি একটি ছাত্র হোস্টেল। ঢুকে পড়ি সেখানে। একটি রুমে উঁকি দিয়ে উপস্থিত কয়েকজন ছাত্রের কাছে জানতে চাই, এখানে বাংলাদেশের কোনো ছাত্র আছে কি না। একটি ছেলে জানায়, শুভ্র গুহঠাকুরতা নামে উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া বাংলাদেশের একটি ছেলে ওদের রুমমেট। তবে শুভ্র এখন বাইরে আছে। তারা আমাদের বসতে অনুরোধ জানায়।
তো শুভ্রের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওর রুমমেট বীরভূম, মেদিনীপুর আর হুগলীর কয়েকজন ছেলের সঙ্গে গল্প করে বেশ মজা পেলাম। খোঁজখবর নিলাম ওদের পড়াশোনার বিষয়ে। বাংলাদেশের কোনো কবির কবিতা জানে কি না জিজ্ঞেস করতে একজন জানায়, পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের কবিতা ওদের পাঠ্য। ওরাও আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নেয়।
ইতিমধ্যে শুভ্র এসে হাজির। ছেলেটির ব্যবহার এত অমায়িক ও স্বতঃস্ফূর্ত যে আমাদের আপন করে নিল মুহূর্তে, যেন আমাদের অনেক আগ থেকেই চেনে সে। জানতে পারলাম, তার বাড়ি রাজশাহীতে।
কথা বলতে বলতে শুভ্র আমাদের নিয়ে এল ব্রাহ্ম-মন্দিরে, যেখানে চৈত্র-সংক্রান্তির প্রার্থনা চলছে রবীন্দ্রনাথের গানে গানে। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম পাশে। মন্দিরটি সম্পূর্ণ বেলজিয়াম কাচ দিয়ে তৈরি। মন্দিরের নান্দনিক সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে ভীষণ।
প্রার্থনার পর ঘুরে ঘুরে মন্দিরটি দেখতে লাগলাম। একপাশে গেটে ঢুকতে ফটকের ওপর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা খোদাই করা—‘এখানে কোন দেব-দেবী, ফল-মূল, পশু-পাখির মাংস ঢোকানো যাবে না।’
ব্রাহ্ম-ধর্মাবলম্বী রবীন্দ্রনাথ যে মূর্তি-পূজাবিরোধী এবং একেশ্বরবাদী ছিলেন, মন্দিরের দেয়ালে খচিত বিভিন্ন বাণী আর নিয়মকানুন তা-ই ধারণ করছে। প্রতিটি লেখা পড়লাম মনোযোগ দিয়ে।
সেখানেই শুভ্র পরিচয় করিয়ে দেয় বাংলাদেশের আরেকটি ছেলের সঙ্গে। নাম সুশান। আসল নাম আহমেদ শাকিল হাশমী। সুশানও রাজশাহীর ছেলে। রবীন্দ্রসংগীতে পড়ছে সেখানে। দ্বিতীয় বর্ষে।
বর্তমানে (২০১০ সাল থেকে) সুশান ত্রিশাল নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। অদ্যাবধি আমার যোগাযোগ আছে তাঁর সঙ্গে। বিশ্বভারতীর পাঠ শেষ করে ২০০৭ সালে সুশান যখন ঢাকায় ফেরে তখন আমি তাঁকে খুঁজে বের করি। কারণ তত দিনে মোবাইলের যুগ এসে গেছে। শান্তিনিকেতন ফেরত এক ছাত্রের কাছ থেকে আমি তার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করি। এখন সে আমার ফেসবুক বন্ধু। থাকেও আমার কাছাকাছি। প্রায়ই কথা হয়।
তো সুশানের মাধ্যমে সেখানে পরিচয় হয় অংকন বসুর সঙ্গে; তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে অংকনদা আমাদের সঙ্গে মিশতে বেশ আগ্রহী হলেন। জানালেন, তার পূর্বপুরুষরা বরিশালের। ব্যস, আড্ডা জমে ওঠে।
তারপর সবাই চলে এলাম রাস্তার ধারের একটি রেস্টুরেন্টে। আমাদের গল্প যেন আর ফুরোচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, সমরেশ, শামসুর রাহমান, তসলিমা নাসরিন থেকে শুরু করে হালের সব কবি-সাহিত্যিক, বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত রাজনীতি এবং সম্পর্ক, খেলাধুলা কিছুই বাদ গেল না। কখন যে দশটা বেজে গেল, টের পাইনি।
অংকনদা ও সুশান কথা বলতে বলতে আমাদের হোটেলের কাছে চলে এলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরো আধা ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে তারা বিদায় নিলে আমরা রুমে ফিরে যাই।
দুই.
আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।
তার আকাশ-ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে,
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন।।
মোদের তরুমূলের মেলা, মোদের খোলা মাঠের খেলা,
মোদের নীল গগনের সোহাগ-মাখা সকাল-সন্ধ্যাবেলা।
মোদের শালের ছায়াবীথি বাজায় বনের কলগীতি,
সদাই পাতার নাচে মেতে আছে আমলকী-কানন।।
আমরা যেথায় মরি ঘুরে সে যে যায় না কভু দূরে,
মোদের মনের মাঝে প্রেমের সেতার বাঁধা যে তার সুরে।
মোদের প্রাণের সঙ্গে প্রাণে সে যে মিলিয়েছে এক তানে,
মোদের ভাইয়ের সঙ্গে ভাইকে সে যে করেছে এক-মন।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এই প্রাণের গানটিই শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর—ছাত্র-ছাত্রী তথা শান্তিনিকেতনের আশ্রমবাসীদের জাতীয় সংগীত। প্রাণের গীতি।
প্রকৃতির যে মায়াময় রূপ, নিসর্গের যে অবর্ণনীয় সৌন্দর্য তিনি এই গানে এঁকেছেন, তা এক কথায় অনন্য। যিনি শান্তিনিকেতনে কখনো যাননি, গানটি শুনেই তিনি বুঝতে পারবেন এখানকার প্রকৃতির অনবদ্য রূপ; মনের অজান্তে টের পাবেন নিবিড় হাতছানি।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন—শান্তিনিকেতনের মতো ‘এমন ঋতুর লীলারঙ্গ’ তিনি আর কোথাও দেখেননি। সত্যি, এক একটি ঋতু এমন স্পষ্টভাবে তার উত্তরীয় পরিবর্তন করে, তা দেখে ও মর্মে উপলব্ধি করে সম্ভবত গুরুদেব রচনা করতে পেরেছিলেন গীতবিতানের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক গানগুলো, যা আজ বাঙালির প্রাণের সম্পদ।
তাই তো বৈশাখে এখানে বসেই লেখা সম্ভব—‘ডাকো বৈশাখ, কাল বৈশাখী, করো তারে লীলা সঙ্গিনী’, বর্ষায়— ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’, শরতে—‘শরৎ ডাকে ঘর ছাড়ানো ডাকা, কাজ ভোলানো সুরে’, শীতে—‘শীতের বনে কোন সে কঠিন আসল বলে’, অথবা বসন্তে— ‘আহা আজি এ বসন্তে, এতো ফুল ফোটে, এতো বাঁশি বাজে’—ইত্যাদি কত না গান।
এই শান্তিনিকেতনে এসেই তিনি ভুলে গিয়েছিলেন শহরের যত অবসাদ আর ক্লান্তি। তাই তিনি লিখেছিলেন—
বহুদিন মনে ছিল আশা
ধরণীর এক কোণে
রহিব আপন-মনে
ধন নয়, মান নয়,
একটুকু বাসা।
১৮৬৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়া ভুবনডাঙ্গার (স্থানীয় ভুবন ডাকাতের নামানুসারে এই এলাকার এমন নামকরণ হয় বলে অনেকের ধারণা) একটি দুই কক্ষের ঘরের নামকরণ করা হয় ‘শান্তিনিকেতন’। জনশ্রুতি আছে, মহর্ষি একবার গরুর গাড়িতে চড়ে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন; বিশ্রামের জন্য হঠাৎ থেমেছিলেন এই শান্ত নিরিবিলি ছায়াঘেরা স্থানে। তখন শান্তির পরশ ছুঁয়ে যায় তাঁর মন।
রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়, পিতৃদেব ওই সময় প্রায়ই হিমালয়ে চলে যেতেন। তিনি নিজেও একবার পিতার সঙ্গী হয়েছিলেন। প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শ কবির ছোটবেলার সেই দিনগুলোকে ভরে দিয়েছিল আনন্দে; প্রকৃতির মাঝে তিনি পেয়েছিলেন মুক্তি, যা তাঁর পরবর্তী জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য তাই হয়ে উঠেছে প্রকৃতিমুখী।
কখনো ঈশ্বর-সান্নিধ্য লাভের বাসনায় দেবেন্দ্রনাথ ভাসতেন চুঁঁচুড়ার মাঝ-গঙ্গায়। বজরাতে। দিনের পর দিন। কোনো দরকার ছাড়া গৃহে ফিরতেন না। এ জন্য ছোটবেলায় পিতার সঙ্গ তিনি খুব কম পেয়েছেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ একা নন, তাঁর ভাইবোনেরাও পিতাকে তেমন পেতেন না। জমিদারের সন্তান হয়েও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সম্পূর্ণ অবৈষয়িক।
সাধক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধনার উৎকৃষ্ট স্থান হিসেবে ভুবনডাঙার এই জনশূন্য নিবিড় ভূমিকে বেছে নিয়েছিলেন।
এখানে ব্রহ্মকে তিনি ঘোষণা করেন—
তিনি
আমার প্রাণের আরাম
মনের আনন্দ
আত্মার শান্তি।
একসময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছে প্রকাশ করেন এখানে ছেলেদের শিক্ষার জন্য একটি ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন। দায়িত্বভার অর্পণ করেন ৪০ বছর বয়সি পুত্র রবীন্দ্রনাথের ওপর, যাঁর কবিখ্যাতি তখন মধ্যগগনে।
মাত্র তিনজন ছাত্র নিয়ে ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ এই বিদ্যালয়ের পত্তন করেন। এর মধ্যে একজন রবীন্দ্রনাথের ১০ বছর বয়সি পুত্র। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ পুরো পরিবার নিয়ে চলে আসেন এখানে—যদিও তখন তাঁর বেশির ভাগ সময় কাটছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। জমিদারি পরিদর্শনে। পরিবার নিয়ে থাকতেন সেখানে। পিতার সিদ্ধান্তে তাঁকে সপরিবার বোলপুরে চলে আসতে হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় বাঙালি-সমাজ কর্তৃক ইংরেজ পণ্য ও স্কুল বর্জনের সিদ্ধান্তে এই বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। রাজধানী কলকাতা থেকে ১১৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাণ্ডববর্জিত বীরভূমের এই নির্জন স্থানে রবীন্দ্রনাথ শিশু-শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেকে গড়ে তুললেন ‘গুরুদেব’ হিসেবে।
পরবর্তী সময়ে ১৯২১ সালে ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দশ বছর পর ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভারত সরকারের পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বাবধানে চলে আসে। তখন অনেক বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাবিদ এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত।
এখানে পদধূলি পড়েছে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, প্রথম রাষ্ট্রপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং তৎকালীন বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদসহ ভারত-বিখ্যাত অনেক নেতার। এখানে পড়েছেন আধুনিক ভারতের অগ্নিকন্যা নেহেরু-তনয়া প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
উল্লেখ্য, অমর্ত্য সেনের মাতামহ আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ছিলেন বিধায় তাঁর মা অমিতা সেন বাবার কাছে সেখানে থাকতেন এবং তাঁর জন্মও ওখানে। শোনা যায়, অমর্ত্য সেনের নামটিও নাকি রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং।
এখানে আরো পড়েছেন স্বনামধন্য বাঙালি সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার ও চিত্রশিল্পী সত্যজিৎ রায়, ভাস্কর নন্দলাল বসু, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, ড. আশরাফ সিদ্দিকী এবং ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন, অধুনা বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, পাপিয়া সরোয়ার, লিলি ইসলাম, অণিমা রায় ও অদিতি মহসীন।
নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত স্থান হওয়াতে প্রতিবছর এখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। কেবল বাঙালি নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ ছাড়াও সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর মানুষের আগমন ঘটে শান্তিনিকেতনে। বিশেষত কলকাতায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষালয়।
কলকাতা থেকে অনেকে সকালে এসে বিকালেও ফিরে যান; অবস্থান করেন ঘণ্টা দুয়েক। কলকাতা টু বোলপুর এবং বোলপুর টু কলকাতা বেশ কয়েকটি ট্রেন আসা-যাওয়া করে প্রতিদিন। লোকাল ট্রেন ছাড়া বিরতিহীন ট্রেনও রয়েছে।
এখানেই রচিত হয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্যের বিশাল একটি অংশ; এই বাড়িগুলোতে বসেই তিনি দিনে-রাতে সকাল-সন্ধ্যায় গড়েছেন সেসব মূল্যবান সাহিত্যকীর্তি। কেবল সেই কারণে এখানকার বাড়িগুলো ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দাবিদার।
আমি জ্ঞানের পূজারি বলেই জ্ঞানী মানুষ আমার নমস্য। তাঁদের পদচারণে ধন্য স্থানের প্রতি হৃদয়ে দুর্বলতা ছিল ছোটবেলা থেকে। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষানির্বিশেষে সব জ্ঞানীর সমান আসন। তাই আমার শান্তিনিকেতনে আসাটা যেন তীর্থস্থান পরিভ্রমণের মতো।
তিন.
আজ পয়লা বৈশাখ ১৪১০ বাংলা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে একা একা হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলাম চারপাশ। মনে মনে বলি—গুরুদেব এ সংগঠনের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত নিন্দা-অপমান নীরবে সয়েছেন, তবু পিছপা হননি।
এই সংগঠন গড়তে তিনি যে শ্রম দিয়েছেন, মেধা খাটিয়েছেন, অর্থসাহায্যের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছেন—তা না করে যদি ওই সময়টা লেখার জন্য ব্যয় করতেন তবে আমরা পেতাম আরো সমৃদ্ধ আরো বিশাল রবীন্দ্র সাহিত্য-ভুবন।
নিজের অনেক ক্ষতি স্বীকার করেও তিলে তিলে তিনি যে একে গড়ে তুলেছেন, তা-ই রবীন্দ্রকর্মের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মকে এভাবে সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর অন্য সব সাহিত্যিক থেকে আলাদা।
এই প্রতিষ্ঠানকে তিনি গড়েছেন নিজ খেয়ালে; আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। প্রতিটি জিনিসের প্রতি ছিল তাঁর সুতীক্ষè নজর। তিনি যে কেমন যত্নবান ও রুচিশীল মানুষ ছিলেন, শান্তিনিকেতনের সর্বত্র তার বহিঃপ্রকাশ দেখে অনায়াসে বোঝা যায়। প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে মুক্তিপিয়াসী কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীরা যেন প্রকৃত মানুষ হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারে—তার সব ব্যবস্থা তিনি করে গেছেন।
প্রাতরাশ সেরে অনেকক্ষণ হাঁটলাম চারপাশে। তারপর হোটেলে ফিরে এসে স্নান করলাম। এর মধ্যে শুভ্র এসে হাজির; আমাদেরকে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবে সে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক উত্তরাধিকারী বিশ্বভারতীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সুপ্রিয় ঠাকুর।
পরে জেনেছি, তিনি রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র। আমরা পৌঁছার পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। দলে দলে শিল্পীরা বর্ষবরণের গানসহ বিভিন্ন রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। কখনো এককভাবে। কখনো সমবেতভাবে।
সুশান, স্বপনদা, দেবদাসদা, ঊর্মিমালাদি, শোভাদি, অংকনদা, অংকনদার বান্ধবী শুক্লা, সুশানের কলকাতার বন্ধু আনিস, আনিসের বান্ধবী শ্রুতি ও শ্রুতির বোন সুবর্ণাসহ প্রায় ১০-১২ জনের একটি দল আমাদের সঙ্গে মিশে যায় অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে।
শ্রুতি ও সুবর্ণার বাড়ি ময়মনসিংহে, আনিসের বাড়ি জামালপুরে। আনিস ও শ্রুতি কলকাতা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়তে গেছে। আর শ্রুতির বোন সুবর্ণা পড়ে বিশ্বভারতীতে। তারা দুই বন্ধু মিলে বেড়াতে এসেছে সুবর্ণার কাছে। উদ্দেশ্য শান্তিনিকেতনের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে শামিল হওয়া।
সবাই মিলে গাছের ছায়ায় বসে আড্ডা দিলাম অনেকক্ষণ। আনিস বেশ রসিক। তার প্রতিটি কথায় আমরা হেসে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ি। সে নিজে কিন্তু হাসে না। আমাদের আনন্দ দেয়ার জন্য সে মাঝে মাঝে গান গেয়ে ওঠে। যাহোক, এতগুলো বন্ধু পেয়ে নিজেদের খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল।
কথায়-আড্ডায় দুপুর হয়ে যায়। অথচ আমরা টের পেলাম না। সবাই তখন স্থির করলাম, তিনটার মধ্যে দুপুরের খাবার সেরে বোলপুরের ‘গীতাঞ্জলি’ সিনেমা হলে গিয়ে ১৬ঃয উবপবসনবৎ ছবিটি দেখব।
আড্ডা শেষে আনিস আমাদের পূর্বপল্লির একটি রেস্টহাউসে নিয়ে যায়। সে উঠেছে সেখানে। ওখানকার ক্যান্টিনের খাবারের বেশ প্রশংসা করল আনিস। জানাল, খাবারের দামটাও বেশ কম। তার কথাই সত্যি। খেয়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম।
খাওয়ার সময় আনিস বারবার বলল, হোটেল ছেড়ে যেন তার সঙ্গে ওই রেস্টহাউসে উঠি। বেশ আড্ডা দেয়া যাবে। খুশিতে আমরাও তখন সিদ্ধান্ত নিলাম পূর্বপল্লির রেস্টহাউসে চলে আসার। সৌভাগ্যক্রমে ডরমিটরিতেও সিট ফাঁকা পাওয়া গেল। কথা পাকা করে ফেললাম ওই মুহূর্তে। পরদিন সকালে আমরা এখানে উঠব।
আমাদের আরো দুই রাত শান্তিনিকেতনে থাকতে হবে। হোটেলে আজ রাতে না করে দিতে হবে। উল্লেখ্য, ওখানে প্রতিদিনের ভাড়া প্রতিজন মাত্র ২৫ টাকা। অথচ আমরা যে হোটেলে উঠলাম সেখানে প্রতিদিন ভাড়া গুনতে হচ্ছে ২০০ টাকা করে।
তিনটার মধ্যে সবাই চলে এলাম গীতাঞ্জলিতে। মধুমিতা সিনেমা হলের কথা মাথায় রেখে বলছি, এত বিশাল এবং সুন্দর সিনেমা হল আমাদের দেশে খুব একটা নেই।
খুব মজা করে সবাই ছবিটি উপভোগ করলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটি মুগ্ধ করে আমাদের। তবে ছবিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের জয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছিল। ছবিটা দেখার পর সেজন্য কিছুটা আহত বোধ করেছিলাম। অবশ্য ভারত-পাকিস্তান বরাবরই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ বলেই মনে করে।
ছবি দেখে চলে এলাম সুশানের হোস্টেলে। এর নাম ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল। নামে ইন্টারন্যাশনাল হলেও এখানে বাংলাদেশের ছাত্রসংখ্যাই বেশি। কয়েকজন মাত্র বিদেশি ছাত্র। পরিচিত হলাম নড়াইলের দেবদাস ও বাদল, কুষ্টিয়ার স্বপনদা আর খুলনার সুব্রতদার সঙ্গে। হোস্টেলের রুমে জমে ওঠে আড্ডা। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, বিদ্যাভবনের সামনের স্থায়ী মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ দেখার পর সুশান আমাকে আলাদা করে ডাকে; সাইকেলে করে নিয়ে আসে শ্রীনিকেতনে। শ্রীনিকেতন মূল ক্যাম্পাস থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। সাইকেলে চড়তে চড়তে তার কণ্ঠের কয়েকটি মধুর রবীন্দ্রসংগীতও শোনা হলো। বেশ মুগ্ধ হলাম সুশানের গান শুনে। শ্রীনিকেতন থেকে ফিরে এসে চিত্রাঙ্গদার বাকি অংশ উপভোগ করি।
রাতে সংগীত-ভবনে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসবে, তাই সুশান আমাকে হোটেল থেকে প্রায় দশটার দিকে নিয়ে এল। খোকন যেতে রাজি হলো না। হোটেল ম্যানেজার সুমনদা থেকে রাতে বাইরে থাকার অনুমতি নিয়ে চলে এলাম আমি। পণ্ডিত ‘অরুণ ভাদুড়ি’র কণ্ঠের সে উচ্চাঙ্গ সংগীত আজো আমার কানে বাজে।
চার.
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।।
সৌন্দর্যপিয়াসী জীবনমুখী রবীন্দ্রনাথ এই পৃথিবীকে এত বেশি ভালোবাসতেন যে, পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কথা তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না কখনো। তিনি জানতেন পৃথিবীর প্রতি তাঁর যত প্রেম থাকুক না কেন, মহাকাল একদিন তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফসল রেখে দিয়ে তাঁকে বিদায় জানাবে। এই নির্মম সত্য সব সময় হৃদয়ে ধারণ করতেন বলেই উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন এমন নির্মোহ বাণী।
সুরের সাধনায় আত্মমগ্ন কবি শুধু চেয়েছিলেন, কালের অনন্ত গহ্বরে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন হতে না দিয়ে চিরদিন মানবের মাঝে বেঁচে থাকতে। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা যত নিখুঁতই হোক না কেন, কালের অমোঘ নিয়মে একদিন বিদায় জানাতে হবে তাঁর প্রিয়তমা বসুন্ধরাকে।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবিগুরুর সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এখানে যে, দৈহিক ও আত্মিক মৃত্যুকে তিনি এক করে ভাবেননি। কর্মবীর মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে না। তাঁদের সৃজনশীল ও মানবহিতকর কর্মের জন্য তাঁরা মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন যুগ যুগ ধরে। হাজার বছর। কালের কোনো মহাশক্তি তাঁদের মৃত্যু ঘটাতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই একজন মানুষ, যিনি কালের গায়ে অক্ষর লেখার জন্য সাধনা করেছেন আজীবন। আসলে কেউ অক্ষর লিখতে সাধনা করে কি? মনে হয় না। প্রত্যেক সৃজনশীল মানুষ সৃষ্টি করে নিতান্তই মনের আনন্দে। সেই কর্ম স্পর্শ করে সমকালীন মানুষকে তো বটেই, অনাগত প্রজন্মকেও। তখন আমরা এমন শব্দমালা উচ্চারণ করি। আদতে এসব আমাদের অত্যুৎসাহ ছাড়া আর কিছু নয়।
যাহোক, মহামতি রবীন্দ্রনাথের সাধনার ক্ষেত্র ছিল এই শান্তিনিকেতন। এখানে খোলা আকাশের নিচে তিনি আসন পেতেছিলেন, এখানে বসে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতি-বর্ণ-ধর্ম-গোত্রনির্বিশেষে পৃথিবীর মানুষকে একই বন্ধনে বাঁধার। উপনিষদের মানসপুত্র উপনিষদীয় শ্লোক আওড়ানোর সময় মানুষে মানুষে যোগসূত্র স্থাপনের যে মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, তা-ই পরবর্তীকালে প্রভাব ফেলে তাঁর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে।
‘আমাদের শান্তিনিকেতন/ আমাদের সব হতে আপন’—এই সংগীতের মন্ত্রে দীক্ষিত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীরা যেন স্বর্গ রচনা করেছে। সবাই পরস্পরের আত্মার আত্মীয়, চিরকালের আপনজন। শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, অতিথি-দর্শনার্থীদের মধ্যেও তারা নিজেদের বিলীন করে দেয় পরম মমতায়। প্রতিটি মুহূর্তে আমি সেই আন্তরিকতার উষ্ণতা অনুভব করেছি।
পয়লা বৈশাখের রাতে অরুণ ভাদুড়ির উচ্চাঙ্গ-সংগীতের আসর শেষ হয়েছিল প্রায় একটায়। সেই আসরে সুশান পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের আরো কিছু ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে; যারা বিশ্বভারতীর বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত। নড়াইলের বাদল ও অবিনাশ, বরিশালের সম্পা ও চট্টগ্রামের অরুণার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিয়ে সুশানের সঙ্গে হোস্টেলে ফিরে এলাম। রাতটা কাটালাম সুশানের কক্ষে।
সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। বেরিয়ে পড়ি সুশানের ব্যক্তিগত সাইকেল নিয়ে; তন্নতন্ন করে ঘুরে দেখি পুরো এলাকাটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষি ও গ্রামোন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত শ্রীনিকেতন। বেড়াই শ্রীনিকেতনের আনাচেকানাচে।
১৯১২ সালে রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের তিন কিলোমিটার দূরে একটি বাড়িসমেত চারপাশের কিছু জমি কেনেন; ১৯২২ সালে সেখানে গড়ে তোলেন পল্লি পুনর্গঠন ইনস্টিটিউট। প্রথম পরিচালক হিসেবে লিওনার্ড নাইট আমহার্স্টকে নিয়োগ করা হয়। আমহার্স্টের সঙ্গে যোগ দেন কবির জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁদের সঙ্গী হন সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, গৌর গোপাল ঘোষ, কালীমোহন ঘোষ এবং কিম তারো কাসারাসহ আরো অনেকে।
বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় ক্যাম্পাসটি ১৯২৩ সালে একই এলাকার চারপাশে স্থাপন করা হয় এবং এটি পরিচিত হয়ে ওঠে শ্রীনিকেতন নামে। শ্রীনিকেতন নামটিও রবীন্দ্রনাথেরই দেয়া। শ্রীনিকেতনে ১৯৬৩ সালে একটি কৃষি কলেজ এবং ১৯৭৭ সালে পল্লি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
তারপর একে একে ঘুরে দেখলাম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নিজস্ব বাড়ি বারিধারা, বোলপুরের পরবর্তী রেলস্টেশন প্রান্তিক, ডিয়ার পার্ক, খোয়াই নদী, অমর্ত্য সেনের শান্তিনিকেতনস্থ বাড়ি প্রতীচি (যে বাড়িতে অমর্ত্য সেনের ৯৫ বছর বয়সী মা অমিতা সেন তখন থাকতেন), কলাভবন (শান্তিনিকেতনের আর্ট কলেজ, যাকে এখন বিশে^র অন্যতম আর্ট কলেজের মর্যাদা দেয়া হয়), বিদ্যাভবন, মানবিক শিক্ষাকেন্দ্র, শিক্ষা ভবন, বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্র, সংগীত ভবন; নৃত্য, নাটক এবং সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র, বিনয় ভবন; শিক্ষা ইনস্টিটিউট, রবীন্দ্রভবন; ঠাকুর শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, পল্লি সংগঠন বিভাগ, পল্লি পুনর্গঠন ইনস্টিটিউট এবং পল্লি শিক্ষা ভবন; কৃষিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট।
তা ছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে নিপ্পন ভবন (জাপানি শিক্ষাকেন্দ্র), চীনা ভবন, ফারসি ভবন, হিন্দি ভবন, জাতীয় ঐক্যের জন্য ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্র, গ্রাম সম্প্রসারণ কেন্দ্র, শিল্পসদন, হস্তশিল্প কেন্দ্র, পল্লিচর্চা কেন্দ্র (সামাজিক শিক্ষা ও গ্রাম উন্নয়ন কেন্দ্র), অণুপ্রযুক্তি কেন্দ্র, গণিত শিক্ষা কেন্দ্র, পরিবেশ শিক্ষা কেন্দ্র।
পাঠভবনে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন পর্যায়ের শিক্ষার জন্য দুটি স্কুল: মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা ও সন্তোষ পাঠশালা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির নাম শিক্ষাসত্র এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলটির নাম উত্তর-শিক্ষা সদন। একমাত্র পাঠাগারটির নাম রবীন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াত ছেলের নামে—শমীন্দ্র পাঠাগার।
পাশর্^বর্তী সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরলাম। মানুষের সঙ্গে কথা বললাম উপযাজক হয়ে। এই সব মানুষদের খুব আন্তরিক মনে হলো। সাঁওতালদের সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালো লেগেছিল। এক সাঁওতাল পরিবারের অন্দরমহলও ঘুরে দেখলাম। সহজ সরল এক সাঁওতাল পুরুষের কাছে আমার এই ইচ্ছে প্রকাশ করতেই সে নিয়ে গেল। খেয়াল করলাম, যত্রতত্র গৃহপালিত শূকর ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রামের মানুষের জীর্ণ বাড়িগুলো ব্যথিত করেছিল আমাকে। দারিদ্র্য যেন তাদের বেঁধে রেখেছে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে।
সাইকেলে ভ্রমণের সময় এমন একটি অনুভূতি আমাকে ছেয়ে ফেলেছিল, যার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত। অমর্ত্য সেনকে শান্তিনিকেতনে সবাই বাবলুদা বলেই ডাকে। তিনি এখনো শান্তিনিকেতনে এলে সাইকেলে চড়ে বেড়ান; ছোটবেলায় যেমন বেড়াতেন।
১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অমর্ত্য সেনকে ঢাকার সংবর্ধনায় প্রথম দেখি। তারপর ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দেখার এবং পুরোপুরি জানার পর থেকে অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে আমি রীতিমতো তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমিই অমর্ত্য সেন! ভাবতে তো আর পয়সা লাগে না। ভাবতে দোষ কোথায়!
সারা দিন ঘুরে ঘুরে আমি, খোকন ও সুশান বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান থেকে ছবি নিলাম। ছাতিম তলা, শালবীথি, পৌষমেলার মাঠ, ব্ল্যাক হাউস, রতন পল্লী, পূর্বপল্লী, মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা, শমীন্দ্র পাঠাগার, গাছতলায় শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের পাঠদান, ব্রাহ্ম-মন্দির, বিভিন্ন ভবন (সংস্কৃতি, জাপানি, ফরাসি, চীনা, হিন্দি)—কোনো কিছু বাদ গেল না। সুশান আমাদের গাইড ও ফটোগ্রাফার হিসেবে দারুণ সঙ্গ দিয়েছিল সেদিন। খাওয়া-দাওয়াও করেছিলাম একসঙ্গে।
সুশানের কাছ থেকে আরো জানলাম, শান্তিনিকেতনে সারা বছর অসংখ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই আছে। ঋতুভিত্তিক উৎসব এখানকার প্রধান আকর্ষণ। বসন্তকালে বসন্ত উৎসব (দোল), বর্ষাকালে বর্ষামঙ্গল, শরৎকালে শারদোৎসব, শীতকালে পৌষমেলা ও মাঘোৎসব, বৈশাখে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান পয়লা বৈশাখ। আর পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রজয়ন্তী। ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো পালনের সময় রবীন্দ্রনাথের গানই গাওয়া হয়। তখন শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিতে সেই ঋতুর রূপটি ধরা পড়ে, যা বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ করে দেয়। এখানে স্পষ্ট যে, শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিই ছিল রবীন্দ্রনাথের ঋতুভিত্তিক গানগুলোর রচনার প্রেরণা।
আরো জানতে পারলাম, সব আয়োজনের মধ্যে ‘পৌষমেলা’ পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। তিন দিনব্যাপী এই মেলা পৌষ মাসের সপ্তম দিন (সাধারণত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ) থেকে শুরু হয়। তখন এত বেশি দেশি-বিদেশি পর্যটক শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসে যে হোটেল, মোটেল, রেস্টহাউস কোথাও থাকার জন্য সামান্য জায়গা পাওয়া যায় না। অনেক আগেই বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। এমনকি অনেকের বাড়ি পর্যন্ত রাতে থাকার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।
সেদিন সন্ধ্যায় গেলাম প্রতীচিতে; অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেনের সঙ্গে দেখা করব বলে। গেটে দারোয়ান জানায় যে, তিনি ভীষণ অসুস্থ; দেখা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অগত্যা মন ভারী করে ফিরে আসতে হলো। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যায়। তারপর সুশানের হোস্টেলে সবাই মিলে চা খেতে খেতে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিলাম। চমৎকার কিছু সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরলাম বেশ রাত করে।
আমরা ওই দিনই কলকাতায় ফিরতাম, যদি রবীন্দ্রভবন দেখার সুযোগ আমরা সেদিন পেতাম। ব্রাহ্মদের পুণ্যদিন বুধবার বলে সেদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। শুধু রবীন্দ্রভবন দেখার প্রত্যাশায় আমাদের তার পরদিন (বৃহস্পতিবার) দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কারণ রবীন্দ্র-ভবনের এই পাঁচটি বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারলে যে শান্তিনিকেতনে আসাই বৃথা।
পাঁচ.
দুপুর একটায় শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস কলকাতার উদ্দেশে বোলপুর ত্যাগ করবে। ঘুম থেকে খুব সকালে উঠে পড়লাম, যাতে সকালবেলাটা কাজে লাগাতে পারি। বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের পাশের রুমের বাসিন্দা একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের সঙ্গে বারান্দায় দেখা। উল্লেখ্য, আনিস চলে যাওয়ার পর ডরমিটরি ছেড়ে আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসি। উৎসাহী হয়ে তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য এগিয়ে গেলাম আমরা। তিনি আমাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করলেন। তার নাম পিটার। মনে হলো, আমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনিও বেশ খুশি।
জানতে পারলাম যে, তারা তিন বন্ধু ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন। ছয় মাস থাকবেন এখানে। ভ্রমণ করবেন পুরো ভারত। আমাদের রুমে আমন্ত্রণ জানালাম। পিটার তখন বললেন, চলুন সবাই মিলে নিচে রেস্টুরেন্টে বসি। চা খেতে খেতে আড্ডা দেয়া যাবে। দাঁড়ান, আমার বন্ধুদের ডেকে আনি।
রেস্টুরেন্টে বসার দশ মিনিট পর তারা তিনজন নেমে এলেন। পরিচয় করিয়ে পিটার বললেন, আমার বন্ধু নিক ও সেনড্রা। তাদেরও বেশ অমায়িক মনে হলো।
দুই বাঙালি এবং তিন ব্রিটিশের সেদিনের আড্ডা আজও আমার মনে ভাসে। সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-ইতিহাস-ভূগোল-ধর্ম-ভাষা—সব নিয়ে তাদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা হলো আমাদের। মাঝে মাঝে ভীষণ তর্কযুদ্ধ বেঁধে যেত যখন আমরা বলতাম, ইংরেজরা অন্যায়ভাবে দু’শ বছর আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল। এই কথার প্রতিবাদ করলেও তারা যুক্তিসংগত উত্তর দিতে পারেনি। তখন আমরা মিটিমিটি হেসেছিলাম।
একপর্যায়ে আড্ডার সমাপ্তি টানতে হয়। আমরা রুমে গিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে একবারে বের হলাম। রবীন্দ্র-ভবন দশটায় খুলবে। প্রস্তাব দেয়ার পর তারাও আমাদের সঙ্গী হতে চাইলেন। কিন্তু তাদের নারী-বন্ধুটির অনীহায় তারা রবীন্দ্র-ভবনে এলেন না।
উত্তরায়ণে দেখলাম রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের মেডেল, বিভিন্ন রচনার মূল পাণ্ডুলিপি, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বসার ঘর, লেখার ঘর ও শোবার ঘর। সব মিলিয়ে উত্তরায়ণকে বলা যায় জাদুঘর। অনুসন্ধিৎসু মনে সবকিছু দেখলাম আমরা। প্রতিটি মুহূর্তে আমি শিহরিত হচ্ছিলাম সেই মৃত্যুহীন প্রাণের কথা ভেবে—
মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
উত্তরায়ণ থেকে বের হয়ে এসে প্রবেশ করলাম মাটির তৈরি বাড়ি শ্যামলীতে; কালো কুচকুচে দোতলা বাড়িটির নকশা আমাকে বেশ মুগ্ধ করে। তারপর একে একে উদীচী, কোনার্ক ও উদয়নে কবির স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখা শেষ করে হোটেলে ফিরে যাই। কোনোরকম দুপুরের খাবার নাকে-মুখে পুরে স্টেশনে চলে এলাম। কারণ ঠিক একটায় আমাদের ট্রেন ছেড়ে যাবে।
বোলপুর স্টেশনেও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে আছে। এই স্টেশন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা ‘ইস্টেশন’।
‘সকাল বিকাল ইস্টেশনে আসি,
চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি,
ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকিট কেনে;
ভাটির ট্রেনে কেউ-বা চড়ে, কেউ-বা উজান ট্রেনে।
সকাল থেকে কেউ-বা থাকে বসে,
কেউ-বা গাড়ি ফেল করে তার শেষ মিনিটের দোষে।—
এই কবিতাটি বড় বড় অক্ষরে স্টেশনের দেয়ালে লেখা। স্টেশনের পাশে একটি বড় হলরুমও এখানে রবীন্দ্র-জাদুঘর। সময়ের অভাবে একনজর ছোট জাদুঘরটি দেখে নিলাম। সেখানে ছড়িয়ে আছে বোলপুর ও শান্তিনিকেতনের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের ইতিহাস।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের চা খেতে খেতে হঠাৎ দেখি সকালের ওই তিন ইংরেজ বন্ধু। তারাও শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করছে। যথাসময়ে ট্রেন এলে আমরা সবাই এক কামরায় উঠি। ট্রেনের মধ্যেও জমে ওঠে আড্ডা। আশপাশের যাত্রীরা বিরক্ত হলেও আমরা তা উপেক্ষা করে আড্ডা চালিয়ে যাই। তিন ঘণ্টার পথের বেশির ভাগ সময়ই কাটে আড্ডা আর গল্পে।
ট্রেন যত কলকাতার দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে, শান্তিনিকেতন আমার কাছ থেকে তত দূরে সরে যাচ্ছে। এক কঠিন আবেগে আমার হৃদয় বারবার মোচড় দিয়ে উঠছিল। অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না। কিন্তু কেন? মনে হয়, আমার এ ক্ষুদ্র জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলো আমাকে পিছু ডাকছিল। আর আমাকে প্রতিশ্রুতিবব্ধ করে চলছিল অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় জীবনের স্বপ্ন। মনে মনে জপ করছিলাম—আমি আসব, এখানে বারে বারে আসব। এ যে আমার ঠিকানা। পৃথিবীতে আমার এই একটাই ঠিকানা।