এডলফ হিটলার, আজও পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত খলনায়ক, যাকে মানুষ মনে রেখেছে পৃথিবীজুড়ে নির্মম তান্ডব চালানোর কারণে। তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারায় প্রায় ৭ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ এবং হতাহত হয় অসংখ্য। বিশ্ব রাজনীতিকে আমূল বদলে দেন তিনি– এসকল কারণে আজ অবধি তিনি স্মরণীয়। পৃথিবীর বুকে তান্ডব রচনা তিনি একা করেননি, তার ঘৃণ্য কর্ম সাধনে তিনি পাশে পেয়েছিলেন একজন গুরু এবং কতিপয় বামহাত, ডানহাত এবং সাগরেদদের। এই অপকর্মের দোসরেরা তুলনামূলক কম পরিচিত হলেও হিটলারের ঘৃণিত কর্মে তাদের অবদান নেহায়েত কম ছিল না। আসুন, এরূপ হিটলারের পাঁচ শীর্ষস্থানীয় দোসর সম্পর্কে জেনে নিই।
নাৎসি পার্টির প্রাথমিক কালের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন ডাইট্রিখ একার্ট। তিনি ছিলেন একজন ধনী জাতীয়তাবাদী কবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী জার্মানিতে তিনি ভাইমারদের শাসন মেনে নিতে পারেননি। একই সাথে তিনি ইহুদিবিদ্বেষী ছিলেন। তার লেখা ‘Storm song’ এর দুটি শব্দ ‘Deutsche Erwache’ নাৎসি পার্টির স্লোগানে পরিণত হয়– যার অর্থ হচ্ছে ‘জার্মানি জাগো’।
হিটলারের সাথে একার্টের প্রথম দেখা ১৯১৯ সালে। হিটলারকে প্রথম দেখাতেই তিনি বেশ মুগ্ধ হন এবং মনে করেন এই ব্যক্তির দ্বারাই তিনি যেরূপ জার্মানির স্বপ্ন দেখেন, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। একার্টের সাথে হিটলারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। একার্ট হিটলারের সাথে তার জার্মান সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা বিস্তারিত আলোচনা করেন। হিটলারও তা মন দিয়ে শুনতেন। বলা হয়ে থাকে, একার্টই ছিলেন হিটলারের আদর্শিক গুরু যার চিন্তার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে হিটলারের নাৎসি জার্মানি গড়ে উঠে। হিটলারকে তিনি তখনকার জার্মানির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথেও পরিচয় করিয়ে দেন। হিটলার নাৎসি পার্টির নেতা নির্বাচিত হলে একার্ট হিটলারের সাথে পার্টি র্যালিতে যোগ দিতেন। একার্ট তার কবিতার মাধ্যমে হিটলারকে ‘জার্মানির ভবিষ্যৎ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ১৯২৩ সালে একার্ট মারা যান। তবে তার মারা যাওয়ার আগে হিটলারের সাথে তার দূরত্ব বেড়েছিল এবং যোগাযোগও বেশ কমে গিয়েছিল।
নাৎসি পার্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং হিটলারের ঘনিষ্ঠ একজন সহকর্মী ছিলেন হেইনরিখ হিমলার। ১৯২৯ সালে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত এসএস বাহিনির নেতা হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী ১৬ বছরে তিনি এসএস-কে ২৯০ সদস্যের বাহিনি হতে দশ লাখ সদস্যবিশিষ্ট দক্ষ বাহিনিতে পরিণত করেন। এসএস কুখ্যাতি অর্জন করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানির ইহুদি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করে। বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ ইহুদি নিধন করা হয়েছিল যার অধিকাংশ ঘটেছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অত্যাচার এবং নিপীড়নের মাধ্যমে। ক্যাম্পগুলো হিমলারের এসএস বাহিনির মাধ্যমেই পরিচালিত হতো বলে ইতিহাসের অন্যতম এই জঘন্য অপরাধের বেশিরভাগ দায় তার উপর বর্তায়। হিমলার একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার হিমলারকে প্রথমে মিলিটারী কমান্ডার এবং পরবর্তীতে রিপ্লেসমেন্ট আর্মির কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে বোঝা যায় হিমলার হিটলারের একজন আস্থাভাজন ছিলেন। তবে যুদ্ধের শেষবেলায় পরাজয় সন্নিকটে বুঝতে পেরে হিটলারের অজ্ঞাতসারে মিত্রশক্তির সাথে শান্তি আলোচনা করার চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু তার প্রতারণার কথা কানে আসার সাথে সাথেই হিটলার তাকে সকল পদ থেকে অব্যাহতি এবং গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের কাছে ধরা পড়ে তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি আত্মহত্যা করেন।
ধনী কূটনীতিকের সন্তান হারমান গোয়েরিং জার্মান এয়ারফোর্সের একজন অফিসার ছিলেন। তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির একজন মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ে যখন উচ্চ নেতৃত্ব থেকে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়, তখন তিনি এবং তার দলের সদস্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বিমানের ক্র্যাশ-ল্যান্ড ঘটিয়ে ধ্বংস করে দেন। ১৯২২ সালে তিনি প্রথম হিটলারের সাথে পরিচিত হন। নাৎসিদের আরেক সেনাদল এসএ-এর কমান্ডের ভার তাকে দেয়া হয়। গোয়েরিং নাৎসি পার্টির অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনাতে শামিল ছিলেন, কিন্তু তা ব্যর্থ হয় এবং তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তিনি অস্ট্রিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও মরফিনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩২ সালে তিনি ‘প্রেসিডেন্ট অফ দি রাইখস্ট্যাগ’ পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলে তাদের ক্ষমতা আরো সুসংহত হয়। তার নেতৃত্বেই কুখ্যাত গেস্টাপো নামক গোপন পুলিশ বাহিনি গঠিত হয়। নাৎসি পার্টির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি দমন-পীড়ন এবং ব্যাপক ইন্টেলিজেন্স কার্যকলাপের জন্য এটি কুখ্যাত ছিল। এটি ছিল হিটলারের অনুগত বাহিনি। এছাড়াও গোয়েরিং নিজের এয়ার ফোর্স বাহিনি ‘লুফটওয়াফা’ প্রতিষ্ঠা করেন। নাৎসিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তার এই বাহিনি ব্যবহার করে। হিটলারের আত্মহত্যার পরপর গোয়েরিং আত্মসমর্পণ করেন। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তবে তা কার্যকরের আগেই তিনি সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
তিনি হিটলারের বিশ্বস্ত সঙ্গীর একজন ছিলেন। তবে হিটলারের অন্যান্য সঙ্গীদের তুলনায় তার ভূমিকা ছিল কিছুটা ভিন্ন ধরনের। পিএইচডি প্রাপ্ত একজন একাডেমিক এবং সাংবাদিক হিসেবে কলম এবং লেখনীর জোর সম্পর্কে গোয়েবলসের বেশ ভাল ধারণা ছিল। তাই তিনি হিটলারের ফ্যাসিবাদী এবং ইহুদিবিদ্বেষী চিন্তাধারার একজন বার্তাবাহক হিসেবে আবির্ভূত হন এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যমে হিটলারের বিষাক্ত চিন্তাধারা জার্মান সমাজে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। প্রথম দিকে তিনি নাৎসি পার্টিতে সমাজতান্ত্রিক ধারণার প্রচারক ছিলেন, যা ছিল হিটলারের পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু পরবর্তীতে গোয়েবলস হিটলারের দিকেই ঝুঁকে পড়েন। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন জার্মানির প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী এবং হিটলারের ভাষণ-এর রূপরেখা তৈরিতে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। হিটলারের মৃত্যুর পর তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জার্মানির চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। তবে মে ১, ১৯৪৫ সালে তিনি সায়ানাইড ক্যাপসুল গ্রহণ করেন এবং এসএস অফিসারদের গুলিতে মারা যান।
তিনি পরিচিত ছিলেন হিটলারে ডিপ্লম্যাট হিসেবে। ১৯৩২ সালে হিটলারের সাথে পরিচিত হবার পর খুব দ্রুত হিটলারের কাছের লোক হয়ে যান এবং একই বছরে নাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়ে হিটলারের পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান (১৯৩৩)। পরবর্তীতে গ্রেট ব্রিটেনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং হিটলারকে জানান যে ব্রিটেন পোল্যান্ডকে যথাযথভাবে সাহায্য করতে পারবে না, যা স্বল্পমেয়াদে সঠিক ধারণা ছিল। এছাড়া ১৯৩৬ ও ১৯৩৮ সালে তিনি জাপান এবং ইটালিকে দর কষাকষি করার মাধ্যমে জার্মানির সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ করেন। রিবেন্ট্রপের অন্যতম সাফল্য ছিল ১৯৩৯ সালের জার্মান-সোভিয়েত নন-অ্যাগ্রেশন প্যাক্ট– যার ফলে হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ করে, যেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সূচনার পথকে সুগম করে। তবে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার কিছুকাল পর রিবেনট্রপের গুরুত্ব কমতে থাকে, কেননা কূটনীতি তখন হিটলার এবং নাৎসি জার্মানির কাছে মূল চিন্তার বিষয় ছিল না। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে রিবেন্ট্রপ ধরা পড়েন এবং ন্যুরেমবার্গ আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেয়।
হিটলার যেরকম সংঘবদ্ধ এবং পরিকল্পিত উপায়ে বিশ্বজুড়ে অশান্তির সৃষ্টি করেছিলেন, তা হয়ত এইসব মানুষদের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া সম্ভব হতো না। তবে তার সঙ্গীদের ব্যাপারে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তারা নিজ নিজ কাজে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিলেও নীতিবোধের দিক দিয়ে সকলেই ছিলেন দূষিত। যদি তা না হতেন, তবে তারা নিজেদের মেধা এবং দক্ষতা দিয়ে উদারনৈতিক জার্মানি গড়ে তুলতে সহায়তা করতেন। এর বদলে তারা সহায়তা করেন হিটলারকে, যার ফলে পুরো বিশ্বকে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়। কেউ যদি হিটলারের ইনার সার্কেলের এই লোকদের সম্পর্কে আরও জানতে চান, তবে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং সাইট নেটফ্লিক্সের Hitler’s Circle of Evil নামক ১০ পর্ববিশিষ্ট ডকুমেন্টারি টিভি সিরিজটি দেখতে পারেন।