চলচ্চিত্র “নকশাল” ও বিপ্লব “নকশাল”


নকশালবাড়ী, ১৯৬৭ সালের আগ পর্যন্ত কজন মানুষ জানতো এ গ্রামের কথা? খোদ ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গের হয়তো অনেকে তখনও শোনেনি এ গ্রামের নাম। নকশালবাড়ী, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার অধীনস্ত একটি গ্রাম। সামষ্টিকভাবে এই উন্নয়ন ব্লকটির নামও নকশালবাড়ী, যার অন্তর্ভুক্ত নকশালবাড়ীসহ আরও ছয়টি গ্রাম। [১] কে জানে, হয়তো গড়পড়তা অন্যান্য বাঙালি অধিবাসীবেষ্টিত গ্রামগুলোর মতো এক সময় এই গ্রামগুলোও ছায়া সুনিবিড়-শান্তিপ্রিয়-শান্ত ছিলো। এখনও হয়তো আছে। কিন্তু নামের আগে ঝুলে গেছে ‘মাওবাদী’ তকমা। ‘লাঙল যার, জমি তার’– এই স্লোগান এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ বা অন্ধ্র প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। হিমালয়ের পাদদেশের তরাই অঞ্চলের এই ক্ষুদ্র জনপদ থেকে ফুঁসে ওঠা আগুনের স্ফুলিঙ্গ আজ স্বাধীন, সার্বভৌম ভারতের অন্যতম জাতীয় হুমকি। [২] ১৯৬৭ সালের ২৫ মে তারিখে বেনগাই জোট গ্রামে ধনেশ্বরী দেবী, সিমাস্বরী মল্লিক, নয়নেশ্বরী মলিক, সুরুবালা বর্মণ, সোনামতি সিং, ফুলমতী দেবী, সমসারি সাইবানী, গৌদরাউ সাইবাণী, খারসিংহ মল্লিক বা নাম না জানা দুই অবুঝ শিশুর রক্তের দাম দিয়েছে  স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রায় ৬,০০০ নাগরিক। [৩] নকশালপন্থীদের ভাষ্যমতে এরা তাদের ‘শ্রেণিশত্রু’ এবং এদের নিহত হওয়াটা তাদের বিজয়ের মুদ্রার অপর পিঠ। চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতালদের গড়ে তোলা বিদ্রোহী দলের উত্তরসূরীরা আজ ভারতের প্রায় চল্লিশ শতাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে, ভারতের মোট বনাঞ্চলের অন্তত পাঁচ ভাগের এক ভাগ নকশালদের দখলে। [৪] গহীন অরণ্যের বাইরে রাষ্ট্রীয় বাহিনী অপেক্ষা করে আছে ‘জাতীয় শত্রু’-দের খতম করতে, অন্যদিকে চারদিক বেষ্টিত হয়ে গহীন অরণ্যের ভেতর এক সত্য-অনিন্দ্য স্বপ্নের চাষাবাস করছে একদল ‘নাগরিক’। তাদের জীবন বিক্রির দামে কেনা হয়েছে সে স্বপ্ন। হয়তো উচ্ছৃঙ্খল, হয়তো আতঙ্ক ছড়াচ্ছে; কিন্তু সেই স্বপ্নের মূল কথা এক অন্যরকম কিন্তু ‘সাম্যের আলোয় এগিয়ে যাওয়া ভারতবর্ষ’। নিজ দেশ ও জনগণের ‘ভাগ্যোন্নয়ন’ এর স্বপ্ন দেখে তারা। এটাও তো ঠিক, সবার স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। ১৯৬৭ সালের পর আজ ২০২০ নাগাদ ৫৩ বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। নকশাল আন্দোলন যৌক্তিক নাকি এটাও আতঙ্কবাদীদের ছক অনুসরণ করে– এই ইস্যুতে কোটি গ্যালন চা ফুরিয়েছে নাগরিক সমাজ। এখনও সে প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর আসেনি। হয়তো কোনোদিন আসবেও না। ‘বিপ্লব’ করতে করতে নিজ রাষ্ট্রের গুলিতে মারা পড়া ‘দেশপ্রেমিক’ নাগরিকদের ‘মাওবাদী সন্ত্রাসী’ পরিচয়েই শেষকৃত্য করা হতে থাকবে।


চলচ্চিত্র ‘নকশাল’ ও বিপ্লব নকশাল: প্রেক্ষাপট

উত্তাল আশির দশক, ক্ষোভে বিক্ষোভে মাতাল শহর কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ততদিনে ‘শ্রেণিশত্রু’ আর ‘বিপ্লব’ এর মতো শব্দগুলো শিখে গেছে। সাবলীল হয়ে গেছে এগুলোর উচ্চারণেও। কিন্তু ততদিনে টনক নড়েছে প্রশাসনের। হাঁটুর সমান বাচ্চাদের এ গলি ও গলি তাড়া করে বেড়াচ্ছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী, দেখামাত্রই গুলি। সেখান থেকে ‘সেফ প্যাসেজ’ নিয়ে সহকর্মী বা সহযোদ্ধাদের ঠকিয়ে বেঁচে আসা একজন প্রাক্তন নকশাল কর্মী যদি আরও কয়েক দশক পরে এসে মুখোমুখি হয়ে যায় সেখান থেকে বেঁচে ফেরা আরও এক নকশাল কর্মীর? কেমন হতে পারে সেই পুনর্মিলনী?

চলচ্চিত্র ‘নকশাল’ ও বিপ্লব নকশাল: পর্দায় দু’পাড়ের কলাকুশলী

‘নকশাল’ চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র অনির্বাণ সেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী। অন্যান্য মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ধৃতিমান চ্যাটার্জী (সিদ্ধার্থ চৌধুরী’র চরিত্রে), শঙ্কর চক্রবর্তী (অরিজিৎ মিত্র’র চরিত্রে), গার্গি রায় চৌধুরী (রীণা সেন’র চরিত্রে), পদ্মনাভ দাসগুপ্ত (নিউজ রিপোর্টার)। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন শ্রাবন্তী ব্যানার্জী, কপিল, নিশিতা গোস্বামী এবং কাঞ্চন মৈত্র। ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ১০৩ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন দেবাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল কাহিনী পরিচালকের নিজের। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ছবির অন্যতম চরিত্রে অভিনয় করা পদ্মনাভ দাসগুপ্ত এবং পুলক দাস। সঙ্গীতায়োজনে ছিলেন রুপম ইসলাম এবং এলান ও। সিনেমাটোগ্রাফি সামলেছেন বিজয় আনন্দ, সম্পাদনা সঞ্জীব দত্তর। ছবির ডিস্ট্রিবিউশনে ছিলো দ্য ক্রাফট হাউজ। বাজেট ছিলো প্রায় এক কোটি টাকা।

চলচ্চিত্র ‘নকশাল’ ও বিপ্লব নকশাল: কথা বা গল্পের কথা

আশির দশকের সেই উত্তাল শহরের ছবিটাকে উসকে দিয়েই শুরু হয় চলচ্চিত্র ‘নকশাল’। তার ৪২ বছর বাদে লালবাজার আর মেট্রো কর্পোরেশনের ফ্যাক্সে একের পর এক উড়ো চিঠি পড়তে থাকে। উঠে আসে অতি পরিচিত বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের কান্না, ঝা তকতকে গ্ল্যামারাস শহরে মাথা গোঁজার একচিলতে ঠাই এর স্বপ্নে চোখ বুজে অন্ধকার গুহার দিকে ছুটতে থাকা এক গৃহকর্তার স্বীকারোক্তি বা অভিযোগ। উঠে আসে বাল্যকালের এক আপোষহীন কর্মীর হঠাৎ করে মধ্যবয়স্ক ‘ঘুষখোর কর্মচারী’ বাবা হয়ে যাওয়ার গল্প। উঠে আসে ছেলের থ্যালাসেমিয়া আর নিরুপায় কিন্তু হাল না ছাড়া এক বাবা এবং পিতৃত্বর কথা। উঠে আসে মধ্যবিত্তের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন, মাস ফুরোতেই মাথার উপরের ছাদের ইএমআই। উঠে আসে বেশ্যা বা শুধু ‘মা’। যুগে যুগে সেফ প্যাসেজ নিয়ে বিদ্রোহের খলনায়ক হয়ে ওঠাদের মুখপাত্র হয়ে উঠে আসে শঙ্কদা বা সিদ্ধার্থ চৌধুরী। ১৯৭১-এর ২১মে দিনটি আবার ৪২টি ক্যালেন্ডার বদলে পুরনো হিসাব চুকাতে ফিরে আসে। এই ছবিতে রাজনীতির ছকে কেটে জীবনকে আঁকা হয়েছে খুব উদারভাবে। তাই জীবন বা রাজনীতি দুটোই এই ছবিতে বড্ড বেশি খোলামেলা, বড্ড বেশি রূঢ়। পরিচালক দেবাদিত্য কোনো দৃশ্যেই কমতি রাখেননি। সব দৃশ্যেই প্রয়োজনের বেশি সৎ দৃশ্যায়ন করেছেন। ছবিতে একেকটি দৃশ্যপট একই সাথে একজন হেরে যাওয়া বাবা, লজ্জিত বিপ্লবী এবং অভাগা নাগরিকের। মিঠুনকে এই চলচ্চিত্রের অন্যতম প্লে কার্ড বলাই যায়।


সেরা চরিত্র: অনির্বাণ সেন (মিঠুন চক্রবর্তী)।

সেরা পার্শ্বচরিত্র: রীণা সেন (গার্গি রায় চৌধুরী)।

সেরা গান: বিপ্লব।


পুনশ্চ: ১

মিঠুন চক্রবর্তীর আসল নাম গৌরাঙ্গ এটা আমরা কমবেশি সব সিনেভক্তরা জানি। কিন্তু মিঠুন যৌবনে নকশাল আন্দোলনের কর্মী ছিলেন এটা কয়জন জানি? হ্যাঁ, ষাটের দশকের আর দশজন বাঙালি যুবকের মতো মিঠুনও নকশাল আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। নকশাল আন্দোলনের অন্যতম নেতা চারু মজুমদারের অন্যতম ঘনিষ্ঠতম কর্মী ছিলেন এই মিঠুন চক্রবর্তী। ভাইয়ের মৃত্যু নকশাল আন্দোলনের ভাবধারার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো মিঠুনকে। তবে কিছু পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বা পুলিশের ‘সক্রিয় তৎপরতা’ শুরু হয়ে গেলে গা ঢাকা দিয়ে মিঠুন চলে এসেছিলেন নতুন শহরে মুম্বাই। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক মিঠুন ভর্তি হয়েছিলেন পুনের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটে। তবে, নকশাল কর্মীর তকমাটা তাকে পিছু করেছে আজীবন। শহর পাল্টে শেকড় ছিঁড়তে পারেননি মিঠুন। ১৯৮০ সালে লেখক ও চিত্রনির্মাতা খাওয়াজা আহমেদ আব্বাস তাঁর ‘দ্য নকশালাইট’-এর মূল চরিত্রে অভিনয় করতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাকে। মিঠুন চক্রবর্তী বিনয়ের সাথে সেটি প্রত্যাখান করেছিলেন প্রথমবার, কারণ প্রাক্তন পরিচিতি ও পাশ এড়ানোর অযোগ্য পিছুটান। যদিও পরবর্তীতে প্রস্তাবটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন।

পুনশ্চ: ২

নকশালবাড়ী আন্দোলন বা তার প্রেক্ষাপট নিয়ে শিল্প-সাহিত্যে অনেক কাজ হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন ‘হাজার চুরাশির মা’-এর মতো উপন্যাস। অরুন্ধতী রায়ের বুকার পুরস্কার পাওয়া ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এও এক চরিত্র এসে যোগ দিয়েছে নকশাল আন্দোলন থেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্নর রায় বা সমরেশ মজুমদারের মতো লেখকরাও নকশালবাড়ী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়েছেন। একসময়কার নাটক, উপন্যাস, থিয়েটার, ছোটগল্প, বড়গল্প, নভেলেট বা গণসংগীতেও উঠে এসেছে এই নকশালবাড়ী আন্দোলন। বিপ্লব হয়তো এভাবেই বাঁচে; সেলুলয়েড বা কাগজে কলমে, যান্ত্রিক বই বা রক্ত মাংসের মানুষের শরীরে।[৫] 


তথ্যসূত্র:

১. সূত্র: www.siliguri.gov.in

২. নকশালবাদ ভারতের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি: প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং; সূত্র ভারতীয় গণমাধ্যম।

৩. হিস্টোরি অফ নকশালিজম: হিন্দুস্তান টাইমস; ২০ জানুয়ারি, ২০০৯।

৪. Primer: Who are the Naxalites?; www.rediff.com

৫. Neta Abhineta by Rasheed Kidwai


 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

শূন্যের ভিতরে শূন্য

জলের ভেতরে জল; কাছে এসে গান গায় তৃষা। দূরের আগুনে পোড়ে– জলের জ্বালাপোড়া শরীর কেন তার দুঃখের কপাল। সাথে পোড়ে

গল্প

ঘুড়ি

দাশবাবুর বাড়ি থেকে হেমন্তের মারমুখো দুপুরে পিচগলা রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় খালেক মিয়ার চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসতে

কবিতা

কোহিনূর

কোহিনূর তোমারে ঘেরিয়া জাগে কত স্বপ্ন–স্মৃতির শ্মশান, ভুলুণ্ঠিত লুব্ধ অভিযান; সাম্রাজ্যের অশ্রু, রক্ত, সমাধি, পতন হে হীরক, একে একে করেছ