সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে জোসেফ স্ট্যালিনের শাসনামলের সবচেয়ে কলঙ্কময় দিক কোনটি— এই প্রশ্নের সবচেয়ে প্রত্যাশিত উত্তর ‘দ্যা গ্রেট পার্জ’, যেটি ইতিহাসে ‘দ্যা গ্রেট টেরর’ নামেও অধিক পরিচিত। ভিন্নমত দমন ও ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য শাসকের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনির বীভৎস নিপীড়নের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক উদাহরণও সম্ভবত এটি।
১৯২৪ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পুরোধা ব্যক্তিত্ব লেনিন যখন মারা গেলেন ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন গৃহযুদ্ধ ও প্রতিবিপ্লবীদের দমন করে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু সংকট সৃষ্টি হয় অন্য জায়গায়। লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরী কে হবে– এটা নিয়ে পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অনেক সমীকরণ ও জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষমেশ স্ট্যালিন ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হন। ১৯২৭ সালের মধ্যেই পার্টির কর্তৃত্ব পুরোপুরি নিজের হাতে নিয়ে নেন। ক্ষমতা সুসংহত করতে তার অনুগতদের পার্টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান।
স্ট্যালিনের জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল পার্টির অনেকে মেনে নিতে পারেননি। পার্টির ভেতরেই কয়েকজন সাবেক বলশেভিক নেতা তার ক্ষমতারোহণের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। এদের মধ্যে ট্রটস্কি, বুখারিন অন্যতম। বলা হয়ে থাকে, লেনিনের পর পার্টির সম্ভাব্য প্রধান হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন ট্রটস্কি। কিন্তু স্ট্যালিনের কূটচালের কাছে পরাজিত হয়ে পার্টির প্রধান হওয়া তো দূরের কথা, তাঁর আর দেশেই থাকা হয়নি। ১৯২৮ সালে ট্রটস্কি মধ্য ইউরোপে নির্বাসিত হন এবং ১৯২৯ সালে তাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়তে বাধ্য করা হয় । ১৯৪০ সালে তিনি মেক্সিকোতে একজন স্পেনিশ কমিউনিস্টের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হন।
পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নির্মম এই রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার পেছনে স্ট্যালিনের উদ্দেশ্য কী ছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিভেদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন স্ট্যালিন একনায়ক হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য এ রকম অভিযান পরিচালনাকে জরুরি মনে করেছিলেন। অনেকে আবার এও বলেছেন, কমিউনিস্ট পার্টির শুদ্ধতা রক্ষা এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে আরও সুবিন্যস্ত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি এই শুদ্ধিকরণ অভিযান পরিচালিত করেছিলেন।
বিশ শতকের ত্রিশের দশকে জার্মানিতে উগ্রবাদী নাৎসি ও জাপানে মিলিটারিস্ট সরকারের উত্থান সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল না। স্ট্যালিন একটা সম্ভাব্য যুদ্ধের পূর্বে নিজের দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে এই শুদ্ধিকরণ অভিযান পরিচালনাকে ‘অপরিহার্য’ বলে মনে করে করেছিলেন বলে মত প্রকাশ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
১৯৩০-এর দশকের শুরুর বছরগুলোতে পার্টি থেকে হাজার হাজার সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়। স্ট্যালিন মূলত পার্টি থেকে ট্রটস্কিপন্থী এবং তথাকথিত ‘প্রতিবিপ্লবী’ এবং ‘জনগণের শত্রু’-দের বিতাড়িত করেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ এই তিন বছরে বহিস্কৃতদের সংখ্যা সর্বোচ্চ আকার ধারণ করে এবং এই সময়ে শুধু বহিষ্কারই করা হতো না, বাধ্যতামুলক নির্বাসনে পাঠানো ও অনেকের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। তাই এই সময়টাকে ‘দ্যা গ্রেট পার্জ’-এর সময়কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
ট্রটস্কির নির্বাসনের পরে সের্গেই কিরোভ পার্টিতে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে লেনিনগ্রাদে কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপদস্থ এই সদস্য গুপ্তহত্যার শিকার হন। স্ট্যালিনের নির্দেশে সোভিয়েত গুপ্তপুলিশ এনকেভিডি(NKVD) এই হত্যাকান্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে। এই গুপ্তহত্যার পরপর স্ট্যালিন তথাকথিত ‘ষড়যন্ত্রকারী’ ও ‘জনগণের শত্রু’-দের চিহ্নিত করতে ব্যাপক আকারে গণতদন্ত শুরু করেন। বলা যায় এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমেই কুখ্যাত ‘দ্যা গ্রেট পার্জ’-এর অভিষেক হয়।
১৯৩৬ সালে মস্কোতে কয়েক দফা ট্রায়াল হয় এবং বহু খ্যাতিমান বলশেভিক নেতাসহ পার্টির অনেক নেতৃত্ব প্রদানকারী সদস্যকে ‘বিপ্লবের চেতনাবিরোধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লেভ কেমেনেভ, গ্রিগরি জিনোভিয়েভ, অ্যালেক্সেই রাইকভসহ আরও অনেক নেতাকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় । স্ট্যালিন পার্টির ভেতরে বলশেভিক বিপ্লব ও প্রয়াত লেনিনের প্রতি নমনীয় সবাইকে তার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন। পার্টির নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, মিলিটারি লিডার থেকে শুরু করে কৃষক, সাধারণ নাগরিক কিংবা বিদেশি- সন্দেহজনক সবাইকে গ্রেফতারের পর ফাঁসি কিংবা ‘গুলাগ’ নামের কুখ্যাত লেবার ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয়।
স্ট্যালিন কুখ্যাত ৩৮ ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। স্ট্যালিন একটি ডিক্রিতে সই করেন, যে ডিক্রিতে বলা হয়েছিল স্বামী কিংবা পিতার অপরাধের জন্য পুরো পরিবার দায়ী থাকবে। এই ডিক্রির মাধ্যমে ১২ বছরের শিশুরও ফাঁসি দেওয়ার আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়!
শুদ্ধিকরণের নামে পরিচালিত এই অভিযানে কমিউনিস্ট পার্টির এক-তৃতীয়াংশ সদস্য মারা যায়। স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করার অভিযোগে সোভিয়েত রেড আর্মির ৩০,০০০ সদস্যকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির অর্ধেকেরও বেশি সদস্য এবং মিলিটারির ১০৩ জন জেনারেল ও এ্যাডমিরালের মধ্যে ৮১ জনই হত্যাকান্ডের শিকার হন।
সরকারি হিসেবেই প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষকে জোরপূর্বক লেবার ক্যাম্পগুলোতে নির্বাসিত এবং সাড়ে সাত লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ‘গুলাগ’ নামের এই ক্যাম্পগুলো অবস্থিত ছিল দুর্গম সাইবেরিয়ায় ও রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে এবং সেখানকার আবহাওয়া ছিল চরমভাবাপন্ন। হাজার হাজার বন্দী এই শ্রম ক্যাম্পগুলোর নোংরা পরিবেশ এবং ভয়াবহ শীতে মারা যায়।
কুখ্যাত এই অভিযান রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল সমাজকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল। দেশের অনেক বিখ্যাত লেখক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও প্রকৌশলীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। এমনকি যারা বলশেভিক বিপ্লবকে সমর্থন ও স্বাগত জানিয়েছিল তাদেরকেও একই পরিণতি বরণ করে নিতে হয়। ১৯৩৮ সালে এই শুদ্ধিকরণ অভিযানের সবচেয়ে কঠিন সময়ের শেষ দিকে স্ট্যালিনের গুপ্ত পুলিশ সংগঠন এনকেভিডির( NKVD) প্রধান নিকোলাই জেজোভ-কেও গ্রেফতারের পর ফাঁসি দেওয়া হয়!
১৯৩৮ সালের শেষের দিকে গণগ্রেফতার ও ফাঁসির হার কমে আসে। কিন্তু রাজনৈতিক গ্রেফতার ও ভিন্নমতাদর্শীদের উপর অত্যাচার চলতে থাকে স্ট্যালিনের মৃত্যু অর্থাৎ ১৯৫৩ সালের আগ পর্যন্ত। লেবার ক্যাম্পে যেসব মানুষকে পাঠানো হয়েছিল, তাদের অনেকের আত্মীয় জানতোও না তাদের প্রিয়জন জীবিত আছে কি না। এমনও কাহিনি প্রচলিত রয়েছে যে, অনেককে মেরে ফেলার পর তাদের আত্মীয়স্বজনকে বলা হয়েছে যে আসামির দশ বছরের জেল হয়েছে।
১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর যখন নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি স্ট্যালিনের অত্যাচারমূলক আইন ও নীতিগুলো রহিত করেন ও ‘দ্যা গ্রেট পার্জ’-এর সম্মুখ সমালোচনা করেন। ১৯৫৬ সালে একটি গোপন বক্তৃতায় তিনি শুদ্ধিকরণ অভিযানকে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং স্বীকার করে নেন, এই অভিযানে নিহতের মধ্যে নির্দোষ মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। তার সময়ে ‘ডি-স্ট্যালিনাইজেশন’ শুরু হয় এবং তিনি ‘গুলাগ’ ক্যাম্পের বন্দিদের ধীরে ধীরে মুক্তি দেন।