১৯৬৯ সাল। পশ্চিম জার্মানির সাধারণ নির্বাচন। প্রথম বারের মতোন এসপিডি এফডিপির সাথে যৌথভাবে সরকার গঠন করে।ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এর মাধ্যমে পূর্ব জার্মানির সাথে পশ্চিম জার্মানির সম্পর্কের ধরন বেশ বদলে যাবে।
পূর্বে পশ্চিম জার্মানি পূর্ব জার্মানির সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছিল। পূর্ব জার্মানির সাথে এর কোনো কূটনীতিক সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু নবনির্বাচিত চ্যান্সেলর উইলি বর্যান্ডট মনে করেন, এখন নীতি পরিবর্তনের সময় এসেছে। তার সরকার নতুন নীতি গ্রহণ করে যার নাম ‘Ostpolitik’ বা ‘পূর্ব নীতি’। ১৯৭০ সালে ব্র্যান্ডটের সরকার পূর্ব জার্মানির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলচনায় বসে। ১৯৭২ সালে দুই জার্মান রাষ্ট্র ‘Basic Treaty’ স্বাক্ষর করে। এর ধারা অনুযায়ী, দুই রাষ্ট্র একে অপরকে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
কিন্তু পশ্চিম জার্মানির ভিতর থেকেই এই নীতির বিরোধিতা হতে থাকে। বিরোধী দল CDU বলে যে এই চুক্তির মাধ্যমে পূর্ব জার্মানির কর্তৃত্ববাদকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো এবং তাদের পালিয়ে যাওয়া জনতার উপর গুলি চালানোকে বৈধতা দেওয়া হলো। কিন্তু ১৯৭২ সালের সাধারণ নির্বাচনে সিপিডি জয়লাভ করে এবং ১৯৭২ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই জার্মানিই এরপর জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করে। বেসিক চুক্তি হতে পূর্ব জার্মানি ব্যাপক লাভবান হয়, কেননা পশ্চিম জার্মানির স্বীকৃতির সাথে সাথে পশ্চিমা শক্তিগুলোও একে স্বীকৃতি দেয়। চুক্তির ফলে পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির কাছ থেকে ঋণ সহায়তা লাভ করে, ফলে পূর্ব জার্মানির অর্থনীতি উন্নতির পথে যেতে থাকে। এছাড়া প্রচুর ফি-এর মাধ্যমে পশ্চিম জার্মানি থেকে মানুষ পূর্বতে যাচ্ছিল বলে পূর্ব জার্মানি লাভবান হচ্ছিল।
কিন্তু এতকিছুর পরও পূর্ব জার্মানি অর্থনীতিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। পূর্ব জার্মানির সরার অবকাঠামোতে খুব একটা বিনিয়োগ করেনি, ফলে তাদের সড়কপথ, রেলপথ, আবাসন ব্যবস্থা দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছিল। এছাড়া গণতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানির সাথে নিবিড় যোগাযোগ হওয়ার কারণে পূর্ব জার্মানির পক্ষে কর্তৃত্ববাদী চরিত্র বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল। তারা পশ্চিম জার্মানি থেকে আগত মানুষের জন্য ফি-এর পরিমাণ প্রচুর বাড়িয়ে দেয় এবং রাষ্ট্রের কোনো গোপনীয় বিষয় যাতে ফাঁস না হয়ে যায় সে লক্ষ্যে দমন পীড়ন বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৪ সালে পূর্ব জার্মানি সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমে সংবিধানে ‘জার্মান’ শব্দটির গুরুত্ব কমিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়, ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি এর অধিকতর আনুগত্য প্রকাশ পায়।
কিন্তু এরই মাঝে ১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানিতে এক কেলেংকারী ঘটে। চ্যান্সলর উইলি বর্যান্ডটের এক সহকারীর সাথে পূর্ব জার্মানির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তিনি পদত্যাগ করেন এবং ক্ষমতায় আসেন হেলমুট স্মিডথ। ১৯৮১ সালে পূর্ব জার্মানির সরকার পশ্চিম জার্মানির কাছ থেকে আরও অধিকতর সুযোগ সুবিধা চাচ্ছিল। ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে স্মিডথ পূর্ব জার্মানি সফরে গেলে পূর্ব জার্মানি তার কাছে প্রস্তাব রাখে যে, বন যেন পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের ‘বিদেশি’ হিসেবে গণ্য করে এবং পূর্ব জার্মানি থেকে কেউ পশ্চিমে আসলে তাদের যেন নাগরিকত্ব দেওয়া না হয়। কিন্তু স্মিডথ তা অগ্রাহ্য করেন। ১৯৮২ সালের সাধারণ নির্বাচনে এসপিডি’র পরাজয় ঘটে। ক্ষমতায় বসেন সিডিউ’র হেলমুট কোহল।
এত ঘটনা সত্ত্বেও পূর্ব জার্মানি প্রতি বছর তাদের নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানি যাওয়া সহজ করে দেয়। ১৯৮৬ সাল নাগাদ প্রতি বছর প্রায় আড়াই লক্ষ করে পূর্ব জার্মান পশ্চিমে যাচ্ছিল। পূর্ব জার্মানি এর নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানিতে অভিবাসিত হওয়ার সুযোগও দিচ্ছিল। অনেকেই এই সুযোগ নিয়ে পশ্চিমে চলে যায়। নিজেদের নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানিতে চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে এর প্রতিদানস্বরূপ তারা পশ্চিম জার্মানি থেকে ঋণ পাচ্ছিল। ১৯৮৭ সালে পূর্ব জার্মানির নেতা হনেকারের পশ্চিম জার্মানি ভ্রমণের সময় তাকে মর্যাদার সাথে বরণ করে নেওয়া হয়, যা পূর্ব জার্মানির কাছে এক বড় প্রাপ্তি ছিল।
কিন্তু পূর্ব জার্মানির জনগণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন কমছিল। পূর্ব জার্মানির মানুষের পশ্চিমে ভ্রমণ তৃপ্তির বদলে হতাশা বয়ে আনছিল। কেননা তারা পশ্চিম জার্মানি গিয়ে দেখছিল উন্নত জীবন যাপন ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা, যা তাদের নিজেদের দেশে নেই। এছাড়া পশ্চিমে রয়েছে মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা, যা পূর্ব জার্মানিতে কল্পনাও করা যায় না। তারা পূর্ব জার্মানির সরকারের হঠকারিতা এবং তাদের দমন নীতি ভালোভাবে বুঝতে পারছিল পশ্চিমে গিয়ে। ফলে তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে এবং তা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ঘটনাক্রমে এই অবস্থায়ও কেউ মনে করেনি যে দুই জার্মানি আবার একত্র হবে। তবে পশ্চিম জার্মানি আশা করত যে, কোনো একসময় দুই জার্মানি একত্র হবে। তৎকালীন চ্যান্সেলর হেলমুট কোহলও তাই বিশ্বাস করতেন। এর কারণও ছিল। ১৯৮৮ সালের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থা ছিল একেবারেই ভঙ্গুর। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটি ভগ্নদশায় ছিল। তৎকালীন নেতা মিখাইল গর্বাচেভের উদার নীতির ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার ব্লকে প্রভাব পড়তে থাকে, যার প্রভাব পূর্ব জার্মানিতেও পড়েছিল। ১৯৮৯ সালে সংস্কারবাদী হাংগেরিয়ান সরকার তাদের অস্ট্রিয়ার সাথে সদ্য খোলা সীমান্ত খুলে দেয় এবং সে রাস্তা দিয়ে পূর্ব জার্মানির অধিবাসীদের পালাবার সুযোগ করে দেয়। হাজার হাজার পূর্ব জার্মান পালাতে থাকে। পূর্ব জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলেও অস্থিরতা ছড়াতে থাকে।
পূর্ব জার্মানি এই অবস্থা পরিবর্তনে পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ঘটে যায় অভাবনীয় এক ঘটনা। গান্টার সাবস্কি, কমিউনিস্ট পার্টির একজন মুখপাত্র, নভেম্বর ৯, ১৯৮৯ সালে ভুলবশত বলে বসেন যে, তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ব জার্মান সরকার তার নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানিতে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দিবে, অথচ মূলত সরকার বলতে চেয়েছিল যে সাধারণ কর্ম ঘন্টায় নাগরিকরা দেশ ত্যাগ করতে চাইলে তাদের বহিঃর্গমন ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। ফলে সে রাতেই হাজার হাজার জনতা বার্লিন দেয়ালের দিকে এগিয়ে যায় এবং গেট খুলে দেওয়ার জন্য বলতে থাকে। হতবিহ্বল গার্ডেরা কী করবে বুঝতে না পেরে গেট খুলে দেয়। হাজার হাজার মানুষ পশ্চিমে চলে যায়। পশ্চিম ও পূর্ব পাশের মানুষেরা উল্লাসে মেতে উঠে। বার্লিন দেয়ালের পতন হয়।
একই জাতিসত্তা হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশ এবং এক দেয়ালের বিভেদ কিভাবে দীর্ঘদিন মানুষকে মানসিকভাবে জিম্মি করে রাখতে পারে তার নিদর্শন হচ্ছে বার্লিন দেয়াল। তাই আজ পতনের প্রায় ৩০ বছর পরেও সে দেয়াল রেখে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর হাজারো দর্শনার্থী সেখানে যায় এবং স্মরণ করে যে, একটি দেয়াল যতই শক্তিশালী হউক না কেন তা মানুষের সম্প্রীতি এবং একতাবদ্ধ অনুভূতির কাছে কিছুই না।
পাশাপাশি আদর্শ কিভাবে বিভেদ সৃষ্টির যন্ত্র হয়ে উঠতে পারে তার বড় প্রমাণ হচ্ছে বার্লিন দেয়ালের উত্থান। তাই আমাদের রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে যে, আদর্শবাদ তখনই শান্তি বয়ে আনে, যখন এটি বিভেদের পরিবর্তে শান্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠে।