সাদমান সাকিব

অপারেশন নেমেসিস: গণহত্যার প্রতিশোধ চালাতে যে মিশন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

একটা জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালানো হলো। গণহত্যা চালিয়ে হতভাগা জাতির সকল বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষকসহ শতকরা ৭৫% মানুষকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা করা হলো। গণহত্যার পর অল্পসংখ্যক মানুষ বেঁচে ছিল তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই গণহত্যার বিচার চাইল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বরাবরের মতো এবারেও ব্যর্থ। গণহত্যার পর বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো এটি কোনোভাবেই মানতে পারলো না। নিজেরাই একটা বিহিত করার সিদ্ধান্ত নিলো। যেই ভাবা সেই কাজ। গণহত্যার জন্য দায়ী প্রধান ব্যক্তিদেরকে তাঁরা গুপ্তহত্যার মিশন চালিয়ে একের পর এক হত্যা করার পরিকল্পনা করলো।

ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে? এটা কিন্তু মোটেও কোনো কল্পকাহিনি নয়।এটা অটোমানদের কুখ্যাত আর্মেনীয় গণহত্যার এবং একই সাথে গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে গুপ্তহত্যার মিশন ‘অপারেশন নেমেসিস’-এর গল্প। অপারেশন নেমেসিসের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলানো দরকার।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে আর্মেনিয়া খ্রিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করার ঘোষণা দেয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজার অধীনে তারা শাসিত হয়েছে। পনের শতকে আর্মেনিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে, কিন্তু অটোমানরা শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্য আর্মেনীয়দের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখতো। অটোমানদের চোখে আর্মেনীয়রা ছিল ‘অবিশ্বাসী’।

আর্মেনীয়রা ইতিহাসে দু’বার অটোমানদের দ্বারা গণহত্যার শিকার হয়। প্রথমবার উনিশ শতকের শেষ দিকে ১৮৯৫-৯৬ সালে এবং আরেকবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪-১৮ সালে।

১৯০৮ সালে সেনাবাহিনীর তরুণ তুর্কিরা সুলতান হামিদকে উৎখাত করে অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল করলে আর্মেনিয়রা কিছুটা আশার আলো দেখতে পায়। কিন্তু সেটা ছিল নিছক শাসকের পরিবর্তন এবং তাদের উপর নিপীড়নের মাত্রা বিন্দুমাত্র কমেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমানরা অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং একই সাথে অক্ষশক্তির খ্রিস্টানরা বাদে বাকি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ‘হলি ওয়ার’ ঘোষণা করে। অটোমানরা ভেবেছিল আর্মেনীয়রা খ্রিস্টাপ্রধান হওয়ার কারণে তাঁরা তাদের আরেক প্রতিবেশী খ্রিস্টানপ্রধান দেশ রাশিয়ার সাথে রাশিয়া-আর্মেনিয়া আঁতাত করে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। এই অমূলক ধারণার কারণেই হলি ওয়ারের প্রধান শিকার হয় আর্মেনীয়রা।

তুরস্কের বাইরেও আজারবাইজানে বাস করা সংখ্যালঘু আর্মেনীয়রা নৃশংস গণহত্যার শিকার হয়। প্রায় দেড় মিলিয়ন আর্মেনীয় এই গণহত্যায় মারা যান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই গণহত্যার বিচার শুরু হলেও প্রহসনের বিচারে প্রধান আসামী একত্রিশ জনের মধ্যে চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই চারজনও আবার রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। তুরস্কের বাইরে পুরো পৃথিবীতে অবাধে ভ্রমণ করার সুযোগ লাভ করে। এটা গণহত্যার পর বেঁচে থাকা আর্মেনীয়রা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ১৯২০ সালে ইয়েরেভানকে রাজধানী করে আর্মেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইয়েরেভানে আর্মেনিয়ান রেভ্যোলুশনারি ফেডারেশনের(এআরএফ) ৯ম বিশ্ব কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ব কংগ্রেসে আলোচনার মূল বিষয় ছিল আর্মেনীয় গণহত্যায় যারা জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা। কংগ্রেস গুপ্তহত্যার অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয়– যেটি ইতিহাসে ‘অপারেশন নেমেসিস’ নামে পরিচিত।

আরমেন গ্যারো, এ্যারন শাখালিন, শাহান নাটালি– এই তিনজনকে অপারেশন নেমেসিসের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরা মূলত অপারেশনের সব পরিকল্পনা করতেন। তবে অপারেশন পরিচালনার দলগুলো বিভিন্ন পেশার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা আর্মেনীয়দের নিয়ে গঠিত হয়। অপারেশনের মূল টার্গেট ছিল ‘তালাত পাশা’। তালাত পাশা-ই মূলত জাতিগতভাবে তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দেন।

আর্মেনীয় গণহত্যার তিন খলনায়ক, তিন পাশা

তালাত পাশা ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষে লড়াই করা অটোমান সাম্রাজ্যের ‘গ্র্যান্ড উজির’। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে তিনি জার্মানিতে আত্মগোপন করে নাম বদলিয়ে ব্যবসায়ীর বেশে থাকা শুরু করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। তাকে ১৯২১ সালের ১৫ মার্চ তারিখে বার্লিনের শার্লোটেনবার্গের রাস্তায় গুলি করে মারা হয়। তাঁর হত্যাকারীর নাম সঘোমন তেহলিরিয়ান।

জামাল পাশা ছিলেন অপারেশন নেমেসিসের আরেক টার্গেট এবং কুখ্যাত তিন পাশার মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন মিলিটারি লিডার এবং তার প্ল্যান বাস্তবায়নে কঠোর প্রকৃতির একজন মানুষ। এজন্য তাকে ‘জামাল দ্যা বুচার’ বলা হতো। তাকে ১৯২২ সালের ২১শে জুলাই তিবলিসিতে স্টেফান জেঘিগিয়ান নামের গুপ্তহত্যাকারী দিয়ে হত্যা করানো হয়।

তিন পাশার মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন এনভের পাশা। তিনি ছিলেন পেশায় একজন মিলিটারি অফিসার এবং ১৯০৮ সালে সংঘটিত হওয়া ‘তরুণ তুর্কি বিপ্লব’-এর একজন নেতা। তিনি তাজিকিস্তানে ১৯২২ সালে হ্যাকপ মেলকুমোভ নামের একজন অপারেশনের সদস্য দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকার হন।

ফাতালি খান খয়স্কি ছিলেন আজারবাইজানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯১৮ সালে বাকুতে যে গণহত্যা সংঘটিত হয় তার পুরো দায়ভার চাপানো হয় তার উপর। তাকে ১৯২০ সালের ১৯শে জুন তিফলিসের এরেভেনিয়ান স্কয়ারে আরাম ইয়েরগেনিয়েন নামের একজন আততায়ী হত্যা করে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গুপ্তহত্যার শিকার হন, যারা গণহত্যায় জড়িত ছিলেন।

সঘোমনের বিচার প্রক্রিয়ার ছবি

বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনায় মাত্র দুজন আততায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পরেন। তার মধ্যে একজন হলেন তালাত পাশার বিরুদ্ধে বার্লিনে অপারেশন পরিচালনাকারী সঘোমন তেহলিরিয়ান। তাকে গ্রেফতারের পর আদালতে ডাকা হয় এবং তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘আমি জানি আমি আমার বিবেকের কাছে নির্দোষ। আমি একজনকে হত্যা করেছি কিন্তু আমি অপরাধী নই, কারণ আমি যাকে হত্যা করেছি সে আমার পরিবারসহ দেড় মিলিয়ন মানুষের হত্যার জন্য দায়ী। আমি নিজের চোখের সামনে আমার মায়ের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছি, আপন বোনকে ধর্ষিত হতে দেখেছি।’

তেহলিরিয়ানের আইনজীবী আদালতে এই যুক্তি প্রদর্শন করেন যে তেহলিরিয়ান গণহত্যাকালীন যে ট্রমার মধ্যে ছিল, সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং সে তালাত পাশাকে হত্যার সময় মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না। আদালত এ যুক্তি গ্রহণ করে এবং তাকে মুক্তি দেয়। অনুরূপভাবে আরেকজন আততায়ীকেও মুক্তি দেয়া হয়।

১৯২২ সালের শেষের দিক থেকে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও জর্জিয়ার সরকার একত্রে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ‘প্রমিথিউস’ বিল পাশ করলে আর্মেনীয় সরকার এই অপারেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।


তথ্যসূত্র:
www.armeniagogo.com
www.operation-nemesis.com
www.mediamax.am/en
www.yonkerstribune.com
www.independent.co.uk

This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu