বাড়ি তার বাংলা: বাঙালির ভাবাবেগে উদ্ভাসিত এক চলচ্চিত্র


বর্তমান সময়ে ভারতের কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাভাষীদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ভাষাগত কিছু সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেবার প্রেক্ষিত থেকে ভাষাভিত্তিক শিল্প সৃষ্টিগুলোর সাথে সাথে একটি সিনেমাও খুব আলোচিত হচ্ছে। যদিও এই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে আরও অনেক আগে। আমি যদি ঠিক ধরে থাকি, তবে আসলেই সিনেমার পরিচালক বা কলাকুশলীদের কেউই বর্তমান প্রেক্ষাপট থেকে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ পাননি। তবে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে এই চলচ্চিত্রটি বাঙালির ভাবাবেগ থেকেই নির্মিত হয়েছে৷ কাজেই ওপার বাংলার কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শ মেনে সময় করে দেখে নিলাম বাড়ি তার বাংলা

‘বাড়ি তার বাংলা’ নামের এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিলো ২০১৪ সালের ১৬ মে। ১০৬ মিনিট সময়কালের বাংলা ভাষার এই চলচ্চিত্রের বাজেট ছিলো ৯০ লাখ ভারতীয় রুপি যা টাকার হিসেবে প্রায় ১ কোটি ৭ লক্ষ ১০ হাজার টাকা।

রঙ্গন চক্রবর্তী পরিচালিত এই সিনেমার প্রযোজনা করেছেন সত্যজিত সেন এবং পিয়াল ভদ্র। মূল কাহিনি লিখেছেন পরিচালক নিজে। চিত্রনাট্য তৈরিতে সাহায্য নিয়েছেন উস্তভ মুখার্জীর। মূল চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় (রূপচাঁদ সেন), রাইমা সেন (ডা. অবন্তি), সুমিত সমাদ্দার (ফটিক) ছাড়াও পার্শ্বচরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন তুলিকা বসু, শান্তিলাল মুখার্জী এবং লাবণী সরকার প্রমুখ। এই চলচ্চিত্রের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ট্রাইপড এন্টারটেইনমেন্ট।

একজন কৌশলী বিজ্ঞাপন লিখিয়ে থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ক্যাম্পেইন লেখক আর তারপর হয়ে ওঠা একজন চারণ কবি। হ্যাঁ, বলছিলাম চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্র রূপচাঁদ সেনের কথা। বাংলা ভাষায় নিজের দখল আর মেধাবী ছন্দচয়নের ক্ষমতাধারী এই লেখক কাজ করেন কপিরাইটার হিসেবেও। লিখেছেন বাচ্চাদের জন্মদিন, অন্নপ্রাশন বা বিয়ের কার্ডের লেখা। আস্তে আস্তে শরীরে লাগে রাজনৈতিক বাতাস। বাবার দল মেরুন পার্টির হয়ে লিখেন নির্বাচনী স্লোগান, ‘হয় মেরুন, নয় মরুন!’

তার এই স্লোগানের জোরেই সেবার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে মেরুন পার্টি। বাংলা শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে একসময় হয়ে ওঠেন সবার কাজের কাজি। যেকোনো সরকারি প্রচারণা বা অনুষ্ঠানের মূল কাজেই ডাক পড়ে তার। তিনিও ছুটতে থাকেন এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। স্বাস্থ্য প্রচারণায় গানে গানে সচেতন করা হয় মানুষকে। সেই গানের কথায় তিনি লিখেন, ‘মাদল বাজে ধিমি ধিমি, আর হবে না ফিতাকৃমি’। সাক্ষরতা অভিযানের জন্য লিখেন, ‘ওলো সই, ওলো সই… আমার ইচ্ছে করে তোদের মতো খাতায় করি সই’। কিন্তু একটা সময় মেরুন পার্টির আচরণ বদলে যায়। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করেন মেরুন পার্টির অভিলাষী আর স্বার্থপর আচরণ। গ্রামীণ জনতার উন্নয়নে মন না দিয়ে তাদের দ্বারা পরিচালিত স্বার্থান্বেষী কর্মকান্ড এক পর্যায়ে তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এরই মাঝে একবার ফটিক তার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসে হলুদ পার্টির নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করে দেবার। হলুদ পার্টির হয়ে তিনি স্লোগান লিখেন, ‘এবার বাংলার গায়ে হলুদ’। তার স্লোগানের জোরে সেবার হলুদ পার্টিও ক্ষমতায় আসে। এবারও রূপচাঁদের সাথে একই ঘটনা ঘটে। হলুদ পার্টির সাথে বিবাদে জড়িয়ে একসময় ঘরে এসে বসেন তিনি। হাতে কলম তুলে নিয়ে পড়ে যান এক বিরল সমস্যায়। সারা জীবন ফরমায়েসিতে কাজ করে আসা মেধাবী এই লেখিয়ে আর নিজের ইচ্ছায় কলম চালাতে পারেন না। সমস্যার প্রগাঢ়তা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে মনঃস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন। সেই টানাপোড়েন থেকেই দেখতে শুরু করেন নিজের মৃত মাকে। সব ঘটনার প্রেক্ষিতে দ্বারস্থ হন একজন মনোবিদের। সেই মনোবিদ রাইমা সেনের সাথে সংলাপে সংলাপে এগিয়ে যায় এর কাহিনি। বাকিটা জানতে হলে দেখে নিতে হবে মাঝারি ব্যাপ্তির এই চলচ্চিত্রটি।

পরিচালকের ইঙ্গিতপূর্ণ কাহিনী এবং দৃশ্যধারণ দর্শককে আশাহত করবে না বলে আমার বিশ্বাস। যাদের পক্ষে আর্ট ফিল্ম হজম করা সম্ভব হয় না তাদের অনেককেও আমি এই চলচ্চিত্রের গুণগান করতে শুনেছি। এখানেই রঙ্গনের সাফল্য। সব ঘাটের গরু গাধা আর বোদ্ধাকে এনে তিনি এক ঘাটে জল খাওয়াতে পেরেছেন। পুরো আয়োজনে তিনি যেভাবে উদারভাবে গূঢ় গভীরতার সাথে নিখাদ হাস্যরসাত্মক সংলাপের অবতারণা করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তাছাড়া অভিনয়ে রাইমা সেনকে ছাপিয়ে গেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ফটিক চরিত্রে সুমিত সমাদ্দারের অভিনয়ও এই আয়োজনের সফলতায় অনেক গুরুত্ব বহন করে। আমাদের দেশে বা ওপার বাংলায় যারা একটু উচ্চমানের চিন্তা উদ্রেককারী চলচ্চিত্র দেখার পাশাপাশি সেখান থেকে কিছু শিক্ষা নেয়ার মানসিকতাও রাখেন, তাদের জন্য খুব সুন্দর একটি পছন্দ হতে পারে এটি। বাংলা ভাষায় এরকম একটি উচ্চমানের চলচ্চিত্র দেখলে আসলে বাঙালি হিসেবে নিজেরও গর্ব হয়। তামিল সিনেমার ইন্ডাস্ট্রি থেকে কাহিনি নামিয়ে তার উলঙ্গ পুনঃনির্মাণ না করেও মৌলিক গল্পে সিনেমা বানানো যায়– এই বক্তব্যের একটি জোরালো দলিল এই সিনেমাটি। ভিএফএক্স, নায়ক নায়িকার লাফালাফি এই সিনেমায় নেই– কিন্তু এটা স্বীকার করতে হবে, এই সিনেমায় প্রাণ আছে। এরকম ভালো সিনেমা দেখার জন্যই হয়তো আমাদের বেঁচে থাকা।

সেরা চরিত্র: রূপচাঁদ সেন চরিত্রে শাশ্বত মুখোপাধ্যায়

সেরা নারী চরিত্র: মনোবিদ ডা.অবন্তির চরিত্রে রাইমা সেন

সেরা ব্যাপ্তি: ৮৭ থেকে ৯৯ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড

সেরা সংলাপ: ভোটের আগে মাংস পোলাও, ভোট ফুরোলেই উচ্ছে দে’


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো

যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো — অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে — দিনমানে কোনো

গল্প

একুশ বছর আগের একদিন

আকাশে অশোক গাছের ছায়া, বিশাল সমুদ্রে মানুষের বসতি, সন্ধ্যার ফ্রাগমেন্ট সবকিছুর মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠা জাদু ও বাস্তবিক প্লাটফর্মে ফুহাদ ভাবে,

গল্প

বার কুইন মৌমিতা

তলপেটে ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে মৌমিতার। বারবার ন্যাপকিন পাল্টাতে হচ্ছে তার। পাশের বাসার ভাবীর কথা অনুযায়ী গরম দুধ খাচ্ছে, বাথরুমে গেলে

অবরোধ

বহুদিন আমার এ-হৃদয়কে অবরোধ ক’রে র’য়ে গেছে; হেমন্তের স্তব্ধতায় পুনরায় ক’রে অধিকার। কোথায় বিদেশে যেন এক তিল অধিক প্রবীণ এক