গ্রেইভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইজ: যুদ্ধ এবং জীবনযুদ্ধ

যুদ্ধের ভয়াবহতা, নির্মমতা আমরা সবাই কমবেশি জানি। যেটুকু জানি না তা হলো– শব্দ বা বাক্য লিখে ‘যুদ্ধ’ বর্ণনা করা যায় না। নারকীয় তাণ্ডবলীলায় নিরীহ মানুষ যখন বোমাবাজিতে মরে, গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে, ঘরহীন অভুক্তরা দিশেহারা হয়ে বাঁচার আশ্রয় খোঁজে, চোখের সামনে সবকিছু ভস্ম হয়ে যেতে দেখে তখন সেটাই হয়তো ‘যুদ্ধ’ হয়ে যায়। সেটাকেই হয়তো ‘যুদ্ধ’ বলা হয়। 

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে- ‘History is written by the victors’ অর্থাৎ ‘ইতিহাস রচিত হয় বিজয়ীর হাতে’।

জাপানিজ ঔপন্যাসিক ও গীতিকার আকিয়ুকি নোসাকা (Akiyuki Nosaka)-কে আমি সে অর্থেই বিজয়ী বলবো, কারণ তিনি জীবন ফিরে পেয়েছিলেন যুদ্ধ থেকে।

সময়টা ১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ সময়। জাপানের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর কোবে তখন জনসংখ্যায় প্রায় ১০ লাখ। হঠাৎ মার্কিনি বোমাবাজি আর গুলিবর্ষণে সবকিছু ধ্বংস হতে শুরু করলো, নিহত হলো নোসাকার পালক পিতা। দুই বোন অপুষ্টিতে মারা গেলো। ১৯৬৭ সালে আত্মজীবনীমূলক ছোট গল্প ‘গ্রেইভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইজ’ (জাপানি নাম ‘হোতারু নো হাকা’) জীবনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন নোসাকা।

পরবর্তীতে অনেকে এই গল্প নিয়ে সিনেমা করতে চাইলেও তিনি অনুমতি দেননি। জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় ও মেধাবী পরিচালক ইসাও তাকাহাতা গল্পটিকে অ্যানিমেশন আকারে দেখানোর প্রস্তাব জানালে লেখক শেষ পর্যন্ত রাজী হন এবং ১৯৮৮ সালে স্টুডিও ঘিবলি থেকে এই অ্যানিমেটি তৈরি হয়।

গল্পটা চৌদ্দ বছরের কিশোর সেইতা এবং তার চার বছরের ছোট বোন সেতসুকোকে নিয়ে। বাবা নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। 

আকাশ জুড়ে বোমার বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল সব পুড়ে ছাই। এমনকি ওদের মা-ও। মায়ের মৃত্যুসংবাদ বোনের কাছ থেকে লুকিয়ে বোনকে আগলে রাখা যেন সেইতা-র কাছে মনে হয় যুদ্ধের ভেতর আরেক যুদ্ধ। অনাথ ভাইবোন দুটো আশ্রয় নেয় ওদের মাসীর কাছে। যুদ্ধের এই অভাবের সময় কে কাকে দেখে? ক’দিন বাদে মাসীদের আদরেও ভাটা শুরু হয়। ওদের মায়ের কিমানো (জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোষাক) বেঁচে খাবারের ব্যবস্থা করতে বাধ্য করে। ওরা মাসীর কাছ থেকে চলে গিয়ে এক হ্রদের ধারে আশ্রয় নেয়। 

চারিদিকে অভাব, এভাবে আর কতদিন? ক্ষুধার তাড়নায় হ্রদের মাছ, ব্যাঙ খাওয়া শুরু করে ওরা। ছোট্ট বোনকে এই দুর্বিষহ সময়েও আনন্দ দিতে সেইতা মাঝে মাঝে জোনাকি ধরে আনে। জোনাকিগুলোই যেন এমুহূর্তে ওদের সঙ্গী, ওদের বিনোদন। 

না খেয়ে আর কত? চারিদিকের ভীষণ অভাব কে মেটাবে? বোনের জন্য খাবার আনতে চুরি করতে যায় সেইতা, ধরা পরে, মার খায়। সাদা পোশাকপড়া সরকারি লোকটার সামান্য দয়ায় ছাড়া পেয়ে সেইতা যখন বেরিয়ে দেখে ওর ছোট্ট অসুস্থ বোন দাঁড়িয়ে আছে ভেজা চোখে; সে দৃশ্যে দর্শকের চোখ ভিজে গেলেও টের পাবে না! এমনই আবেগের সংমিশ্রণ রয়েছে দৃশ্যটিতে।

শেষ দিকের এক দৃশ্যে না খেতে পেয়ে অপুষ্টিতে আধমরা সেতসুকো ক’টা পাথর দেখিয়ে ওর ভাইকে বলছিলো- ‘Seita, this is for you… Steamed rice.  Here’s some cooked soy pulp. Please, eat. You are not having any?’

সেইতা ওর বোনকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে পেরেছিলো কিনা তা আমি বলবো না, শুধু বলবো পরিচালক তাকাহাতা এই সিনেমায় বারবার যুদ্ধের নিষ্ঠুরতম চিত্র সহজ করে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন।

অ্যানিমেশন শুনলে প্রথমে আমাদের মাথায় আসে বাচ্চাদের জন্য নির্মিত রসাত্মক কিছু, এই সিনেমা সে ধারণা একেবারে শেষ করে আপনার হৃদয় নিংড়ে দেবে সে কথা বলতে পারি!

চার বছরের ছোট্ট শিশুর মায়ের জন্য যে আকুলতা, তেষ্টায়-ক্ষিধেয় তার যে নির্ভরতা, সেই ছোট্ট শিশুই যুদ্ধের বিভীষিকায় পতিত হয়ে অনাথ জীবনে ভাইয়ের সঙ্গে কিভাবে লড়াই চালিয়ে গেছে তার গল্প ‘গ্রেইভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইজ’।

সব হারানো এক ভাইয়ের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তার ছোট্ট বোনের জন্য লড়াই, তাকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা এবং অবশেষে তাদের দুজনার জোনাকিপোকার সঙ্গে মিশে যাবার গল্প; সব নিয়েই ‘গ্রেইভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইজ’। নিঃসন্দেহে এটি যুদ্ধ নিয়ে এখন পর্যন্ত বানানো সেরা সিনেমাগুলোর একটি।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
আন্তর্জাতিক

জার্মানি: একটি দেয়ালের উত্থান এবং পতনের গল্প-১

একটি দেয়াল একটি রাষ্ট্রকে ঠিক কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে? একটি দেয়াল ঠিক কতটুকু গুরুত্ব বহন করতে পারে, একটি বিশাল রাষ্ট্রের

কবিতা

কুড়ি বছর পরে

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি! আবার বছর কুড়ি পরে- হয়তো ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে- তখন

গল্প

ডাঙ্গায় ডলফিন

অভিষেক ডুবে যায়। ছোটবেলায় সে একবার মামা বাড়ির পুকুরে ডুবতে ডুবতে বেঁচে গিয়েছিল। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। চলন বিলে

গল্প

ফড়িং জীবন

ইদানীং অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখে হেলাল। রাতে ঘুম হয় না। অনেকগুলো গাঙপাখি, গায়ের রঙ হলুদ, ঝাঁক বেঁধে হেলালের দিকে ধেয়ে