আলফা (২০১৯): জৌলুসহীন সময়ে আশা জাগানিয়া চলচ্চিত্র

চলচ্চিত্রআলফা’: কর্ম কারিগর পরিচিতি

সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একজন রিকশা পেইন্টার, তার আশেপাশের সমাজের বাস্তব চিত্র আর একটি লাশ-এই নিয়েই চলচ্চিত্র ‘আলফা’। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেলেও চলচ্চিত্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বিলম্বে মুক্তি পায়। ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটি অপেক্ষাকৃত ব্যতিক্রম ঘরানার অন্য আরও গোটা দশেক অবাণিজ্যিক, গল্প ও নির্মাণশৈলীভিত্তিক মৌলিক চলচ্চিত্রের মতোই আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ এর চিত্রনাট্য, কাহিনী ও পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘আলফা’।  মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা শহরের বুকে শান্তির আগুন ছড়িয়ে দেয়া গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের এই সদস্য মূলত বাংলাদেশের শিল্প-চলচ্চিত্র জগতের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলা মঞ্চনাটকের এই কান্ডারির প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ছিলো ‘একাত্তরের যীশু’। ২০১১ সালে ‘গেরিলা’র জয়জয়কারের পর দীর্ঘ সময় নিয়ে ২০১৯ এ চলচ্চিত্র ‘আলফা’ নিয়ে আবার রুচিশীল, বোধ-উদ্দীপক বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের সামনে আসেন পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ।

চলচ্চিত্র ‘আলফা’: যাদের জাদুতে অনন্য  

চলচ্চিত্র ‘আলফা’র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, প্রযোজক ফরিদুর রেজা সাগর এবং এশা ইউসুফ।

চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রাহক সমীরণ দত্ত, আবহ সঙ্গীতের সুরকার অলকানন্দ দাশগুপ্ত। সম্পাদনা করেছেন ক্যাথরিন মাসুদ। মূল ও নাম চরিত্র আলফার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মী আলমগীর কবির। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গন্ধজেঠার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বর্ষীয়ান ও  প্রথিতযশা অভিনয়শিল্পী এটিএম শামসুজ্জামান। মূল চরিত্রের মতো অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যেও ছিলো নতুনত্ব। চরিত্রের প্রয়োজনে অডিশনের মাধ্যমে চরিত্র ভাগ করে দেয়া হয়েছে অভিনয়শিল্পীদের মাঝে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গোলেনূর, হেকমত, সুলেমানের মা, কালী, মফিজ, পুলিশ কর্মকর্তা, ডোম সরদার, শিব গৌরী, সুলেমানের স্ত্রী, রুপা, মালা, শিরিন, বকুল-দের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যথাক্রমে দিলরুবা দোয়েল, হীরা চৌধুরী, ইশরাত নিশাত, মোস্তাফিজ নূর ইমরান, ভাস্কর রাসা, সাজ্জাদুর সাজ, এহসানুর রহমান, হ্যারিস, তোরা, লতা, কলি, বেবি এবং নাঈমী। শিশুচরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন রাজু, হাবিব, ইমা ও শান্তা। দোকানদারদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেতু, মিঠু বর্মণ ও জাহাঙ্গীর।

সিনেমা ‘আলফা’: যে দ্যুতিতে উজ্জ্বল 

চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্র ‘আলফা’ একজন স্বাধীন মানুষ; যন্ত্রণা আর যান্ত্রিকতায় ভরা সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীর মাঝে ভাসমান একটা টঙঘরে সাজিয়ে নিয়েছে নিজের জীবন। রিকশা পেইন্টিং আর মনের স্বাধীনতায় নানা কাজের মাঝে ডুবে থাকা আলফা’র চরিত্রটি গ্রীক মিথের কোথাও কোথাও মিলেই যায়। বিচিত্রতায় ভরা এই রিকশা পেইন্টিং কারিগরের সারল্য আর সরলতাই এই চলচ্চিত্রের অন্যতম মূল বিষয়বস্তু ছিলো। নির্মাতার গল্প বলার নিজস্ব ভঙ্গিটি সিনেমার গল্পের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাত্রা নিয়েছে। সহজ, প্রাঞ্জল আর বোধগম্য সংলাপে পুরো চলচ্চিত্রটিই কেনো যেনো অনেক বেশি বাস্তব ও বাস্তবসম্মত ঠেকেছে যা পূর্বাঞ্চলের সিনেমাশিল্পের মূল অলঙ্কার।

তৃতীয় লিঙ্গের একটি চ্যালেঞ্জিং চরিত্র কালী’র ভূমিকায় অভিনয় করা মোস্তাফিজ নূর ইমরানও কম প্রশংসা পাবার যোগ্য নন। এখানে সিনেমার আলোচনার পাশাপাশি উল্লেখ প্রয়োজন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ কয়েকটি সফল ও প্রশংসিত-সমালোচিত ওয়েব সিরিজ, ওয়েব ফিল্ম এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করে আপন ক্যারিশমায় প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই মোস্তাফিজুর নূর ইমরান। শুধু মোস্তাফিজুর নূর ইমরানই নন, তার সমসাময়িক এবং একই ধরণের মাধ্যম থেকে দর্শক জনপ্রিয়তা পাওয়া শ্যামল মাওলা, নিশাত প্রিয়ম, নাসির উদ্দীন বা রুকাইয়া জাহান চমক প্রমুখরাও এই অপেক্ষাকৃত নতুন প্ল্যাটফর্মের বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিয়ে নিজ জাত চিনিয়েছেন।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবনের অনেক বড় একটা গল্প নিজ চরিত্র ‘কালী’র মুখে, ভূমিকায় বলে গেছেন মোস্তাফিজ নূর ইমরান; সংলাপ আর সহজাত বাচনভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি সমাজের অমানবিক আচরণ, নীচ দৃষ্টিভঙ্গি আর তুচ্ছ করার মানসিকতা এবং এতে তাদের নির্বিকার, নিরুত্তর, অভ্যস্ত ও সহনশীল জীবনযাপন। গন্ধজেঠার চরিত্রে অভিনয় করা প্রথিতযশা অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান এই চলচ্চিত্রে অনেকটাই বটবৃক্ষের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। পর্দায় বেশিক্ষণ সুযোগ পাননি, তবে দর্শকের মনে থেকে গেছেন পুরোটা সময় জুড়েই। অন্যান্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শিল্পীদের সরল ও বাস্তবধর্মী অভিনয় এই চলচ্চিত্রটিতে সজীবতা ও প্রাণের স্পন্দন নিয়ে এসেছে। কোনো অংশে সিনেমাটিকে মেকি বা অবাস্তব মনে হয়নি। লাশের সাথে কথা বলার মত পরাবাস্তব দৃশ্যগুলোতেও একটা আন্তরিক গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। নবীণ কিন্তু পরিণত অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফও এজন্যে প্রশংসা পাওয়ার দাবীদার।

সিনেমা ‘আলফা’: যেসব দাঁড়িপাল্লায় সফল 

চলচ্চিত্রের শ্যুটিং শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমকে (bdnews24.com) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক চলচ্চিত্রে সভ্যতা, সম্পর্ক, মুক্তবাজার অর্থনীতি, আধিপত্যবাদ এবং বিশ্বায়নের বিপরীতে তৃতীয় বিশ্বের একজন সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প তুলে ধরার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, চলচ্চিত্র দর্শনপূর্বক এই সমালোচনা লিখতে গিয়ে বলা যায় তিনি তা রাখতে পেরেছেন। নির্মাতা গ্রিক বর্ণমালার অক্ষর ‘আলফা’কে বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়ে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু এই চরিত্রের মাধ্যমেই বলে গেছেন তুলনামূলক এই সমাজের অপেক্ষাকৃত দায়িত্বশীল কিন্তু অগুরুত্বপূর্ণ মানবিক মানুষদের কথা। নির্মাতা তার সেলুলয়েডীয় এই নির্মাণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সাধারণ নাগরিকদের জীবনের মূল্য, প্রাকৃতিকভাবেই মৃত্যুবরণ করার অধিকার বা রাষ্ট্রীয় হঠকারী সিদ্ধান্তে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে নদীতে ভেসে বেড়ানো নাগরিক লাশেদের গল্প বলেছেন খুব ধী ও প্রজ্ঞার সাথে। পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে পরিচালক একটি ঘোর তৈরি করে রাখতে পেরেছিলেন যা পরাবাস্তব ও বাস্তবতার মিশেলে একান্ত প্রয়োজনীয় ছিলো। এই চলচ্চিত্রে ভিন্নধর্মী এক নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছেন পরিচালক।

পর্দার পেছনের কুশীলবদের দুর্দান্ত, আন্তরিক এবং পেশাদার কাজ এই চলচ্চিত্রটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও অনন্য  করেছে। প্রতিটি দৃশ্যে জীবন ও জীবন্ত সত্তার যে প্রতিফলন ঘটেছে তা মূলত এই সিনেমার সহজ গল্প বলার বৈশিষ্ট্যটিকে আরও বিশেষভাবে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করেছে। আবহসঙ্গীতে ব্যবহৃত গানটি সিনেমার গল্পের আরও ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিলো, যেনো কোনো এক রহস্যময় মাঠে দাঁড়িয়ে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল অজ্ঞাত শিল্পীর বাঁশি থেকে ভেসে আসা সুর-আর চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছিলো মেরাজের সেই বোরাক। যেনো অস্ফুট কিন্তু আত্মিবিশ্বাসীর সুরে জাতিস্মর কোনো এক গল্পকার বলে যাচ্ছেন এক অশরীরির চোখে দেখা একটি সমাজের গল্প, একটি নদী, নদীতে ভেসে থাকা কয়েকজন মানুষ আর একটি লাশকে ঘিরে চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকা জীবন, প্রেম, দ্রোহ, আইন, সমাজ, রাষ্ট্র বা আনুসঙ্গিক গল্পসমূহ। সামাজিকভাবে শিকড়বিহীন চরিত্র আলফা থেকে শুরু করে শতবর্ষ-পুরাতন ধ্যানধারণায় খুঁটি গেড়ে স্থবির হয়ে থাকা সমাজের নিগৃহীত কালী, প্রত্যেকের চরিত্রই বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে বলয় নির্মাণ করেছে। সেই বলয়ে ঘুরেছে ভাসমান সমাজেও বিদ্যমান প্রেম, দ্রোহ, মানুষের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ও স্বভাবজাত ভালোবাসা, অভিভাবকত্ব, বেদনা, ক্ষোভ, অভিযোগ, অনিয়ম, আইনের উলঙ্গ শাসন।

চলচ্চিত্র ‘আলফা’: সম্মাননা পুরস্কার 

‘ভারত-বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার’ এর প্রথম আসরে চলচ্চিত্র ‘আলফা’র জন্য সেরা নির্মাতার পুরস্কার পান পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অস্কারের ৯২ তম আসরে ‘বেস্ট ইন্টারন্যাশনাল ফিচার ফিল্ম’ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে নির্বাচিত হয় চলচ্চিত্র ‘আলফা’। কলকাতায় অনুষ্ঠিত ২৫ তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ থেকে ‘আলফা’ ও ‘চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্র দুটি অংশ নেয়। এছাড়াও দেশে বিদেশে চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মাঝে তুমুল আলোচিত-প্রশংসিত হয় ব্যতিক্রম ঘরানায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি।

বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়কার জৌলুস হয়তো এখন আর নেই। কবে সেই জৌলুস আর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট হবে তাও আমরা জানি না। তবে এরকম নির্মাণগুলো আমাদের মনে আশা যোগায়, ভরসা দেয়।

সুদিন আসবেই!

 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

চারিদিকে প্রকৃতির

চারিদিকে প্রকৃতির ক্ষমতা নিজের মতো ছড়ায়ে রয়েছে। সূর্য আর সূর্যের বনিতা তপতী— মনে হয় ইহাদের প্রেম মনে ক’রে নিতে গেলে,

মহিলা

এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো; এইখানে এসে প’ড়ে- থেমে গেলে- একটি নারীকে কোথাও

কবিতা

প্রাক্তন

নয়ন মাহমুদ-এর কবিতা প্রাক্তন তুমি চলে গেলে নিশ্চুপ, কোনো এক পৌষের রাতে: বললে, ‘কবুল।’ কবিতাকে বিষাদে ভরিয়ে দিয়ে আমার হাতে

মরীচিকার পিছে-

ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে ছুটে যায় দুটি আঁখি! -কত দূর হায় বাকি!