বহুল প্রত্যাশিত ‘জাস্টিস লিগ স্নাইডার কাট(২০২১)’ বনাম ‘জাস্টিস লিগ (২০১৭)’: পার্থক্য এবং বিশ্লেষণ

জ্যাক স্নাইডারের ‘জাস্টিস লিগ’ চার ঘন্টা দুই মিনিটের একটি মাস্টারপিচ সিনেমা। একটি মাস্টারপিচ সিনেমা হবার জন্য যা যা দরকার, এই সিনেমাতে তার কোথাও কোনো কমতি পাবেন না। এটি Avatar, Avengers: Endgame, The Irishman, Dances with Wolves, Malcolm X এর মতো চলচ্চিত্রের চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয় এবং সুপারহিরোপ্রেমী দর্শকদের কাছে অনেক বেশি উপভোগ্য।

চার ঘন্টার এই কাটটি এমন এক সাহসী চলচ্চিত্রায়ন যা মার্টিন স্কোরসেজির সেই অভিযোগকে দুর্বল করে দিয়েছে। ২০১৯ সালে মার্টিন স্কোরসেজি একটি সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছিলেন, ‘আধুনিক সুপারহিরো সিনেমাকে চলচ্চিত্র হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।’ সম্ভবত এই সিনেমাটি দেখার পর স্কোরসেজির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেও হতে পারে!

স্নাইডার কাটের গল্প:

চলচ্চিত্র জগতে ডিসিইইউ (DCEU- DC Extended Universe)-এর যাত্রা শুরু হয় জ্যাক স্নাইডারের ২০১৩ সালে ‘ম্যান অব স্টিল’ সিনেমার মুক্তির মধ্য দিয়ে। তারপর ২০১৬ সালে জ্যাক স্নাইডারের পরিচালনায় আসে ‘ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস’। অতঃপর ২০১৭ সালে আসে জ্যাক স্নাইডার এবং জস উইডেনের যৌথ পরিচালনায় ‘জাস্টিস লিগ’। কিন্তু জাস্টিস লিগের ২০১৭ ভার্সনের পিছনে লুকিয়ে আছে কিছু ঘটনা। জাস্টিস লিগ সিনেমার কাজ চলাকালীন সময়ে পরিচালক জ্যাক স্নাইডারের মেয়ের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়। এর দরুন স্নাইডার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ চলার সময়েই তিনি এই প্রোজেক্টটি ছেড়ে চলে যান। এর পেছনে আরও একটি কারণ ছিল– ওয়ার্নার ব্রোস স্নাইডারকে সিনেমাটিতে কমেডি যুক্ত করা এবং সিনেমার সময়সীমা ২ঘন্টা রাখার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, যাতে সিনেমাটি মার্ভেলের সিনেমাগুলোর মতো হয়। কিন্তু স্নাইডার এই বিষয়টি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি যা দেখাতে চান তা কোনোভাবে দুই ঘন্টায় দেখানো সম্ভব ছিল না, আর যেভাবে সিনেমাটির চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল তাতে জোর করে কমেডি যুক্ত করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব ছিল না। তাই তিনি এই প্রোজেক্ট থেকে সরে আসেন। এরপর ওয়ার্নার ব্রোস জস উইডেনকে নিয়ে আসে সিনেমাটি শেষ করার জন্য। জস উইডেন এর আগে মার্ভেলের প্রথম দুটি ‘অ্যাভেঞ্জার্স’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখক এবং পরিচালক, তাই তিনিই ছিলেন স্টুডিও’র সেরা পছন্দ। আর স্টুডিওর ইচ্ছামতো জস উইডেন সিনেমাটি চার ঘন্টা থেকে কেটে দুই ঘন্টায় নিয়ে আসে এবং অতিরিক্ত কমেডি যুক্ত করার জন্য এবং কাহিনিতে পরিবর্তন আনার জন্য রি-শ্যুট করে। আর এর ফলে যে সিনেমা আমাদের সামনে মুক্তি পায়, সেটিকে আমরা সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছি। সেই জাস্টিস লিগ কেমন ছিল, সেটা আপনারাও জানেন। জস উইডেনের মাধ্যমে পরিবর্তিত করে যে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল, তাতে স্নাইডারের শ্যুট করা অংশ থেকে মাত্র ৩০ শতাংশ নেওয়া হয়েছিল। এখন স্নাইডার কাট দেখার পরে এটা স্পষ্ট ২০১৭ সালের জাস্টিস লিগ মুভির সব থেকে আকষর্ণীয় দৃশ্যগুলো কিন্তু স্নাইডারের পরিচালনায় শ্যুট করা অংশ থেকে নেওয়া হয়েছিল।

কাহিনি সংক্ষেপ:

স্নাইডার ‘জাস্টিস লিগ’ চলচ্চিত্রটিকে ৬টি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। যে অধ্যায়গুলির নামের সাথে সিনেমার কাহিনির সম্পর্ক নির্ণয় করাটা খুব মজাদার একটি বিষয়। আর যদি সিনেমাটির কাহিনির কথা বলি, তাহলে ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া জাস্টিস লিগের কাহিনির ডার্ক ভার্সন এটি। স্টেফেনওলফ নামক ভিনগ্রহবাসী মাদারবক্স সংগ্রহ করার জন্য পৃথিবীতে আসবে। ব্যাটম্যান একটা দল বানানোর জন্য সুপারহিরোদের কাছে যায়। ‘ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস’ চলচ্চিত্রের শেষে ডিসি ইউনিভার্সের অন্যতম শক্তিশালী সুপারহিরো সুপারম্যানের রহস্যজনক মৃত্যুর পর তাকে বাঁচানোর কাহিনি সিনেমাটিতে এসেছে। এর পাশাপাশি এই সিনেমাতে ডিসি ইউনিভার্সের অন্যতম শক্তিশালী ভিলেন ‘ডার্কসাইড’-এর উপস্থিতি দেখা গেছে। ডার্কসাইডকে অনেক বেশি অশুভশক্তিসম্পন্ন এবং ভয়ংকর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এন্টি-লাইফ নামক ইক্যুয়েশন লাভের বাসনায় ডার্কসাইড হাজার হাজার গ্রহ ধ্বংস করে তাদের জীবনীশক্তিকে কাজে লাগাতে থাকে। ডার্কসাইডকে আপনি মার্ভেলের থানোসের সাথে তুলনা করতে পারেন।

‘জাস্টিস লিগ স্নাইডার কাট’ বনাম ‘জাস্টিস লিগ’:

এখন কথা হচ্ছে, আপনি যদি ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া জাস্টিস লিগ সিনেমাটি দেখে থাকেন, তাহলে এই সিনেমার পিছনে আপনার ৪ ঘন্টা সময় ব্যয় করার  কোনো প্রয়োজন আছে কি না!

২০১৭ সালের জাস্টিস লিগ সিনেমাটি দেখার পর আপনার মনে হবে এটা একটি মোটামুটি সময় পার করার মতো সিনেমা। এই সিনেমাটি নিয়ে আপনাদের যত আশা ছিল, সবগুলোকে মাটি চাপা পড়ে যাবে। আর ২০২১ সালের ‘জাস্টিস লিগ স্নাইডার কাট’ দেখলে মনে হবে কল্পজগতের মহাকাব্য।

২০১৭ সালে জাস্টিস লিগ মুক্তির সময়ই জ্যাক স্নাইডার জানিয়েছিলেন– এটি তার ডাইরেক্ট করা জাস্টিস লিগ নয়। আর সেই থেকে শুরু হয় পিটিশন। আর সেই পিটিশনের ফল আমাদের সামনে। এখন ২টি সিনেমা পাশাপাশি রাখলে রাত আর দিনের মতো পার্থক্য মনে হবে। এককথায় বলতে গেলে, ‘জাস্টিস লিগের স্নাইডার কাট’ দর্শকদের এক ধরনের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই সবাই উপভোগ করতে পারছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর আছে কি না এখন পর্যন্ত আমার জানা নেই।

২০১৭ সালের জাস্টিস লিগ সিনেমায় এক্যুয়াম্যান, ফ্লাশ এবং সাইবর্গকে নিয়ে আসা হয়। এর আগে ডিসিইইউতে এই চরিত্রগুলোকে আনা হয়নি। তাই এই চরিত্রগুলোর অরিজিন সিনেমাটির জন্য আবশ্যকীয় ছিল। কিন্তু জস উইডেন ২ঘন্টার সিনেমা থেকে সেগুলো বাদ দিয়ে দেন, যেটা স্নাইডার কাটে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে সাইবর্গের ব্যাকস্টোরি। স্নাইডার কাটে সাইবর্গ পুরো সিনেমার প্রাণ। আর বাকি দুই চরিত্র এক্যুয়াম্যান এবং ফ্লাশের ব্যাকস্টোরি এখানে তুলে না ধরলেও তাদের ব্যাকস্টোরি সম্পর্কিত অনেকগুলো তথ্য তুলে ধরেছে। আর এর পিছনে যথেষ্ট কারণও ছিল। সেই সময় এক্যুয়াম্যান এবং ফ্লাশের সোলো(একক) ফিল্ম নিয়ে কাজ করার কথা ছিলে পরের বছরে, তাই স্নাইডার চাইলেও খুব বেশি ব্যাকস্টোরি দেখাতে পারেননি। তবে তাদের শক্তির সক্ষমতা দেখিয়েছেন বার বার। সিনেমার শেষে ফ্লাশ যখন টাইমট্রাভেল করে, তখন তো সবার থ্ মেরে যাবার দশা! এখন প্রশ্ন হলো, জস উইডেন সাহেব কী এটিও স্বেচ্ছায় বাদ দিয়েছিলেন!

আপনি যদি জস উইডেন এবং জ্যাক স্নাইডারের দুটি ভার্সনই দেখে থাকেন তাহলে আপনি সাবলিলভাবে দুটি সিনেমার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারবেন। স্নাইডার কাট দেখার পর জস উইডেনের ভার্সনটি মনে হবে দুঃস্বপ্নের মতো। আর আপনি যদি আগে থেকে উইডেনের ভার্সনটি না দেখে সরাসরি স্নাইডার কাট দেখেন, তাহলে বলতে হবে, আপনার মতো সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই।

স্নাইডার কাট দেখার পরে আপনি বুঝতে পারবেন স্নাইডার অর্থশালী স্টুডিওর কথা না শুনের নিজের ক্রেটিভিটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তিনি ঠিক কাজটিই করেছেন। স্টুডিও সাধারণ দর্শককে শিল্প গেলানোর জন্য হালকা মেজাজের সিনেমা বানাতে চাইলেও, স্নাইডার ডিসি কমিক্সের ডার্ক টোনকে ফলো করেছেন।

চরিত্র, চিত্রায়ন এবং ভিএফএক্স:

যদি সিনেমার চরিত্রগুলোর কথা বলি তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যতগুলো সুপারহিরোদের লিগ বিষয়ক সিনেমা আছে তাদের মধ্যে সব থেকে ভালোভাবে সবগুলো চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়েছে এই সিনেমাটিতে। তাছাড়া সিনেমার মূল খলনায়ক ডার্কসাইডের ব্যাকস্টোরি দেখানো যেটি জস উইডেনের ভার্সনে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়েছিল। জস ‍উইডেনের ভার্সনে স্টেফেনওলফ কেনো মাদারবক্স কালেক্ট করতে চাচ্ছে সে বিষয়ে কোনো কিছু স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। কিন্তু স্নাইডার কাটে স্টেফেনওলফের মাদারবক্স কালেক্টের পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ দেখানো হয়েছে। আর সব থেকে মজার বিষয় হলো ২০১৭ সালের ভার্সনে স্টেফেনওলফকে কখনোই এলিয়েন ভিলেন মনে হয় না, কিন্তু স্নাইডার কাটে স্টেফেনওলফের জন্য যে আর্মর ব্যবহার করা হয়েছে এবং ভিএফএক্স ব্যবহার করা হয়েছে তাতেই সবকিছু পাল্টে গেছে।

চলচ্চিত্রটি HBO Max নামক স্ট্রিমিং মাধ্যমে ১৮ মার্চ ২০২১ সালে দুইটি ভার্সনে মুক্তি পায়, একটি রঙিন ভার্সন, আরেকটি ব্লাক এন্ড হোয়াইট ভার্সন। সিনেমাটি মুক্তির পর পরিচালক জ্যাক স্নাইডার নিজেই জানিয়েছেন জাস্টিস লিগের আরও দুটি পর্বের পরিকল্পনা তার রয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওই দুটি পর্ব কখনো আসবে কি না তা প্রায় অনিশ্চিত! তাই ডিসি কমিকস ভক্তদের অপেক্ষার প্রহর গোনা কিংবা নতুন করে পরবর্তী দুটি পর্বের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়াজ তোলা ছাড়া উপায় নেই।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

রাসের মেলা

আজ রাস পূর্ণিমা। রাসের মেলা বসেছে শহরতলির খালধারের এই রাস্তা আর দু-পাশে যেখানে যেটুকু ফাঁকা ঠাঁই আছে তাই জুড়ে। নামকরা

একজন প্রবীণ বয়াতি

মায়ের কাছে সন্তানের অঙ্গীকার, তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে তবেই না বাড়ি ফিরবো লক্ষী মা, রাগ করো না, মাত্রতো আর

কবিতা

শকুন্তলা সংখ্যা: ‘মাহিরা রুবি’-এর কবিতা

দর্পণের বিশেষ সংখ্যা ‘শকুন্তলা’-তে প্রকাশিত মাহিরা রুবি-এর তিনটি কবিতা তুমি ঘুমিয়ে গেলে তুমিও চন্দ্রবিন্দু; বিস্ময়চিহ্নের আগে তোমাকে বসিয়ে দিলে চুম্বনও

কবিতা

সংবাদ শিরোনাম

বকুল আহমেদের তিনটি কবিতা সংবাদ শিরোনাম ঈশ্বরের আকাশে হোলিমেঘ রঙধনুর অট্টহাসিতে জীবন আমাদের বিষাদী উপাখ্যান; লাখো প্রাণ– মেঘেদের সফেদ রঙ