দ্য স্টোনিং অফ সোরাইয়া এম: অবিচারের বলিদান ইরানি নারীর বাস্তব আখ্যান

২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মার্কিন পরিচালক সাইরাস নোওরাসতেহর পরিচালনায় দ্য স্টোনিং অফ সোরাইয়া এম রোমহর্ষক কাহিনী ও মর্মস্পর্শী ইরানি প্রেক্ষাপটে নির্মিত এক আমেরিকান ড্রামা ধাঁচের সিনেমা । ফরাসি-ইরানি সাংবাদিক ও লেখক ফ্রেইদ্যুনে সাহেবজাম রচিত ১৯৯৪ সালের বেস্টসেলার, লা ফ্যেমে লাপিদে (দ্য স্টোনিং অফ সোরাইয়া এম: আ ট্রু স্টোরি ) উপন্যাস অবলম্বনে দ্য স্টোনিং অফ সোরাইয়া এম সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচিত হয়। উপন্যাসটি ইরানে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। সিনেমাটি ২০০৮ সালে টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডিরেক্টরস চয়েজ’ পুরস্কার লাভ করে। ১৯৮৬ সালে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের এক গ্রামের বাসিন্দা সোরাইয়া মানুতচেহরি নাম্নী ৩৫ বছর বয়স্কা এক নারীর মিথ্যা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নির্মম মৃত্যুর সত্য কাহিনী অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মিত।

দুই ঘন্টাব্যাপী সিনেমাটির লোমহর্ষক কাহিনীর গতিশীলতা, চরিত্রায়ণ, এবং প্রতিটি চরিত্রের অভিনয় এত নিখুঁত ও বাস্তব যে, কোনো রকম বাড়তি ইফেক্ট ছাড়াই দর্শকদের মনে এটি প্রবল ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়। কেবল দর্শকপ্রিয়তাই নয়, দ্য স্টোনিং অফ সোরাইয়া এম সিনেমার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথেষ্ট সাহসী, শক্তিশালী এবং তাৎপর্যপূর্ণ একটি নির্মাণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।


কাহিনী ও প্রেক্ষাপট:
সিনেমার প্রেক্ষাপট ইরানের কুপেয়া গ্রামের নিষ্পাপ ত্রিশোর্ধ এক চার সন্তানের জননী সোরাইয়া মানুতচেহরিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সোরাইয়া তার স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের সুযোগ সৃষ্টির জন্য স্বামীর দেয়া বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। ফলশ্রুতিতে সে স্বামীসহ এক প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তি ও কতিপয় সংকীর্ণ মানসিকতা সম্পন্ন গ্রামবাসীর সম্মিলিত মিথ্যা ষড়যন্ত্রের নির্মম বলি হয়। ‘বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ সম্পর্কের’ দায় মাথায় নিয়ে সোরাইয়াকে ইসলামী শরীয়া আইন মোতাবেক কোমর পর্যন্ত মাটিতে পোতা অবস্থায় নিক্ষিপ্ত পাথরের ঘায়ে মৃত্যদন্ডে দন্ডিত করা হয়। অবিশ্বাস্য এই ঘটনাটি ফরাসি-ইরানি সাংবাদিক ফ্রেইদ্যুনে সাহেবজাম গাড়ি নষ্ট হওয়ার সুবাদে অপেক্ষমান অবস্থায় ‘জাহরা’ নাম্নী এক মধ্যবয়সী নারীর বয়ানে শোনার সুযোগ পান। জাহরা তাকে জানায় আগের দিনই তার ভাগ্নি সোরাইয়াকে মূলত এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের মুখে ঠেলে দেয় তার পরকীয়ায় আসক্ত ও নির্যাতনকারী স্বামী আলি– যাকে শলাপরামর্শ ও সাহায্য করে গ্রামের এক ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব, মোল্লাহ হাসাম। জাহরার মুখে অশ্রুতপূর্ব এই ঘটনাটি ফরাসি-ইরানি সাংবাদিকটি টেপে রেকর্ড করে নেয়। জাহরা সাংবাদিকটিকে বলে, দুর্গম ও সংকীর্ণ মানসিকতার পুরুষতান্ত্রিক এই কুপেয়া গ্রামে নারীদের বাকস্বাধীনতা একেবারে নেই বললেই চলে। সাংবাদিকটি যেন সোরাইয়ার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।

জাহরার ভাষ্যমতে, ফরাসি-ইরানি সাংবাদিকের নষ্ট গাড়ি ঠিক করা শহরের মোটর মেকানিক হাসেমকে জড়িয়েই অবৈধ সম্পর্কের মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয় সোরাইয়ার বিরুদ্ধে, যার বাড়িতে সোরাইয়া তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর অসুস্থ সন্তানকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত ছিল। মেয়র ইব্রাহিমের সামনে সোরাইয়ার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের শুনানি ও বিচারকার্য সংঘটিত হয়। পুরো ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে মেয়রের মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহের সৃষ্টি হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত প্রচলিত শরীয়া আইনেই সুরাইয়াকে ‘ব্যভিচারী’ সাব্যস্ত করে পাথর ছুঁড়ে হত্যার নির্দেশ প্রদান করেন। ঘটনাটি আরও হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় এই ‘সাজানো’ মৃত্যুদণ্ডাদেশ তথা হত্যাকাণ্ডটি কার্যকরে সোরাইয়ার নিজ পিতা, দুই ছেলে, স্বামী এবং গ্রামবাসী সোল্লাসে অংশগ্রহণ করে।


পর্যবেক্ষণ:
পাথরের ঘায়ে সোরাইয়ার মৃত্যুদন্ডের দৃশ্য ও সংশ্লিষ্ট পরিবেশটি এতটাই করুণ ও জীবন্ত যে দুর্বল স্নায়ুর অধিকারী ও আবেগপ্রবণ ব্যক্তিদের যারপরনাই ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে।‌ রক্তপাত, নির্যাতন ও মৃত্যুদৃশ্যের জন্য সিনেমাটিকে ‘R’ (রেস্ট্রিকটেড) রেটিং করা হয়েছে।

ঘটনার বর্ণনাকারী হিসেবে জাহরা ও সাংবাদিক ফ্রেইদ্যুনে সাহেবজামের সরাসরি উপস্থিতি সিনেমাটির বর্ণনাকৌশলে ভিন্নমাত্রা যোগ করে কাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে এবং সিনেমার কাহিনী ও বাস্তব ঘটনার মাঝে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ফারাক দূর করেছে।

প্রকৃতপক্ষে, দ্য স্টোনিং অফ সোরাইয়া এম সিনেমাটি ইরান তথা বিশ্বের সমগ্র ‘বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদা’ অঞ্চলের এক প্রতিচ্ছবি হয়ে সেলুলয়েডে ধরা দিয়েছে। বাকস্বাধীনতাহীন নারীদের নীরব অভিব্যক্তিকে অগ্রাহ্য ও ইসলামী শাসনকে ভুল ব্যাখ্যা করে একে বিতর্কিত করার প্রয়াসে লিপ্ত কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এ সিনেমায়। সমালোচিত হয়েছে সে সব কুচক্রী যারা শরীয়া আইনের কিছু অংশ মানে আবার কিছু অংশ নাকচ করে। সোরাইয়া প্রকৃত সুবিচার পেত যদি ‘তথাকথিত ব্যভিচারের’ সমঅপরাধী মোটর মেকানিক হাসেমকেও শরীয়া আইনানুযায়ী বিচারের আওতায় আনা হতো। বিবেচনা করা হতো কাউকে দোষী প্রমাণ করার ক্ষেত্রে শরীয়া নিয়মানুসারে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ও প্রমাণ গ্রহণ করার বিষয়টি । সোরাইয়া নির্দোষ জেনেও মোল্লা হাসাম, মেয়র ইব্রাহিম, সোরাইয়ার স্বামী আলি নিজ স্বার্থে আইন মোতাবেক সোরাইয়াকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ব্যাপারে সরব ছিল বটে তবে একই সাথে তারা অগ্রাহ্য করেছে এক নিষ্পাপ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার যা হত্যারই নামান্তর।

হয়ত এ কারণেই পৃথিবী জুড়ে নিষ্পাপ, নির্মোহ এমন হাজারো মানুষকে নিজ স্বার্থের বলিদান দেয়া চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্যে ১৪০০ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইরানি কবি হাফিজ বলেই ফেলেছেন:

‘এমন ভন্ডের বেশ ধরো না, যে মনে করে– কোরআন শরীফ থেকে বড় বড় উদ্ধৃতি দিলেই তার ছলচাতুরী গোপন থাকবে।’

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

জোড়া জোড়া হাত

কাজী মহম্মদ আশরাফের তিনটি কবিতা কেউ বোঝে না কেউ বোঝে লোকাল বাসের চালকেরা বোধহয় প্রতিজ্ঞা করেছে ডাস্টবিন দেখে দেখে বাসটা

গল্প

আবর্তন

গত কয়েকদিন তীব্র মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছিলেন তড়িৎ বাবু। প্রবীণ সেতারি তড়িৎ মুখোপাধ্যায়। স্ত্রী বিছানায় শয্যাশায়ী, তিনি নিজেও এখন সব সময়

গল্প

নেতার ছায়াসঙ্গী

হরফ আলি ঘরে ফেরামাত্র বউ কৈফিয়তের সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘আইজগে কিছু করতে পারিছো। নাকি সারাদিন নেতার পিছে ফ্যা ফ্যা করে