কাজলা দিদি: যুগ যুগ ধরে কেন এত প্রিয়

‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কৈ’– তুমুল পাঠক প্রিয় এবং যুগ যুগ ধরে পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে থাকা কাজলা দিদি কবিতার মাঝেই বেঁচে আছেন কাজলা দিদির স্রষ্টা যোতীন্দ্রমোহন বাগচী। কোনো একটি বিশেষ কবিতা, গল্প বা উপন্যাস দিয়ে কোনো লেখক, কবির মূল্যায়ন করা যায় না— এ কথা যেমন সত্যি তেমনিভাবেই সাহিত্য জগতে কেবল একটি বা দুটি সৃষ্টি দিয়েই পাঠকের হৃদয় দখল করে নিয়েছেন এমন সাহিত্য কর্মের সংখ্যাও কম নয়, সাহিত্যিকের সংখ্যাও কম নয়। বহু সাহিত্যকর্মের মধ্যে কোনো একটি সাহিত্যকর্ম সেই সাহিত্যিককে আলোয় নিয়ে আসে। কাজলা দিদি এরকম একটি কবিতা। শোকগাঁথা কবিতাখানি পাঠকের কাছে এতটাই প্রিয় যে কাজলা দিদি আজ সবার মুখে মুখে। কাজলা দিদির জন্য চোখ ভিজে ওঠে না এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অসম্ভব মন খারাপ করা, বুকে শূন্যতা সৃষ্টি করা একটি কবিতা বলে হয়তো পাঠকের হৃদয়ে এর ঠাঁই হয়েছে। এই যে কাজলা দিদি নামের একটি চরিত্র সৃষ্টি করে, একটি কবিতা সৃষ্টি করে কবি যতীনন্দ্রমোহন বাগচী বেঁচে আছেন এখানেই কবির স্বার্থকতা। একটি বিশেষ সাহিত্যকর্ম যে অনেক সাহিত্যকর্মকে ছাপিয়ে যায়, পাঠকের হৃদয়ে বাঁচতে হলে এরকম একটি সৃষ্টিই যথেষ্ট কবির এ কবিতাখানিই তার উৎকৃষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। কবিকে তাই অনেকে কাজলা দিদির কবি বলে চেনে, জানে এবং ভালোবাসে। এটা যে কেবল এই কবির ক্ষেত্রে ঘটেছে এমনটা নয়, দেশের বাইরের অনেক লেখককে কেবল একটি উপন্যাস বা কবিতা দিয়ে অনায়াসে চিনে নেয়া যায়। এটি হয় গ্রহণযোগ্যতার জন্য। উৎকৃষ্ট থেকেও উৎকৃষ্টতর সৃষ্টির খোঁজে সাহিত্য অতৃপ্ত পাঠকেরা যা পেতে চায় তা যদি কবির কবিতায় থাকে তাহলে অবশ্যই সেই সৃষ্টি অন্যসব সৃষ্টির থেকে আলোচনায় থাকে কালকে উত্তীর্ণ করে। কাজলা দিদির প্রতি বাঙালির আবেগ যুগোত্তীর্ণ। কয়েক যুগ অতিবাহিত হলেও সেই আবেগে এতটুকু চিড় ধরেনি। কিন্তু কেন?

প্রথমত, কাজলা দিদি চরিত্রটি একটি আবেগিক চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যে আবেগের প্রতি বাঙালির দুর্বলতা চিরকালের। ভাই-বোন সম্পর্ক, বা দিদির সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক, এসব বাঙালির অস্থিমজ্জায় গেঁথে আছে।

দ্বিতীয়ত, কাজলা দিদি চরিত্রটি কবিতায় জীবিত নয় মৃত। যাকে হারানোর শোক বোনের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে।

আর তৃতীয়ত ও সর্বশেষ হলো, কবিতার বর্ণনায় গ্রাম বাংলার প্রকৃতির চিরচেনা রূপ উপস্থাপন করা হয়েছে যা সহজেই পাঠককে আকৃষ্ট করে।

কাজলা দিদি কবিতাটি চতুর্থ শ্রেণিতে পাঠ্য। দিদির জন্য শিশু মনের যে হাহাকার তা আজ পাঠ করা শিশুমনকেও নাড়া দেয়, আলোড়িত করে। কবিতাটি পাঠ করার পর তাদের মনে প্রথম যে প্রশ্ন জাগে তা হলো, কাজলা দিদি কোথায় গেছে? এই কবিতায় দিদি হারানো ছোট্ট এক বোন তার মার সাথে দিদিকে নিয়ে নানা কথাবার্তা বলে এবং সে বিশ্বাস করে তার কাজলা দিদি একদিন ঠিক ফিরে আসবে। যে বোনটি জানে না বা তখনো তার বোঝার বয়স হয়নি মৃত্যু কী।

এজন্য কাজলা দিদির ছোট্ট বোনটি বলে, ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল/ মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল/ ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে/ বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে/ উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল/ দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল।

কিন্তু তার মা তাকে সত্যিটা বলতে পারে না বিধায় মুখ লুকিয়ে কাঁদে। কাজলা দিদি চরিত্রটি গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নেয়া দিদির প্রতিরূপ। যে তার ছোট ভাইবোনকে পরম স্নেহে বড় করে। মূলত কাজলা দিদি কবিতা লিখতে গিয়ে কবি চিরন্তন বাংলার রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গ্রামীণ জীবনের মমত্বোবোধ, প্রীতি, বোনের প্রতি ভালোবাসা, শোলক বলা সবকিছুর বর্ণনাই নিঁখুত। পরিবারের একে অন্যের প্রতি যে মমতা এবং কাউকে হারানোর যন্ত্রণাও কবিতাটিতে চিত্রিত হয়েছে।

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীকে রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধানতম সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি পল্লি প্রিয় একজন কবি ছিলেন। গ্রাম বাংলা ছিল তা সাহিত্যের উপজীব্য। কাজলা দিদি কবিতায়ও তিনি গ্রামের প্রকৃতির বর্ণনা এনেছেন নিপুণভাবে। বাংলার গ্রামবাংলার সুখ দুঃখ তিনি তার সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঁশবাগান, পুকুর, নেবুর তল, ভুঁইচাপা, বুলবুলি ইত্যাদি এরকম কিছু শব্দের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন যা পল্লি প্রকৃতির আদি রূপের ইঙ্গিত বহন করে। কাজলা দিদি কবিতাটি কবির কাব্য মালঞ্চ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। কবিতা লেখার পাশাপাশি কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী সম্পাদক, যুগ্নসম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পত্রিকার মালিকও ছিলেন তিনি। গ্রামের চিরাচরিত রূপ তিনি তার কলমে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করেছেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ

  • লেখা (১৯০৬),
  • রেখা (১৯১০),
  • অপরাজিতা (১৯১৫),
  • বন্ধুর দান (১৯১৮),
  • জাগরণী (১৯২২),
  • নীহারিকা (১৯২৭)
  • কাব্যমালঞ্চ
  • নাগকেশর
  • পাঞ্চজন্য

তার আরও কবিতা রয়েছে যা পাঠকের কাছে ব্যাপক সমাদৃত। এরকম একটি কবিতা হলো ‘অন্ধবধু’। তবে কাজলা দিদি এদের সবার থেকে আলাদা। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কাজলা দিদি একটি সার্থক কবিতা এবং সার্থক চরিত্র।


 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

নীল ব্যালকনি

নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের টুকরোগুলো পেটকাটি-চাঁদিয়ালের মতো উড়তে উড়তে শেষমেশ গোঁত্তা খেয়ে আরব সাগরের জলে প’ড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তরেখায়।

হাসির গল্প

এক কথায় এত কিছু

শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জামাই কোনো কথা বলে না। শালীরা-শালারা কত ঠাট্টা-তামাসা করতে আসে; সে কোনো উচ্চবাচ্য করে না। তখন শ্বশুর গিয়ে

কবিতা

আকাশে চাঁদের আলো

১ আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ বাতাসে ঘুঘুর ডাক—অশত্থে ঘুঘুর ডাক—হৃদয়ে ঘুঘু যে ডাকে—নরম ঘুঘুর

গল্প

পৃথ্বী-পুরাণ

একটা গাছ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে লতাপাতারা গলাগলি করে বলে : চুপ, একদম নিশ্চুপ ভ্রমরার বোল্লার টুপ। টুপ করে ঘুম