নিয়োগপত্র নাকি!
না নিয়োগ পত্র নয়। পোড়া কপাল! আর হয়তো নিয়োগপত্র পাওয়া হবে না এ জীবনে। বাড়িতে এসেই একটি খাম চোখে পড়ল। ভাবলাম চাকরির নিয়োগপত্র হবে হয়তো। তাড়াহুড়ো করে খুলে পড়তে আরম্ভ করলাম। অবাক ব্যাপার! অদ্ভুত নিমন্ত্রনপত্র। তাতে লেখা আছে “বিশ্ব ফকির সম্মেলনে আপনাকে আমন্ত্রণ।” এটা একদিকে যেমন খুশির সংবাদ অন্য দিকে কষ্টের। যদিও সারা পৃথিবী থেকে কয়েকশ ফকির আসবে। একজায়গায় একসাথে সম্মেলন করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সম্মেলন হয়। এবার বাংলাদেশে। আর এরকম একটা বড় সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ। আমি গরিব মানুষ। বাবার সামর্থ্য হয়নি অনেক টাকা ঘুস দিয়ে আমাকে চাকরি পাইয়ে দেবার। বেকার বসে আছি। কী হবে বসে থেকে? নেই কাজ তো খই ভাজ। তাই গিয়েছিলাম রাস্তার মোড়ে ফকিরদের ভিক্ষা নিয়ে একটি জরিপ করতে। ওরা আমার থেকে অনেক ভালো। তাই এটাকে একটা কাজ হিসেবে বেছে নিলাম। সে সূত্রে কিছুটা ভাবও জমেছিল। প্রথম প্রথম ওরা আমাকে তাদের কাছে বসতে দিতো না। তারা আমাকে দেখলেই কথা বলত না। ঘাপটি মেরে বসে থাকতো। একদিন ওরাও বুঝে গেল ওদের আর আমার মাঝে কোনো তফাত নেই। আমিও ওদের মতোই। পার্থক্য শুধু পোশাকের। ওদের কষ্ট, অনুভূতি, আবেগ নিয়ে ভেবেছিলাম কিছু একটা লিখব। তাই এত সখ্যতা, কিন্তু তাই বলে তাদের একটা বড় সম্মেলনে আমাকে এভাবে ডাকবে?
একবুক কষ্ট নিয়ে বসে আছি। হাতে হলুদখাম। রাজ্যের চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেখানে ফকিরদের নিয়ে সম্মেলন সেখানে আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আমি তো আর ভিক্ষা করি না। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে আমি ভিক্ষুকের চেয়ে অধম। ভিক্ষুকেরা আমার চেয়ে ভালো আছে। তাদের প্রতিদিন একটা ভালো আয় আসে। আমার তো সেটাও আসে না। বেকার জীবন মানে রাজ্যের অভিশাপ নিয়ে বসে থাকা। এর থেকে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু মারা গেলেও তো জীবনের কাছে হেরে যাওয়া। আমি হারতে রাজি নই। আবার জিততেও তো পারছি না। চাকরি কোথায় দেশে! চাকরি অবশ্য আছে। তবে তা গরিবের জন্য নয়। অন্তত আমার মতো গরিবের জন্য তো নয়ই। অতএব আমার থেকে ফকিররা ঢের ভালো। সেখানে তাদের সম্মেলনে যেতে আপত্তি কোথায়?
ফকির সম্মেলনে যাচ্ছি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম। কিন্তু এ সম্মেলনে যাওয়ার জন্য পোশাকটা কী হওয়া দরকার? ফাটা? ছেড়া? কাটা? না ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে সম্মেলনে যেতেই হবে। ভাবলাম ফকিরদের সম্মেলন যখন, তখন এত স্যুটটাই পড়ে কী হবে? তার চেয়ে বরং ছেড়া ফাটা একটা কিছু পরলেই হল। শেভ করার ইচ্ছা ছিল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সেটাও অর্থের অভাবে করা হয়নি। ফকির সম্মেলনে যাচ্ছি, আমি তো আর বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি না। এত সাজগোছের কী আছে? বরং এভাবে গেলেই আরও ভালো। আপত্তি কোথায়, ফকিররা নিশ্চয় সেজেগুজে আসবে না। বরং তাদের দীনতা আরও প্রকাশ করবে তীব্রভাবে। তাদের মধ্যে আমি কেন অস্বস্তির কারণ হব? তাই ঠিক করলাম আমার সবচেয়ে পুরনো পোশাকটা পরে আমি সম্মেলনে যাবো। এটাও অবশ্য যা-তা ব্যাপার না। সারা বিশ্ব থেকে প্রায় শ খানিক ফকির এদেশে আসবে। এটা কি যা-তা ব্যাপার? আমার ক্ষমতা নেই অন্য দেশে যাওয়ার অথচ তারা আসছে। তাদের সাথে হাত মেলানোটাও কম কিসে?
বিরাট সম্মেলন। দেশে বিদেশের নানান জায়গা থেকে সব বয়সী ফকিরদের ভিড় দেখতে পাবো। আমার মনে আগ্রহের সীমা নেই। আমাকে উক্ত সম্মেলনের বিশেষ অতিথি করা হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মন্ত্রী গোছের কেউ একজন। আগেই শুনেছি ফকিরদের মধ্য থেকে কেউ একজন সামনের ইলেকশানে দাড়াবে। ফকিরদের দাবি দাওয়া নিয়ে কথা উঠতে পারে। আমি ওদের মধ্যে নিজেকে খুব তুচ্ছ ভাবতে লাগলাম। ওরা ওদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরতে চাই।
যাবার পথে হাত উঠিয়ে একজনের ডাক শুনতে পেলাম। মতি মিয়া। ব্রিজের উপরে অবস্থান। ঠিক মাঝখানে। রোদ্রে বসে । বয়স আঠত্রিশ। এক হাত ইচ্ছে করেই কেটে ফেলেছে। ভিক্ষা ভালো পাওয়ার আধুনিক উপায়। সেও যাচ্ছে ফকির সম্মেলনে। আমি ব্রিজের উপরে আসতেই আমাকে সালাম দেয়। কুশল জিজ্ঞেস করে। তারপর বলে ভাইজান আপনাদের মত শিক্ষিত পোলাপান এ ব্যবসায় বিরাট দরকার। ভিক্ষাবৃত্তি একটা মজার পেশা ভাইজান। আপনি আইলে দেখবেন অনেক মজা পাইবেন। অন্য পেশায় যাইতেই ইচ্ছে করবো না। তয় জানেন কি ভাইজান এই ব্যাবসায়ের উপরেও ষড়যন্ত্র চলতেছে। সরকার নাকি এ ব্যবসাও এ দেশে থাইকা তুইলা দিব। আজ ঐ সম্মেলনে এগুলান তুলে ধরবেন ভাইজান। আমার মনে ভাবনার উদয় হয়। তাইতো এটা তো ভারি অন্যায়। এই ব্যবসা উঠে গেলে আমাদের মতো বেকার পোলাপান কী করে খাবে? আমরা চুরি ছিনতাই ডাকাতি করতে পারবো না। পাশ করা মানে আমাদের অভিশাপ। সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। কিন্তু আমি তো এখনো এ পেশা বেছে নিই নি। আমি অভিশপ্ত। অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে এ পেশাকেই বেছে নেব ঠিক করলাম। দেশের যে অবস্থা এ পেশাতেও কিছুদিন পর হয়তো নিয়োগ দেওয়া হবে। আয়ে বিয়ে সার্টিফিকেট লাগবে। মামু খালু লাগবে। এ পেশাতে আসতেও ঘুষ লাগবে। হয়তো অনেক টাকা। দু চার লাখে কাজ হবে না। এ যুগে দু চার লাখে চা খাওয়াও হয় না। চা খাওয়া মানে কমপক্ষে পাঁচ লাখ। মিষ্টি খাওয়াতে হবে। অভিজ্ঞতা লাগবে। ছ’মাস অথবা একবছরের অভিজ্ঞতা। আমার ভাবনার রশ্মি টেনে ধরে মতি মিয়া। ভাইজান আমাদের ফকির কমিটির সভাপতির দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। সামনে ইলেকশান আসতেছে। আমরা ভোট আপনারেই দিমু। আমি মুখ তুলে হাসি। আমাকে কেন ফকির কমিটির সভাপতি করা হবে আমার মাথায় আসে না। আমি তো ওদের মতো এখনো ভিক্ষাবৃত্তিতে আসিনি অথচ ওরা ধরেই নিয়েছে আমি ওদের লিডার। আমাকে ওরা চাই। আমি মতি মিয়াকে শান্ত করি। ওসবের দরকার নাই। আমাকে সম্মলনের বিশেষ অতিথি করা হয়েছে এতেই আমি খুশি। লিডার ফিডার হতে চাই না। মতিকে আশ্বস্ত করি।
মতির সাথে কথা শেষ না হতেই এক লোক আমার দিকে এগিয়ে আসে। নাম ইয়াছিন আলি। কালো চশমা পরে। অন্ধত্বের ভান করে। চশমার আড়ালে একজোড়া সুস্থ চোখ তার হয়ে কথা বলে। মুখে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ। বোবা। ঠিক বোবাও নয়। ভান করে। একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় তাকে দেখা যায়। দিন চার-পাঁচ হাজার পর্যন্ত তার একার আয়। কেউ ভিক্ষায় টাকা কম দিলে তাকে মনে মনে গালি দেয়। গ্রামের বাড়ি পীরগঞ্জ। তিনতলা বাড়ি। টাইলস বসানো। বিরাট গেট। ভিক্ষা তার নেশা। গ্রামের লোকজন জানে ইয়াছিন ঢাকায় ব্যাবসা করে। ইয়াসিনের আন্ডারে পঞ্চাশটা বাচ্চা ছেলে খাটে। তাদের বয়স কম। তিন থেকে ছয় বছরের মধ্যে। তাদেরকে খুব ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেয় সে। ছোট্ট ছোট্ট শিশু। মুখে কিছু বলবে না। মায়া মায়া ভাব নিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। না দেওয়া পর্যন্ত নড়বে না। এরই প্রশিক্ষণ। এসব বাচ্চাদের ইয়াছিন কোত্থেকে যে জোগাড় করেছে আমার জানা নেই। শুনেছি কিছু কিছু বাচ্চা নাকি হাসপাতাল থেকে চুরিও করেছে। ইয়াছিন আমাকে দেখে প্রতিবাদের সুর তোলে।
দ্যাখেন ভাইজান দ্যাশে নাকি ভিক্ষুক থাকবো না। তাদের পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করব নাকি। গায়ে যে আমার ভিক্ষুকের রক্ত। ইচ্ছা করলেই কি ছাড়ন যায়?
আমি মুখ তুলে হাসি। সম্মেলনে সব যেন আমাকেই তুলে ধরতে হবে। আমাকে সবাই ভরসা করছে। আমার মতো শিক্ষিত ভিক্ষুক নাকি তাদের একটাও নাই। আমি ইয়াছিন আলিকে বোঝানোর চেষ্টা করি। আমি ভিক্ষুক নই। ইয়াছিন তা মানতে নারাজ। তার দাবী সকল বড় মানুষের একই কথা। কোনো মহামানবই নিজেকে মহামানব স্বীকার করে না। নিজেকে মহান ভাবে না। কোনো চোর নিজেকে চোর ভাবে না। আমিও নাকি তাই করছি। আমি ইয়াছিনের কথায় অবাক! ইয়াছিন আমাকে চোর ভাবছে নাকি মহামানব? এ কেমন কথা? কিছুই বুঝতে পারছি না।
মতি মিয়া এতক্ষণ চুপ করে ছিল। হঠাৎ বলে ওঠে, ভাইজান বিদেশ থাইকা নাকি ভিক্ষুক আইবো। অনেক বড় বড় ভিক্ষুক। ইংরেজিতে কথা কয়। গান করে। বাদ্যযন্ত্র নিয়া ভিক্ষা করে। নিজ হাতে গিটার বাঁজায়। আমি ওদের লগে হাত মেলাতে চাই ভাইজান। একটু ব্যবস্থা করে দিয়েন।
আমি মতিকে কিছুই বলি না। বিস্ময়ের হাসি আসে মুখে। আমি নিজেও কী করে সখ্যতা গড়ব ভাবি। ওসব দেশে একবার যেতে পারলে এই শালা ফকিরের দেশে কে থাকে? মতি মিয়া স্বপ্ন দেখে। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন। মতি মিয়ার হাতে একখান গিটার। মতি মিয়া গিটারে সুর তুলেছে। গান ধরেছে ইয়াছিন আলি। শুধু ডলার পড়ছে তাদের টাকার থলিতে। আমেরিকান ডলার। বাংলা গান গেলে কি আমেরিকানরা ডলার দেবে? ভাবতে থাকে মতি মিয়া। ইয়াছিন আলি ইংরেজি গান জানে না। না, এখানে ইয়াছিন আলি কেন আসবে? ইয়াছিন আলি দুষ্টু লোক। দুষ্টু লোককে বিদেশে নেওয়া ঠিক না। সেখানে গিয়েও খারাপ কাজ করবে। সে দেশের আইন কানুন কড়া। সবাই মিলে ফেঁসে যাবে। পুলিশের গুতুনি খেয়ে শেষে ফিরতে হবে দেশে। তার চেয়ে একাই যাবে মতি মিয়া। কিন্তু একটা সমস্যা। মতি মিয়া গিটার কখনো ছুঁয়েও দেখেনি। তাহলে? মতি মিয়ার স্বপ্নে ছেদ পড়ে। ইয়াছিন আলির তর সয় না। বড্ড তাড়াহুড়ো করে। মাইক্রো ভাড়া করেছে সে। অনেকগুলো ফকির একসাথে যাবে। প্রায় দশ বারো জন। একটা মাইক্রোবাসই যথেষ্ট। সম্মেলন হচ্ছে শহর থেকে দূরে। ছায়ানিবিড় নিরিবিলি একটি গ্রামে।
আমরা মাইক্রো বাসে উঠে বসি। দশ বারোজন ভিক্ষুক একই মাইক্রোবাসে। একইসাথে। আজ যে যার মতো গুছিয়ে এসেছে। সবাই চাই টাকা। একটা উন্নত জীবন। ভালবাসা এদের কাছে মুখ্য নয়। সবার মনে আশা একটা। বিদেশি ভিক্ষুককে হাত করতে পারলে তার সাথে বিদেশে পাড়ি দেবে। সে দেশে গিয়ে ভিক্ষা করবে। অনেক বড়লোক হবে। মতি মিয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি। মতি মিয়া উড়ছে। মাইক্রোবাসের সিটটাকে আজ তার কাছে বিমানের সিট বলে মনে হচ্ছে। ইয়াছিন আলির চোখেও স্বপ্ন। সম্মেলনে কত বড় বড় ভিক্ষুকের সাথে তার পরিচয় হবে। খাতির হবে। তার মনে একটায় আশা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে ভিক্ষা করবে। দেশে ঝড় তুফান এলেও সে ভিক্ষা বন্ধ করবে না। তার ব্যবসাতে নতুন বাচ্চা খাটবে। পঞ্চাশ থেকে প্রায় একশোটি বাচ্চা। মাইক্রোবাস ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে। যে যার মত স্বপ্ন দেখি আমরা। আমার মনে রাজ্যের আক্ষেপ। বুকে অজানা ব্যথা। চাকরি চাকরি আর চাকরি। কোথাও একটা মেলাতে পারিনি চাকরি। সরকারি বেসরকারি কোন নিয়োগই বাদ রাখিনি। আমি কোনো ক্ষমতাবান মামার আদুরে ভাগ্নে নই। অর্থওয়ালা বাবার আদুরে সন্তান নই। বাবা পরের জমিতে কামলা খেটে মানুষ করেছে আমাকে। অথচ সত্যিকারের মানুষ কি হতে পেরেছি? এজীবনে একটাও নিয়োগপত্র হাতে আসেনি। রাতের আঁধারে অযোগ্য লোকের চাকরি হয়ে যায় এখন। যোগ্যতার বিচার বলতে এখন শুধু টাকা। বিদ্যা নয়। এসব ভাবতে ভাবতে ঝিমুনি আসে চোখে। কিছু সময়ের জন্য সম্মেলনের কথা ভুলে যায়। ফের স্বপ্ন দেখি। একটা ভালো চাকরি পেয়েছি। মায়ের জন্য দামি শাড়ি কিনে দিয়েছি। বাবার জন্য লুঙ্গি পাঞ্জাবি। মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখে ভালো লাগছে। মা হাসছে। হাসছে আর হাসছে। হেসেই চলেছে অবিরাম।
আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয় কালু ফকির। সে আমার পাশের সিটে বসেছে। তার মুখেও প্রতিবাদের সুর। এ ষড়যন্ত্র মেনে নেওয়া যায় না, ভাইজান? আমরা হৈলাম ভিক্ষুক মানুষ। ঢাকা শহরে অবাধে ভিক্ষা করমু। বড়লোকের কাছে গিয়া হাত পাতমু। যেখানে খুশি সেখানে গিয়া ভিক্ষা করমু। আমাগো নাকি ঢাকায় ভিক্ষা করতে দিব না। আরে ভাই কন তো এয়ারপোর্টে ভিক্ষা করমু না তো কই করমু? এয়ারপোর্ট হৈল বড়লোকের চাষ। প্লেন থাইকা কোটিপতিরা নামে। আমরা তাদের কাছে গিয়া হাত পাতি। তারা ভিক্ষা দেয়। তারা ভিক্ষা দিব না তো কি ফকিরে ভিক্ষা দিব? এয়ারপোর্ট, বেইলি রোড, সোনারগাঁও, রুপসি বাংলা সব আমাগো জন্য নাকি বন্ধ! আচ্ছা কন তো ভাইজান এসব এলাকা বন্ধ হইলে ঢাকা শহরে ভিক্ষা করার মতো কি আর কোন জায়গা থাকে? আরে ভাই আমাগো নাকি পুনর্বাসন করবো। ভালো কাম দিব? কই সেসবের তো বালাই না। খালি মুখে বড় বড় জ্ঞান দেয়। বুলি ছাড়ে।
আমার মুখে বিদ্রুপের হাসি। ভয় পাইয়ো না কালু। ভয় ডর করে লাভ নাই। এদেশে উদ্যোগ আছে কর্মসূচি নাই। তুমি অবাধে ভিক্ষা করতে পারবা।
কালু আমার উপরে ভরসা করে। আমি কালুকে সান্ত্বনা দিই। সম্মেলনে সব তুলে ধরার আশ্বাস দিই। কালু আমার চোখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
সম্মেলনে এসে দেখি শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। অসংখ্য ভিক্ষুক। আমি আমার বিশেষ অথিতির আসনে গিয়ে বসলাম। পৃথিবীর সব ভিক্ষুকের প্রতি আমার যে মনোভাব ছিল এখানে এসে তা দূর হয়ে গেল। আসলে পৃথিবীর সব ভিক্ষুকই অসহায়। সবার হাত পাতার ধরণ এক। তাদের অসহায়ত্বকে কেন্দ্র করে এই সম্মেলন। তারাও পেট চালানোর দায়ে ভিক্ষা করে। সম্মেলনে এসে অসংখ্য ভিক্ষুকের মাঝে আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম। সবার মাঝে হাহাকার। ভাত চাই। টাকা চাই। বস্ত্র চাই। চিকিৎসা চাই। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। হাজার হাজার ভিক্ষুক। কারো হাত নেই। কারো পা নেই। কারো শরীরে ক্ষত। পঁচে গেছে। কারো বা কথা বলার শক্তিই নেই। উঁচু মঞ্চে বসে আমার যতদুর চোখ যায় শুধু ভিক্ষুকের সমারোহ। যেন একটা ফসলের মাঠ। ভিক্ষুকের চাষ হয় এখানে। অসংখ্য ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হৃদয়ে হাহাকার। ভিক্ষুকের চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে চারিদিক। আমি আনমনে তাকিয়ে থাকি। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখে পরিষ্কার একটি চিত্র ফুঁটে ওঠে। একটি লাল সবুজের চিত্র।