অফিসের বসের সামনে বমি করা ঠিক না। আবার উঠে যেতেও পারছি না। বিশ্রী গন্ধ। গন্ধটা ঠিক কয়েক মিনিট পর পর আমার নাকে আসছে। পঁচা গন্ধ। মৃত তেলাপোকা পঁচা। ভেতরের খাবারগুলো মুখ দিয়ে উঠে আসার উপক্রম হল একবার। খুব কষ্টে সামলাতে হল। আবার উঠে যেতেও পারছি না। বস ঢাকা থেকে অল্প কিছুদিন হল এখানে এসেছেন। বেশ বড় অফিসার। এর আগে যিনি ছিলেন তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। আজকাল ভালো মানুষগুলো কোনো অফিসে বেশি দিন টিকতে পারে না। তিনিও পারেন নি। আমার নতুন সাহেবটি একটু কড়া মেজাজের। আমাকে এসেই বেশ কয়েকবার ধমক দিয়েছেন। ভারি ভারি কথা শুনিয়েছেন। মনে হচ্ছে তিনি এখানে বেশি দিন টিকে থাকবেন।
আমি এই অফিসের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। বসকে সবসময় পাওয়া যায় না। জরুরি প্রয়োজনে আমাকে ডাকা হয়েছে। কি জানি কী ভুল করেছি ? তার একটি স্বাক্ষরেই আমার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে। এমনকি চাকরি হারিয়েও পথে বসতে পারি। তাই বাধ্য হয়ে বসে আছি। তার শরীর থেকে তীব্র সুঘ্রাণ বেরুচ্ছে। আমি বিরক্ত। কারণ পারফিউমের ঘ্রাণ আমার কাছে তেলাপোকার ঘ্রান মনে হচ্ছে। অনেকগুলো মরা, পঁচা তেলাপোকার গন্ধের মতো। ক্রমেই এটি তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হচ্ছে। বেশ কদিন হল আমার এ সমস্যা হয়েছে। সবরকম ঘ্রাণই পঁচা তেলাপোকার দুর্গন্ধ হয়ে নাকে আসছে। অবশ্য অফিসের বসকে একথা বলা যায় না। তিনি আমার পরিচিত। প্রথম দিনই আমি তাকে চিনতে পেরেছি। বসের বাম পাশে কাটা কালো দাগ আছে। ওটা আমাদের বন্ধুত্বের স্বাক্ষর বহন করে। অবশ্য আমাকে তিনি চিনতে পারেন নি। যদিও আমাদের শৈশবটা ছিল অনেক স্মৃতিময়। তবুও তিনি আমাকে চিনতে পারেন নি। অফিসের বসদের সবাইকে চিনতে হয় না। এখন নিশ্চয় আমার পরিচয় দেওয়া চলে না। নিশ্চয় এটা বলা চলে না তাকে, আমাকে চিনতে পারিস ইকু? আমি তোর শৈশবের বন্ধু নিপু। বলা যাই-ই বা কী করে? তিনি তো আমার দিকে সেভাবে নজরই দেন নি। যদিও দু একবার ডাক পড়েছে তবু সেটা ধমক খাওয়ার জন্য। অফিসের কর্মচারীদের ধমক খাওয়াটা নিয়ম। খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। বসের বকা না খেলে কাজে মন বসে না।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বসের সামনে বসে থাকতে। এখনও গন্ধটা যায় নি। তিনি অনেকক্ষণ ধরে আমাকে বসিয়ে রেখেছেন। কিছুই বলছেন না। বলবেনই বা কী করে? ফোনের পর ফোন এসে যাচ্ছে। তিনি কথা বলেই যাচ্ছেন। ফোন রেখে দেওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। বসে থাকতে থাকতেই হঠাৎ পেটের খাবারগুলো আর একবার উঠে আসতে চাইলো। এবারও শেষ মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। বস সেটা লক্ষ্য করলেন। একবার ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। তারপর ফোন রেখে বললেন, আপনার কী সমস্যা? এভাবে বসে আছেন কেন? কিছু বলবেন? তিনি একবারে তিনটি প্রশ্ন করলেন। অসম্ভব ভুলো মনের মানুষ দেখছি! তিনি নিজেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এখন বলছেন আমি বসে আছি কেন? অফিসের বসদের বোধধয় সবকিছু মনে রাখতে নেই। আমি আমতা আমতা করে বললাম, স্যার আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বস অবাক হয়ে আমার দিকে একবার তাকালেন। বসের তাকানো দেখে মনে হল পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়ের প্রাণী হলাম আমি। তারপর আগুন চোখ। বললেন, এখন যান। পরে বলব। এভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকবেন না। এটা আমার পছন্দ নয়। কাজে ফাকি দেওয়া আমি একদম পছন্দ করি না। আমি আমতা আমতা করে একবার শুধু জ্বি স্যার বললাম। ইচ্ছে হচ্ছিল বসকে জানাই, আমি তার ছোটো বেলার বন্ধু নিপু কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুল না। থ মেরে বসে রইলাম। বস এবার ধমক দিয়ে বললেন এখনো বসে আছেন কী জন্য। যান গিয়ে কাজে মন দিন। আমি বসকে বুঝতে পারি না। উদ্ভট লোক। ডেকে এনে এতক্ষণ বসিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না তবুও তিনি আমাকে বসিয়ে রাখলেন। আবার উল্টো ধমক দিচ্ছেন।
গভীর মনযোগ দিয়ে কাজ করছিলাম। বস আবার আমাকে ডেকে পাঠালেন। অফিসে ঢুকতেই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ফাইল সোজা আমার গায়ে ছুঁড়ে মারলেন। বললেন, আপনি এটা কী করেছেন? বরাবরের মতো দু-চার কথা শুনিয়ে দিলেন। ফাইলটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমার একটি ভুলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ফাইলটি আমি দেখিনি। আমার ফাইল নয়। ওটা আমার পাশের চেয়ারে আবির সাহেব দেখেছিলেন। বুঝলাম না বস তাকে কেন ডাকলেন না? আমাকেই বা ডেকে এনে কেন এভাবে ঝাড়ি মারছেন? আমার তখন ভয়ে রাস্তার পাশে থ মেরে দাড়িয়ে থাকা বিড়ালের মতো অবস্থা। ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। একটুও নড়াচড়া করছি না। এবার চাকরিটা বুঝি গেল! কিন্তু ফাইলটি তো আমার নয়। ভুলটাও তো আমি করিনি। আমি ফাইলটি হাতে নিয়ে বললাম স্যার এটা আমি দেখিনি। আবির সাহেব দেখেছেন। তিনি প্রচণ্ড রাগে চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুঝলাম আামার কথা তিনি বিশ্বাস করছেন না। তিনি আমাকে মাত্র কটা দিনের সময় দিয়ে ফাইলটির ভুলগুলো শুধরে আনতে বললেন। যদি না পারি তো নির্ঘাত চাকরি হারাতে হবে। আমি আমার বস ইকরামুল হোসেন ইকুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা কি সেই ইকু যে আমার শৈশবের বন্ধু ছিল। আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। তবে কখনো কখনো বিশ্বাস করতে হয়। আমার ধারণা অনেক টাকা পয়সা সম্মান প্রতিপত্তি হলে চোখের উপর একটা পুরু আবরণ পড়ে। সেই আবরণের কারনে মানুষ আপন মানুষগুলোকেও চোখের সামনে দেখতে পায় না। সবাইকে পর মনে হয়। কিন্তু আমি তো আপন কেউ না। কোনোকালে, কখনো আমি তার ভালো বন্ধু ছিলাম সেটা হয়তো ভুলেই গেছে। আমার বারবার ইচ্ছে করে তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বলি, আমি তোর শৈশবের বন্ধু নিপু। এখন সে বস। তুই করে তাকে আর বলা যায় না। তুমি করেও বলা চলে না। আপনিই বলতে হবে। গন্ধটা আবার ভক করে আমার নাকে এল। আবারও সেই বমি হবার উপক্রম। আমি জানি না এরকম কেন হয়? আমি কোনোরকম পারফিউমের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। বস আমাকে এখনও বকে চলেছেন অথচ তার কোনো কথাই আমার কানে আসছে না। শুধু পারফিউমের গন্ধ নাকে আসছে। তবুও সেটা তেলাপোকার গন্ধ হয়ে। তিনি আবার আমাকে ধমক দিয়ে বললেন আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন?
কোনো রকমে ফাইলটি হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মনের ভেতরে তখন আশ্বিনের মেঘ। হঠাৎ হঠাৎ ভেতরটা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো কেমন যেন চমকে চমকে উঠল। হৃদয়ের ভেতরে কম্পন। প্রবল ঝড় বইতে লাগল অন্তরে। হঠাৎ করেই মাথাটা ঘুরে উঠলো। এটা কী সেই ইকু? ইকু আমাকে কেন চিনতে পারে না? আমি তো ওকে প্রথম দিনেই চিনেছি। শৈশবের স্মৃতিগুলো কয়েক মুহূর্তের জন্য মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো। ইকুর বাবা ছিল না। মামার বাড়িতে থাকতো। ওর মামার বাড়ি ছিল আমাদের গ্রামে। ইকুকে নিয়ে কত যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি তার কোনো ঠিক নেই। ঘুড়ি উড়িয়েছি। ও ভালো ঘুড়ি বানাতে পারত। আমি ওর কাছ থেকে ঘুড়ি বানিয়ে নিতাম। একদিন কী কারণে যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। গাল কেটে রক্ত বেরুচ্ছে। আমি ভয়ে চুপ করে আছি। ও উঠে দাড়িয়ে সে কি কান্না! ওর রক্ত পড়া বন্ধ হল কিন্তু দাগটা রয়ে গেল চিরকালের জন্য। তারপর আর ওর দেখা পাওয়া গেল না। শুনেছিলাম ওর মামা ওকে এখান থেকে নিয়ে ঢাকায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। তারপর থেকে আমি ইকুকে প্রত্যেকটি মুহূর্তে অনুভব করতাম। ওর শূন্যতা অনুভব করতাম। মনে মনে ওর একটা ছবি আমার হৃদয়ে চিত্রপটে একে কল্পনা করে রেখেছিলাম। ওকে আমি একমুহূর্তের জন্য ভূলতে পারিনি। মনে মনে ওকে কত খোঁজ করেছি কিন্তু আর ফিরে আসেনি এ গ্রামে। শুনেছিলাম ওর মামা গ্রামের সব জমি যায়গা বিক্রি করে চিরকালের জন্য এ গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছেন।
দীর্ঘ বছর পর যখন ওকে দেখলাম তখন আমিও ঠিকমত চিনতে পারেনি। ওর কাটা দাগটা দেখে মনে হল ইকু। বসের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলাম। এক কলিগের কাছে জানতে পারলাম ওর সম্বন্ধে। তখন আমার মনে সন্দেহের লেশমাত্র রইল না। ও আমার বন্ধু ইকু ছাড়া আর কেউ নয়। আমি যেভাবে ওকে হৃদয়ের চিত্রপটে গেঁথে রেখেছি ও হয়তো আমাকে সেভাবে গেঁথে রাখেনি। এখন যদি পরিচয় দিয়ে না চিনতে পারে? আমাকেই লজ্জায় পড়তে হবে। বার বার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও ফিরে এসেছি ওর রুক্ষ মেজাজের কাছে হার মেনে। অথচ শৈশবে তো এমন রাগ ছিল না।
খুব মন দিয়ে কাজ করছি। বসের দেওয়া নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজগুলো করতে হবে। নির্ভূল কাজ না করতে পারলে নির্ঘাত চাকরি ছাড়তে হবে। ছোটো বেলায় তো আমরা শত্রু ছিলাম না। তাহলে বস আমার সাথে শত্রুর মতো আচরণ কেন করে? আমার চেহারায় কী খারাপ মানুষের ছাপ লেগে আছে? হয়তো কিছু কিছু মানুষের থাকে। না, মন দিয়ে কাজ করেও নির্দ্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারলাম না। অনেক বেশি কাজ। আমার চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না। বস আমাকে তার চেম্বারে ডাকলেন। তার ধারনা আমি মহা ধুরবাজ টাইপের লোক। মহা ফাঁকিবাজ। আমার মতো কর্মচারী অফিসে থাকলে উন্নতি হবে না। ক্ষতি হবে। তিনি আমাকে তিন দিনের আল্টিমেটাম দিলেন। এর মধ্যে যদি কাজে মনযোগী না হই তাহলে নির্দ্বিধায় আমার চেয়ারে অন্য কেউ বসবে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম আবির সাহেব আমাকে তাড়ানোর চক্রান্ত করেছেন। বসের ডাক শুনলেই ওর মুখে কেমন একটা যেন হাসি ফুটে ওঠে। তিরস্কারের হাসি। আমি চলে গেলেই তার প্রমোশন নিশ্চিত। তাই হয়তো আমার নামে কথা লাগিয়েছে।
সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর চাকরি করব না। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বসের ঝাড়ি শুনতে ভালো লাগে না। পথে পথে ভিক্ষা করব তবুও আর চাকরি নয়। শুধু মনের ভেতরে একটু কষ্ট থেকে যায়। ইকুকে আমার পরিচয়টুকু দিতে পারলাম না। আমি চাকরি ছাড়ার জন্য একটা দরখাস্ত হাতে অফিসে ঢুকলাম। অবাক ব্যাপার এবার আর তেলাপোকার কোনো গন্ধ আমার নাকে এল না। বসের পারফিউমের সুঘ্রাণ আজ আমার কাছে সুঘ্রাণ বলেই মনে হল। ঠিক বেলি ফুলের মতো। যা আশা করেছিলাম তা হল না। বস আমার দিকে আর আগের মতো ভ্রু কুঁচকে তাকালেন না। আমি আমার চাকরির রিজাইন লেটারটা বসের হাতে দিলাম। বস কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, চলেই যাবেন? জ্বি স্যার বলে আমি উঠে দাড়ালাম।
চাকরি ছেড়েছি বেশ কিছুদিন। চিন্তায় শরীরটা ভেঙে পড়েছে অনেক। ইদানিং গন্ধটা ফের যখন তখন নাকে আসছে। একটা কাজের সন্ধানে আমি উদাস মনে রাস্তায় হাটতে লাগলাম। আবার গন্ধটা আমার নাকে এলো। হঠাৎ করেই মাথাটা চক্কর দিতে লাগল। বমি করে ফেললাম। বমির সাথে রক্ত উঠে আসতে লাগল। সব কিছু অন্ধকার দেখতে লাগলাম। তারপর আর জ্ঞান ছিল না। চোখ খুলতেই আমি অবাক। আমার সামনেই আবির সাহেব বসে আছেন। আমি আবির সাহেবকে সহ্য করতে পারিনা। তিনিই ঘুস দিয়ে আমার জায়গাটা দখল করেছেন। আমি আজ চাকরি হারিয়েছি।
আমি হাসপাতালের বেডে। দুদিন জ্ঞান ছিল না। ডাক্তার আমাকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। আমি সিরিয়াস কোন অসুখে আক্রান্ত। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি আমার জীবনের চাকা এত তাড়াতাড়ি থেমে যাবে। আর বাঁচবো না। আমার পরিবার আমাকে ঘিরে কান্নাকাটি করছে। কিছুক্ষণ পরেই আমি ইকুকে দেখতে পেলাম। আমার চোখদুটো ছল ছল করে উঠল। আমি জানি না তিনি কি করে জানতে পেরেছেন আমি আর বাঁচবো না! নাকি পারেন নি? ইকু কী আমাকে চিনতে পেরেছে? এযুগে বন্ধুত্বও টাকার কাছে বিক্রি হয়। আমি নিশ্চিত সে আমাকে চিনতে পারেনি।একটা অফিসের পুরোনো কর্মচারী মারা যাওয়ার সময় যে রকম করুণা নিয়ে তার স্টাফরা দেখা করতে আসে ঠিক সেরকম হয়তো তিনিও এসেছেন একজন পুরনো বস হিসেবে। তার মধ্যে বন্ধুত্বের ছিটে ফোটা পর্যন্ত নেই, নেই একফোঁটা অনুতাপ করুণা আর ভালবাসা। মাথাটা ভন ভন করে ঘুরতে লাগল।
ইকু আসে নি। কিরকম একটা যেন ঘোর আমার মনের মধ্যে সবসময় কাজ করতে লাগল। জানি ইকু আমাকে দেখতে আসবেও না। আমি যাকে দেখতে পেলাম সে ইকু নয়। আবির সাহেব নিজেই। আমি আবির সাহেবকে ইকুর পরিচয় দিয়ে কিছু বলতে চাইলাম। আমার বন্ধুত্বের কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু আমার মুখ দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হল না।
আফসোস ইকু আমাকে শেষবারের মতো চিনতে পারল না। আমি নিজেও তার পরিচয় কাউকে দিতে পারলাম না। আমার মনের ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা হতে লাগল অনেকদিন পর, আবার সেই মৃত তেলাপোকা পচাঁর গন্ধটা নাকে এল। চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করলাম। ক্রমেই কিরকম যেন চোখটা বুঁজে এলো ফের। চোখবুজেই পরিস্কার দেখতে পেলাম ইকু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি ইকুকে বাহুডোরে আলিঙ্গন করলাম। দুজনেই হারিয়ে গেলাম ফের আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশবে। খোলা মাঠে আমি আর ইকু। ইকু আমাকে একটা ঘুড়ি বানিয়ে দিয়েছে। আমি ঘুড়ি উড়াচ্ছি। বাতাসের সাথে দোল খেয়ে ঘুড়ি উড়ছে। হঠাৎ অবাক হলাম এত্ত সুন্দর ঘুড়িটাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করছি! কিন্তু কেন? আমি সুতো কেটে দিলাম। ঘুড়ি তার আপন মনে উড়ছে। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তাকিয়ে দেখি ইকু। ইকু আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। আমি পড়ে গেছি। আমার গাল বেয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। আমি কাঁদছি না। ইকু চিৎকার করে কাঁদছে। ঠিক সেই ঘোরের মধ্যেও একটি প্রশ্নে আমার হৃদয় বিদ্ধ হল, এটাই কি জীবন? যার কোন নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু কেন? কেন? কেন?