শেখ শরীফ
শেখ শরীফ, অ্যাকাডেমিক নাম মো. শরিফুল ইসলাম। পেশায় শিক্ষক, নেশায় পাঠক ও লেখক। তাঁর কাছে জীবন মানে শেখা এবং প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখা। সাহিত্য তাঁর আত্মপ্রকাশের মাধ্যম, আর একাকিত্ব তাঁর ভাবনার ক্ষেত্র। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ওমর আলীর কবিতা এবং একাকিত্বের শিল্প (২০২৩)।
শেখ শরীফ

মাজেদ বুড়ার ভূতের গপ্পো

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

শেখ শরীফ-এর গল্প

মাজেদ বুড়ার ভূতের গপ্পো

গাইবান্ধার আঞ্চলিক ভাষায় লেখা একটি ভূতের গল্প

শোনেক ভাই, তোর দাদা, আশরাফ খাঁ আর মুই এই তিনজন হামরা মাঠের হাঁটোত গেছি। হামরা তিনজোন সোগসোমে এক সাথেই হাঁটোত যাই এক সাথেই হাঁট থেকে বাড়িত আসি। কিন্তুক সেদিন যে কি হলো? তোর দাদা আগেই হামার ঘরোক থুয়ে ঐ পাক দিয়ে তার বেটির বাড়িত গেলো। মুই আর আশরাফ খাঁ থাকনেম বাজারোত। হামরা এলাকার বিভিন্ন জায়গাত থ্যাকা ভ্যাড়া, বকরি আনে বাজারোত কেনা বেঁচা করি। আল্লার কী কাম সেদিনকে একটাও ভ্যাড়া, বকরি কিনবের পাই নেই। যা হোক ভাই সেদিন ক্যামা আন্দারও করছিল খুব। এ্যানা করে ঝুপঝুপ করে ঝড়ি পড়ে। চারদিকে এক্কেবারে ঘুঁটঘুঁটে আন্দার। দু’চোখোত কিচ্ছু দেখা যায় না। আশরাফ কোনটে বেন হেনে দুটো পলিথিনের ব্যাগ কিনে আনলো। তারপর কলো, “মাজেদ চা। নেও তা বাহা। মাতাত ভালো করে প্যাঁচে নেও। মাতাত পানি না পরলেই হলো। মাতাত ঝড়ি পড়লে জ্বর হয়।”

দু’জন আল্লার নাম নিয়ে বার হনেম। এমন আস্তার আস্তা ভাই। শুনলে কি কবু! মাঝে মাঝেই ভাঙ্গা। আর তার উপর কাদোর কাদো। পাও যেটে পরে এক্কিবারে ভেতরত যেন ডুবে যায়। এই নকের বেঙ্গিটিগুলো ভাই খায়া যায়। আর আস্তা পার হবার ধরে বড়ো বড়ো হোলা ব্যাঙগুলো ঝাঁপ দিয়ে একপাশ থেকে আরেক পাশোত যায়। যাবার ধরে এ্যানা করে ফির চিরিত করে মুতেও দেয়। ঝড়ির পানি তো ঠাণ্ডা কিন্তুক ব্যাঙের মুত কিন্তু বোঝা যায় একনা গরম। মাজেদ বুড়ার এই কথা শুনে রাকিব, রেবা, মমিনুল, হালিম সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। আলেক আবার বলতে থাকে, শোন্তো দাদার কথা। ব্যাঙের মুত নাকি একনা গরম। দাদা তুমি এটাও দেখছেন। মাজেদ বুড়া এবার কিছুটা রাগ হয়ে বলে, মুই কি মিচা কতা কতিচোম। আশরাপোক কয়া দেকিস কি কয়? মেনাজের মাও বলে, "কও তো বাহা তুমি। অরা কী জানে আগের কতা হামরা জানি।"

মাজেদ বুড়া এবার গায়ের ওপর তার ভাড়ি এবং তালি দেওয়া কাঁথাকে শরীরের সাথে ভালো ভাবে জড়িয়ে নেয়। আর সেই সাথে হাঁটু দুটোকে আরো খানিকটা প্রশস্ত করে দেয়। আর পোড়ের আগুন একটু একটু করে খোঁচরাতে থাকে। আর ঘুটের আগুনকে নিজের জানুর দিকে টানতে থাকে। এমন ভাবে পোড়ের আগুনকে নিজের দিকে টানতে থাকে যেন আগুন বুঝতেই পারে না। আসলে সবাই যেখানে বসে গল্প শুনছে সেখানে আগে থেকে কাউকে ডাকা হয় নাই। প্রচণ্ড শীতের কারণে খরকুটা এবং শুকনো গোবরকে একত্রিত করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাকে পোড় বলে। তাই ছেলে বুড়া সবাই শীতের সন্ধ্যায় বসে একত্রে গল্প করছে আর আগুন পোহাচ্ছে। এটা নতুন কিছু নয় এটা গ্রামের মোড়ে মোড়ে সন্ধ্যার একটি নিত্যদিনের চিত্র। এবার মাজেদ বুড়ার বলার ভঙ্গি একটু বদলায়। একটু এদিক তাকিয়ে বলে সব কিছু ভালোই আছিল। মুই আর আশরাপ কাদোন খচে খচে আসতিছি। সড়কের দুই দিক থ্যাকে ঘুগরিপোকার ডাক আর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাং শব্দ শোনা যায়। আবার ককনো ককনো সড় সড় করে মাউছে আলাত সাপের হিসহিস শব্দ শোনা যায়। এ্যানা করে ভয়ও নাগে। তাই মাঝে মাঝে মুই যাত্রা পালাত থেকে ডায়লোগ কতিছোম। তখন ডায়লোগ কতিছুনু সিরাজউদ্দৌলা থ্যাকে। ঠিক সেই সোমে, ক্যান জানি পেছোন দিক থ্যাকে আশরাপ কলো, “চাচা কার য্যানো পায়ের শব্দ। মনে হয়, কেউ হামার ঘরে পাছে পাছে আসতিছে।”

ওর এ্যানা তকোন বয়স কম। কেবল বিয়ে করছে। মুই এ্যানা করে বুজবের আগে থেকেই পাছোম। কিন্তুক মুই কিছু কম নাই। মুই যদি কিছু কম তাহলে তো অই ভয় পাবি। মুই ওক সাওস দিয়ে কনু-কিছু নয় পাছের দিক দেকিস নে। পাছোত কিছু হোক যায়া। ওগলে কিছু নয়। ওগলে মনের এক ধরনের ভয়। এরপরে ভাই আবার জোরে জোরে ডায়লোগ কওয়া শুরু করনু। (সিরাজ: আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি। কিন্তু তুমি এ কাজ করো না মোহাম্মদি বেগ।)

কলজের মধ্যে য্যান ধকধক করে শব্দ হবার নাগলো। ভাই তোরা বিশ্বেস করবে নস-যেই হামরা সাদেকপুরের কাছে বাঁশঝাড়ের কাছোত আসনেম। আর শুরু হলো ভাই ওর কাণ্ডকীর্তি। যেঙ্কা মনে কর তুফান আসলে হয় সেঙ্কে ভাই। বাঁশগুলোক যেন খালি এ পাশ থেকে ও পাশোত নিয়ে যাবোর নাগলো। যেন কী শুরু হয়ে গেছে। হামি আশরাপের হাতখেন ধরনেম শক্ত করে। তোরা কলে কবু কী ভাই ঐ য্যান খালি থত্থর তত্থর করে কাঁপপের নাগলো। কোনো কতা কবার পাচ্চে না। হামাকো তো ভয় নাগছে। হামি খালি য্যান জোরে জোরে আয়তাল কুসতি পড়া শুরু করনেম। কিন্তু কাউকে যে ডাকমো সেই শক্তি গায়োত নাই। এই যে এতো জোরে ডাকপের চাই। কিন্তুক মুক দিয়ে কোনই শব্দ বার হয় না। হামি জানি অন্তরাশি হয়ে গেছিনেম ভাই। কলজে শুকে হামার কাট হয়ে গেছিল। খুব যে আত হছে তাও নয়। তবে ঝড়ি পড়ার জন্যে কেউ বাড়ির বারে বার হয় না। এশার আযান হছে কি হয় নাই এঙ্কে একটা সময় হবে। মুই আশরাপোক কনু দেখ বাঁশের নিচ দিয়ে যাওয়া যাবা নয়। বাঁশের নিচ দিয়ে গেলে ঐ চাপা দিয়ে মারে ফেলাবি। আর নিচ দিয়েও নামা যাবা নয়, ডিগির মদ্যে নিয়ে মারে ফেলাবি। এটি খাড়ায়ে থাকা ছাড়া আর কোন বুদ্ধি নাই।

আশরাফ কেনা হঠাৎ করে কলো, "চাচা মোর কাছে ম্যাচ আছে, আগুন জ্বালালে বোধহয় কিছু একটা হবি।" হামি কনেম এঙ্কার মদে কেঙ্কা করে ম্যাচের কাটি জ্বলায় বাহে। তাও কনেম, "আচ্চা দেখতো জ্বলপার পাস নাকি।"

এর মধ্যেই কেটা যেন বাড়ির মধ্যে থেকে লাইট মারার আলো আসলো। হামি ডাক দেওয়াতে বাড়ি থ্যাকা নাদু দা বার হয়ে আসলো। ছোট বেটে-খাটো তাই। হেন্দু মানুষ তাই। আসলে তাক কনেম দাদা এঙ্কে এঙ্কে অবস্থা। তখোন নাদু দা কলো এটি যে কি সমস্যো চাচা। যাও হাটো তোমার ঘরোক আস্তাত ধুয়ে আসি। নাদু দ্যা হামার ঘরোক আস্তাত তুলে দিয়ে আসলো। কোনোমতে খালি হামরা দু’জনে আজকে যেটে তোরা কাশদাহের পুল খেন দেকদিছিস ওর কাছা কাছা আসছি। আগে তো কোন পুল আছিল না। এনা ছোট বাঁশের বাতি দিয়ে এপার থেকে ওপার যাওয়া আসা করা যায়। এখোন তো নদী ছোট হয়ে গেছে আগে এর চায়া এনা বড় আছিল। আর ঝড়ির সমে তো আরো বেশি। ওই পুলের পাশে কিন্তুক একটা তেঁতুলের গাছ আছে। তখোন ভাই কি আর কম কোন যেন পাতা নাই। ঐ তেঁতুলের গাছের নিচে কিন্তুক মড়াপোড়া হতো। এখোন কত বুদ্ধি বাড়াছে শুনি। একন নাকি কারেন দিয়ে লাশকে ওরা পুড়ে ফেলায়। যা হোক ভাই সেদিন বোধহয় ঝড়ির মধ্যেই মরা পুড়ে সবাই চলে গেছে। তকনো এ্যানা করে ধুমে উড়ছিলো। আর গন্দ নাকে এসে নাকোত নাকতিছিলো। শরীরটে কেন জানি এ্যানা চাউর দিয়ে উঠলো। পুলের কাছোত যকোন আসনেম দেকি এ্যানা করে জ্যোছনার আলো দেখা যায়। খুব যে বেশি আলো ভাই তাও নয়।

সেই আলোত হামি আর আশরাফ দেকি শকুন দিয়ে গাছ ভর্তি। এতো শকুন এর আগে কোন দিন মুই দেকোম নাই। বাপরে বাপ। কোনটে হেনে যেন আসছে। একটা শকুন যেন আরেকটার উপরোত বসে আছে। হামার ঘরোক দেকেই কেঙ্কা যেন একটা শব্দ করে উঠলো। তারপরে দেখি কালো কুচকুচে নাড়ে মাতার যেন কী ভাই ওটা। আশরাফ তো ভয়ে ডুকরে উঠে কলো ওমা আ আ। তার সাথে সাথে হামাক ধরলো জোর করে জাপটে। হামি তো নরবেরও পায়নে চরবেরও পাই নে। এরপরে পুলের কাছে যায়া দেখি কোন পুল নাই। পানি সৎ গেতিছে। আরে এগ্গুলে খেকশিয়াল গায়ের পশম খাড়া করে পানির মদ দিয়ে সাতার কাটে ওপারে উঠে কোনটে যেন মিলে গেতিছে। এঙ্কে ভাই চলতেই থাকলো। সেগলে কী তাজা ভাই! এক একটা হামার ঘরে যে পাটা কুত্তেটা আছে না ওটার চায়ে মোটা আর তাজা। কী কালোর কালো, বাপরে বাপ! গায়ের পশমগুলো সজারুর নাকান খাড়া খাড়া। কান দুটো খাড়া করে হা করে সামনের লম্বা লম্বা দাঁত বার করে দৌড়াচ্ছে। আর ঘোত ঘোত করে শব্দ করতে থাকে। হামি আশরাপোক কনেম এই যে আরো কতো কি সাজবে তার কোন হিসেব নাই। হামি এবার সাহোস করে কনেম তোর তো হামরা কোন ক্ষতি করি নাই। তুই হামার ঘরে সাথে এরকম করতিছিস ক্যান। হামরা কী তোর কোন আস্তানা ভাঙ্গে দিছি না তোর কোন ক্ষতি করছি ক তো। এই রখম করে জোরে জোরে হামি কবার নাগনেম। তাও দেকি কোন কুল কিনারা পাই না। পুল খেনো খুঁজে পাই নে। কোনটে যে নুকে থুসে। হামি এবার সুরা ইয়াসিন আর আর রহমান পড়া শুরু করনেম। দেকি কোনটে বেন থেকে বাঁশের পুল হাজির। হামি কনেম। দেক আশরাপ এই সুরা পড়তে পড়তে পুল পার হওয়ার নাগমি। তাছাড়া আর পুল পার হওয়া যাবার নয়। তাই করনেম। পুল পার হবার ওই যেন খালি সোত সোত করে হামার ঘরে পাশ দিয়ে উড়ে যাবার নাগলো। এবার কিছুদূর যাবার পরে দেকি দুই দিকে দুখেন পাও মেলে দিয়ে ওই দাঁড়ে আছে। নিচের দিকে পাও দেখা যায়। শুধু আসমানের দিকে ওক দেকা যায়। তখোন ঝড়ি পড়াব বন্ধ হচ্ছে। হামারঘরে যে কি হছিল ভাই কি কমো। ওর এবার এই রূপ দেখে হামার হাত পাও গেলো ঠাণ্ডা হয়ে। শরীরে পশম খালি যেন খাড়া হয়ে। এই দেখ এই দেখ সেদিনের কথা মনে হতেই ফির পশম খাড়া হছে। ওর মুখ দিয়ে মনে হচ্ছিল যেন রক্তের মতোন কি যেন পড়ছিলো। আর তোরা যে আলিফ লায়লার মধ্যে একটা ভূতের ছবি দেকিস এর চেয়ও ভয়ঙ্কর। হামি চোখ বন্ধ করে আশরাপোক কনেম, “তুই ওপর দিকে দেকিস নে। যা হবার হবে।”

এই কথা কয়ে ম্যাচটা জ্বালানেম। সাথে সাথে ঐ কেনা ডুকরে উঠে কলো আজকে বাঁচে গেলি। তকোন হামরা লক্ষ্মী ডাক্তারের বাঁশের তল পার হয়ে পুলের পাড়োত কাছে। অটি আসে দেকি ভুঁটের আলো নাগে নিয়ে তোর দাদি আর আশরাপের মাও দাঁড় হয়ে আছে হামার ঘরে যেন্নে। বাড়িত আসে দেকি রাত তকোন একটার মতোন বাজে। হামরা ঘরে আসতে নাগে ত্রিশ মিনিট থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট। সেটি নাগছিলো সাড়ে তিন ঘণ্টা চার ঘণ্টা। বুজলো ভাই।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu