মো. রেজাউল করিম
১৯৬৪ সালে কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান-এ স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেন। শিশু সাহিত্য ও কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। প্রকাশিত উপন্যাসগ্রন্থ: অনাবাসী, আমার বান্ধবীগণ, আয়নাল হক উপাখ্যান।
মো. রেজাউল করিম

পোখারা টু সারানকোট: সোনালী বরফের খোঁজে

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

চিতোয়ান ছেড়ে সাতসকালে রওনা দিয়েছি পোখারার উদ্দেশে। ভারত উপমহাদেশের তিনটি জায়গা বিশ্বের বুকে ভূ-স্বর্গ হিসাবে খ্যাতি পেয়েছে। কাশ্মির, ধুলিখেল ও পোখারা। প্রথমটি ভারত-পাকিস্তানে এবং শেষ দুটো নেপালে। কোনটি সেরা তা নির্ধারণ করা খুবই দুরূহ। তবে পোখারা প্রসঙ্গে এক বিশ্ব ভ্রমণকারীর উক্তি স্মরণ না করে পারছি না, তিনি লিখেছেন– I have yet to find a better place in this world and i have travel all round the globe in my 45 years of travelling. I love POKHARA!!! বাড়ির কাছেই নেপাল। সুতরাং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এখনো যারা নেপালে যাননি তারা দ্রুত ঘুরে আসুন।

পোখারাতে যখন পৌঁছুলাম তখন মধ্যাহ্ন। শহরের প্রবেশমুখে ডান হাতে তাকালেই চোখে পড়বে বিস্তৃত ও সুউচ্চ পাহাড়ের খাঁজে-খাঁজে সাদা বরফ। জুন মাসের প্রখর সূর্যতাপে বরফ গলে যাচ্ছে। তবে আজকে সূর্য নিষ্প্রভ। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। যত বেশি পারা যায় এ-সৌন্দর্যের রস আস্বাদন করতে চাই। স্মৃতির মানসপটে এমনভাবে গেঁথে রাখতে চাই, কোনো আঁচড়েই যেন তা ম্লান হয়ে না যায়।

টিম লিডারের আহ্বানে গাড়ি থেকে নামলাম। সর্বাগ্রে দাপ্তরিক কাজ সেরে নেয়ার পালা। এখানে এক ঘণ্টার একটা কর্মসূচিতে অংশ নিতে হবে। অফিসে ঢুকতেই বিদেশি মেহমানদের প্রতি সৌজন্য-সম্মানে সকলকে একটি করে উত্তরীয় পড়িয়ে দেয়া হলো। দাপ্তরিক কথাবার্তা চলছে, আমার মন অস্থির-চঞ্চল, তবে মুখাবয়ব অবিচল-অচঞ্চল। হালকা নাস্তা পর্ব সেরে হোটেল অভিমুখে দৌড়। আমাদের জন্য বুকিং রয়েছে ফিসটেইল রিসোর্টে।

পাঠক, সম্ভব হলে পোখারাতে যাওয়ার আগেই এই রিসোর্টে আপনি বুকিং দিয়ে রাখুন। বৃটিশ যুবরাজ চার্লস, জাপানি যুবরাজ নারুহিতোসহ মান্যগণ্য ব্যক্তি যারা পোখারাতে অবস্থান করেছেন, তারা এই রিসোর্টেই থেকেছেন। পর্যটকদের অতি প্রিয় বিশ্ববিখ্যাত ফিউয়া লেকের তীরে এই রিসোর্টটি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন প্রকৃতির এক সন্তান। এর ছাদে ‘রুফ টপ ক্যাফেটারিয়া’ কিংবা আপনার কক্ষ– সবখান থেকেই তুষার শুভ্র অন্নপূর্ণা পর্বতমালা দৃশ্যমান।

খাবারের দর-দাম এখানে বেশ চড়া। দল ভেঙে গেলো। আমি ও আকরাম সাহেব একত্রে আছি। চিতোয়ান ফরেস্টের ভীতিকর অবস্থায় আমার ওপরে তার যে রাগ-অনুরাগ কিংবা মান-অভিমান হয়েছিলো, গত রাত্রির বিশেষ ডিনারপর্বে তা কেটে গেছে। দু’জনে মিলে চলে গেলাম ফিউয়া লেক পাড়ে। ছোট্ট শহরের মূল সড়কের পাশেই ফিউয়া লেক। লেক পাড়ে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। প্রতিটি রেস্টুরেন্টের পেছনের দিকে উন্মুক্ত অঙ্গনে খাবার ব্যবস্থা, এরও পরে সবুজ লন পেরিয়ে লেকের অবস্থান।

চমৎকার খোলামেলা একটি রেস্টুরেন্ট বেছে নিলাম। নেপালের রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে থাকতে হয়। বসে বসে কাল সকাল অবধি ভ্রমণের পরিকল্পনা তৈরি করছি। সামনের টেবিলে ষাটোর্ধ্ব দু’জন সাদা চামড়া দীর্ঘকায় রমনী। দু-একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম প্লেটে ফল-মূল আর সেদ্ধ সবজি ছাড়া আর কিছু নেই। ধীরে-সুস্থে রসিয়ে-চাবিয়ে আহারপর্ব সমাধা করছে। ইতোমধ্যে কয়েকবার সরাসরি আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছে (যদি আমি ভুল না করি)। ধুলিখেলের অভিজ্ঞতা মনে দগদগে ঘা হয়ে আছে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে অচেনা-অজানা-অপরিচিত সাদা চামড়া রমণীর সাথে বন্ধুত্বের বাসনা মনে আর নেই।

কিন্তু এবারে তারা বেশ সশব্দে জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়ার আর ইউ ফ্রম? যা ভেবেছিলাম তাই হলো। মার্কিন মুলুকের খুব কম সাধারণ মানুষ আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে। ওরা নাকি বান্ধবী। একজনের বাড়ি আরিজেনো স্টেট, অপরজনের কলারেডো। কেউই বাংলাদেশের নাম শোনেনি। একশো ডলার খরচা করে কাঠমুন্ডু থেকে বায়ুযানে চেপে সে দেশে যাওয়া যাবে শুনে যেন আকাশ থেকে সরাসরি মর্ত্যে নেমে এলো। দু’জনই এসেছে এই গ্রন্থে বহুল আলোচিত সেই ট্রেকিং-এ। দু’জনই নাকি প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যায়। স্বামী-সন্তান বাদে তাদের কেন এই ভ্রমণ বিলাস-অভিলাষ তা জানা হলো না।

ইতিমধ্যে আমাদের খাবার এসেছে। ভাত, ভর্তা, সবজি, ডাল ভুনা, মাছ, দধি, সাথে ফাউ আচার ও সালাদ। ফিউয়া লেকের রুই জাতীয় মাছ, অপূর্ব তার স্বাদ, যেন যমুনা নদীর রুই। নেপালে ইতিপূর্বে কখনো এমনতরো স্বাদের মাছ খাইনি। ভিন্ন স্বাদের দই, মন্দ নয়। আমাদের খাওয়ার প্রতিও বিদেশিনিদের আগ্রহ-উৎসাহ-কৌতূহল যেন এশীয়দেরকেও ছাড়িয়ে গেলো। আমাদের ডিশগুলো সম্পর্কে বললাম, ওরা নাকি রাতে এ ধরনের ডিশ টেস্ট করে দেখবে। দেখুক– মন্দ কী।

খাওয়া শেষে ফিউয়া লেকের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল লেক– সম্ভবত খুব গভীর, যে কারণে পানি স্বচ্ছ কিন্তু কৃষ্ণবর্ণ। অসংখ্য প্যাডেলচালিত নৌকোতে করে পর্যটকেরা লেকের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লেকের মাঝখানে একটি মন্দির। দু’জনে মিলে পোখারা ভ্রমণের সবটুকু আনন্দরস হাড়-মাংস নিংড়ে উপভোগ করতে চাই। বেশ শক্ত-সমর্থ একটি নৌকো ভাড়া করলাম আধা ঘণ্টার জন্য। উদ্দেশ্য লেকের বুকে ভাসতে ভাসতে তুষারশুভ্র অন্নপূর্ণা পর্বতমালার নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করা। হোটেল থেকে দেখেছিলাম একনজর। এখানে এসে বিশাল পানির রাজ্যে ভাসতে ভাসতে বরফাচ্ছাদিত অন্নপূর্ণা পর্বতমালা দেখে মন জুড়িয়ে গেলো। ভাবছিলাম, আমি যা দেখছি, তা কী কোনদিন কুসুম, ফারহান, সুজানকে নিয়ে একসাথে দেখতে পারবো? সেই মহেন্দ্রক্ষণ কি কোনোদিন আসবে?

আবার কবে এই স্বর্গনগরীতে আসতে পারব জানি না। পরিকল্পনা সাজিয়েছি খুব জবরদস্ত। অন্নপূর্ণাকে আরো কাছ থেকে দেখতে চাই। তার জন্য যেতে হবে সারানকোট। আমার সঙ্গী আকরাম সাহেব বহু দেশ ঘুরেছেন, দেখেছেন অনেক জায়গা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, উনি আমার ভ্রমণ পরিকল্পনায় পুরো সমর্থন দিয়ে চিরাচরিত বাঙালি ভেদ-বিভেদের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

এবারে চলেছি সরানকোটে। দরদাম করে বেশ সস্তায় একটি ট্যাক্সি পেয়েছি। অন্যরা যেখানে এক হাজারের নিচে কেউ বোথ ওয়ে ট্রাভেলে রাজী নয়, সেখানে সে ছ’শোতেই রাজী। পরে বুঝেছিলাম এত কমে রাজি হওয়ার রহস্য। ড্রাইভার ভদ্রলোকের বাড়ি সারানকোট। বাসার সওদাপাতি পৌঁছে দেয়ার জন্য সে স্বল্প ভাড়ায় আদাদেরকে নিতে রাজী।

পোখারা থেকে সারানকোটের দূরত্ব আড়াআড়ি তিন কিলোমিটার, কিন্তু সড়ক পথে পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেড়িয়ে যেতে হয় সেখানে। পোখারাতে সমুদ্র সমতল থেকে ভূমি তথা পাহাড়ের উচ্চতা দ্রুতই বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরের উত্তর প্রান্তে ফিউয়া লেকপাড়ের (সমুদ্র সমতল থেকে) উচ্চতা যেখানে ৮২৭ মিটার (২৬৮৭ ফুট), সেখানে সারানকোটের উচ্চতা ১৬০০ মিটার (৫২০০ফুট)। ফিসটেইল চূড়ার উচ্চতা ৭০০০ মিটার (২২৭৫০ ফুট) আর ধবলগিরির উচ্চতা আরো বেশি ৮১৬৭ মিটার (২৮৪৯২ ফুট)।

সারানকোটের উচ্চতা ফিউয়া লেকপাড় থেকে আরো প্রায় দুই হাজার পাঁচশত ফুট বেশি। যেটা নেপালে আসা বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় দর্শনযাগ্য স্থান। সারানকোটে পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু স্থান ‘সানরাইজ পয়েন্ট’ এ সূর্যোদয়ের সময় এসে দাঁড়ালে সামনে সুউচ্চ-সুবিস্তৃত-সুবিশাল অন্নপূর্ণা পর্বতের যে অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়, তা অবিস্মরণীয়-অকল্পনীয়-অভূতপূর্ব। সারানকোট যাওয়ার পথ খুব সরু-সঙ্কীর্ণ, আঁকা-বাঁকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ। পথের যে পাশটায় পোখারা শহর, সে-পাশটাতে গভীর খাদ।

অনেক নিচে অন্নপূর্ণা পাহাড়ের উপত্যকায় গড়ে উঠেছে পোখারা শহর। অপূর্ব সে দৃশ্য, এমনটি আর কখনো দেখিনি। বাড়গুলোকে যেন হচ্ছে কৌটার ঢাকনামাত্র। অনেকটা পথ এগিয়ে আমাদের ছোট্ট টয়োটা কারটি থেমে গেল। সামনের পথ আরও খাড়া, গাড়ি আর চলতে পারবে না। দু’জনে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। কেবল আমরা নয়, আরো অসংখ্য পর্যটক গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথটুকু হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে। পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরাও উঠতে থাকলাম উপরে। এক সময় আমরা দু’জন পৌঁছে গেলাম সারানকোটের সর্বোচ্চ চূড়া সানরাইজ পয়েন্টে।

হিমালয় পর্বতমালার পৃথিবীর অন্যতম সুউচ্চ চূড়াগুলো আমার চোখের সামনে। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম অন্নপূর্ণা, মাছাপুচড়ে, ধবলগিরি, মানাসলু ও অন্য আকাশছোঁয়া পর্বতচূড়ার নৈসর্গিক অপরূপ রূপশ্রী। কখন যে কল্পনার ভেলায় ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম সেই পর্বতচূড়ার মধ্যে, মনেই নেই। সর্বোচ্চ চূড়াটির নাম মাছাপুছড়ে (Machhapuchhare), নেপালি শব্দ, এর অর্থ হলো মাছের পুচ্ছ বা লেজ। আমার কাছে পর্বতশৃঙ্গটিকে আদৌ মাছের লেজের মতো মনে হয়নি। যাই হোক শৃঙ্গটি ‘ফিস টেল’’ নামেই এখন পরিচিতি। বাংলাদেশের দুঃসাহসী পর্বতারোহীরা নাকি এভারেস্টে ওঠার আগে মহড়ার অংশ হিসেবে ‘ফিস টেইল’ শৃঙ্গেও উঠেছেন।

হাঁটতে হাটতে সানরাইজ পয়েন্টে চলে এলাম। নিজেকে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। পাঠক, ‘ফিস টেইল’ পর্বতচূড়ার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালে আপনারও এমনটিই মনে হবে। সম্মুখপানে যত দূর চোখ যায় শূন্য। পোখারা শহরও পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ছে। আবারো ঘুরে দাঁড়ালাম ফিস টেইলের দিকে। শ্বেত-শুভ্র বরফাচ্ছাদিত পর্বতচূড়া। একটি নয়, দু’টি। পাহাড় আমাকে সর্বদাই কাছে ডাকে। বেশিক্ষণ পাহাড়ের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে নিজের মধ্যে আরো একজনকে’ (তবে সে মিসির আলী নিশ্চয় না) যেন জেগে ওঠে। সে বলে পাহাড়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। হৃদয়-মন অস্থির হয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। শবাসনে চলে গেলাম। আকরাম ভাই অবিরাম ক্যামেরায় মুহূর্তগুলো ধারণ করছে।

কিছুটা স্বাভাবিক অনুভব করাতে উঠে দাঁড়ালাম। যত বেশি ভয়ঙ্কর সুন্দর ও সুউচ্চ পাহাড় দেখি, মনের মধ্যে তার অস্তিত্ব ততই বেশি অনুভব করি। এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। উচ্চমূল্যের বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু পর্যটক বহুবর্ণের গ্যাস বেলুনে (একে ইংরেজি ভাষায় বলে ‘প্যারাগ্লাইডিং’) চেপে ফিস টেইল পর্বতচূড়ায় গিয়েছিলেন। সন্ধার আগেই তারা ফিরে আসছেন। হঠাৎ-ই কালো মেঘ এসে ফিস টেইলকে ঢেকে দিলো। আবার কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার হয়ে গেলো। সূর্যের আলোতে ফিস টেইলের বরফ এই উজ্জ্বল রূপালি হয়ে ওঠে, আবার পরমুহূর্তেই রূপের ছটা হারিয়ে যায়।

ড্রাইভার জানালেন মূলত সূর্যোদয়ের সময় ফিস টেইল প্রকৃত রূপ দর্শনার্থীদের কাছে তুলে ধরে। সে সময়ে সূর্যালোকের সপ্তবর্ণের ছটায় ফিস টেইল সোনালি বর্ণ ধারণ করে। পর্যটকেরা মূলত সে সময়েই তাকে দেখতে আসে। আমরা ভুল সময়ে এসেছি। আকরাম সাহেব তার সাথে দর-দাম শুরু করে দিয়েছে। আকস্মিকভাবে তিনি ঘোষণা দিলেন, সূর্যোদয়ের সেই মহেন্দ্রক্ষণ দেখার জন্য তিনি ভোর রাতে এখানে আসবেন। রওনা দিতে হবে রাত সাড়ে তিনটায়। একদিকে অনিচ্ছা, আবার এমন দৃশ্য দেখার আকাঙ্ক্ষা। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। এই সংকীর্ণ খাড়া পাহাড়ি রাস্তায় রাতের অন্ধকারে গাড়িতে করে আসার কথা চিন্তা করতেই গা ছমছম করে। ড্রাইভার জানলেন তিনি আঠারো বছর রাতের অন্ধকারে এই পথে বাসায় ফিরেন, আবার ভোরে শহরে যান। ভোরবেলায় সারানকোটের ট্রিপ থাকলে শহরে থেকে যান। কথা দিয়ে ফেললাম আবারো আসবো।

রাত সাড়ে তিনটায় গাড়ি চললো পোখারা টু সারানকোট। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ তখনও রূপের লালিত্য নিয়ে জেগে আছে। তার আলো ছড়িয়ে পড়ছে হিমালয়ের অসংখ্য চূড়ার গভীর গিরিখাতের মধ্যে। নিঝুম রাতে পাহাড়ি পথে খেলনা সদৃশ ছোট্ট টয়োটা কারটি ছুটে চলেছে সারনকোটের উদ্দেশ্যে। খাড়া ও আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। পথের পাশে পাহাড়ি জোনাকি পোকার মিটিমিটি আলো রাতের অন্ধকার দূর করে আমাদের পথ যেন আলোকোজ্জ্বল করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টায় লিপ্ত। অনেক নিচে গভীর খাদ পেরিয়ে উপত্যকা ঘিরে গড়ে উঠা পোখারা শহরের বিদ্যুৎ বাতিগুলো জোনাকি পোকার মতোই মিটিমিটি জ্বলছে। ঠিক যেন তারাভরা আরেকটি আকাশ পাহাড়ের নিচে ভাসছে। আধাঘণ্টা পর আমাদের বাহন নির্ধারিত জায়গায় থেমে গেল। সামনে সান রাইজ পয়েন্টের পথ আরও খাড়া, তাই আমরা সবাই নেমে পড়লাম।

কেবল আমরা নয়, শত শত পর্যটকও তাদের গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথটুকু হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে। পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা উঠতে থাকলাম ওপরে। হৃদয়ে সূর্যোদয় দেখার প্রলোভনে এই অন্ধকার ভোররাতে উর্ধ্বশ্বাসে উঠছি সবাই উপরে, আরও উপরে। আমরা সবাই পৌঁছে গেলাম সারনকোটের সর্বোচ্চ স্থান সানরাইজ পয়েন্টে। সূর্য তখনো ওঠেনি, কিন্তু সুবহে সাদেকের মহেন্দ্রক্ষণে স্বর্গীয় আলোর হালকা এক আভায় অন্ধকারের ভেতরেও দৃশ্যমান হিমালয়ের পর্বতমালার তুষারঢাকা সুউচ্চ চূড়া। এবার কেবলই অপেক্ষার পালা। কিছুক্ষণ পরে শুভ্রতার আচ্ছাদনে আকাশছোঁয়া চূড়াগুলো ধীরে ধীরে সোনালি আলোয় ঝিকমিক করে উঠলো। পর্যটকদের করতালিতে চমকে উঠলাম। চেয়ে দেখি অন্নপূর্ণার পর্বতচূড়া ছেয়ে ভেসে উঠছে রক্তিম লাল বিরাট বলের মতো সূর্য। বিচ্ছুরিত হলো রক্তিম আলোর অসংখ্য রশ্মি আর জ্বলে উঠল তুষারঢাকা একেকটা চূড়া। স্বর্গীয় এক দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল গোটা ফিসটেইলের চূড়ায়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।

ধীরে ধীরে ভোরের আলো কেটে গেল। এখন অনেক নিচে পোখারা শহরটি দেখা যাচ্ছে আরও স্পষ্টভাবে। আবারো দেখলাম সাজানো-গোছানো পাহাড়ঘেরা পোখারা শহর। আর তার পাশ ঘেঁষে নীল শান্ত গভীর এক হ্রদ, ফিউয়া লেক নামে পরিচিত। এ লেকের স্বচ্ছ পানির ওপর হিমালয়ের চূড়াগুলোর প্রতিবিম্ব পড়ে অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ঝলমলে রোদ বের হতেই পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা নিচে নেমে এলাম।

সোজা চলে গেলাম ‘ডেভিস ফল’ দেখতে। ১৯৬১ সালে ৩১ জুলাইয়ে এক সুইস দম্পতি এখানে গোসল করতে নেমেছিলেন। আকস্মিক এক প্রবল জলধারায় সুইস ভদ্রমহিলা পানিতে তলিয়ে যান এবং মৃত্যুবরণ করেন। সেই থেকে এই জলপ্রপাতের নাম ডেভিস ফলস। তখন সকাল আটটা। সুউচ্চ গিরিখাত থেকে বিপুল জলরাজি বের হয়ে শ্বেত-শুভ্র বিপুল ফেনারাশি সৃষ্টি করে অজানা এক গভীর গুহায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বিপুল এই জলরশি নাকি পাঁচ কিলোমিটার দুরবর্তী ফিউয়া লেক থেকে আসছে। এখানে প্রায় আধা কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ টানেল বা গুহার মধ্য দিয়ে জলরাশি প্রবাহিত হয়েছে। খুব কাছে যেয়ে ছবি তোলা সমস্যা। পানির ঝাপটায় ক্যামেরা ভিজে যায়। বর্ষাকালে নাকি জলপ্রবাহ আরো রুদ্র রূপ ধারণ করে অসাধারণ সুন্দরী হয়ে ওঠে। হায়! এখন বর্ষাকাল না, তাও এত নয়নাভিরাম দৃশ্য, বর্ষাকালে কী অপরূপাই না সে হয়ে ওঠে।

সারানকোট পাহাড়চূড়ায় কোনো দোকানপাট নেই। আছে কিছু ছোট ছোট কুটির। সেখানে নাকি পয়সা দিয়ে রাত্রিযাপনও করা যায়। কিন্তু ডেভিস ফলস পাড়ে রীতিমতো বাজার, আমাদের দেশের মতোই। ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে যে ধরনের দোকান থাকে আর কি। রেস্টুরেন্টও কম না। তাড়াহুড়ো করে দু’জনে কোনো রকমে নাক-মুখে বাটার মাখানো টোস্ট গিলে রিসোর্ট অভিমুখে রওনা দিলাম। রিসোর্টে পৌঁছুতে কিছুটা বিলম্বই হয়েছিলো। টিমের অন্যেরা রওনা দেয়ার অপেক্ষায় রিসেপশনে বসে। সাথে আকরাম সাহেব আছেন। সুতরাং আমার সাথে রাগারাগি করা চাট্টিখানিক কথা নয়।

পুনশ্চ: পোখারা থেকে ফেরার পথে পোখারা-চিতোয়ান সড়ক সংযোগের কাছে আপনারা মনোকামনা রেস্টুরেন্টে যাত্রাবিরতি করতে ভুলবেন না প্লিজ। মহাসড়কের তীরেই পাহাড়ি খরস্রোতা নদী। নদীর ওপারে সবুজাবৃত খাড়া পাহাড়। সড়ক থেকে বেশ কিছুটা নিচে লাল বর্ণের ইট আর একই রঙের টালি দেয়া ছাদের চমৎকার রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং। চারিদিকে নানাবর্ণের ফুলের সমারোহ। রেস্টুরেন্ট থেকে নদীর ওপারে সোজা পাহাড়ের চূড়ায় চলে গেছে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রোপওয়ে। মনোকামনা রেস্টুরেন্টের দক্ষিণ ভারতীয় ডিশ আপনার মুখের রসনা পূরণ করবে নিশ্চয়।

ট্যাগসমূহ

অগ্নিফুল সংখ্যা অণুগল্প অনুবাদ ইতিহাস ঈদ সংখ্যা ২০২২ উপন্যাস সংক্ষেপ একালের গল্প কবিতা কলকাতার দিনগুলি কাজী নজরুল ইসলাম কাজী মহম্মদ আশরাফ গণঅভ্যুত্থান সংখ্যা গল্প চিরায়ত গল্প ছোটগল্প জসীমউদ্দিন জীবনানন্দ দাশ জীবনের গল্প নীতিগল্প পর্যালোচনা পলাশ মজুমদার পিন্টু রহমান প্রবন্ধ প্রেমের গল্প ফেলুদা সিরিজ বই বিখ্যাতদের গল্প বুক রিভিউ ব্যক্তিত্ব ভ্রমণ ভ্রমণ ডায়েরি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাহির তাজওয়ার মিনহাজ শোভন মুভি রিভিউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রূপকথা শিশিরভেজা গল্প সংখ্যা শিশু-কিশোর গল্প সমকালীন কবিতা সমকালীন গল্প সাক্ষাৎকার সিনেমা সুকান্ত ভট্টাচার্য হাসির গল্প
magnifiercrossmenu