পার্ল হারবার: মার্কিন শোকগাঁথার এক মহাকাব্য

প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অনেক দেশ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ আরব দেশেই দাপ্তরিক কাজে সফরের সৌভাগ্য হলেও মার্কিন মুলুকে কখনো যাওয়া হয়নি। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রে একটা প্রশিক্ষণের জন্যে নির্বাচিত হলে অপ্রত্যাশিত মরুঝড়ের ন্যায় আমার হৃদয়ের গহিনে আচানক যারপরনেই এক আলোড়ন ওঠে।

সংবেদনশীল দায়িত্ববোধ কিংবা কোম্পানির প্রচলিত কার্যবিধি অনুযায়ী আমাকে দুজন অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল। সান ফ্রানসিসকো এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন গেইট পার হবার পর আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টি দেখে তারা বুঝতে পারে, ‘আর ইউ আববাস অব বাংলাদেশ?’ হ্যাঁ সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই একজন জানায়, ‘আমি জোয়ান ডেভিড।’

অপরজন একটু খোলাসা করে বলে, ‘আমি জুলিয়ানা, ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর, সেন্ট্রাল মোটিভ পাওয়ার সার্ভিস, স্টকটন।’

জানতে চাইলাম, ‘How far is Stockton from here?’

’60 miles. It will take more than an hour.’ জুলিয়ানা মিষ্টি হেসে জানায়।

চুক্তিকৃত গ্যাস টারবাইন পাওয়ার প্লান্টের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করার জন্যে কর্মরত সংস্থা আমাকে আমেরিকা পাঠায়। সহযাত্রী হিসেবে ওদের গাড়িতে ওঠে অবাক বিস্ময়ে চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। নির্ধারিত গন্তব্যে নিয়ে যাবার পর প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী মহিলাটিই বুঝিয়ে দিলো, ‘হোটেল মিডওয়ে ইন। যা আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। কোম্পানিতে কর্মরত দূরের লোকজন কর্মদিবস চলাকালে এখানেই খায়, প্রয়োজনে রাত্রিযাপন করে। নিজস্ব মেসের মতো।’

তিনতলায় থাকার রুম এবং দোতলায় ডাইনিং দেখিয়ে বলে, ‘ডাইনিং এ সফট ড্রিংক, হার্ড ড্রিংক, জুস, ফ্রুট সবকিছু আছে। যখন যা লাগে, ইচ্ছেমতো নেবে, কেউ তোমাকে উঠিয়ে দেবে না।’

মার্কিন মুলুকে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে শুরু হয় আমার অন্য এক জীবন। একান্নটি অঙ্গরাজ্যের ভেতর জনসংখ্যায় সর্বাধিক প্রায় পৌনে চার কোটি জনবল অধ্যুষিত এ অঞ্চলের আয়তন ১ লক্ষ ৬৪ হাজার বর্গমাইল। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর আয়তনে বৃহত্তম স্টেট আলাস্কা এবং এদিক থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে কিলোমিটার প্রচলিত হলেও বিশ্বের সকল ক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য যুক্তরাষ্ট্রে এখনো দূরত্বের একক মাইল। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের শহরগুলোর বাইরেও বহু স্থানে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রায় সর্বত্রই চোখে পড়েছে– সবুজের সমারোহ, ফসলের মাঠ, ফল ফলারির বাগান, পত্র-পুষ্পের সমাহার। সেখানে প্রতিদিন প্রত্যুষে উঠে সাতটার ভেতরে ব্রেকফাস্ট। সাড়ে সাতটায় প্রশিক্ষণে যোগদান, প্রথমে তাত্ত্বিক পরে ব্যবহারিক। সেখানে আমাকে সবকিছু শেখানোর দায়িত্ব ছিল ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর মিসেস জুলিয়ানার ওপর। আর সে গ্যাস টারবাইন পাওয়ার প্লান্ট ইঞ্জিন সম্পর্কে এতই ওয়াকিবহাল যে, তার টিচিং এ আমার খুঁটিনাটি বিষয়ে শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়।

সপ্তাহে পাঁচদিন কর্মদিবস। শনি-রবি ছুটি। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে চাইলে আমার প্রশিক্ষক-কাম-পথনির্দেশক ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে আসেন। আমাকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলে তেপান্তরের মাঠে কিংবা সানরোজ, সান্টাক্রুজ সি-বিচ নতুবা নাপা ভ্যালি ওয়াইন ভিলেজ। এভাবে ক্রমাগত। একদিন নিয়ে যায় সিলিকন ভ্যালি মাউন্টেন ভিউতে। যেখানে রয়েছে গুগল, ইউটিউব, ফেসবুক, ইয়াহু ইত্যাদি ইন্টারনেট ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার।

মিসেস জুলিয়ানা। এখন একাকী এবং অযৌগিক। বয়স ৩৮। তের বছর একত্রে থাকার পর হাজব্যান্ড এখন আলাদা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বাস করে। ঐ দম্পতির ১২ বছর বয়সি একটি ছেলে রয়েছে। উপযুক্ত বয়ফ্রেন্ড না পাওয়ায় প্রায় পাঁচ বছর ধরে স্বতন্ত্রভাবেই বাস করে। জুলিয়ানা যখন প্রাত্যহিক আমাকে গ্যাস টারবাইনের কারিগরি দিকগুলো শেখাতেন, ওগুলোতে মনোনিবেশ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক সৌন্দর্যও আমি নিবিড়ভাবে অবলোকন করতাম। এই বয়সেও চমৎকার ফিগার। ৫ ফুটট ৭ ইঞ্চি উচ্চতায় দোহারা গড়ন। চুলগুলো গ্রিবা পর্যন্ত এলিয়ে থাকে। শ্বেতচর্ম হলেও চুলগুলো কৃষ্ণবর্ণ। আমার মনে হয়, সর্বাঙ্গ দেখানোর জন্যেই এমন স্কিনটাইট জিন্স ও টি শার্ট পরে। আমার ম্যাডামেরই বা দোষ কী! এই অফিসের অনেক মেয়েই তো টি শার্ট ও শর্ট জিন্স পরে কাজ করে। পথেঘাটে মার্কেটে এমনও দেখেছি– আসন্ন সন্তানসম্ভবা পোয়াতি মেয়েরা বেঢপ ঢোল পেটের ওপর টি-শার্ট এবং নিম্নাঙ্গে ক্ষুদ্রাকার শর্ট জিন্স পরে কী সাবলীলভাবে না ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ইতিমধ্যে দু’মাস পার হয়ে গেছে। সংশিষ্ট পাওয়ার প্লান্টের অপারেশন ও মেইনটেন্যা’স সম্পর্কে আমার ধারণা অনেকটাই স্বচ্ছ। এখন ফল্ট ফাইন্ডিং এবং ট্রাবল শুটিং নিয়ে প্রতি কর্মদিবসেই বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ অবস্থায় আমাকে একদিন জানানো হয়, হাওয়াইতে তাদের এক কারখানায় এ ধরনের গ্যাস টারবাইনের ওভারহলিং-এর কাজ চলমান রয়েছে। সেখানে যেতে হবে।

১০ অক্টোবর ২০১৪ আমরা হাওয়াইতে পৌঁছুলুম। সঙ্গে রয়েছে আমার প্রশিক্ষক জুলিয়ানা। একইভাবে সেখানেও হোটেল মিডওয়ে-ইন। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোটো-বড় অনেকগুলো দ্বীপের সমন্বয়-ওয়াহু গোল্ড, কাওয়াই, মাওয়াই, লাওয়াই ইত্যাদি। চায়নিজ, ফিলিপিনো এবং পলিনেশিয়ান সভ্যতার সংমিশ্রণ হাওয়াই। আমেরিকানরা হাওয়াইকে উচ্চারণ করে হুওয়াই। কর্মদিবস বাদে ছুটির দিনে দর্শনীয় স্থান দেখার আগ্রহ জুলিয়ানাকে পূনঃব্যক্ত করলাম।

আমাদের অবস্থান ছিল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ওয়াহুগোল্ড। এখানেই রয়েছে রাজধানী হনলুলু এবং ঐতিহসিক পার্ল হারবার। পার্ল হারবার আমেরিকানদের শোকগাঁথায় ভরপুর এক মহাকাব্য। আমরা প্রথমেই দেখতে যাই এ্যারিজোনা মেমোরিয়াল। এটি ঐতিহাসিক জাতীয় শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত।

সেখানে একজন মিলিটারি অফিসার আমাদের সার-সংক্ষেপে জানায়:

৭ই ডিসেম্বর ১৯৪১। সেদিন কী ঘটেছিল এই পার্ল হারবারে!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। জাপানি এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার ২২০ মাইলের ভেতরে প্রবেশ করলেও র‌্যাডার অনুসন্ধান করতে ব্যর্থ হয়। সেসময় এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে উড়াল দেয় একসঙ্গে ১৫৩টি যুদ্ধবিমান। প্রাথমিকভাবে এটা দেখে কর্তব্যরত স্টাফ ভেবেছিল, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মহড়া বিমান উড়ে আসছে। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই অতর্কিত বেপরোয়াভাবে হামলা চালায় আমেরিকার শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজগুলোর ওপর। দু’একটি রণতরি প্রতিরক্ষার জন্যে প্রস্তুত হতে হতে উড়ে আসে আরো ১৬৭টি যুদ্ধবিমান। ইউএসএস এ্যারিজোনা, নেভেদা, ওকলাহামোসহ বিধ্বস্ত হয় বহু যুদ্ধজাহাজ। তছনছ হয়ে যায় আমেরিকার সাউথ প্যাসিফিক নৌ কমান্ড। দেড় হাজার নৌ সেনাসহ প্রাণহানি ঘটে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তির। জাপানী ৩২০টি যুদ্ধবিমানের মাঝে বিধ্বস্ত ২৯ টি বাদে ধ্বংসলীলা শেষে ফিরে যায় সবই। তারপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

হাজারো দর্শনার্থীর মাঝে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম ইউএসএস এ্যারিজোনার ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত স্মৃতিসৌধ। এরপর গেলাম পার্ল হারবারের সেরা আকর্ষণ ঐতিহাসিক জীবন্ত কিংবদন্তি ব্যাটলশিপ ইউএসএস মিশৌরিতে। সেখানে ২২ ডলার দর্শনীর বিনিময়ে হাজার হাজার দর্শক। ব্যাটলশিপ মিশৌরির সিঁড়িতে ওঠার আগে ডানপাশে একটি অসম্ভব সুন্দর রোমান্টিক যুগলের আকর্ষণীয় আবেগঘন জীবন্ত মুর্তি। ইউনিফর্ম পরিহীত একজন নৌ সেনা বিশেষ ভঙ্গিমায় তার প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে চুম্বনরত। উভয়য়ের পোষাক এতই জীবন্ত কিছুক্ষণ না দাঁড়িয়ে দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। বুড়োবুড়ি যুবক-যুবতী একই ভঙ্গিমায় মুর্তিটির পাশে দাঁড়িয়ে অপর দম্পতির সাহায্যে একের পর এক ছবি তুলছে।

ব্যাটলশিপ ইউএসএস মিশৌরি। চারদিক আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত। আমেরিকানদের মতে এটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধজাহাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রণতরীটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫। জাপান নিঃশর্তহীনভাবে এই জাহাজের ডেকের ওপর সেদিন টোকিও বে-তে আত্মসমর্পণ করেছিল। সে কারণে এটি দুর্বার শক্তি ও অনাবিল শান্তির প্রতীক। এবং প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধেও জাহাজটি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ৮৮৭ ফিট জাহাজটি নির্মাণের পর ১৯৪৪ সালের ২৯ জানুয়ারি পানিতে ভাসানো হয়েছিল। কিংবদন্তিতূল্য এই জাহাজটিতে রয়েছে ১৬ ইঞ্চি কামানসহ ভূমি ও আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য অত্যাধুনিক ৩২ টমাহক মিসাইল এবং আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ১৬ হারপুন মিসাইল। ৩১ মার্চ ১৯৯২ ডি-কমিশনের পর থেকে সর্বকালের শক্তিধর এই জাহাজটি পার্ল হারবারে সকলের জন্যে উম্মূক্ত করে রাখা হয়েছে।

———-সমাপ্ত———-

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

লিচু চোর

বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে সে কি বাস করলে তাড়া, বলি থাম একটু দাড়া। পুকুরের ঐ কাছে না লিচুর এক গাছ

গল্প

প্রাগৈতিহাসিক

সমস্ত বর্ষাকালটা ভিখু ভয়ানক কষ্ট পাইয়াছে। আষাঢ় মাসের প্রথমে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করিতে গিয়া তাহাদের দলকে-দল ধরা পড়িয়া

ভ্রমণ ডায়েরি

কলকাতার দিনগুলি ০৬

কলকাতার দিনগুলি ষষ্ঠ পর্ব আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ এবং বাংলা ভাষার শক্তিশালী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশালাকৃতির ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর উপন্যাসগুলো পড়ে

কবিতা

বাইবেলের মোরগ

রিগ্যান এসকান্দারের দুটি কবিতা ‘বাইবেলের মোরগ’ এবং ‘প্রেম ও যুদ্ধবিষয়ক’ বাইবেলের মোরগ প্রিয়তমা ডিডো, তোমার কান্নার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে একটা