আহমেদ আববাস
ইতোপূর্বে পেশাসংক্রান্ত কাজে দু’একবার দেশের বাইরে গেলেও কোনো আরব দেশে যাবার সুযোগ হয়নি। ২০১০ সালে দাপ্তরিক কাজে হঠাৎ অনির্ধারিতভাবে লেবাননে যাবার জন্যে মনোনীত হলে এতটাই খুশি হয়েছিলাম যে, তা লিখে জানাতেও রীতিমত শব্দ নির্বাচনে সামর্থহীন এবং সংকুচিত। ০৭ মে ২০১০ আমি সেই স্বপ্নরাজ্যের রাজধানী বৈরুতে যাই। আমার কল্পলোকই হয়ে ওঠে আমার কর্মস্থল। দেড়মাস ছুটি কাটানোসহ একটানা দেড় বছরকাল সেখানে অবস্থান করি।
লেবানন ভূমধ্যসাগর পাড়ে সমুদ্র পাহাড়বেষ্টিত একটি চমৎকার আরব দেশ। দেশটির রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী চমকপ্রদ ইতিহাস এবং বিবিধ প্রত্নতাত্বিক উত্তরাধিকার। সুদুর অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত না করে বলতে গেলে বলতে হয় ষোল শতক থেকে ১৯২০ পর্যন্ত দেশটি অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে এবং একইসাথে দীর্ঘকাল প্রদেশ হিসেবে সিরিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ছোট দেশটির সিংহভাগ সীমানাই সিরিয়ার সাথে, পূবদিকে মাত্র ৭৯ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে বিশ্ব মানবতার শত্রু ইসরায়েলের সঙ্গে এবং দক্ষিণে বিস্তৃত ভূমধ্যসাগর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়লে দেশটি চলে যায় ফ্রান্সের অধীনে। ২৩ বছর ফেঞ্চ শাসনাধীনে থাকার পর ১৯৪৩ সালে লেবানন স্বাধীনতা লাভ করে।
আমাদের দপ্তরে আইটি সংযোগের দায়িত্ব পায় উইসাম নামে এক শিয়া যুবক। সেই আমাদের ডিশ, নেট কানেকশন এবং ইন্টারেনেটের মাধ্যমে সুলভে দেশে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেয়। লেবাননে শনি-রোবাবার সাপ্তাহিক ছুটি হলেও আমরা শুক্রবারেই সাপ্তাহিক ছুটি পালন করি। এজন্যে শুক্রবার এলেই উইসামকে নিয়ে লেবাননের পথে প্রান্তরে ছুটে বেড়াই। ক্ষুদ্রায়তনের দেশ বলে একই জায়গায় আমরা বারবার গেছি, কিন্তু প্রতিবারই নতুনত্বের স্বাদ পেয়েছি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হলেও লেবানন মরুভূমি নয়। গড়পরতা সবুজময়। আর এই বৈরুতই মধ্যপ্রাচ্যের সর্বাধিক শোভিত শহর। ২৩ বছর শাসন ও শোষণ করে ফ্রান্স দেশটিকে কিছুটা তাদের ধাঁচে তৈরির চেষ্টা করে। জননন্দিত নেতা রফিক হারিরি মাত্র ১২ বছর ক্ষমতায় থেকে লেবাননকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যান। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু গড় আয় ১৯,৪৫০ ইউএস ডলার। মালয়েশিয়ায় দেখেছি– মাহাথির মোহাম্মাদ যেমন জনপ্রিয়, তুরস্কে যেমন দেখেছি কামাল আতাতুর্ক সর্বজন সমাদৃত, একইভাবে রফিক হারিরি লেবাননে সকলের প্রিয়পাত্র। ১০,৪৫০ বর্গ কিলোমিটার সম্পন্ন সংকীর্ণ ভূখন্ডের জনসংখ্যাও সঙ্গতিপূর্ণ, প্রায় ৬০ লাখ (২০১৮)। সুন্নি-শিয়া মিলিয়ে ৫৬% মুসলিম এবং অবশিষ্ট ৪৪% খ্রিস্টান। জনসংখ্যার সাথে সমতা বজায় রেখেই সরকার গঠিত হয়।
এক ছুটির দিনে উইসাম আমাকে নিয়ে ছোটে ব্যালবাকে। রোমান ঐতিহ্যের ধ্বংসাবশেষ। চাকচিক্য এবং জেল্লার কারণে ব্যালবাককে বলা হত জ্যোতি নগরী বা City of Sun চোখে পড়ে, বড় বড় চাঁই পাথরের তৈরি ভবন, গেইট, রঙ্গশালা, হলঘর ইত্যাদি। ব্যালবাক সিরিয়া সীমান্তের গা ঘেঁষা প্রাচীন প্রত্ন নগরী, বৈরুতের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এখানকার দোকানগুলোতে অনেক অপ্রচলিত, লুপ্ত এবং সেকেলে জিনিস পাওয়া যায়। লোভ সংবরণ করতে না পেরে ৭২০০০ এলএল/লেবানিজ লিরা (প্রায় পাঁচ ডলার) দিয়ে আমি একটা ৩৬ ইঞ্চি সোর্ড কিনে ফেলি।
আরেকদিন যাই বিব্লসে। ফিনিশিয়, মিশরিয় এবং রোমান সভ্যতার স্মৃতি বহন করে চলেছে বিব্লস। এখানে রয়েছে ১২শ শতকের ঐতিহাসিক ক্রুসেডার ক্যারল। বিব্লসের অতি নিকটেই রয়েছে জেইতা গ্রোতো। এই স্থানে প্রাচিন, আধুনিকতা এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্য একাকার হয়ে গেছে। ১০ কিলোমিটার ব্যবধানে একইদিনে বিকেলবেলা ফারাইয়া পর্বতে গমন করি। যেখানে ঘরদোর, গাছপালা বরফে ঢাকা পড়ে অভিন্ন সমত্বরণ হয়ে রয়েছে। এদিন ধবল তুষারপাতের ওপর স্কেটিং করার সুযোগ হয়, চড়াই উৎরাইয়ে পেছল খেলে দারুণভাবে সময়টাকে উপভোগ করি।
লেবাননে যুগে যুগে অনেক ধর্মাবতারের আবির্ভাব ঘটেছে। এখানে রয়েছে শীশ নবীর সমাধিস্তম্ভ। এই ক্ষুদ্রায়তনের রাজ্যেই রয়েছে- নূহ নবীর কবর, ইলিয়াসা নবী, ইয়াহিয়া নবীর সমাধিস্থল। বলা হয়ে থাকে, লেবানিজরা স্বর্গের অপ্সরীদের বংশধর। এজন্যে যে, শীশ নবীর জন্ম, উত্থান, অবস্থান, বংশবৃদ্ধি, মৃত্যু এবং সমাধি এই লেবাননেই। তৎকালে উল্লেখিত নবীর বিপরীতে কোন মানবী না থাকায় সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে স্বর্গীয় দূত পূণ্যলোক থেকে একজন অপ্সরী নিয়ে এসে তাঁর সাথে বিয়ে দেন। এ কারণে লেবাননের মেয়ে পুরুষ উভয়েরই অঙ্গসৌষ্ঠব সৌন্দর্যে ভরপুর।
লেবাননে সারা বছরই স্ট্রবেরি, পিচ, আপেল, তীন, কমলালেবু, আঙুর, আলুবোখারা, মাল্টাসহ প্রচুর রসনারোচক ফল জন্মে। তেমনি ঐসব ফলের আবরণের মতোই নরম, মসৃন, কোমল এবং পরকলার মতো স্বচ্ছ, নির্লোম দৃষ্টিনন্দন সেখানকার মেয়েদের ত্বক। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এমনকী মার্কিন মুলুকের মেয়েরাও এতটা সুন্দরী নয়। অ্যারাবিয়ান রমণীদের ঐসব সৌন্দর্যে সহযোগিতার কাজেই প্রয়োজন পড়ে অনুন্নত দেশের মেয়েদের। লেবাননের প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে বাঙালি গৃহ পরিচারিকা। একইকাজে আগত ফিলিপাইন, নেপাল, ভারত এবং ইথিওপিয়ার(আবিসিনিয়া) মেয়েরাও সেখানে রয়েছে।
সমুদ্রের কোল ঘেঁষে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে রাস্তা কেটে বিভিন্ন চড়াই উৎরাইয়ে গড়ে উঠেছে বৈরুত মহানগরীর অধিকাংশ ঘরবাড়ি, মানব বসতি এবং সমাজ-সভ্যতা। সেই পাহাড়েই গায়েই রয়েছে নানাবিধ বনজ এবং ফলজ গাছপালা। লেবানন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আরব দেশে বিভিন্ন প্রকার ফল ফলাদি রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ আয় করে। অন্যতর উপার্জনের উৎস পর্যটন ব্যবস্থা, ব্যাংকিং, বেকারি ও খাদ্যসামগ্রী বিকিকিনি। গিরিগাত্রের লোকালয় পেরিয়ে সামান্য ব্যবধানে সমুদ্রতটেই স্থাপিত এবং সজ্জিত হয়ে আছে শতশত নাইট ক্লাব, সুপার নাইট ক্লাব, বিবিধ পানশালা। বৈরুতে ওয়াইন অবারিত এবং অনাবৃত। তরুণ উইসাম এক সন্ধেয় পরিচিতির জন্যে সেখানে নিয়ে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখায়। নাইট ক্লাবের নাচনেওয়ালি ও সেবাদানকারী মেয়েদের অধিকাংশই রাশান, মরক্কান এবং বাল্টিক অঞ্চলের।
বৈরুত নগরীর জনসাধারণের জীবনযাপন প্যারিসের মত পরিচ্ছন্ন, অগ্রসর, উম্মূক্ত, উদ্দাম এবং বিনোদনমূলক। সেখানকার মতো অনেকটাই মনোরঞ্জনের পর্যাপ্ত উপকরণ থাকার কারণেই হয়ত লেবাননকে মধ্যপ্রাচ্যের প্যারিস বলা হয়ে থাকে।
উইসাম একদিন তার বাড়িতে আমাদের জন্যে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করে। সেখানে গেলে সবার সাথে পরিচয় করে দেয়। একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, তুরস্ক, সিরিয়ার মত লেবাননেও ‘ফাদার’-কে বাবা সন্বোধন করে। দুপুরের খাবারে রুটি, বিরানি, পাঁপড়, কাবাব, আস্ত দুম্বার রোস্টসহ নানা ব্যঞ্জনের মহা আয়োজন করা হয়। ফল ফলারি তো আছেই। সবচাইতে সুস্বাদু এবং মুখরোচক ফল হলো তীন, যা লেবাননে পর্যাপ্ত, বিস্তর এবং সহজলভ্য।
আরবগণ অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তাদের আতিথ্য ভোলা যায় না। নানাস্বাদের খাবার গ্রহণের পর শুরু হয় পরিবারের সবার সাথে বিভিন্ন ফ্লেভারের নারজিলার ধুম্র নির্যাস উপভোগ। তারই সদৃশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশে গুলশান বনানীতে শিসা হিসেবে শৌখিনবাজরা যা উপভোগ করে থাকে।
আমি সেখানে অবস্থানকালে অনেকের বাসায়ই গেছি। আমার এক লেবানিজ সুহৃদ হামদানের মায়ের আতিথেয়তার কথা এখনো মনেপড়ে। আপনি একবার বৈরুতে গেলে তাদের মাধূর্যপূর্ণ আচরণ, নগরীর মোহনীয় সৌন্দর্যমন্ডিত প্রলোভন পুনশ্চ যাবার জন্যে আপনাকে প্রলুব্ধ করবেই।