ঘেরে শংকরবাবু নামে একজন মাছের ডাক্তারও আছেন। সংকরবাবুর সুন্দরী বিদুষী স্ত্রীর নাম শ্রেয়াশ্রী। তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদেরকেও একটি বাড়ি দেয়া হয়েছে। শ্রেয়াশ্রী’র খুব সখ পড়াশোনা করা। সে এমএ পরীক্ষার্থী। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির আঙিনায়, আশেপাশে সে ফুল আর সবজি বাগান গড়ে তুলেছে। শ্রেয়া শুধু রূপবতী তা নয়, সে খুব গুণী মেয়েও। তার হাতের কাজও অসাধারণ। নিজের হাতে মেয়েদের নানা কারুকার্য করা ভ্যানিটি ব্যাগ, জুয়েলারি তৈরি করে সে। কিন্তু লিভারের একধরনের কঠিন অসুখে ভুগছে শ্রেয়া। তাই মাঝেমধ্যেই বিষন্নতা এসে ভর করে তার ডাগর চোখ দুটোতে। এমন সুন্দর সাজানো সংসার, অত্যন্ত কেয়ারি ভালমানুষ স্বামীটিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই শ্রেয়ার দু’চোখ জলে ভরে যায়। মাঝেমধ্যেই একাকী নির্জন দুপুরে প্রবল এক কান্না এসে মিষ্টি স্বভাবের এই মেয়েটিকে ভাসিয়ে দেয়, ডুবিয়ে দেয় দুঃখের সাগরে। জীবন এত সুন্দর; অথচ কত অনিশ্চিত, কত ছোট!
গারোদের একটি বিশেষ প্রিয় পানীয় হলো ‘চৌ’। চৌ হলো বিশেষ ধরনের মদ। এই মদ পরিবেশিত হয় গারোদের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও বিশেষ বিশেষ অতিথিদের জন্য। এই বিশেষ পানীয়টি ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন যেন সম্পূর্ণ হয় না তাদের। রান্না করা সাদা ভাত বিশেষভাবে তৈরি একটি ভেষজ পথ্যের সংমিশ্রণ করে শুকনা হাড়িতে রেখে কলা পাতা দিয়ে ঢেকে মাটির তলায় সপ্তাহ খানেকের জন্য রেখে দেয়া হয়। সাতদিন পর মাটির নীচ থেকে তুলে সেই গলে যাওয়া গাঁজানো ভাত পানি দিয়ে ঘোটানোর পর তরল পদার্থটুকু থিতু হবার জন্য কিছুক্ষণ রেখে দিতে হয়। এভাবেই তৈরি হয়ে গেল চৌ মদ। পরে উপরের তরলটুকু ছেকে নিয়ে সুদৃশ্য জার ও পেয়ালায় সেই চৌ মদ পরিবেশন করা হয়।
গারোদের প্রিয় খাবার হলো শামুক, কুইচ্চা মাছ আর শুকরের মাংস। খারি তরকারি গারোদের একটি বিশেষভাবে রান্না করা তরকারি। খারি তরকারি রান্না হয় তেল ছাড়া। খানিকটা খাবার সোডা, হালকা মসলা, কাঁচা মরিচ দিয়ে রান্না এই তরকারি যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত।
শশীপল্লী’র প্রতিটি রাত, প্রতিটি দিন এক অনবদ্য সৌন্দর্য আর মুগ্ধতা নিয়ে আমাকে বিস্মিত ও অভিভূত করেছে। এর প্রতিটি সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা আর রাত্রি তাদের আলাদা আলাদা রূপ, রস আর গন্ধ নিয়ে আমাকে বিমোহিত করে তুলেছে।
ইচ্ছে করছে সকালের কুয়াশা মাখা সবুজ ঘাস, কুসুম রঙা সূর্যোদয়, ঘুঘু আর ঝিঁঝিঁ ডাকা ঝিম ধরা দুপুর, মনোরম গোধূলিরঙা বিকেল, মোহময়ী সন্ধ্যা আর গুরুগম্ভীর রাত এই সমস্ত কিছু নিয়েই দু’হাত দিয়ে এই প্রকৃতিকে আকড়ে ধরি, গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরি একান্ত নিজের করে। এ যেন খুব নিজের, খুব চেনা, খুব আপন এক ভুবন।
শশীপল্লীতে এসে পরিচয় হলো একদল ক্ষুদে সঙ্গীত শিল্পীর সাথে। এরা হলো কয়েক জন গারো শিশু। তাদের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, সরলতা, কৌতূহলী চাহনি অচিরেই মন কেড়ে নিল আমাদের। শামীম জানাল, এই ক্ষুদে শিল্পীদের আজ বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে আমাদেরকে গান শোনানোর জন্য। দেখলাম, শিল্পীরাও উশখুশ করছে গান পরিবেশন করার জন্য। আমরা বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে বসলাম। শিল্পীত্রয় বসলো উঠোনের শেষপ্রান্তের সানবাঁধানো উঁচু বেদীতে। একে একে গান শুরু করলো ‘প্রথমা’, তার ছোট বোন ‘স্নেহা’ এবং সবশেষে ‘অথরা’। তারপর আমাদের বিশেষতাদের পরিবেশিত গানগুলো মূলত প্রভু যীশুর বন্দনা সংগীত। এই গানগুলো তারা শিখেছে তাদের স্কুল থেকে। তারা গারো ভাষার সংগীত ও নাচেও বেশ পারদর্শী। সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী ‘অথরা’। তার অদ্ভুত রকমের আলোর দ্যুতি ঝরানো চোখদুটো আমাকে প্রিয় শিল্পীবন্ধু ‘ফাতেমা তুজ জোহরা’র কথা মনে করিয়ে দিল। কী অসাধারণ সেই চোখ! সেই বোঁচা নাক, ঠোঁটে চাপা মাদকতাময় হাসি। আমি প্রথমবার অথরাকে দেখেই বলে উঠলাম, ‘কী আশ্চর্য, এ যে দেখছি আমাদের ‘ফাতেমা তুজ জোহরা’! তারপর যত বারই অথরাকে গান গাইতে বলি, আমি ঘোষণায় শুধু বলি, ‘এবারে আমাদের গান গেয়ে শোনাবে শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা।’ অমনি ঘুমঘুম রহস্যময় সেই চোখ দুটো তুলে ঠোঁট সুঁচালো করে গান শুরু করে দেয় অথরা। ততদিনে সে জেনে গেছে ফাতেমা তুজ জোহরা তার উপহার পাওয়া নাম। আমরা যত দিন শশীপল্লীতে ছিলাম, এই শিল্পীরা আমাদের প্রচুর গান শুনিয়েছে, নাচ দেখিয়েছে। কখনও একক গান ও নাচ, কখনও সমবেত গান ও নাচ। তবে চুপিচুপি বলে রাখা ভাল, এই নাচ ও গানের পর সন্মানী না দিলে শিল্পীরা কিন্তু খুব মর্মাহত হয়। নাচ দেখানো ও গান শোনানোর এত উৎসাহের পেছনে সন্মানী পাওয়াও শিল্পীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। তাদেরকে খাবারের জন্য দাওয়াত করলে তারা তখন খুব সেজেগুজে জমকাল পোশাক পরে মাথায় ফুল গুঁজে বেড়াতে আসতো। খাবার খেতো খুব পরিপাটি করে।
বিদায় নেয়ার কাল সমাগত। আগামীকাল বিদায় নেব এই সবুজ অরণ্য থেকে, পাখির কলকাকলি মুখরিত গানের ভুবন থেকে। ফিরে যেতে হবে রাজধানী ঢাকায়। তারপর সেখান থেকে পৃথিবীর রাজধানী নিউইয়র্কে। মহানগরী ঢাকা একদা ছিল আমার অতি প্রিয় শহর। যার বর্তমান ধূলিধূসরিত রূপ আমাকে একধরনের আক্ষেপ আর বিষন্নতায় আচ্ছন্ন করে তোলে।
যদিও ক্রমশ রাজধানী ঢাকা এখন তার ডালপালা ছড়িয়ে চারিদিকে বিস্তৃত হচ্ছে, বাড়ছে এর আয়তন। ঢাকার বুকে বসছে মেট্রোরেল। অদূর ভবিষ্যতে হুইসেল বাজিয়ে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে যাবে জীবন্ত সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে দুরন্ত গতির মেট্রোরেল। আশা করি তাতে মানুষের দুর্ভোগ অনেক কমে যাবে। কিন্তু তবুও ঢাকার এই বড় হওয়া, উঁচু হওয়া, ছুটে চলা আমাকে মুগ্ধ করে না। কারণ রাজধানীকে কেন্দ্র করে যে বিশাল জনস্রোত, তাকে ধারণ করার মতো জায়গা, শক্তি এই শহরটির নেই। ঢাকাকে দেখে আমার বড় মায়া হয়; মনে হয় প্রতিটি মূহুর্তে যেন ধুঁকছে এই নগরী। বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মিলিত গরম নিঃশ্বাসে যেন উষ্ণ হয়ে উঠেছে এর প্রাণবায়ু। জনতার প্রবল চাপে এর প্রাণ ওষ্ঠাগত। নির্মাণের খোঁড়াখুঁড়ি, গাড়ির কালো ধোঁয়ায়, বিষাক্ত বাতাসে নাভিশ্বাস উঠছে একদার তিলোত্তমা নগরীর। কেউ শুনছে না তার আর্তনাদ, তার গগণবিদারী চিৎকার। আমাকে বাঁচাও; এই তীব্র আকুতিমাখা আবেদনে কেউ কি সাড়া দেবে? কোথায় আমাদের নগরপিতা?
শহরমুখী জীবিকার সন্ধানে ধেয়ে চলা এই মানুষগুলো যদি স্ব-স্ব বাড়িতে থেকে সকালে একমুঠো গরম ভাত, গরম ডাল আর উঠোনের এক কোণার বেগুনগাছের ঝোপ থেকে দুটো বেগুন পুড়িয়ে হাতে ডলা ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে কাজে যেতে পারত, রাতে বাড়ি ফিরে আসত আম কাঁঠালের ছায়া ঘেরা নিজের বাপ-দাদা’র ভিটের বসত বাড়িটিতে— তাহলে জীবন কতই না সুখের হতো। শহরের বিশাল চাকচিক্যময় অট্টালিকার পাশে ঝুপরির জীবন থেকে যে এই জীবন অনেক আনন্দের, অনেক গর্বের, অনেক অহংকারের হতো সন্দেহ নেই!
তবুও জীবন কোথাও থমকে নেই; ছুটে চলার নাম-ই তো জীবন। কেউ ছুটছে দুরন্ত বাঘের পিঠে, কেউ ঘোরায় চড়ে, কেউ গরুর গাড়িতে, কেউ গাধার পিঠে, কারওবা শ্রীচরণই ভরসা। কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়, কেউ মাঝপথে বসে পড়ে, কেউ কেউ বিজয় নিশান তুলে আগে আগে চলে।
এদের সবার মতো আমিও এই পৃথিবীর এক পরিব্রাজক। আমার শ্রীচরনই ভরসা। আমি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে কেবল হেঁটে চলেছি। কখনও কোনো ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে মন চায়নি; তাই এই চলায় ক্লান্তি আসেনি। না পাওয়ার বেদনা বা হতাশা এসে বিশাল অজগরের মতো গিলে খেতে পারেনি আমার মনের ‘সুখপাখি’-টাকে। এ এক আনন্দময় যাত্রা। বারবার ফিরে আসব বলেই; যেতে চাই বহু, বহুদূরে! আমার এই পথ পরিক্রমায় দু’চোখ মেলে ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই অপরূপ এই পৃথিবীকে। ইচ্ছে করে বোহেমিয়ান হয়ে পথে পথে ঘুরব; তাইতো যাযাবর জীবন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। কিন্তু মাটির ঘরের স্নিগ্ধ ছায়াতে বারবার ফিরে আসব জেনেই আমি পথকে ভালবেসেছি।
আজ দিনটি শুরু হয়েছিল আশ্চর্য সুন্দর হয়ে। গতরাতে প্রচন্ড ঝড় আর বৃষ্টি হয়ে আজকের দিনটি যেন স্নিগ্ধ সৌন্দর্য ধারণ করেছে। আজ ঘুম ভেঙেছে খুব সাতসকালে। বাইরে হাঁটতে বেরিয়ে সমস্ত শরীর যেন জুড়িয়ে গেল। সকালের ঠান্ডা, শিরশিরে ফাল্গুনের হাওয়া। গাছেগাছে কোকিল ডাকছে। সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঐক্যতান। এরা দেখছি সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায় বিরতিহীন ডেকেই চলেছে। সম্ভবত এরাই বনের মিউজিশিয়ান। কোকিল, ঘুঘু, শালিক বা ময়নার গানের সাথে এরা অর্কেস্ট্রা বাজায়। তানপুরায় সুর তোলে। আমি গায়ক নই, তাই তাল, লয়, মাত্রা, সুর বা শোম ধরতে পারিনে। আমার জায়গায় ফাতেমা তুজ জোহরা আপু হলে ঠিক ঠিক বলে দিত। গানের ভুবনে তিনি একজন পাকা জহুরী। তিনি অন্তর দিয়ে গান করেন। তাই চোখ বুজেও তিনি বাতাসের উত্তাপ, গন্ধ শুঁকে দিন-রাত্রির প্রহর বলে দিতে পারেন। তিনি সকালবেলার সংগীত বিকেলে বা রাতে পরিবেশন করতে পছন্দ করেন না। পাখিদের রাজ্যেও দেখছি সঙ্গীতের একই নিয়ম। ঘুঘু সম্ভবত দুপুরের শিল্পী। সে কেবল ঝিমধরা দুপুরেই সুর তোলে।
যাই হোক, গত রাতের গ্রামীণ ঝড়ের আসল রূপটি দেখলাম। বাতাসের তোড় শুরু হতেই বিজলি চলে গেল। বাইরে নিকষ কালো রাত। প্রচন্ড ঝড়ের গর্জন। মুষলধারে বৃষ্টি, ক্ষণক্ষণে বিদ্যুৎ-এর চমক। টিনের চালে গাছের ডালের আন্দোলন, বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিল। বাতাসের হুইসেল শুনে আলমগীর কবীরের ‘সীমানা পেরিয়ে’ সিনেমার ঝড়ের সিকোয়েন্সের কথা মনে পড়ছিল। বাতাসের শোঁ-শোঁ, বৃষ্টিফোঁটার কলকল শব্দে ভয় হচ্ছিল; জলোচ্ছ্বাস হবে নাতো?