শিল্পী ও শিল্পের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন


শেখ শরীফের ভাবনা

শিল্পী ও শিল্পের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন


কবিতা উচ্চাঙ্গের শিল্পকর্ম এতে কোন সন্দেহ নেই। কবিতার পাঠ একদিকে যেমন হৃদয়গ্রাহী ঠিক তেমনিভাবে কবিতার উপাদান আর অনুষঙ্গ একজন পাঠকে নিয়ে যায় ভাবনার  অতলান্তিতে। একজন কবিতাপ্রেমি কবিতার স্বাদ গ্রহণ করতে গিয়ে কবিতার দৈহিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে তিনি যে তৃপ্তি অনুভব করেন তা তাকে স্বর্গীয় সুখ দিতে পারে। আবার একজন কবি কবিতা লেখার ক্ষেত্রে বিখ্যাত হবার লোভে যেমন লেখেন না ঠিক তেমনি শুধু নিজের মানসিক তৃপ্তির জন্যও লেখেন না। বরং তিনি তাঁর চিন্তার জগতকে জানান দিতে চান বিশ্বমানুষের মনের সাথে। ফলে তিনি যা ভাবেন তা তিনি ভাষার সাঁচে ফেলে রূপদান করতে চান। কেননা আমাদের মনের ভেতরে এখন এই বোধ দানা বেঁধেছে যে মনের প্রকাশভঙ্গির পদ্য ছন্দের রূপায়নই কবিতা। কবিতা শিল্পের একটি জটিল প্রক্রিয়ার নাম। যে প্রক্রিয়ায় সত্যিকারের শিল্পীর কোন মুক্তি নেই। কেননা তাকে শিল্পের শুদ্ধতার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হোক আর নাই হোক নিজের তৃপ্তির জন্য লিখলেও সব লেখাকেই তিনি শিল্পিত লেখা বলতে পারেন না। আর সে কারণেই হয়তো জীবনানন্দ দাশ যে উপন্যাসগুলো লিখেছিলেন সেগুলো আর কোনদিন প্রকাশ করেননি বরং ট্রাঙ্ক ভর্তি করে বছরের পর বছর রেখে দিয়েছিলেন। তিনি যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তাই হয়তো হোরেসের উপদেশ মনে রেখেছিলেন। হোরেসের উপদেশবাণী ছিলো কোন লেখাকে প্রকাশের পূর্বে নয় বছর ধরে পরিচর্যা করতে হবে। এখান থেকে বোঝা যায় লেখাকে তিনি কতটা পরিশীলিত করে তুলতে বলেছেন। হেলাফেলায় আর যাই হোক সাহিত্যচর্চা যে করা যায় না তা বোঝা যায়। কবি সৈয়দ শামসুল হক যখন লিখতে বসতেন তখন পরিশুদ্ধ হয়ে, সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পড়ে, সুগন্ধি মেখে, সবচেয়ে দামি কাগজে কলম দিয়ে লিখতেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক জীবনে একটি লেখাও লেখেন নি কিন্তু তিনি এমন শিষ্য তৈরি করেছেন যাঁরা তাঁকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। আহমদ ছফা ফাউস্ট অনুবাদ করার জন্য আগে বারো বছর ধরে জার্মান ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করেছেন তারপর বারো বছর ধরে ফাউস্ট জার্মান থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন।  ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক যখন বুঝতে পেরেছেন তাঁর লেখা এক রকমের হয়ে যাচ্ছে তখন তিনি লেখা বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যা লিখবার তা আমার হয়ে গেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কোন লেখা লেখার পর বার বার ঘসা-মাজা করতেন। শব্দকে উপযুক্ত স্থানে বসাতে তাঁর চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলো না। রবীন্দ্রনাথ সন্দেহাতীতভাবে প্রতিভাবান এবং সৃজনশীল সাহিত্যিক। তিনি কোন কোন  শব্দকে কেটে আবার সেই শব্দ দিয়ে শিল্পীত মনে ছবি এঁকেছেন। যদিও তাঁর অসংখ্য গান আর ছোট গল্প আছে যেগুলো একই ধাঁচের, একই বিষয় কেন্দ্রিক। আবার কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়লে আর প্রবন্ধ পাঠ করার তেমন দরকার হয় না আবার প্রবন্ধ পড়লে কবিতার বিষয়ের স্বাদ পাওয়া যায়। ওমর আলীরর অসংখ্য কবিতা আছে যেগুলোর  বিষয় একই, উপাদান একই, এমনকি চিন্তা সূত্র একই। জীবননান্দ দাশ প্রকৃতিকে যেভাবে কবিতায় এনেছেন সেখানে প্রকৃতির কোন উপাদানকে কবিতায় বাদ দেওয়া যায় না। তারপরেও তারও অসংখ্য কবিতা আছে যে কতিগুলোতে একই অনুষঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বার বার এসেছে। এখানে তাঁর বোধ প্রকৃতি নিয়ে আলাদা আলাদো ভাবে কাজ করেছে।

অবশ্য এমন লেখকও আছেন যারা লেখার পর কখন প্রকাশ করবেন এর চিন্তায় বিভোর থাকেন। সেখানে কবিতাকে নিখুঁতভাবে গড়ে তোলার সময় নেই  অনেকখানি মোহের ঘোর কাজ করে তাদের মধ্যে। রাতারাতি কবি বা ঔপন্যাসিক তকমা পাবার লোভে কে কতগুলো বই প্রকাশ করতে পারেন সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তবে আশার কথা হচ্ছে তাঁরা লিখছে এবং বই আকারে প্রকাশ করছে। তবে এই ক্ষেত্রে বোধহয় হোরেসের উপদেশ মনে করা যেতে পারে। আর তা হচ্ছে তিনি উপদেশ দিয়েছেন এই ভাবে, “ যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে লিখিয়া দেশের বা মনুষ্য জাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।”  সেই বোধ থেকেই হয়তো তাঁরা লেখেন বা লিখে যাচ্ছেন। আবার নিজের টাকা খরচ করে বইও প্রকাশ করছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক সাহিত্যের যে মাধ্যমই হোক না কেন লেখবার রুচি আর পাঠক তৈরির রুচি লেখকের হাতে। কেননা লেখক যে রকম লিখবেন পাঠক সেরকম করেই আপনাকে গ্রহণ করবে। বাজারে অনেকে লেখক আছেন যারা লিখেছেন অঢেল এবং পাঠক তাঁদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বীধামাত্র করবেন না আমরা তা জানি। কিন্তু সেই লেখক যদি ইচ্ছা করতেন তিনি সারা জীবন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র মতো কম লিখবেন কিন্তু যুগের পর যুগ তাকে নিয়ে পাঠকরা কথা বলবে। তাহলে কেমন হতো? পাঠককে শুধু শুধু একটা মিথ্যা ঘোরের মধ্যে রেখে দেওয়া পাপ নয় কি? কিংবা তিনি যে তার জীবনের মূল্যবান সময়টি এক ধরনের মিথ্যা স্বপ্নের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছেন এবং বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ করার  চেষ্টা করছেন তার কী হবে।  একজন সমালোচক হিসেবে হয়তো আমি কাউকে লেখার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে পারি নে কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে আমি একটা ভালো বই চাই। যে বইটি আমার অর্ন্তলোকের সন্ধান দিবে। আমার মনের ভেতরে গিয়ে সজরে আঘাত করবে।  আমার শরীরের রোমকূপকে শিহরিত করে তুলবে। সময়ের সাথে নাথে কিংবা যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুনত্বকে গ্রহণ করার জন্য মনের ভেতরে পরিবেশ তৈরি হবে। কিন্তু মন যদি পড়ে থাকে পুরাতন শিল্প কিংবা লেখার প্রতি তাহলে কি বলবো পাঠক হিসেবে আমরা পুরাতন নাকি বলবো সে রকম ভালো বই পাচ্ছি না এ সময়ে। কিংবা ভালো লেখক তৈরি হচ্ছে না। এ দায়টা কার। বাজারে লক্ষ লক্ষ বই কিন্তু তার বেশির ভাগ ষাটের দশক, সত্তর দশক, কিংবা আশির দশকের লেখকরা স্থান করে রেখেছেন। তাঁরা তাও ধরে রেখেছেন তাঁদের সেই প্রথম যৌবনের সৃষ্টি দিয়ে। আর আজ যা সৃষ্টি করছেন তা যেন প্রথম যৌবনের অনুরূপ। প্রথমকে অতিক্রম করার শক্তি যেন তাঁরা হারিয়ে ফেলছেন। যদি তাঁরা কলমকে থামিয়ে দিয়ে দেখেন যে তাঁরা কী লিখছেন এবং আগের লেখার সাথে বর্তমানের লেখার পার্থক্য কই তাহলে হয়তো তাঁরা নিজেরাই সেটা ধরতে পারবেন। যদিও আশি বছর বয়সেও রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তাও তাতে শিল্পীত রবীন্দ্রনাথের চিত্র ধরা পড়ে। প্রকৃত শিল্পীর বা  শিল্পীর হয়তো ঐ এক বড় গুণ যা লেখেন সেখানেই সোনা ফলে। অবশ্য আরেকটি বিষয় খুব ভালো লাগছে এটা ভেবে যে, যেকোন ব্যক্তিরই ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে তিনি লিখবেন কি লিখবেন না এটা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপারা। এ ব্যাপারে কারো নাক গলানো চলে না। কিন্তু নাক হয়তো গলানো যায় না কিন্তু আলোচনা বা সমালোচনা করার অধিকার থেকে কেউ তো  বঞ্চিত করতে পারে না। একজন লেখক হয়তো মেঘের সৌন্দর্য দেখাতে চান তাতে যদি মেঘের সাথে রামধনুকে দেখাতে পারেন বা মেঘের নানা রঙকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারেন কিংবা সাদা ঘোড়ার স্রোতকে দেখাতে পারেন তাতে মন্দ কী। আর একজন লেখক সত্যিই যদি শুধু কলমের খোঁচায় একটি লাইন লিখে বুঝাতে চান এটি তাঁর কবিতা তা পাঠক হিসেবে পাঠোদ্ধার করা কতটা কষ্টসাধ্য হয়তো যিনি পাঠ করবেন তার চেয়ে আর কেউ এ বিষয়টি ভালো বুঝবেন না। আর যিনি এমন এক লাইনের কবিতাকে কবিতা বলছেন তিনি কোন দৃষ্টিকোন থেকে কবিতা বলছেন তিনিই ভালো জানেন। অবশ্য হাইকু হলেও তো তিন লাইনের দরকার। কিংবা রুবাইয়াত হলেও চার লাইন। তাই বলে এক লাইনের কবিতা। ভাববার বিষয়। প্রতিষ্ঠিত কোন লেখক যখন এই ধরনের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন তখন পাঠকের রুচিকে কতটা তিনি বিকৃতি বা কবিতার প্রতি বিরাগভাজন করে তৈরি করেন তা বোঝা যায়।  আবার তদবির করে লেখা প্রকাশ কিংবা যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক আছেন তাঁদের লেখাই প্রকাশ করতে হবে এটাও কতখানি যুক্তিপূর্ণ সে বিষয়টিও ভেবে দেখো যেতে পারে। আর প্রতিষ্ঠিত লেখক যে লেখা লেখেন তাঁর তো লেখার অনেক প্লাটফর্ম আছে তাহলে যারা নতুন লিখেন তারা কোথায় লিখবেন। যদি এমন হয় তারা ছাড়া আর কেউ লিখবেন না তাহলে তো কথা নেই । বিশ্বদ্যিালয়ের যে জার্নালগুলো বের হয় সেখানে যে লেখাগুলো প্রকাশ করা হয় তাঁর বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য। সেখানে অপরিচিত কোন লেখক লেখা দিলে সে লেখা আর আলোর মুখ দেখে না। কিংবা কোন অপরিচিত লেখকের লেখা প্রকাশ করলেও দেখা যায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নাম যৌথভাবে নাম দিয়ে লেখা প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ যাঁদের নাম ব্যবহার করা হয় তাঁরা একটি বর্ণও লেখেন না। হয়তো সামান্য একটা কিংবা দুটো তথ্যসূত্র ঠিক করে দিয়েই মূল লেখার ভাগিদার বনে যান। অথচ যাঁরা লেখেন সে লেখাগুলোতেও খুব একটা সৃজনীশক্তি নেই। অযৌক্তিক উদ্ধৃতি পর উদ্ধৃতি দিতে দিতে লেখা হয়ে পড়ে বৃদ্ধ। সেই সাথে চিন্তার খোরাক সেখানে পাওয়া যায় না বললেই চলে। এই হলো জার্নালের অবস্থা। আর সস্তা কবিতার কথা কী বলবো। কবিতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হতে হতে কবিতার তো বারোটা বেজেছে। কবিতা পড়তে গেলে এখন ফিজিক্স, রসায়ন, বায়োলজির সব থিউরি আগে বুঝতে হবে তারপর কবিতা পাঠ করতে হবে। সাথে এক্সপার্ট হতে হবে চিহ্ন নিয়ে। কোন চিহ্ন কোন ধরনের অর্থ প্রকাশ করে তা রাখতে হবে নখদর্পণে। কবিতা হচ্ছে এখন গণিতের সংখ্যার ভাষায়। বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার নিয়ে নয়। সেই আর একদল কবিতার পরীক্ষক আছেন তাঁরা দাবি করেন সহজ কোন শব্দের প্রয়োগ করবেন না। বরং তাঁরা কবিতা লিখবেন বাংলা অভিধানের সবচেয়ে কঠিন আর তৎসম শব্দ প্রয়োগ করে। যেন পাঠক কবিতারর ভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়ে বলতে বাধ্য হন নতুন আঙ্গিকের কবিতা। বলতে বাধ্য হন কী শব্দের গাঁথুনি। একেবারে নতুন আলপানা। আবার সেইসাথে পাঠক তাঁদের সবচেয় ভালো কবিও বলবেন। এবং তাঁেক আবিষ্কার করবে উত্তরাধুনিক সময়ের যোগ্য কবি বলে। অথচ শিল্পের বিচারে আমরা কতটুকু আধুনিকতাকে ধারণ করতে পারি সেটাই এখন ভাববার বিষয়। কেননা পশ্চিমা বিশ্ব যখন আধুনিকতার জয়গান গেয়েছেন কিংবা শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, জীবন যাপনে আধুনিকতাকে স্পর্শ করতে পেরছে সেখানে আমরা কতটুকু তাকে ধারণ করতে পারছি কিংবা এখনও পেরেছি।

শিল্পের শুদ্ধতার প্রশ্ন অনেক পরের। কিন্তু কী লিখছি কেন লিখছি এ প্রশ্ন বোধ হয় মাথায় নিয়ে লেখার প্রাসঙ্গিকতা কাজে দিবে। যদিও শিল্পের জন্য শিল্প কিংবা জীবনের জন্য শিল্প এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা এখন অপ্রাসঙ্গিক। কেনানা রণেশ দাশগুপ্তরা এই বিষয়গুলো নিয়ে ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে’ বইয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন। আমাদের ভাবা উচিত ইউরোপে আধুনিকতা কত সালে এসেছে আর আমাদের এখানে সেই আধুনিকতার জোয়ার কত সালে এসেছে। ইচ্ছামতো কবিতায় কঠিন শব্দ আরোপ করে দিলাম আর বললাম- অসাধারণ হয়েছে, চমৎকার হয়েছে এমন মারহাবা দেবার আগে যে শব্দগুলোকে খুলে ফেলা যায় সেগুলোকে খুলে ফেলে কবিতার শরীরকে দেখা হোক কবিতায় কী থাকে। আরোপিত শব্দ নিয়ে আর অলঙ্কার নিয়ে কবিতা হয় না বা হতে পারে না। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা থেকে একটি শব্দও সরে ফেললে তার কবিতার মূল চিন্তা ঠিক থাকবে না। অথবা জসীম উদ্দীনের ‘পল্লীজননী’ কিংবা ‘কবর’ কবিতাও ঠিক একই ধরনের। আজকের সময়ে যে কাব্যগ্রন্থগুলো প্রকাশিত হচ্ছে বা প্রকাশ করা হচ্ছে সেগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। বা পাঠক ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? এমন কি হতে পারে না একটি কবিতা প্রকাশিত হবে এক বছরে লেখক বেঁচে থাকবেন সেই একটি কবিতার জন্য। কবিকে ঐ একটি কবিতার জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সেই কবিতা হবে ‘এ দেশের শ্যামল রঙ রমনীর সুনাম শুনেছি’ কিংবা ‘আজো বাতাসে লাশের গন্ধ পাই’ কিংবা ‘কোন এক মাকে’ কবিতার মতো কবিতা। কবিতা আনবে বিপ্লব, কবিতা আনবে সমাজের পরিবর্তন, কবিতা করবে পাঠকের রুচির পরিবর্তন। কবিতায় পাঠক পাবে সমাজের, দেশের, রাষ্ট্রের, সমাজের, অর্থ ব্যবস্থার, রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। কবিতা যদিও এই দায়িত্বগুলো নেয়নি কিন্তু কবিতাতো এই দায়িত্বগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারে না। ইজমের যুগ শেষ। এক্সপ্রেশিনিজম, সুপার ন্যাচারালিজম, কিউবিজম, ফবিজম, এগজিস্টটেনসিয়ালিজম, স্ট্রাকচারিলজম ছাড়াও আরো নানা ইজমের পিছনে আমরা না বুঝেই কবিতায় ব্যবহার করছি। ত্রিশের দশকের কবিরা যদিও এগুলোর সফল ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু আজকের কবিতায় তা আমাদের কবিগণ কতটা ব্যবহার করতে পারছেন। মিথ্যা শব্দের খচখচানি কবিতাকে প্রতিনিয়ত করে তুলছে অভিধান নির্ভর। নাকি কবিগণ আগাম কোন কিছু দেখতে পারছেন যে পরবর্তী প্রজন্ম যারা কবিতা লিখতে আসবেন তারা এমন অভিধান নির্ভর শব্দ কবিতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবেন। আর এটা ভেবে তাঁরা এমন কবিতায় শব্দ ব্যবহার শুরু করেছেন। আর যদি তাঁরা তা না লেখেন তবে কালের গর্ভে তাঁরা হারিয়ে যেতে পারেন।  কিন্তু তাঁরা বোধহয় একটি বিষয় ভুলে গেছেন যে মানুষের মুখের ভাষা নিয়ে কাব্যচর্চা করলে সেই বিষয়টিই পাঠক প্রিয়তা লাভ করে। তবে কবিতা কিংবা শিল্প সাহিত্যে পাঠক প্রিয়তার বিষয়টি প্রশ্ন সাপেক্ষ। কেননা আমরা কোনটি জাত আর কোনটি অজাত এখনও বুঝে উঠতে সক্ষমতা অর্জন করি নি। এখন কোন লেখক যদি শুধু নিজের জন্যই কাব্যচর্চা করেন এবং বৃদ্ধ বয়সে সেগুলো নিজে নিজে পড়ে সময় কাটাবেন তাহলে তো কোন কথাই নেই। কেননা ‘ভাষা মানুষের মুখ থেক কলমের মুখে আসে। উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।’ প্রমথ চৌধুরী এমনটি বলেছিলেন। যদিও তিনি এভাবে বলেছিলেন কিন্তু তিনি নিজেও কিন্তু এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেন নি। বরং তাঁর প্রবন্ধ পাঠ করলে ভাষার কাঠিন্য চোখে পড়ে। যাহোক সত্য ঠিক এটাই যে কবিতা প্রচলিত শব্দে হলে তো দোষের কিছু থাকে না বরং সেখানেই একজন কবির সার্থকতা নিহিত থাকে। আল মাহমুদ দেখিয়েছেন সেই পারঙ্গমতার ক্ষেত্রটি তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোতে। আরো অনেক কবি আছেন যাঁরা এই ধারাটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছেন।

তবে বর্তমান সময়ে যে কবিতার ক্ষেত্রে একটি শূন্যতাবোধ কাজ করছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অনেক কবি হয়তো বিষয়টি স্বীকার করতে দ্বীধা করবেন না। কেননা তাঁরা কোন নতুন বই প্রকাশ করার পর কতটুকু পাঠকের কাছে সারা পাচ্ছেন সে বিষয়টি তাঁদের চেয়ে আর কেউ ভালো বলতে পারবে না। আপত অর্থে তাঁরা হয়তো মুখ ঘুরিয়ে বলবেন বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁরা ভালো সারা পেয়েছেন। কিন্তু যে অর্থে কবিতা নিয়ে কথা হবার কথা তা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। কবিতা কী তাহলে লেজুরবৃত্তি হয়ে যাচ্ছে? কবিতা লেখা কী তাহলে সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে? কবিতার কী কোন যোগ্য পাঠক তৈরি হচ্ছে না? পাঠক কী তাঁর রুচিকে সব রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ কিংবা আবৃত্তির কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন? সঠিক উত্তর পাওয়া মুশকিল। কেননা কবিতার মানদণ্ড আমরা যে অর্থে বিচার করি তা আর সে স্থলে নেই। এখন কোন কবি কবিতা লেখার পর তার প্রেক্ষাপট কিংবা চিন্তন দক্ষতার স্তর নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে কবি যে কবিতার ব্যাখ্যা দেন সত্যি তা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। আবার কোন কোন কবি হয়তো বলেই বসেন কবির কাজ কবিতা ব্যাখ্যা করা নয় তার জন্য পাঠক আছেন। তারা তার বিভিন্ন  ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন। কবি লিখেছেন এটাই তাঁর কাজ। কবি রফিক আজাদ ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো’ এই কবিতা যতটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে অন্য কবিতাগুলো পাঠক আর অনুসন্ধান করেনি। রফিক আজাদ বলেছেন এই কবিতা ছাড়াও তাঁর আরো অনেক ভালো কবিতা আছে যেগুলো নিয়ে পাঠক বা সমালোচক তেমন কোন আলোচনা বা সমালোচনা করেননি। তাহলে আমরা পাঠক হিসেবে বা সমালোচক হিসেবে যে উচ্চতর রুচির অধিকারী নই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কেননা আমরা বাংলা সিনেমার এক ডায়ালগ আর পারিবারিক অশান্তি কিংবা প্রেমের বাইরে এসে কিছু ভাবতে শিখিনি। কিংবা হিন্দি সিরিয়াল দেখে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করতে আমরা ওস্তাত। অথবা সস্তা প্রেমের কাহিনীর সাহিত্য কিংবা আজকের যুগে কোন এক লেখকের বাইরেও যে আরো অনেক ভালো বই কিংবা লেখা থাকতে পারে তাঁর অনুসন্ধান থেকে আমরা বিরত থাকার চেষ্টা করি। এটা আমাদের স্বভাব। কারণ আমরা বাঙালিরা অতিশয় ভোজন রসিক এবং অলসতা পছন্দ করি। যাঁরা প্রকাশনা সংস্থার সাথে জড়িত আছেন কিংবা ক্লাসিক লেখার অনুসন্ধান করেন তাঁরা বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিপ্টের জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারেন। তাছাড়া বৎসর জুড়েই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভালো গল্প কবিতা কিংবা উপন্যাসের বই বাজারে ছাপতে পারেন। এ জন্য কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তাহলে বৎসরে যে বইগুলো প্রকাশিত হবে ঐ বইগুলো নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় প্রদর্শনী এবং বিক্রি হবে। তাহলে মেলার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির দরকার হবে না। আর বইয়ের বাজারে আলতু ফালতু বই দিয়ে বাজার ভরে যাবে না। সেই সাথে যিনি লিখবেন তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লিখে জীবিকা উপার্জন করার মানসিকতা রাখবেন। নচেৎ তিনি লিখবেন না। এই ক্ষেত্রে পাঠকরাও ভুল বই বাছাই থেকে বিরত থাকতে পারবে। আবার যিনি লিখবেন তিনিও সময় নিয়ে সময় নিয়ে কলম চালাবেন। যা মনে আসে তাই লিখবেন না। লিখলেও ঘসামাজা করে তারপর বাজারে দিবেন। যা তখন তৈরি হবে মাস্টারপিস আহমদ ছফার ফাউস্ট কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ কিংবা ‘চিলেকোঠার সিপাই’ এর মতো। তখন হয়তো আর কেউ শিল্পীর শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না। কারণ পাঠকের সময় নষ্ট করা রীতিমতো অপরাধের সামিল।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

ভাত ও ভাতার

এ ঘরে সর্বসাকুল্যে দুইটা মাত্র মুখ। মা ও মেয়ে। মেয়ের নাম নাজমা। মায়ের কোনো নাম নেই। বয়স হলে মায়েদের নাম

হাসির গল্প

আমাদেরটাই পথ দেখাল

রহিম শেখ খুবই অসাবধান। আজ এটা ভাঙে, কাল ওটা হারায়। এজন্য বউ তাকে অনেক বকে। কিন্তু এতো বকেও বউ তাকে

সহজ

আমার এ গান কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে– আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে– তবুও হৃদয়ে গান আসে!