“কদম্বিনি মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই”– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছোট গল্প বাংলা সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ গদ্য শাখা। একজন লেখক ছোট্ট একটা কাহিনীর বর্ণনাধর্মী বিশ্লেষণ এবং সম্পর্কিত এক বা একাধিক চরিত্র নিয়ে যে প্লট তৈরি করেন সেটি-ই ছোট গল্প। বলা হয়ে থাকে বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প হল সবচেয়ে আধুনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের পথযাত্রা এর পূর্বেও কয়েকটা ছোট গল্প কয়েকজন লিখেছেন যেমন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) নামক অনুবাদ গ্রন্থটির ঘটনা উপস্থাপনায় গল্পরসের পরিচয় পাওয়া যায়। নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লেখকরা গল্প রচনায় পটভূমি প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সার্থক গল্প অর্থাৎ সফল ছোট গল্প প্রস্তুত করতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের প্রধান শিল্পী এবং সার্থক শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের পদযাত্রা। ছোট গল্পের সার্থক স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে যেসব ছোট গল্প সংকলন করেছিলেন সেই ছোটগল্প গুলো এখনো পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সমান জনপ্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পের দাবি রাখে। তাঁর ‘ঘাটের কথা’ ছোট গল্পটি বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ছোটগল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের সাহিত্যে ছোট গল্পের যাত্রা শুরু হয়। ছোটোগল্পকে বলা হয় ‘Peculiar product of the nineteenth century.’ । আধুনিক ছোটোগল্পের জনক অ্যাডগার অ্যালেন পো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের অনুপ্রবেশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পকে আরো সমৃদ্ধ করেন- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, পাঁচকড়ি দে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জহির রায়হান, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, ত্রৈলক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, অন্নদাশঙ্কর রায়, জগদীশ গুপ্ত, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রমথ চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সৈয়দ শামসুল হক, মনোজ বসু, হুমায়ূন আহমেদ এবং আরো অনেকেই।
ছোট গল্পের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে আধুনিক ছোট গল্পের জনক অ্যাডগার অ্যালেন পো বলেছেন –
‘… a brief prose narrative requiring from half an hour to one or two hours in its perusal.’
ছোট গল্পের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে সমালোচক উইলিয়াম হেনরি হাডসন তাঁর ‘An introduction to the Study of Literature’ গ্রন্থে বলেছেন–
“A Short story must contain one and only to its logical conclusion with absolute singleness of Method.’ ছোট গল্প সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক ও ছোটগল্পকার প্রথম চৌধুরী বলেছেন– “ছোটগল্পকে প্রথমত ছোট, দ্বিতীয়ত গল্প হতে হবে। ছোটগল্পের হীরক কাঠিন্যের মধ্যে থাকবে জীবনের কোন বিশিষ্ট দিক ও খণ্ডাংশ।” এম. এই আব্রামস্ ছোট গল্প কি এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন–
“A Short story is a brief work of prose fiction, and most of the terms for analyzing the component, the types, and the narrative techniques of the novel are applicable to the short story as well.”
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছোটোগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন–
‘ছোটগল্প হচ্ছে প্রতীতি (impression) জাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যকাহিনী যার একতম বক্তব্য কোনো ঘটনা বা কোনো পরিবেশ বা কোনো মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক্য সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে।” ছোট গল্প মূলত কাকে বলে এ বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “সোনার তরী” কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায়–
“ছোট প্রাণ ছোট কথা ছোট ছোট দুঃখব্যাথা
নিতান্তই সহজসরল।
সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছ’টা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে আতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।”
এই কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এবং সাহিত্যিকদের অনেকটা হাতে-কলমে শিখিয়ে দিয়েছেন মূলত ছোট গল্প কি। ছোট গল্প অল্প কথায় সাহিত্যে সৌরভ ছড়ায়। পাঠকের মনে এবং প্রাণে ছোট গল্প স্বতঃস্ফূর্তভাবে দোলা দিয়ে যায় কিন্তু গল্পের সমাপ্তিতেও পাঠক আরো গল্পের জন্য অপেক্ষা করে। ছোট গল্পের মাঝে নিজস্ব ঢঙ রয়েছে, নিজস্ব রীতি-নীতি রয়েছে। ছোট গল্প কত শব্দের মধ্যে হতে পারে এটা নিয়ে ধরাবাঁধা কোন নিয়ম নেই। অনেকেই মনে করেন ছোট গল্প পাঁচশ থেকে দু’হাজার শব্দের মধ্যে হলে ভালো। তবে এতে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বর্তমান সময়ে পাঠকরা একই গল্প দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়তে অনীহা প্রকাশ করেন, বর্তমান পাঠকদের জন্য ছোট গল্প একটা যত উপযুক্ত এবং পারফেক্ট প্ল্যাটফর্ম। আজকাল বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ম্যাগাজিনে অনুকল্প ছাপানো হচ্ছে । যেগুলো আকারে ছোট গল্পের চেয়ে আরো ছোট, কখনো কখনো একশো শব্দের ভিতরে অনুকল্প ছাপানো হচ্ছে, আবার কখনো কখনো তিনশ শব্দের ভিতর অনুগল্প ছাপানো হচ্ছে। সাহিত্যে ছোট গল্পকে নানান ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে । তবে প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্য সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, তিনি বলেছেন- “ছোট গল্প প্রথমে গল্প তারপরে ছোট” । উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নষ্টনীড়, অতিথি এই গল্পগুলো আকারে অনেক বড়। আবার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তুলনামূলক অনেক ছোট ছোট আকারে ছোট গল্প লিখেছেন। ছোট গল্প যত বড়ই হোক না কেন উপন্যাসের সাথে ছোট গল্পের পার্থক্য রয়েছে। উপন্যাসে অনেকগুলো কাহিনী অবলম্বন করে বিস্তৃত বর্ণনা থাকে অন্যদিকে ছোট গল্প দু’একটি জীবন এবং জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ অংশগুলো নিয়ে লেখা হয়। ছোট গল্পের চরিত্র তাকে কম। ছোট গল্পের শুরুতে চমক থাকে এবং গল্পের শেষে নাটকীয়তা থাকে। পাঠকের মনে হবে- শেষ হয়ে হইল না শেষ। গল্প পাঠ শেষে পাঠকের মনে যেন গল্পের রেস রয়ে যায়, এটা ছোট গল্পের উৎকৃষ্টতম সমাপ্তি।
গল্প যত ছোট বা বড় হোক, ছোট গল্প ছোটগল্পই। ছোট গল্পকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে–
প্রেমবিষয়ক– মহামায়া, দুরাশা, দৃষ্টিদান, একরাত্রি এগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম বিষয়ক ছোট গল্প।
সামাজিক– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা, সম্পত্তি সমর্পণ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতাপুত্র।
প্রকৃতি ও মানুষ–
অতিপ্রাকৃত– ক্ষুধিত পাষাণ, মনিহার, জীবিত ও মৃত এই গল্পগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতীত প্রাকৃত ছোট গল্প।
হাস্যরসাত্মক– রাজশেখর বসুর খোকার কাণ্ড, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কায়ার কল্প, রাজশেখর বসুর ‘ভূষন্ডির মাঠে’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অধ্যাপক’ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্যমনস্ক চোর।
উদ্ভট– বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নারায়ণী সেনা, কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভগবতীর পলায়ন ইত্যাদি।
ঐতিহাসিক– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দালিয়া’ ।
বৈজ্ঞানিক– প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবিশ্বাস্য, হিমালয়ের চূড়ায়, সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কু ও ফ্র্যাংকেনস্ট্যাইন, মরুরহস্য, মুহম্মদ জাফর ইকবালের বেজি, আমড়া ও ক্রাব নেবুলা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশ্বমামা ও অহি-নকুল, নীল মানুষের কাহিনি ইত্যাদি।
গার্হস্থ্য– এ ধরনের গল্পের ভেতর রয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবধান, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের তিলোত্তমা ইত্যাদি।
নাগরিক জীবনের ব্যতিক্রমী গল্প– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবিবার, ল্যাবরেটরী, শেষ কথা।
মনস্তাত্ত্বিক– শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’, রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্ট মাস্টার’।
মনুষ্যতর– এরকম গল্প হচ্ছে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঘিনী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নারী ও নাগিনী।
বাস্তবনিষ্ঠ– মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নমুনা, প্রাগৈতিহাসিক, অচিন্ত্য সেনের বস্ত্র, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তারাবিবির মরদপোলা, দুধেভাতে উৎপাত, পায়ের নিচে জল।
ডিটেকটিভ গল্প– নীহাররঞ্জন গুপ্তের সংকেত, পরশুরামের নীল তারা, সমরেশ বসুর আর এক ছায়া উল্লেখযোগ্য।
বিদেশি পটভূমিকাযুক্ত গল্প– প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের মাতৃহীন, রাখাল সেনের সহযাত্রী ইত্যাদি।
মানুষের ব্যাক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা, বাস্তবিক সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থা, প্রেম-দ্রোহ, অথবা যে কোন উপলব্ধি থেকে অনুভূতি নিয়ে ছোট গল্প লেখা হয়ে থাকে। ছোট গল্প গদ্য রীতিতে আধুনিককালের এমন এক সাহিত্যকর্ম যেখানে বর্ণনাগুলো ছোট চরিত্র কম কিন্তু রচনা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। উপন্যাসের মতো অনেকগুলো চরিত্র একত্রিত করে ঘটনার বাহুল্যতা ছোটগল্পে থাকে না ছোট গল্প অকস্মাৎ কোনো কাহিনী নিয়ে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘটনার পরিসমাপ্তির দিকে এগোতে থাকে। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অনেকগুলো লুকায়িত গল্প থাকে। একজন লেখক অনুভূতি থেকে সেই গল্পগুলো প্রকাশ করেন। ভাষার মাধুর্যতা, চরিত্রের বিশ্লেষণ, ঘটনার অনুধাবন, নিজস্ব নির্মাণশৈলী এবং মনমুগ্ধকর প্লট নির্মাণের মাধ্যমে ছোট গল্পের জন্ম হয়। ছোট গল্পে রূপকথা, উপকথা, লোককথার পাশাপাশি নগরায়ন, প্রযুক্তি, তথ্য এবং বিজ্ঞানের বিকাশ, সামাজিক মূল্যবোধ, ব্যক্তি জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সংসারের টানাপোড়ন, অর্থনৈতিক অবস্থা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের যাত্রা শুরু হয় এরপরে বিভিন্ন কথাসাহিত্যিকের কলমের আগায় ছোটগল্পের পথ পরিবর্তন হয়েছে বারবার। ধীরে ধীরে ছোট গল্প তার শক্তিশালী অবস্থান করে নেয়। বাংলাদেশের ছোট গল্পে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি (বাঙালির মুক্তির সনদ) ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের যুদ্ধ বিজয়ের গৌরবগাঁথা কাহিনী চমৎকারভাবে স্থান লাভ করেছে।
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়, বলিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যবান। আবুল ফজল, আবুল মনসুর, আলাউদ্দিন আল আজাদ, জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ এঁদের পরবর্তীতে জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, হরিপদ দত্ত, হরিশংকর জলদাস বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন অবিরত।