প্রত্যেকবছর অক্টোবর মাসে ঘোষিত হয় নোবেল পুরস্কার। সুইডিশ ধনকুবের আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছে অনুসারে, তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপর পাওয়া সুদ থেকে নির্ধারিত হয় পুরস্কারমূল্য। তবে অর্থমূল্য থেকেও নোবেলের স্বীকৃতির মূল্য অনেক বেশি। নিজের নিজের ক্ষেত্রে সেরা বলে বিবেচিত হন পুরস্কার বিজয়ীরা। একবার দেখে নেওয়া যাক ২০১৯ সালে বিজ্ঞানে কারা পেলেন নোবেল আর তাঁদের অবদানটা ঠিক কেমন।
শুরু করা যাক শারীরতত্ত্ব বা চিকিৎসাবিজ্ঞান দিয়ে। জীবিত কোষে অক্সিজেনের প্রয়োজন কিন্তু সব সময় অক্সিজেনের সরবরাহ একইরকম থাকে না। পরিস্থিতি পাল্টে গেলে প্রয়োজনের তুলনায় কম অক্সিজেন পেতে পারে কোষ। এমন অবস্থায় নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নেয় কোষের জৈবনিক প্রক্রিয়া তা নির্দেশ করার জন্য নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী– উইলিয়াম জে কেলিন জুনিয়র, পিটার জে র্যাটক্লিফ এবং গ্রেগ এল সেমেনজা। বায়ুমণ্ডলের এক পঞ্চমাংশ জুড়ে রয়েছে অক্সিজেন। প্রায় সব প্রাণীকোষের মাইটোকন্ড্রিয়া এই অক্সিজেন ব্যবহার করে খাবার থেকে শক্তি উৎপন্ন করে। এই রূপান্তর যে উৎসেচকের সাহায্যে ঘটে তা আমরা জানতে পেরেছিলাম গত শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে। ১৯৩১ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী অটো ওয়ারবার্গ বেশ পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছিলেন ব্যাপারটা। এর সাত বছর পরে অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে নোবেল পান যিনি, সেই কর্নেইল হেম্যানস অন্য একটা চমকদার জিনিস আনেন আমাদের গোচরে। আমাদের গলার দু’পাশে থাকা ক্যারোটিড বডি বিশেষ কোষকলার সাহায্যে শরীরে অক্সিজেনের স্তর বুঝে নেয় এবং তারপর আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই সময় ক্যারোটিড বডির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে মস্তিষ্কের সঙ্গে। সুতরাং অক্সিজেনের স্তর যখন বেশ খানিকটা নেমে যায়, যাকে বলে হাইপক্সিয়া, তখন ক্যারোটিড নেমে পড়ে ক্ষতি সামলানোর কাজে। কিন্তু হাইপক্সিয়া নিয়ন্ত্রণে আরও কয়েকটা বিষয় কাজে আসে। হাইপক্সিয়া দেখা দিলে শরীরে এরিথ্রোপয়েটিন নামে একটা হরমোনের স্তর বাড়তে থাকে। এর প্রভাবে বাড়ে লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদন। একে বলে এরিথ্রোপয়েসিস। বিংশ শতকের শুরুতে এ ঘটনা জানা থাকলেও অক্সিজেন যে ঠিক কীভাবে এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে তা জানা ছিল না বিজ্ঞানীদের।
আমরা জানি যে হরমোন একটা প্রোটিন এবং আরও সব প্রোটিনের মতই এর উৎপাদন ঘটে বিশেষ জিনের নির্দেশে। গ্রেগ সেমেনজা এই বিশেষ জিনের কাজ বোঝার চেষ্টা করেন। কোষের নিউক্লিয়াসে থাকা ডি এন এ-র যে অংশে এই জিন উপস্থিত তার আশেপাশের অঞ্চলটা সমীক্ষা করেন তিনি। এদিকে স্যার পিটার র্যাটক্লিফও এ কাজে মনযোগ দেন। দু’জনের গবেষণাতেই বোঝা গেল যে অক্সিজেনের স্তর সব কোষকলাতেই কমবেশি উপস্থিত। এরিথ্রোপয়েটিন উৎপন্ন হয় যেখানে মানে কিডনিতে, শুধু সেখানেই যে অক্সিজেনের পরিমাণ বোঝার প্রক্রিয়া চলে তা নয়। আরও কিছুটা গভীরে ঢোকার ইচ্ছে হয় সেমেনজার। লিভারের কোষ নিয়ে কাজ করে তিনি দেখলেন যে বিশেষ এক প্রোটিন এরিথ্রোপয়েটিন উৎপাদনকারী জিনের জায়গাটায় আটকে ফেলে নিজেকে। এই প্রোটিনের নাম তিনি দিলেন হাইপক্সিয়া ইনডিউসিবল ফ্যাক্টর। ১৯৯৫ নাগাদ বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করে সাড়া ফেললেন তিনি। হাইপক্সিয়ার সময় হঠাৎ-ই বেড়ে যায় এই প্রোটিনের স্তর। অন্য সময় সেটা কম থাকে এবং দ্রুত ভেঙে যায় কিন্তু হাইপক্সিয়া হলে বেশ উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হয়। ক্যান্সার গবেষক উইলিয়াম কেলিন এ ব্যাপারে একটা নতুন মাত্রা যোগ করলেন। তিনি এক বিশেষ ধরণের ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করছিলেন যা বংশানুক্রমে ঘটে অর্থাৎ এর সূত্র রয়ে গিয়েছে জিনের মধ্যে। এই ক্যান্সারের সংক্ষিপ্ত নাম ভি এইচ এল। কেলিন দেখালেন যে ভি এইচ এল রোগ যে জিনের সঙ্গে যুক্ত তারও একটা ভূমিকা আছে হাইপক্সিয়ার ক্ষেত্রে। র্যাটক্লিফ তাঁর গবেষণা সহযোগীদের সঙ্গে মিলে দেখালেন যে হাইপক্সিয়া ইনডিউসিবল ফ্যাক্টরের ক্ষয়ের পেছনে রয়েছে ভি এইচ এল জিনের ভূমিকা। ২০০১ সালে র্যাটক্লিফ ও ক্লেইন যৌথভাবে গবেষণাপত্র লিখে এই সম্পর্কটাকে পরিষ্কার করলেন। এভাবে যেন অনেকগুলো বিষয় এসে এক জায়গায় মিলে গেল। এই তিন জন বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলে আজ আমরা জানি যে কীভাবে অতিরিক্ত কায়িক শ্রমের সময় আমাদের পেশীতে অক্সিজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় বা কীভাবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রভাবিত হয় অক্সিজেনের মাত্রার ওঠানাম্য। বহু রোগের ক্ষেত্রেও অক্সিজেনের পরিমাণ বুঝতে পারার সক্ষমতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন মূত্র নিষ্কাশনের দীর্ঘকালীন সমস্যায় ভোগেন যে সব মানুষ তাদের কিডনির ক্ষমতা কমে যায় আর এর ফলে সেখানে এরিথ্রোপয়েটিনের উৎপাদন কমে যায়। এতে কমে লোহিত কণিকার উৎপাদন, দেখা দেয় রক্তাল্পতা! ক্যান্সারেও এর প্রভাব আছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষে এমনভাবে পরিবর্তন ঘটে যাতে অক্সিজেন নিয়িন্ত্রণের ব্যাপারটা পাল্টে যায় আর বেশি বেশি রক্তবাহী ধমনী তৈরি হয়। এতে পুষ্টি পেয়ে হুড়মুড় করে বাড়তে থাকে ক্যান্সার কোষের দল। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো তাই পথ খুঁজছে অক্সিজেনের স্তর বোঝার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বা সেটাকে উত্তেজিত করে ক্যান্সার বিস্তার রোধ করার।
এক একটা সঙ্কট অদ্ভূতভাবে সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। এমনটাই ঘটেছিল সত্তর দশকের জ্বালানি সঙ্কটের সময়। প্রশাসনের চাপেই হোক বা নিজেদের তাগিদ থেকেই হোক, প্রত্যেকটা উন্নত দেশেই বিজ্ঞানীরা খুঁজছিলেন তেলের বিকল্প। এমন সময়েই উঠে এল উন্নত এবং ছোট ব্যাটারির ধারণা, এল লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। এই ব্যাটারির নীতি আবিষ্কারের জন্যই দেওয়া হয়েছে ২০১৯ সালে রসায়নের নোবেল পুরস্কার। পেয়েছেন জন বি গুডএনাফ, এম স্ট্যানলি হুইটিংহ্যাম এবং আকিরা ইয়োশিনো। এর মধ্যে গুডেনাফের বয়স ৯৭, সব থেকে বেশি বয়সে নোবেল পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন তিনি। স্তয়ানলি হুইটিংহ্যাম ওই তেল সঙ্কটের সময় কাজ করছিলেন সুপারকন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহী নিয়ে। সেটা করতে গিয়ে একটা ব্যাটারির পরিকল্পনা করলেন তিনি। দেখলেন, একটা অভিনব ক্যাথোড বা ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার বানানো যায় টাইটেনিয়াম ডাই-সালফাইড দিয়ে। এই ক্যাথোডের আণবিক স্তরে এমন ফাঁক রয়েছে যেখানে লিথিয়াম আয়নের জায়গা হতে পারে। এই ব্যাটারির ধনাত্মক তড়িৎদ্বার আংশিকভাবে তৈরি হলো ধাতব লিথিয়াম দিয়ে যার সহজেই ইলেকট্রন কণা ছেড়ে দেওয়ার বৈশিষ্ট্য আছে। এই ব্যাটারির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল দুর্বল কিন্তু ধাতব লিথিয়াম বিস্ফোরক আর তাই এই ব্যাটারি প্রতিশ্রুতি দেখালেও সুস্থায়ী হলো না। জন গুডএনাফ দেখালেন যে সালফেটের বদলে অক্সাইড ব্যবহার করা ভালো। ১৯৮০ নাগাদ তিনি কোবাল্ট অক্সাইড ব্যবহার করলেন আর তার মধ্যে রাখলেন লিথিয়াম আয়ন, ফলে পাওয়া গেল চার ভোল্টের ব্যাটারি। ১৯৮৫ সালে প্রথম কার্যকরী লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি বানালেন আকিরা ইয়োশিনো। অ্যানোডে সরাসরি লিথিয়াম ব্যবহার করার বদলে তিনি পেট্রোলিয়াম কোক নামে কার্বন-সমৃদ্ধ পদার্থ ব্যবহার করলেন। কোবাল্ট অক্সাইডের মতো এটাও লিথিয়াম আয়ন ধরে রাখতে পারে অণুগুলোর মধ্যে থাকা ফাঁকে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সবথেকে বড় সুবিধে হল এই যে এটা কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ানির্ভর নয় যেখানে তড়িৎদ্বারগুলোর ক্ষয় ঘটে। তার বদলে এখানে যে প্রক্রিয়া চলে তাতে অ্যানোড থেকে ক্যাথোডের মধ্যে লিথিয়াম আয়নের চলাচল ঘটে। ১৯৯১ সালে এই ব্যাটারি আসার পর থেকে বিপ্লব ঘটে গিয়েছে ইলেকট্রনিক্সের জগতে। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা আজ অনেকটাই ছাড়তে পেরেছে মানব সভ্যতা।
মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার শেষ নেই। উন্নত টেলিস্কোপের সাহায্যে আহরিত হচ্ছে নানা তথ্য, তৈরি হচ্ছে অর্থপূর্ণ লেখচিত্র। কিন্তু এগুলোকে বাঁধা দরকার তাত্ত্বিক একটা কাঠামোয়। গণিতের জ্ঞান ব্যবহার করে সেই কাঠামো নির্মাণ করবেন যে বিজ্ঞানী তিনি হবেন আলোর দিশারী। আইনস্টাইন আমাদের দিয়ে গিয়েছেন একটা দৃঢ় ভিত্তি– সাধারণ আপেক্ষিকতা। সেটা দিয়ে বিংশ শতকের শুরুতে অনেকেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন জগৎকে। রাশিয়ার আলেকজাণ্ডার ফ্রিডম্যান থেকে শুরু করে বেলজিয়ামের পাদ্রী জর্জেস লেমাইত্রে খুব সুন্দর সুন্দর সমীকরণ উপস্থিত করলেন, কেউ কেউ দিলেন একটা আদি কণার ধারণা যা থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। পরে জর্জ গ্যামোর কাজের ফলে এল বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের তত্ত্ব যা আজ মহাবিশ্বের উৎপত্তির সূত্র হিসাবে অধিকাংশ জায়গায় স্বীকৃত। সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্রকে প্রসারিত করে যা পাই এবং বিগ ব্যাংয়ের তাত্ত্বিক কাঠামো বিশ্লেষণের যা ফলাফল তাতে বলে যে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় চোদ্দশো কোটি বছর আগে। তখন তা ছিল অতীব উত্তপ্ত এবং ঘন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রসারণ ঘটল, বাড়তে লাগল সেটা আর একইসঙ্গে ঠাণ্ডাও হতে লাগল। চার লক্ষ বছর পরে মহাবিশ্ব স্বচ্ছ হয়ে এল এবং আলোর ফোটন কণা তার মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে পারল। আদি সেই বিকিরণ আজও ধরা রয়েছে এই মহাবিশ্বে। এই তথ্যের ভিত্তিতে তাত্ত্বিক গণনা করে জেমস পীবলস একটা কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন। তাঁর কাজ শুরু ষাটের দশক থেকে। পীবলস নিজের তত্ত্বের ভিত্তিতে মহাবিশ্ব গঠনের অন্যান্য আরও অনেক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। এরই ফলে আজ আমরা বুঝতে পারছি যে এই মহাবিশ্বের মাত্র পাঁচ শতাংশের সম্বন্ধে তথ্য আহরণ করতে পেরেছি আমরা। এই পাঁচ শতাংশ দিয়েই তৈরি গাছ-নদী-পাহাড়-নক্ষত্র-পালসার। বাকি পঁচানব্বই শতাংশ ডার্ক এনার্জি আর ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরি।
এই মহাবিশ্বের নানা রহস্য খুঁজতে যখন ব্যস্ত বিজ্ঞানীরা তখনই একদিন, ১৯৯৫ সালে, মাইকেল মেয়র এবং দিদিয়ের কুয়েলজ খুঁজে পেলেন সৌরজগতের বাইরে এক গ্রহকে। সূর্যের সমগোত্রীয় এক নক্ষত্রকে ঘিরে পাক খাচ্ছে সেটা। দক্ষিণ ফ্রান্সের এক মানমন্দির থেকে তাঁরা শনাক্ত করলেন বৃহস্পতির প্রায় সমান আকারের গ্রহ ৫১ পিগেসি বি-কে। সেই আমাদের জানা প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট। সেই শুরু, তারপর থেকে মিল্কি ওয়েতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে চার হাজার এক্সোপ্ল্যানেট।
এই তিনজন পদার্থবিজ্ঞানী মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানার সীমাকে প্রসারিত করেছেন অসামান্যভাবে। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন এঁরা।