“What I admire in your father is that, for his whole life, he stayed with only one woman. This is a project in which I grossly failed, twice.”
উপরের কথাগুলো যদি কোনো সাধারণ মানুষের হতো, তবে তা সহজে মেনে নেওয়া যেতো। তবে যেহেতু কথাগুলো বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের, তাই একটু নড়ে চড়ে বসতেই হয়! তবে কী ঘটেছিল তর্কসাপেক্ষে ইতিহাসের অন্যতম সেরা মেধাবীর ব্যক্তিগত জীবনে, যে কারণে তিনি নিজেকে পরাজিত মনে করেছিলেন? আসুন আজ সে সম্পর্কেই জানা যাক।
যারা কেবল আইনস্টাইনকে বিজ্ঞানী হিসেবে চিনেন, তারা অবাক হবেন এই জেনে যে, প্রেম আইনস্টাইনের জীবনের অন্যতম সমার্থক শব্দ। জীবনে বহুবারই তিনি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, কিন্তু কোনোটিই চূড়ান্ত সফলতার দিকে যেতে পারেননি। আলবার্ট তার প্রথম স্ত্রীর মিলেভা মারিকের সাথে পরিচিত হন ১৮৯৬ সালে সুইস ফেডারেল পলিটেকনিকে পড়তে গিয়ে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। মিলেভা পদার্থবিজ্ঞানে বেশ আগ্রহী ছিলেন এবং আইনস্টাইনও তাই। দেখতে যে খুব সুন্দরী ছিলেন মিলেভা তা বলা যাবে না। তার উপর তিনি ছিলেন আইনস্টাইনের চেয়ে চার বছরের বড় এবং খোঁড়া। বলা যায়, পদার্থবিজ্ঞানই তাকে আইনস্টাইনের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। তাদের সাধারণ আগ্রহ পরস্পরকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে, ফলে বন্ধুত্ব প্রেমে গড়াতে বেশিদিন সময় লাগে না।
কিন্তু কিছুদিন পর মিলেভা গর্ভবতী হয়ে পড়লে তাদের জীবনে জটিলতার সৃষ্টি হয়। সে সময়ে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক কে ভালো দৃষ্টিতে দেখা হত না। মিলেভা এবং আইনস্টাইনের প্রথম কন্যা লিসেরল জন্ম নেন এবং এর ফলে মিলেভার পড়াশুনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু তা স্বত্বেও তাদের প্রেমময় সম্পর্কে ছেদ পড়ে না। ১৯০৩ সালে আইনস্টাইনের মায়ের প্রবল আপত্তি থাকা স্বত্বেও আইনস্টাইন এবং মিলেভা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয়। বিয়ের সময় আইনস্টাইনের বয়স ছিল ২৪ মিলেভার ২৮।
আইনস্টাইন তখন অতটাও পদার্থবিজ্ঞানে সুবিধা করে উঠতে পারেননি। বিয়ের পর আইনস্টাইন দম্পতি আরো দুই সন্তানের জনক হন। তবে তখনো আইনস্টাইনের কপালে পিএইচডি ডিগ্রি অথবা চাকরি, কোনোটাই জুটেনি। শেষমেশ বন্ধুর সহযোগিতায় সুইজারল্যান্ডের বার্নে এক পেটেন্ট অফিসে তার চাকুরি হয়, যদিও তা আহামরি কিছু ছিল না। মিলেভা অনেক কষ্ট করেই সংসার চালাতেন। কিন্তু খুব দ্রুতই আইনস্টাইনের ভাগ্য বদলাতে থাকে। ১৯০৪-০৯ সালের মধ্যে তার বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক পেপার প্রকাশিত হয়। ১৯০৯ সালে তিনি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে একাডেমিক ক্যারিয়ার শুরু করেন।
একদিকে সুসময় আসলেও কোথায় যেন এক সুর এর মাঝেই কেটে গিয়েছিল। আইনস্টাইন এবং মিলেভার সম্পর্ক ধীরে ধীরে বেশ খারাপ হতে থাকে। বৈজ্ঞানিক কাজে আইনস্টাইনকে পরিবারসহ প্রাগে চলে যেতে হয় এবং তখন থেকেই তার পারিবারিক জীবনের অধঃপতনের শুরু. এই দোলাচলের মধ্যেই আইনস্টাইন ১৯১২ সালে তার কাজিন এলসার সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এলসার কাছে প্রায়ই মিলেভার ‘বিষণ্ণতা’ এবং ‘ঈর্ষাপরায়ণতা’ নিয়ে অভিযোগ করতেন। এক পর্যায়ে আইনস্টাইন মিলেভাকে তালাক দিতে চাইলেও মিলেভা তাতে অস্বীকৃতি জানান।
এর বিপরীতে আইনস্টাইন যা করেন তা সত্যিকার অর্থেই ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির। আইনস্টাইন সম্পর্কে থাকার বিনিময়ে মিলেভাকে কিছু শর্ত জুড়ে দেন। এগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু শর্ত হল–
এই সমস্ত শর্ত দেখলে এ কথা যে কারও কাছে পরিষ্কার হবে যে, আইনস্টাইন মিলেভাকে তার জীবনে আর চাইছিলেন না। এ ধরনের শর্ত যে কারো উপরেই আরোপ করা উক্ত ব্যক্তির জন্য অপমানজনক। অথচ আইনস্টাইন ঠিকই এলসার সাথে সম্পর্ক রেখে চলছিলেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এত কিছুর পরও মিলেভা তার সন্তানদের জন্য সব শর্ত মেনে আইনস্টাইনের সাথে থেকে যেতে রাজি হয়েছিলেন। তারা দুই জন আরও প্রায় ৫ বছর বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু সময়টা সুখকর ছিল না। অবশেষে ১৯১৯ সালে মিলেভা আইনস্টাইনের সাথে বিচ্ছেদে রাজি হন। মজার ব্যাপার হলো, তালাকের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আইনস্টাইন মিলেভাকে নোবেল পুরস্কার থেকে পাওয়া অর্থ দিতে রাজি হন, অথচ তখনো তিনি পুরস্কার পাননি! তবে কিছু বছর পর আইনস্টাইন ঠিকই নোবেল পুরস্কার জিতে নেন।
মিলেভার সাথে বিচ্ছেদের বছরেই আইনস্টাইন তার কাজিন এবং প্রেমিকা এলসাকে বিয়ে করেন। কিন্তু সে বিয়ের আগেও ঘটে যায় আরেক ঘটনা। প্রচলিত আছে যে, এলসার সাথে প্রেম থাকা অবস্থাতেই আইনস্টাইন এলসার মেয়ে আইলসের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন! আইলস তখন আইনস্টাইনের সেক্রেটারি। এ বিষয় স্বয়ং এলসার কানে চলে যায় এবং তিনি নাকি তার মেয়েকে বাধা দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। অতঃপর আইলস তার আরেক প্রেমিককে বিয়ে করে ফেললে এলসার পথের কাঁটা দূর হয়।
কিন্তু এলসার সাথে বিয়ের পর যে আইনস্টাইনের নারীপ্রীতি শেষ হয়, তা কিন্তু নয়। বিবাহিত অবস্থায় আইনস্টাইন একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এবং মজার ব্যাপার ছিল, এসব সম্পর্ক নিয়ে তিনি এলসার সাথে খোলামেলা আলোচনাও করতেন! ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে একাধিক নারী তার জীবনে এসেছিল, তাদের নাম মার্গারেট, এস্টেলা, টনি এবং এথেল। তাদের সাথে আইনস্টাইন ছুটি কাটাতেন, বই পড়তেন, এমনকি কনসার্টেও যেতেন। এলসার কাছে লেখা চিঠিতে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, মেয়েরা তার পিছনে পড়ে আছে এবং প্রচুর ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মনোযোগ’ দিচ্ছে।
তবে এত কিছু জানার পরেও এলসা আইনস্টাইনকে ছেড়ে যাননি। তার কারণ কী ছিল তা ততটা স্পষ্ট না হলেও এলসার লেখা এক চিঠিতে আইনস্টাইন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়–
“Such a genius should be irreproachable in every respect. But nature does not behave this way, where she gives extravagantly, she takes away extravagantly.”
এলসা জীবনের শেষ পর্যন্ত আইনস্টাইনের সাথে থেকে যান। বিবাহিত থাকা অবস্থায় ১৯৩৬ সালে তিনি মারা যান।
ইতিহাস সচেতন মানুষেরা আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত জীবনকে এক এক রকমভাবে দেখেছেন। প্রথম স্ত্রী মিলেভার প্রতি তার আচরণ কে কেউ কেউ দেখেছেন স্ত্রীদ্বেষী (Misogynist) হিসেবে। মিলেভার প্রতি তিনি যে সব শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতা এবং পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দেয়। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, আইনস্টাইনের অনেক তত্ত্ব, বিশেষ করে ‘বিশেষ আপেক্ষিকতা’ তত্ত্বে মিলেভার অবদান ছিল, কিন্তু তাকে সেটির জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এসব আমলে নিলে মনে হয় যে, তিনি একজন নির্দয় স্বামী ছিলেন।
তবে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আইনস্টাইনের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশিত হলে তার সম্পর্কে ধারণা কিছুটা বদলায়। বিশেষ করে নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ তিনি মিলেভা এবং তার সন্তানকে দিয়ে দেন। এতে তার সহানুভূতিশীলতার কিছুটা হলেও পরিচয় পাওয়া যায় ।
তবে তা ব্যক্তিগত সম্পর্কে আইনস্টাইনের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হয় না। একজন পিতা এবং স্বামীর দায়িত্ব হচ্ছে তার সন্তান এবং স্ত্রীর প্রতি খেয়াল রাখা। সে ব্যাপারে আইনস্টাইন চূড়ান্তভাবে অবহেলাই করেছেন। এমনকি দ্বিতীয় বিয়েতেও তিনি সম্পর্কে সততা ধরে রাখতে পারেননি।
এ সমস্ত বিষয় থেকে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় করে উদয় হয় তা হচ্ছে যে, আসলেই আইনস্টাইন একটি স্বাভাবিক এবং স্থিতিশীল সম্পর্কে থাকার মতো যোগ্য ছিলেন কিনা! তার চরম অস্থিতিশীলতা এবং বারংবার বিশ্বাসভঙ্গ কিন্তু সেই প্রশ্নকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে ।তিনি নিজেও সম্ভবত ব্যাপারটা জানতেন বলেই বন্ধুর ছেলের কাছে লেখা চিঠিতে এক জীবনে এক নারীর সাথে না থাকতে পারার বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।
যদি আইনস্টাইন তার জীবনে কোনো ভালবাসার প্রতি অবিচল ছিলেন, তবে তা ছিল বিজ্ঞানের প্রতি তার ভালোবাসা। এ ব্যাপারে খুব কম মানুষই দ্বিমত পোষণ করবেন যে, আইনস্টাইন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছিলেন। তবে যারা ব্যক্তি জীবনের আইনস্টাইনকে জানবেন, সহসাই তারা বুঝবেন যে সুতীব্র মেধাবীর অবস্থান মানবিক ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়।