গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ: জাদু বাস্তবতার দিকপাল


‘ম্যাজিকাল রিয়েলিজম’— বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘জাদু বাস্তবতা’। শব্দ দুটো বলার ভেতরই আলাদা কেমন একটা অনুভূতি আছে। বাস্তবতায় জাদু আসে কোথা থেকে, আর জাদুতেই বা বাস্তবতার স্থান কোথায়! এমন গোলমেলে একটি ব্যাপারকে সাহিত্যের মাধ্যমে অভিনব কায়দায় সবার সামনে তুলে ধরেছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ কিংবা ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’— উপন্যাস দুটোর নাম কেই না শুনেছে, মানুষের মনে সহজেই জায়গা করে নেয়া উপন্যাস দুটি এই মহান কথাসাহিত্যিকের। তার হাত ধরেই লাতিন সাহিত্য আবারও উজ্জীবিত হয়ে উঠে। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মার্কেজ।


জাদু বাস্তবতা সাহিত্যের এমন একটি শাখা, যেখানে আপাত খুব সাধারণ একটি জীবন বা ঘটনাকে কল্পনার মিশেলে ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। এখানেই বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়। প্রতিটি চরিত্র, ঘটনা জীবন্ত একটা রূপ পায় লেখকের কলমের কালিতে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জন্ম ৬ মার্চ, ১৯২৭ সালে কলম্বিয়ার আরাকাটাকায়। বিশাল পরিবারে তিনি ছিলেন সবার বড়, তাকে সবাই ‘গ্যাবো’ বলেই ডাকতেন। বাবা ছিলেন একজন পোস্ট অফিসের কেরানি, টেলিগ্রাফ অপারেটর এবং ভ্রাম্যমাণ ফার্মাসিস্ট। বাবার ব্যস্ততার কারণে মার্কেজের ছেলেবেলা কাটে নানীর কাছে। যার সুবাদে মার্কেজ নানীর কাছে রূপকথার গল্প শুনতেন। সেগুলো বলার ঢঙ ছোট্ট মার্কেজকে কল্পনার জগতে নিয়ে যেতো। ভূত, প্রেত, রাজকন্যা’র চরিত্রগুলো তার নানী এমনভাবে উপস্থাপন করতেন, যেন সেগুলো বাস্তবেই ঘটেছে। গল্পের উপাদান আর উপস্থাপন কৌশল ছোট্ট মার্কেজের মনে গেঁথে গিয়েছিল তখন থেকেই। পরবর্তীতে সেটা তিনি ফুটিয়ে তোলেন তার সাহিত্যকর্মে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৬ সালের দিকে, যখন তিনি আইন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।  ‘এল এস্পেক্তাদোর’— ম্যাগাজিনের সম্পাদকের একটি মন্তব্য মার্কেজের নজর কাড়ে। সম্পাদকের মতে, ‘কলম্বিয়াতে উদীয়মান তরুণ কোনো লেখক গড়ে উঠছে না।’ মার্কেজ নিজের সম্ভাবনা দেখতে পান, তাই সিদ্ধান্ত নেন তার লেখাগুলো সম্পাদকের কাছে পাঠাবেন। তার লেখাগুলো সম্পাদক খুবই পছন্দ করেন এবং সেগুলো ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয়।

এমন চমৎকার সূচনাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তার লেখক হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কলম্বিয়ান প্রেসিডেন্টের হত্যাকান্ডের ঘটনা। এই ঘটনার পর মার্কেজ ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে চলে আসেন। সেখানে তিনি সাংবাদিক ও অনুসন্ধানী রিপোর্টার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন।

১৯৫৪ সালে মার্কেজ কলম্বিয়ান নেভির একজন নাবিকের ঘটনা বর্ণনা করেন, যিনি জাহাজ দুর্ঘটনায় বেঁচে গিয়েছিলেন। জাহাজটির দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে এতোদিন সবাই বজ্রপাতকেই দায়ী করে আসছিল। কিন্তু নাবিকের ভাষ্যমতে, জাহাজটি আসলে আমেরিকান চোরাকারবারিদের আক্রমণে ধ্বংস হয়। এমন নিউজ করা কারণে মার্কেজ আমেরিকানদের চোখের বিষ হয়ে উঠেন রাতারাতি। বাধ্য হয়ে তিনি ইউরোপে পাড়ি জমান কিছুদিন পর। সেখানে তিনি লেখালেখি আর ম্যাগাজিনের জন্য ফিচার লিখেই সময় পার করতে থাকেন। পাশাপাশি নিজের প্রথম উপন্যাস ‘লিপস্টর্ম’ ছাপানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন। ইতোমধ্যে উপন্যাসটি লেখার ৭ বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ১৯৫৫ সালে তার প্রথম উপন্যাসটি আলোর মুখ দেখে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সবচেয়ে সফলতম সাহিত্যকর্মটি লেখার ধারণা যখন আসে, তখন তিনি গাড়ি ড্রাইভিং করছিলেন। হঠাৎ তার মাথায় কি যেন খেলে গেল। এরপর ১৮ মাসের জন্য তিনি একেবারে গর্তে ঢুকে পড়েন! আয়-রোজগার বলতে গেলে একেবারেই বন্ধ। একসময় তার পরিবার প্রায় ১২০০০ ডলারের ঋণ করে ফেলে, ঘরে তখন স্ত্রী আর দুই সন্তান। এমন করুণ একটি মুহূর্তের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৩০০ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিতে কলমের শেষ আঁচড় দেয়ার মাধ্যমে। ১৯৬৭ সালে ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাসটি ছাপানোর প্রথম সপ্তাহে এর স্প্যানিশ ভাষার সবগুলো কপি বিক্রি হয়ে যায়। ততক্ষণে উপন্যাসটি ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে! পরবর্তী ৩০ বছরে উপন্যাসটির প্রায় ২৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় এবং বিশ্বজুড়ে ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়।

কভার: নিঃসঙ্গতার শত বছর

উপন্যাসটির গল্প শুরু হয় আর্কেদিও বুয়েন্দিয়া আর তার স্ত্রী উরসুলা ইগোরানকে ঘিরে, যারা কলম্বিয়া ছেড়ে অন্য শহরে পাড়ি জমানোর জন্য বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে আর্কেদিও ‘মাকান্দো’ নামের এক শহরের স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য আর্কেদিও আর তার স্ত্রী নিরলস কাজ শুরু করেন। মূলত কল্পিত শহরটিকে মার্কেজ নিজের জন্মস্থানের মতো কল্পনা করেছিলেন। একসময় শহরটি বড় হতে থাকে, নিত্যদিনের কোলাহল, ব্যস্ততা, জীবন আর মৃত্যুর মাধ্যমে শহরটির বয়স বাড়তে থাকে। সময় যায় আর শহরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গড়ে উঠে। গল্পের উপাদান হিসেবে ছিল ইতিহাস, কল্পনা, যৌনতা আর নানা সংস্কার-কুসংস্কারের এক অদ্ভুত মিশ্রণ, যার কারণে সাহিত্যকর্মটি আদর্শ এক ম্যাজিকাল রিয়েলিজমের মর্জাদা পায়।

তার অন্যান্য সাহিত্যকর্মগুলোর ভেতর ‘নো ওয়ান রাইটস্ টু দ্য কর্নেল’ (১৯৫৮), ‘ইন দ্য ইভিল আওয়ার’ (১৯৬২), ‘দ্য স্টোরি অব এ শিপরেকেড সেইলর’ (১৯৭০), ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (১৯৮৬) অন্যতম। তার বেশকিছু লেখা বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। তার অন্যান্য সাহিত্যকর্মের ভেতর ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’-কে সেরা হিসেবে ধরা হয়। যদিও মার্কেজের মতে, ১৯৭৫ সালে লেখা ‘দ্য অটাম অব দ্য প্যার্টিয়ার্স’ তার সবচেয়ে সেরা সাহিত্যকর্ম।

নিজের লেখা কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে হওয়া বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন,

‘আমার কল্পনার জন্য সকলে আমার প্রশংসা করে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমার লেখায় এমন কোনো লাইন নেই যেটা বাস্তবতা থেকে উৎসারিত নয়। প্রকৃতপক্ষে অনেকেরই জানা নেই যে, ক্যারিবিয়ান বাস্তবতা অনেকটা বুনো কল্পনার মতোই।’

মার্কেজের লেখা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা এখনও বর্তমান। ২০১৪ সালে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে মনা সিম্পসম মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাস সম্পর্কে বলেন,

‘নিঃসঙ্গতার শত বছর উপন্যাসের মতো স্বতঃস্ফূর্ত উপন্যাস সাহিত্যের আধুনিক যুগে খুব কমই আছে।’

মার্কেজ ও ফিদেল ক্যাস্ট্রো, Image source: desiinformamonos.org

মার্কেজ নিজের পরিণত বয়সের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন কলম্বিয়ার বাইরে। দেশের প্রতি নিজের রাগ আর হতাশার কারণে মার্কেজের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল বামঘেঁষা। সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুরাগ থেকে তিনি বন্ধুত্ব গড়ে তুলেন কিউবান লিডার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে। সমাজতন্ত্র নিয়ে তিনি টুকটাক লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু তিনি কখনো তাদের দলে নাম লেখাননি। আদর্শের কারণে মার্কেজকে আমেরিকান সরকার নিজেদের দেশে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করে। বিভিন্ন সময়ে তাকে আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি সেখানে যাননি। পরবর্তীতে বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় এলে মার্কেজের উপর থেকে সকল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং তাকে আমেরিকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। তার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মার্কেজ প্রথমবারের মতো আমেরিকা ভ্রমণ করেন।

১৯৯৯ সালে মার্কেজের লিম্ফোমা অসুখ ধরা পড়ে, কিন্তু তিনি লেখালেখি চালিয়ে যান ২০০৪ সাল পর্যন্ত। কিন্তু আস্তে-আস্তে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলার কারণে তার পক্ষে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল মেক্সিকোতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সাহিত্যকর্মগুলো শুধু কলম্বিয়া নয়, পুরো বিশ্বের সম্পদ। তার প্রচেষ্টাতেই লাতিন আমেরিকা সাহিত্য তাদের হারানো গৌরব ফিরে পায়। মৃত্যুর আগে তিনি হাভানার নিকটে একটি আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম স্কুল গড়ে তোলেন। তাছাড়া ক্যারিবিয়ান উপকূলে ‘স্কুল অব জার্নালিজম’ প্রতিষ্ঠা করেন।

আসুন, একটা গল্প শুরু করা যাক। যেখানে একজন নিঃসঙ্গ কর্নেল থাকবেন, শত বছরের পুরনো শহর থাকবে, থাকবে তাদের কোলাহল আর নীরবতা। শহরের দেয়ালের আড়ালে জমে থাকা গল্পগুলো আবার জীবন ফিরে পাবে, তারপর ভবিষ্যতের বাসিন্দাদের নিজেদের গল্প শোনাবে। রাত গভীর হবে কিন্তু গল্প ফুরোবে না, সেটা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প, আপনার-আমার গল্প।


তথ্যসূত্র:
১. Thoughtco
২. Mentalfloss
৩. The Gurdian

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

মায়াহরিণীরা!

হরিণ মায়াময় প্রাণী! হরিণের প্রতি হরিণীর মায়া, বাচ্চার প্রতি মা হরিণের, বাবা হরিণের, আর সব হৃদয়ের বোন। এইভাবে হরিণের মায়ার

গল্প

জাকির তালুকদারের গল্প

দর্পণ-এর গল্পবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ‘শিশিরভেজা গল্প’-তে প্রকাশিত জঙ্গনামা জাকির তালুকদার সুরুযের আগে বিছান না ছাড়ে যেই নারী লক্ষ্মী কয় তার

হাসির গল্প

টুনটুনির বুদ্ধি

টুনটুনি আর টুনটুনা একসঙ্গে তো আছে। সেদিন টুনটুনি টুনটুনাকে বলল, “দেখ টুনটুনা! আমার যে বড় পিঠা খেতে ইচ্ছা করছে।” টুনটুনা