জেলফেরত


ছয় বছর আট মাস পর আজ নেত্রকোনা জেলা কারাগার থেকে ছাড়া পেলাম। আমার জন্যে কেউ জেল গেটে অপেক্ষায় ছিল না। শহীদ মিনার পার হয়ে সোজা তেরিবাজার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। শহর জুড়ে চৈত্রের রোদের কড়া চোখ রাঙানি। মাঝে মাঝে চৈতালি বাতাসের সাথে কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভুতি হয় গায়ে।

রুপক বইঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক বদলে গেছে শহরটা। উঁচু উঁচু বিল্ডিং আকাশ ফুঁড়ে আরও উপরে উঠে যেতে চাইছে। শহর বদলাবেই তো। ছয় বছর আট মাস কি সামান্য কিছু সময়? এই সময়ে সারা দুনিয়ার সবকিছু বদলে গেছে, সব মানুষ বদলে গেছে। কেবল আমি বদলে যাইনি। শুধু আমার ভেতরটা পুড়ে গেছে, ঝলসে গেছে কী এক নিদারুণ কষ্টে! না পাবার কষ্টে!

নিয়ামুল আমাকে দেখেমাত্র চিনেছে। সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। এই জীবনে ওর কাছে আমার অনেক ঋণ। ভালোবাসার অপরিশোধ্য দেনা। এখন তেরিবাজারে তার ওষুধের দোকান। কত আড্ডা মেরেছি ওর দোকানে বসে। সে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল আমাকে দোকানের ভেতর। আমাকে একটানে বুকে চেপে ধরল। বুঝতে পারছি কান্নার একটা দলা নিয়ামুলের গলায় আটকে আছে। কিন্তু আমার কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। একজন খুনের সাজানো মামলায় সাজা খাটা মানুষ ছয় বছর আট মাস পর কতটুকু অনুভূতি নিজের ভেতর পুষে রাখতে পারে?

আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি নিয়ামুলকে বললাম, দোস্ত, সাবু ভাইয়ের দোকান থেকে কিছু খাবার আনা। সে নিজে উঠে গিয়ে গরম পরোটা আর কলিজা ভুনা নিয়ে আসলো। তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। আহা, কতদিন পর মুক্ত বাতাসে, মুক্ত দেহ মনে পেট ভরে খেলাম! নিয়ামুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে থানার মোড়ের দিকে রওনা দিলাম। মাথাটা ভার লাগছে। একটু ঘুমাতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু কোথায় ঘুমাবো? এই শহরে এখন আমার কে আছে আপনজন?


২.

এই শহরের সাতপাই এলাকায় আমাদের বাসা ছিল। যতদূর জানি, বাবা সেটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন আমি জেলে যাবার পরপর। মা আর বাবা এখন গ্রামের বাড়িতে থাকেন। আমার সাথে তাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই অনেক বছর। আমি তাদের সন্তান, এটা পরিচয় দিতে তারা রাজি নয়! জেলখানা থেকে আজ ছাড়া পাবো, এই খবরটাও তারা কেউ জানতেন না। মা বাবার সাথে সম্পর্ক না থাকার মূল কারণ ছিলো খুনের ঘটনাটা। প্রবীরদা’র খুনের ঘটনা। প্রতিহিংসা থেকে আমাকে সেই ঘটনায় ফাঁসিয়ে দেয়া হলো।

আমি সেদিন সকালে প্রবীরদা’র বাসায় ছিলাম। প্রবীরদা’র ছোট বোন তরুদি স্কুলে ছিলো। সে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। সকাল নয়টায় আমাদের বন্ধু মমিন আর তমির প্রবীর দা’র বাসায় আসে। ওরা প্রবীরদা’র সাথে দেখা করতে চায়। আমাকে দেখে ওরা কিছুটা বিব্রত হয়। মমিন আমাকে বলে, হিমাদ্রি, তুই একটু বাইরে যা। আমাদের কিছু প্রাইভেট কথা আছে দাদার সাথে। আমি কথা বাড়াইনি। সিগারেট কিনতে পোস্ট অফিসের কাছে চলে আসি। যখন ফিরি, তখন দেখি প্রবীরদা’র গলাকাটা লাশটা খাটের উপর পড়ে আছে। প্রবীরদা’র বিরোধী গ্রুপ খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে জড়িয়ে দিল এই খুনের মামলায়। আমার প্রমাণ করার কোনো সুযোগই ছিল না যে, আমি আসল খুনি নই।

তরুদি আমাকে খুব ভালো জানতো। তার থেকে আমি তিন বছরের ছোট। তবু তরুদির সাথে আমার একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। ভালোবাসার সেই অমোঘ আহ্বান আমরা কেউ উপেক্ষা করতে পারিনি। তরুদির রূপ আর গুণের কমতি ছিল না। ভালো গান করে, অভিনয়, আবৃত্তি করে। আরও কতো কী! শহরের সাংস্কৃতিক পাড়ায় তরুদি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রবীরদা জানতেন আমাদের দুজনের সম্পর্কটা। তিনি বেশ উদারমনা মানুষ ছিলেন। কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাসী একজন অকৃতদার মানুষ ছিলেন। সহজভাবেই দেখেছিলেন  আমাদের সম্পর্কটা। কিন্তু খুনের মিথ্যা মামলায় আমি জেলে গেলে তরুদি বাধ্য হয়েছিলো বাস্তবতা মেনে নিয়ে শিবেনদাকে বিয়ে করতে। কিংবা বলা যায় শিবেনদা জোর করে তরুদিকে বিয়ে করেছিলো। সে এখন সরকারি দলের এমপি। তার কাছের লোকজন বলে, অল্পদিন বাদেই উনি মন্ত্রি হবেন ।

ঠিক করলাম, শিবেনদা’র বাসভবনে যাবো। ওখানে গেলেই তরুদির দেখা পাবো । তাছাড়া শিবেনদা’র মুখোমুখি হয়ে একটা ধাক্কা খাওয়াতে চাই তাকে । শুনলাম জেলার রাজনীতি এখন তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন । তার কথা ছাড়া শহরের বাতাস উত্তর থেকে দক্ষিণে কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায় না ।


৩.

আমি অনেকটা পথ হেঁটে শিবেন দা’র বাসায় হাজির হলাম । দোতালা বাড়ির নীচতলায় এখনো বেশ কিছু সাক্ষাতপ্রার্থী বা তদবিরকারী বসে আছে । পিএস হিসেবে যে ছেলেটি কাজ করছে তাকে আমি চিনি না। আমাকে দেখে সে বেশ আগ্রহ নিয়ে কাছে এগিয়ে এলো। কার কাছে, কী কাজে এসেছি জানতে চাইল। আমি বললাম, শিবেনদা অথবা তরুদির সাথে দেখা করতে এসেছি। আমি একটা কাগজে আমার নাম লিখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমাকে দোতলায় ডেকে পাঠানো হল।

দোতলায় বিশাল হলরুম। আমি এক পাশে আড়ষ্ট হয়ে সোফায় বসলাম। দেয়ালের এক কোণে খুব বড় করে বাঁধানো আছে শিবেনদা আর তরুদির বিয়ের ছবি। শিবেনদা’র মুখটায় তৃপ্তির হাসি। তরুদিকে কেমন যেন প্রাণহীন, বাসি ফুলের মতো দেখাচ্ছে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিজের অসতর্ক মুহূর্তে বেরিয়ে এলো। গোলাপি সুতি শাড়ি আর চোখে পাতলা কালো ফ্রেমের চশমা পরে তরুদি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো । আমাকে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে গেলো।

— তুমি?

— চিনতে পারছো তাহলে?

— কবে বের হলে?

— আজই, দুপুরে।

— তারপর, তুমি কেমন আছ?

— এটা জানা কি তোমার জন্য খুব জরুরি?

— এভাবে কেন বলছো হিমাদ্রি?

—একজন জেলফেরত খুনির মুখে তুমি নিশ্চয়ই কবিতার লাইন বা গানের কলি আশা করো না!

তোমাকে খাবার দিচ্ছি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও— এই বলে তরুদি ভেতরে চলে গেল। খাবার টেবিলে আমরা মুখোমুখি বসলাম । তরুদি খুব দরদমাখা হাতে আমার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে। শত হোক, আমি তো তার সাবেক প্রেমিক। এটা ভাবতেই আমার ভেতরে পুড়ে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া সত্ত্বাটা একটা চাপা ক্রোধে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। তরুদি জানালো, শিবেনদা একটা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণের কাজে নেত্রকোনার বাইরে গেছে । ফিরতে রাত হয়ে যাবে । আমি চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছি। তরুদি আমার চিবুকে হাত দিয়ে বলল, এভাবে মাথা নিচু করে খাচ্ছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে খাও। আমি ভাতের একটা নলা মুখে দিয়ে বললাম, তরু, আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছি । আমি এসেছি তোমার আর শিবেনের সুখের জীবনটাকে তছনছ করে দিতে। এই বলে আমি খাবার অর্ধেকটা রেখে হাত ধুয়ে উঠে গেলাম ।

ড্রয়িং-রুমে এসে আমি আর তরুদি বসেছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। শিবেনদা তার পথের কাঁটা দূর করার জন্যে প্রবীরদাকে খুন করিয়েছে। তরুদিকে পাবার জন্য সেই খুনের মামলায় আমাকে ফাঁসিয়ে এতোগুলো বছর আমার জীবন থেকে সে কেড়ে নিয়েছে । অথচ শিবেনদা’র ভেতরে যে এমন লম্পট, কূটবুদ্ধির আরেকটা শিবেন বাস করে তা আমি কোনোদিন বুঝতে পারি নাই। কিন্তু আজ সে বিরাট জননেতা, রাজনীতিবিদ। ঘেন্নায় আমার মুখে থুতু জমে গেছে ।

তরুদি আমার শরীর ঘেঁষে বসলো। সেই আগের মতো। তাকে আগের তরুদির মতো মনে হচ্ছে আমার কাছে । আমার ভেতরটা প্রবল স্রোতে নদীর ভেঙ্গে পড়া পাড়ের মতো হুড়মুড় করে ভেঙ্গে গেলো । তরুদি আমার দাড়িতে, মুখে, মাথায় ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি কষ্ট চেপে ধরে না রাখতে পেরে এক ঝটকায় তার বুকে মাথা রাখলাম। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। সাত বছর আগে যেভাবে নিতাম। কিন্তু পরক্ষণে আমার পুড়ে যাওয়া সত্ত্বাটা জানিয়ে দিল, হিমাদ্রি, তুমি প্রতিশোধের নেবার জন্যে তৈরি হও। আবার তরুকে নিজের কাছে ফেরত নেবার জন্যে তৈরি হও!

আমার কান্নায় তরুদির বুকের আঁচল ভিজে যাচ্ছে। তবু সে আমাকে তার বুকে চেপে ধরে আছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা অবলম্বন ফিরে পেলো। যেন সারা জীবনের অবলম্বন। সে বিড়বিড় করে বলল, হিমাদ্রি, তুমি আমার উপর প্রতিশোধ নাও! আমার উপর ভয়ানক প্রতিশোধ নাও!

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

ব্যাঙ ও বাচ্চা ছেলেপুলে

একদা আমাদের হরিচরণের বাগানে কয়েকজন ছেলেপুলে খেলা করছিল। বাগানের একদম মাঝখানে একটা পুকুর। ছেলেপুলেগুলা খেলতে খেলতে ওই পুকুরের ধারে চলে

কবিতা

মরিয়মের নদী হতে ইচ্ছে করে

মরিয়মের নদী হতে ইচ্ছে করে মরিয়মের নদী হতে ইচ্ছে করে, কলোরাডো নদী– ফিরোজা সবুজ রঙ! তাকে জড়ো করতে বলি পাতা,