ধরুন আপনার বন্ধুকে নিয়ে কোনো এলাকায় ঘুরতে গিয়েছেন। সে আপনাকে অপেক্ষা করতে বলে কোথাও চলে গেল। আপনি তার জন্য ঠিক কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন? ১ ঘণ্টা? ১০ ঘণ্টা ? এক দিন? এর চেয়ে বেশি সময় হয়ত আপনি অপেক্ষা করবেন না।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানি সেনা কর্মকর্তা হিরু ওনদা তার কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন জানেন? ২৯ বছর!
হিরু ওনদা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করা জাপানি সেনাদের মধ্যে অন্যতম যিনি ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মির আত্মসমর্পণের পর ২৯ বছর পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন। তবে কেন এবং কীভাবে তিনি এমনটা করেছিলেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
হিরু ওনদা ২২ শে মার্চ, ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন জাপানের বিখ্যাত সামুরাই যোদ্ধা। তার বাবা জাপানের অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সার্জেন্ট ছিলেন যিনি দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে অংশ নেন এবং মারা যান। বাবার পথ ধরে ১৯৪০ সালে ওনদা জাপানি সেনাবাহিনীতে নাম লেখান। এর ঠিক এক বছর পরেই জাপান পার্ল হারবার আক্রমণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
সেনাবাহিনীতে ওনদাকে গড়ে তোলা হয়েছিল একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিসেবে। সেখানে তিনি অপ্রথাগত সেনা দক্ষতা, যেমন: গেরিলা যুদ্ধ, ফাঁদে ফেলা এবং প্রপাগান্ডা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।
১৯৪২ সালে জাপান ফিলিপাইন দখল করে নেয়। কিন্তু ফিলিপাইনের সরকার এবং আমেরিকান সেনাবাহিনীর সাথে জাপানের সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৯৪৪ সালের শুরুতে আমেরিকা ফিলিপাইনে জাপানি সেনাদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য শক্তিশালী আক্রমণ চালায় এবং এর ফলে জাপানিরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ১৯৪৪ সালের শীতকাল নাগাদ জাপানি সেনারা ফিলিপাইনের মূল দ্বীপগুলো থেকে পিছু হটে এবং ছোট দ্বীপগুলোতে আশ্রয় নেয়।
ডিসেম্বর ২৬, ১৯৪৪ এ জাপানি লেফটেন্যান্ট হিরু ওনদাকে এরকম এক ছোট দ্বীপ লুবাংয়ে পাঠানো হয় গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে আমেরিকান এবং ফিলিপাইনের সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য।
হিরু ওনদা গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় পারদর্শী ছিলেন, যা দীর্ঘদিন মিত্রশক্তির এই অঞ্চলে যুদ্ধ করার পথে পথের কাঁটা হয়েছিল। কিন্তু ওনদা লুবাং দ্বীপে পৌঁছাতেই সেখানে অফিসাররা ওনদাকে গেরিলা যুদ্ধের পরিবর্তে মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধ করতে আদেশ দেন। এর ফলে আমেরিকান সেনারা যখন দ্বীপটিতে আসেন, জাপানি সেনারা তাদের সাথে সম্মুখ লড়াই করে এবং দ্রুতই পরাজিত হয়।
পরাজয় ঘনিয়ে আসছে দেখে ওনদা তিনজন সেনা সদস্য প্রাইভেট উইচি আকাটসু, কর্পরাল সইচি শিমাদা এবং প্রাইভেট ফার্স্ট ক্লাস কিনশিচি কজুকাকে নিয়ে জঙ্গলে চলে যান এবং তাদেরকে আদেশ দেন তার সাথে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতে, যেই গেরিলা যুদ্ধ তিনি ২৯ বছর ধরে চালিয়ে যান! তার প্রতি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শেষ আদেশ ছিল যুদ্ধে থাকতে এবং লড়াই করতে।
কিন্তু তাই বলে ২৯ বছর! কেন ওনদা এমনটি করলেন?
তৎকালীন জাপানি মিলিটারি কোড অনুযায়ী, সকল সেনাদের শিখানো হতো যে আত্মসমর্পণ অপেক্ষা মৃত্যু ভালো। তাছাড়া, জাপানি ইতিহাস এবং সাহিত্য ঘেটে দেখলে দেখা যায়, যেসব যোদ্ধা যুদ্ধের কারণের প্রতি সবসময় অনুগত ছিলেন, যদিও যুদ্ধ জয় করার সম্ভাবনা অনেক কম বা নেই বললেই চলে– এরকম সেনাদের নায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। হয়ত এসব বিশ্বাস নিজের ভিতর জাগ্রত ছিল বলেই ওনদা লুবাং দ্বীপে থেকে যান এবং লড়াই চালাতে থাকেন।
তবে কীভাবে তিনি টিকে ছিলেন এত বছর? তার কাছে কী যুদ্ধ শেষ হবার খবর পৌঁছায়নি?
ওনদা এবং তার লোকেরা বেঁচে ছিলেন চুরি করা চাল, নারিকেল এবং মাংস খেয়ে, যেগুলো তারা বিভিন্ন ফার্মে হানা দিয়ে সংগ্রহ করতেন।
আগস্ট, ১৯৪৫ সালে জাপান আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু যুদ্ধে যে জাপান আত্মসমর্পণ করেছে, সে ব্যাপারে ওনডা সন্দেহ করেনি। তাই সে তার সঙ্গীদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। স্থানীয় কৃষকদের হত্যা, পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধেও তারা জড়িয়ে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্র জাপানের গেরিলা ইউনিটের অস্তিত্ব জানত। কিন্তু এই গেরিলা ইউনিটের কেন্দ্রীয় সেনা ইউনিটের সাথে যোগাযোগ করার কোনো পদ্ধতি ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্র এদের কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানা চেষ্টা করে, সেই চেষ্টা মধ্যে একটি ছিল গেরিলাদের অবস্থানে বিমান নিয়ে লিফলেট ছেড়ে দেওয়া।
হিরু ওনদা এবং তার লোকেরা প্রথম লিফলেট পান অক্টোবর, ১৯৪৫ সালে। কিন্তু তারা এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, তাদের ধারণা ছিল জাপান আত্মসমর্পণ করেনি। তারা সেই লিফলেটকে একেবারেই গুরুত্ব দেননি। ওনদা একে প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেন।
১৯৪৫-এর শেষদিকে আরও লিফলেট আসলে ওনদা এবং তার লোকেরা লিফটেনগুলো গভীরভাবে পরীক্ষা করেন এবং মনে করেন যে এগুলো ভুয়া।
আসলে তাদের মনে গভীর বিশ্বাস ছিল যে, জাপান কোনোভাবেই আত্মসমর্পণ করবে না।
১৯৪৯ সালে ওনদার এক লোক, প্রাইভেট আকাটসু উপলব্ধি করেন যে, যুদ্ধ আসলেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তিনি তার ইউনিট ত্যাগ করেন এবং ছয় মাস একাকীত্বে থেকে মার্চ, ১৯৫০-এ ফিলিপাইন আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
আকাটসুর আত্মসমর্পণে বাকি বিশ্ব লুবাং দ্বীপে জাপানি গেরিলাদের অস্তিত্বের কথা জানতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র গেরিলাদের পরিবারের সদস্যদের ছবি এবং চিঠি সংগ্রহ করে লুবানং দ্বীপে তা বিমান পথে গেরিলাদের অবস্থানে ফেলে। কিন্তু ওনদারা ছবি এবং চিঠি দেখে মনে করেন তাদের পরিবারের সদস্যরা দখলদারিত্বে বসবাস করছে এবং বেঁচে থাকার জন্য কর্তৃপক্ষের আদেশে এসব পাঠাচ্ছে।
দিন দিন ওনদার বেঁচে থাকার সংগ্রাম কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাদের খুঁজতে ফিলিপাইন সার্চ পার্টি গঠন করে। ততদিনে তারা ঘোষিত অপরাধী ছিল। ১৯৫৪ সালে এবং ১৯৭২ সালে পুলিশ অফিসারদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে তার দুই লোক মারা যায়। ১৯৫৯ সালে অফিসিয়ালি তাকেও মৃত ঘোষণা করা হয়। ওনদা সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন এবং একা একাই ফিলিপিন সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ লড়তে থাকেন।
জাপানি জনগণ ওনদার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সেরকম একজন ছিলেন নরিও সুজুকি, যিনি একজন পর্যটক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তার এক ভ্রমণ সফরে লেফট্যানেন্ট ওনদার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার ইচ্ছা পূরণ হয় ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে, ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপের জঙ্গলে তিনি ওনদার দেখা পান। ততদিনে বৃদ্ধ সেনা কর্মকর্তা ওনদাকে তিনি জাপানের আত্মসমর্পণের কথা বলেন।
ওনদা বলেন যে যতদিন একজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি না দিচ্ছে, ততদিন তিনি দ্বীপ ছাড়বেন না।
সুজুকি জাপানে গিয়ে সরকারকে ওনদার কথা অবহিত করেন এবং সরকার ওনদার কমান্ডিং কর্মকর্তার ব্যাপারে খোঁজ নেয়। মেজর ইয়সিমি তানিগুচি ততদিনে একজন বই বিক্রেতা হয়ে গিয়েছিলেন। তাকে উড়িয়ে নেওয়া হয় ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে, ওনদার কাছে।
মার্চ ৯, ১৯৭৪ সালে ৫২ বছর বয়সী ওনদা তার সামরিক পোশাকে বের হয়ে আসেন জঙ্গল থেকে। তিনি তার কমান্ডিং অফিসারের আদেশে অস্ত্র সমর্পণ করেন। মজার ব্যাপার হলো, মেজরের সাথে দেখা হবার পূর্বেও তিনি দ্বিধান্বিত ছিলেন এবং একে ফাঁদ মনে করেছিলেন!
তিনি আত্মসমর্পণের অংশ হিসেবে তার তলোয়ার ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টকে প্রদান করেন। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে করা নানা অপরাধের জন্য তাকে ক্ষমা করে দেন। অবশেষে জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণের ২৯ বছর পর ওনদার যুদ্ধও শেষ হয়।
অবশেষে ওনদা তার নিজ দেশ জাপানে ফিরে আসেন। তাকে সাদরে গ্রহণ করে নেয় জাপানি জনতা। যুদ্ধ পরবর্তী জাপানে অনেক উন্নতি হয়েছিল, তবে কোথায় যেন তাদের গর্বের জায়গা অনুপস্থিত ছিল। ওনদার দেশে ফেরত আসা তাদের হারিয়ে যাওয়া গর্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
জাপান যতটা উচ্ছ্বসিত মনোভাব দেখায় ওনদার ফিরে আসাতে, ততটাই ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপের অনেক মানুষ ওনদার বিনা বিচারে জাপান চলে যাওয়ায় ক্ষুদ্ধ হয়, বিশেষ করে তারা যাদের পরিবারের মানুষ ওনদা এবং তার লোকেদের কাছে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে ওনদাকে দোষ দেওয়া যায় কিনা, তাও ভাবনার বিষয়, কেননা তিনি ভেবেছিলেন জাপান তখনো যুদ্ধে আছে।
জাপানে আসার পর ওনদা রাজনীতিতে যোগ দেন। কিন্তু পরিবর্তিত জাপানের সাথে তিনি ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ১৯৭৫ সালে তিনি ব্রাজিলে চলে যান এবং পরবর্তী বছর বিয়ে করেন।
১৯৮৪ সালে তিনি আবার জাপান ফিরে আসেন এবং ওনডা নেচার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে টিকে থাকার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে শিক্ষা দেয়া হতো। ১৯৯৬ সালে তিনি লুবাং সফরে যান এবং সেখানকার এক স্কুলে ১০ হাজার ডলার দান করেন। জীবনের পরবর্তী সময় তিনি জাপানে এবং ব্রাজিলে কাটান।
২০১৪ সালে ৯১ বছর বয়সে টোকিও শহরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কেউ ওনদার যুদ্ধের পর ২৯ বছরের যুদ্ধকে অর্থহীন কার্যকলাপ মনে করেন আবার কেউ কেউ ওনদাকে মনে করেন দায়িত্বশীলতা এবং ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। তবে যে যাই মনে করুক না কেন, ব্যতিক্রমধর্মী চমকপ্রদ কাজের জন্য হিরু ওনদা অনেকদিন মানুষের স্মরণে থাকবেন।