দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

“আমি প্রথমত একটা মানুষ, তারপর একজন লেখক”

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

নাহিদা আশরাফী। কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্মস্থান বরিশাল। “জলধি” নামক সাহিত্যপত্রের সুসম্পাদক। তার গল্পসমূহে বর্তমান সময় বাস্তবতার কথা উঠে এসেছে সাবলীলভাবে। নারীবাদী চিন্তা-ভাবনার বাইরে বেরিয়ে মানবতাবাদকে তিনি তার মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার লেখাতে এর প্রভাব লক্ষণীয়। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: জাদুর ট্রাংক এবং বিবর্ণ বিষাদেরা (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) এপিটাফ (কাব্যগ্রন্থ , ২০১৫), শুক্লা দ্বাদশী (যৌথ কবিতাগ্রন্থ, ২০১৬), দীপাঞ্জলি (যৌথ কবিতাগ্রন্থ, ২০১৬), মায়াবৃক্ষ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৬), প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), মুক্তির গল্পে ওরা এগারোজন (মুক্তিযুদ্ধের গল্প, সম্পাদিত)।


প্রশ্ন: সাহিত্যচর্চার এ পথে আসার কারণ কী?

নাহিদা আশরাফী: সাহিত্যচর্চার পথে আসবার আসলে কোনো কারণ থাকে না। মূলত কারণ বা যুক্তি খুঁজে কখনো সাহিত্যচর্চা হয় না। সাহিত্যচর্চাটা মন ও মননশীলতার ব্যাপার। ভেতর থেকেই কেউ একজন সাড়া দেয় বোধহয়।

প্রশ্ন: এটা কবে থেকে সাড়া দেয়? একদম ছোটোবেলা থেকে সাড়া দেয় নাকি একটা নির্দিষ্ট বয়সে উত্তীর্ণ হবার পরে?

নাহিদা আশরাফী: ছোটবেলা থেকেই। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার সময় পরীক্ষার খাতায় একটা কবিতা লিখেছিলাম– পরবর্তীতে যেটা স্কুল ম্যাগাজিনেও ছাপা হয়েছিল।

প্রশ্ন: কবিতাটির নাম কী ছিল?

নাহিদা আশরাফী: কবিতাটার নাম ছিলো “ধবলবক”।

প্রশ্ন: কত সালের দিকে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে একটা মজার গল্পও আছে জানি। গল্পটি শুনতে চাই।

নাহিদা আশরাফী: হ্যা। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। সম্ভবত ৮৫-৮৬ সালের দিকে হবে। বেশ একটা মজার কাহিনী। কবিতাটি আমি লিখেছিলাম আমার বৃত্তি পরীক্ষার খাতায়। পরীক্ষা দিচ্ছি–  এমন সময় মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলা বক। বকগুলো দেখে কয়েকটা লাইন মাথায় আসলো। সঙ্গে সঙ্গে খাতাতেই লিখলাম। পরিদর্শক যিনি ছিলেন উনি এসে ঘুরে ঘুরে দেখছেন। অতঃপর পরিদর্শকের সাথে আমার কথোপকথন।

– এই মেয়ে, তুমি বৃত্তি পরীক্ষা দিচ্ছো আর বাইরের দিকে তাকিয়ে আছো কেনো?

– আমার লেখা শেষ।

– লেখা শেষ তো বাইরে তাকিয়ে আছো কেন, রিভিশন দাও। বাইরে কী দেখছো?

– বক দেখছি।

– (খাতাটি টেনে নিয়ে) দেখি, খাতার মধ্যে কী লিখেছো?

– তুমি এটা কখন লিখেছো?

– এখন লিখেছি, বাইরের বক দেখে।

– (মুচকি হেসে) তুমি যে এখানে লিখেছো, তুমি কি জানো না খাতাটা তুমি জমা দিয়ে দেবে! তাহলে তোমার কবিতাটা থাকবে কী করে?

আমি মহা চিন্তায় পড়লাম। তাই তো! কিন্তু তখন তো আর মাথায় ওটা কাজ করেনি, আমার লেখার ছিল লিখেছি।

প্রশ্ন: সাহিত্য জীবনে আপনাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন কে?

নাহিদা আশরাফী: শুধু সাহিত্যে বলবো না সৃজনশীল সবকিছুতেই আমি সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছি আমার বাবা-মা’র কাছ থেকে।

প্রশ্ন: সাধারণত দেখা যায় সাহিত্যচর্চা করতে আসলে পরিবার বেশিরভাগ সময় বাঁধা দেয়, আপনার ক্ষেত্রে তো তাহলে এমনটি ঘটেনি।

নাহিদা আশরাফী: না, এমনটি ঘটেনি। আমার পরিবার সম্পূর্ণভাবে সাহিত্যবান্ধব। এত বেশি উৎসাহ পেতাম তা বলে বুঝাতে পারবো না। “জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা” থেকে শুরু করে “নতুন কুঁড়ি” এবং একের পর এক প্রোগ্রামগুলোতে আমি অংশগ্রহণ করেছি। এ বিষয়ে আমার পরিবার থেকে ছিল অবাধ স্বাধীনতা।

প্রশ্ন: যতদূর জানি আপনি “নতুন কুঁড়ি” পুরস্কার কিংবা বিভিন্ন “জাতীয় পুরস্কার” অর্জন করেছেন।

নাহিদা আশরাফী: হ্যা, আমার যাত্রা ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা’ থেকে। আবৃত্তি, বিতর্ক ও রচনা প্রতিযোগীতায় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি দু’বার। এছাড়া আমি “নতুন কুঁড়ি” পুরস্কারও পেয়েছি।

প্রশ্ন: যতটুকু জানি আপনার লেখালিখি শুরু কবিতা দিয়ে পরবর্তীতে কথাসাহিত্যে আসা…

নাহিদা আশরাফী: প্রথমে কবিতাটা দিয়েই শুরু হয়েছিলো। এরও একটা কারণ আছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, অধিকাংশ লেখকই ছন্দ প্রবণতা দিয়েই সাহিত্যের যাত্রা শুরু করেন। আমার মনে হয়, ছন্দটা মানুষের হৃদয়ে ভাবাবেগের একরকম দোলা তৈরি করে। আর ছন্দটা দোলা দিলেই– প্রাথমিকজ্ঞানে একজন চেষ্টা করে একটা কবিতা বা ছান্দসিক কিছু একটা লেখার।

প্রশ্ন: একটা গল্প এবং কবিতা লেখার মধ্যে লেখকের মনস্ততাত্ত্বিক পার্থক্যটা কেমন? অন্যকথায়, আপনি যখন একটা কবিতা লেখেন তখন আপনার ভিতরের অনুভূতি কেমন আর যখন একটা গল্প লেখেন তখনকার অনুভূতি কেমন?

নাহিদা আশরাফী: দুটো ক্ষেত্রেই মনস্ততাত্ত্বিক পার্থক্য তো রয়েছেই। কবিতা হচ্ছে, একটা অলৌকিক সত্তাকে ধরা। আর গল্প হচ্ছে যা ঘটেছে এবং যা ঘটেনি এই দুইয়ের সংমিশ্রণ ঘটানো। কবিতায় কবির অনুভবকে অল্প ও নান্দনিক কথায় পাঠকের দরবারে তুলে ধরবার দায়বদ্ধতা থাকছে, কিন্তু গল্পের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন, এখানে গল্পকার বর্ণনার ঘনঘটায় তার কল্পনা ও বাস্তবতার তুলি চালাবার এক বিস্তর ক্যানভাস পাচ্ছেন।

প্রশ্ন: পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে আপনার গল্পে নানাবিধ প্রক্রিয়া দেখা যায়, যেমন– অনুষঙ্গ পুরাণ গল্পে আপনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘পাঠক, বাবলু আর লোকটি যেতে থাক।’ অথবা পাঠককে সম্বোধন করেছেন ‘প্রিয় পাঠক’ বলে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গদ্যের মধ্য দিয়ে উহ্যভাবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন– গদ্যসাহিত্যে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

নাহিদা আশরাফী: গদ্যসাহিত্যে ইন্টার‍অ্যাকশনটা খুব জরুরী, সেই ইন্টার‍অ্যাকশনটা আপনি কোন ওয়েতে করবেন এটা নির্ভর করে, আপনি যে প্লাটফর্ম নিয়ে লিখছেন তার উপর। আপনার সাথে গল্পের চরিত্রের, গল্পের চরিত্রের সাথে পাঠকের এবং এর মধ্য দিয়ে আপনার সাথে পাঠকের যে সম্পর্কটা বা পারস্পরিক বোঝাপড়াটা হচ্ছে সেটা খুবই জরুরী। আমি গল্পটা বলছি অর্থাৎ নিজেকে কথকের ভূমিকায় দেখতে বরাবরই খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

প্রশ্ন: আপনার গল্পের গদ্যের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় আপনার গল্পের গদ্য একদম ঝরঝরে… তারপরেও আপনি আপনার গল্পের ভিতরে ভাষা ও কাহিনীর মাধ্যমে এক ধরনের অন্তর্জাল সৃষ্টি করেন, এই অন্তর্জাল সৃষ্টির বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

নাহিদা আশরাফী: অন্তর্জাল সৃষ্টি করাটাই তো লেখকের কাজ। যে কোনো ঘটনাকে লেখক তার দৃষ্টিতে দেখে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করবে। কিন্তু এই অন্তর্জাল সৃষ্টির প্রক্রিয়াটাকে যে যত নিখুঁত করতে পারেন তিনি ততটাই স্বার্থক। মাকড়সা যখন জাল বোনে, তখন আপনি একটা জিনিস খেয়াল করবেন(এটা কিন্তু সায়েন্স দ্বারা স্বীকৃত) এর প্রতিটা স্টেপ একইরকম। একারণে মাকড়সার জালকে আমরা অনন্য এক শিল্পবোধের জায়গা থেকে দেখি । আবার বাবুই পাখির কথাই ধরুন। কী নিপুণ, কী নিখুঁত বাসা তৈরি করে – গদ্যের বুননটাও তেমন। যতটা নিখুঁত হবে গদ্যসাহিত্যের রসাস্বাদনে পাঠক ততটাই আনন্দ খুঁজে পাবেন। আমরা প্রত্যেকে আসলে ওই চেষ্টাতেই ছুটি। এই ছোটার ক্ষেত্রে কেউ এগিয়ে যাই, কেউ পিছিয়ে পড়ি, কেউ হয়তো আস্তে আস্তে পড়তে পড়তে পঠন প্রক্রিয়াটাকে আরও উন্নত করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।

প্রশ্ন: একটা গল্পের কী সবসময় উদ্দেশ্য থাকতে হবে– এমন কোনো বিষয় কী আছে?

নাহিদা আশরাফী: উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্যহীনতা দুটি শব্দই যখন অভিধানে আছে তার মানে উদ্দেশ্যহীনতাও একটা গল্প তৈরি করতে পারে। আমরা বিশ্বসাহিত্যের অনেক গল্পে এমন দৃষ্টান্ত পাই। একজন পথিক হেঁটে যাচ্ছে, আপনি এই দৃশ্যকে উদ্দেশ্যহীন ভাবতে পারেন, অথচ অজস্র উদ্দেশ্য এর মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। কাজেই উদ্দেশ্যহীন বলে মূলত আমরা যে বিষয়টা ভাবছি, সেটাই হয়তো একটা সময়ের বাঁক পেরিয়ে এক বিশাল উদ্দেশ্য নিয়ে হাজির হবে আপনার আমার সামনে। কিছুকিছু ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যহীনতাই একটি উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে দেখা যায় অনেকে গদ্য নিয়ে অনেক ধরনের নিরীক্ষা করছেন, আপনার কী এ ধরনের কোনো ইচ্ছা আছে?

নাহিদা আশরাফী: গদ্যসাহিত্য সবসময়ই একটি নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। নিরবিচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চায় নিরীক্ষা না থাকলে বাস্তবতার বোধকে আপনি বা আমি কিভাবে পরিবর্তন,পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবো? আপনি দেখুন বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে আমরা পেয়েছি ডরোথি রিচার্ডসন, জেমস জয়েস বা ভার্জিনিয়া উলফের মত লেখকদের যারা নিরীক্ষাধর্মী কাজের জন্যে প্রসিদ্ধ। কথন থেকে সংলাপে গিয়ে আবার কথনে ফেরা অর্থাৎ সুচারু বাঁক বদলের ক্ষেত্রে নিরীক্ষাধর্মী কাজের সাফল্য প্রশ্নাতীত। বাংলা সাহিত্যে শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যের আর এক অনন্য উদহারণ হতে পারে। ভাষা ও প্রকরণে আলাদা কিছু ফুটিয়ে তুলতে না পারলে শুধু বিষয় বৈচিত্র্য দিয়ে গদ্যসাহিত্যকে আমি নিরিক্ষাধর্মী সাহিত্য বলতে রাজি নই। অতি সম্প্রতি কিছু গল্পের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য পাচ্ছি। তাই নিরীক্ষা করতে করতে নিরীক্ষার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াটাও উচিৎ নয়। যেমন সম্প্রতি একটা গল্প শুনে মনে হয়েছে এটা গল্প না হয়ে প্রবন্ধ নামে সামনে এলেই বোধকরি আমার পড়তে আরামবোধ হত।

প্রশ্ন: “জলধি” আপনার পত্রিকা, যেটা এপার বাংলা ওপার বাংলায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে, আপনি যেহেতু একইসাথে একজন সাহিত্যিক এবং একজন সাহিত্য সম্পাদক, সেহেতু একটা প্রশ্ন এসে যায়, লেখক সত্তা এবং সম্পাদক সত্তা এ দুটোর মধ্যে ডিফারেন্স বা পার্থক্য কী?

নাহিদা আশরাফী: মেলা পার্থক্য। আমি যখন লিখছি তখন আমি লেখক। একজন লেখক সর্বদাই লেখক, একজন সম্পাদক সর্বদাই লেখক নন। তবে উভয় সত্তার জন্যেই মননশীল পাঠক হওয়াটা খুব জরুরি। একজন লেখক তার নিজের লেখা গল্পের প্রকৃত পাঠক হয়ে উঠবে না কখনই, কারণ যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই তিনি লেখাটিকে দেখতে চান না কেন তার ভিতরে লেখক সত্তাটাই কাজ করবে। কিন্তু একজন সম্পাদক এই দুঃখবোধ থেকে দূরে থাকেন। প্রভাবিত না হলে একজন নির্মোহ সম্পাদক সাহিত্যের প্রধানতম সূত্রধর হতে পারেন।

প্রশ্ন: একজন সম্পাদকের প্রধান কাজ কী বলে আপনি মনে করেন?

নাহিদা আশরাফী: সম্পাদকের একটা দায়বদ্ধতা থাকে। এই দায়বদ্ধতা থেকেই একজন সম্পাদক সম্পাদনার স্বরূপ খুঁজে পাবেন। প্রশ্ন এটাই যে এই দায়বদ্ধতা কার প্রতি এবং কেন? এই দায়বদ্ধতা সাহিত্যের প্রতি। যখন একটি পত্রিকা সেটা সাহিত্যের ছোট কাগজ হোক কিংবা সাহিত্য পত্রিকা, পাঠকের হাতে তুলে দেবার আগে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হয়; লেখক পাঠকের মধ্যবর্তী জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি যেন নির্মোহ সম্পাদনার কাজটা করতে পারি এবং লেখক ও পাঠকের সেতুবন্ধনটা যেন সেই শক্ত থামের উপর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি। নবীন ও প্রবীণ লেখকের নিবিড় সম্পর্কের একটা স্বাচ্ছন্দ্য পথ তৈরির পাশাপাশি নবীন লেখকের পরিচর্যার বিষয়টিও একজন সম্পাদকের দায়িত্ব বলে মনে করি আমি ।

প্রশ্ন: এসবই কী তাহলে সম্পাদনার প্রধান কাজ?

নাহিদা আশরাফী: সম্পাদকের আরও অনেক কাজ আছে। যেমন লেখক তৈরি করা। লেখক তৈরিতে একজন সম্পাদকের যে কী অসাধারণ ভূমিকা থাকতে পারে এটা আমরা আমাদের লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস ঘাটলে পেয়ে যাবো। একজন বুদ্ধদেব বসু, একজন আহসান হাবীব বা একজন মোহাম্মাদ নাসিরউদ্দিনের হাত ধরে কতশত প্রথিতযশা লেখকেরা উঠে এসেছেন একবার ভাবুন। একটা কথা এক্ষেত্রে না বললেই নয়, সাহিত্য গণিত, রসায়ন বা পদার্থ বিষয় নয় যে শিখে এসে সাহিত্যকর্ম শুরু করে দেবেন। সাহিত্য হচ্ছে আপনার ভেতরের স্বতঃস্ফূর্ত সেই অনুভব যা নিজে থেকেই আপনাকে তাগিদ দেবে সৃষ্টিশীলতার ফল্গুধারা প্রবাহে। এই যে প্রবাহমানতা এটাই আপনাকে সাহিত্যের পথে সত্তর ভাগ এগিয়ে দেবে। কিন্তু ওই যে বাদবাকি তিরিশ ভাগ। এ গ্যাপটা কিন্তু সবসময় থেকেই যাবে। ওই তিরিশের গ্যাপ পূরণে একজন সম্পাদকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে বলে আমি মনে করি। এবার আসি সম্পাদকীয়তে। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের ভাষা এমন হওয়া উচিৎ যেখান থেকেও একজন তরুণ বা নবীন লেখক তার রসদের যোগান পেতে পারেন। ভাষা হতে হবে সরল, স্বচ্ছ, বোধগম্য , সুস্পষ্ট ও বক্তব্যনির্ভর। লন্ডন টাইমস এ একটি সম্পাদকীয় নিয়ে চার্চিলের মন্তব্য ছিলো,’ দ্যা টাইমস ওয়াজ স্পিচলেস ওভার দ্যা আইরিশ হোম রুল এন্ড ইট টুক থ্রি কলামস টু এক্সপ্রেস ইটস স্পীচলেসনেস’। আমি সম্পাদকীয় লিখতে গেলে চার্চিলের এই উক্তিটি অন্তত মাথায় রাখি।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ের লিটলম্যাগগুলো নতুন লেখক তৈরিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?

নাহিদা আশরাফী: আমি পজিটিভ মানুষতো, এজন্য পজিটিভ-ভাবেই সবকিছু দেখতে ভালোবাসি। জানেন তো লেখক কখনও তৈরি করা যায় না। বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে চোখ বোলালেই একটা বিষয় কিন্তু খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে আপনার কাছে। একজন নবীন লেখকের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত বিচরণক্ষেত্র হল ছোট কাগজের উঠোন। ইদানীং কিছু লিটলম্যাগ দেখে খুব আশাহত হই। সম্প্রতি কলকাতায় একটি সেমিনারে একটা কথা খুব ভালোভাবে বলতে চেষ্টা করেছি, ‘আপনি যদি মনে করে থাকেন যে– দশজনের গল্প নিয়ে, পাঁচজনের কবিতা নিয়ে, দুইজনের প্রবন্ধ নিয়ে ছাপিয়ে দিলাম মানেই আমি সম্পাদক বনে গেলাম; তাহলে আপনি বিরাট ভুলের রাজ্যে বসবাস করছেন। নতুন লেখককে উৎসাহ দেওয়া, লেখার তাড়নাকে উসকে দেওয়া– মানে লেখকের ভেতরের আগুনকে পর্যাপ্ত ও পরিণত মাত্রায় প্রয়োগের বিদ্যেটা একজন সম্পাদকই দারুণভাবে বোঝাতে পারেন।

প্রশ্ন: নারীবাদ সম্পর্কে আপনার চিন্তাধারা কী?

নাহিদা আশরাফী: আমি নারীবাদী না যেহেতু সেহেতু এটা নিয়ে চিন্তাও করি না। আমার কোনো বাদিতা (মতবাদ) থাকলেও একটাই আছে, ‘মানবতাবাদ’। আমি প্রথমত একটা মানুষ, তারপর একজন লেখক।

প্রশ্ন: আপনার লেখক সত্তার ভিতর নারী সত্তা কি আসে না?

নাহিদা আশরাফী: না, কোনোভাবেই আসে না। আমি যখন যে চরিত্রকে চিত্রায়ন করবো তখন সেই চরিত্রের সাইকোলজিটা আমাকে ধরতে হবে। আমি কিন্তু তখন নারী বা পুরুষ কোনটাই নই, একজন লেখক।

প্রশ্ন: আপনার সবচেয়ে প্রিয় লেখক কে?

নাহিদা আশরাফী: আমার প্রিয় লেখকের তালিকা অনেক দীর্ঘ। তারাশঙ্কর এর কবি, থেকে শুরু করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা… এই লম্বা তালিকা সহসা শেষ হবে না। তবু প্রিয় কিছু বইয়ের কথা– এই মুহূর্তে যা মনে পড়ছে বলছি। লিও টলস্টয়ের “আনা কারেনিনা”, টনি মরিসনের “বিলাভেড”, ভার্জিনিয়া উলফের “মিসেস ডালওয়ে”, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের “হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড”, এলিফ শাফাকের “ফোরটি রুলস অফ লাভ”, রবীন্দ্রনাথের “গোরা”, আবু ইসহাকের “সূর্যদীঘল বাড়ি”, আখতারুজ্জামানের “খোয়াবনামা”, আল মাহমুদের “পানকৌড়ির রক্ত”, মহাশ্বেতা দেবীর “হাজার চুরাশির মা”… আরও অনেক আছে। কবিতার বই এসটি কোলরিজের “দ্যা রাইম অফ এনসিয়েন্ট মেরিনার”, দান্তের “ডিভাইন কমেডি”, ওয়াল্ট হুইটম্যানের “লিভস অফ গ্রাস”, এবং রেবেকে ডনহামের “কোল্ড প্যাস্টোরাল”, হোমারের “ওডিসি”…বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ, সৈয়দ শামসুল হক, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, রফিক আজাদ–এর কবিতা ভালোবাসি।

প্রশ্ন: এই ভালোলাগার কি পরিবর্তন হতে পারে?

নাহিদা আশরাফী: আসলে আমার কাছে বই খাবারের মতো । বেঁচে থাকার জন্য খাবারের প্রয়োজন ঠিক যতটা আমার কাছে একটি বই ঠিক ততটা। এটার অপরিহার্যতা আমার কাছে এরকমই। অতএব লেখা যা পাই পড়ার চেষ্টা করি। একারনে অনেকের অনেক লেখা আমার ভালো লাগে। ধরুন– বিনয় মজুমদার আমার প্রিয় একজন লেখক, আমার মনে হয় না দ্বিতীয় ‘ফিরে এসো চাকা ’আর একটা তৈরি হবে, কিন্তু তার মানে আবার এই নয় যে তার সব লেখাই আমার ভালো লাগে। একজন লেখকের সব লেখা ভাল লাগার কোন কারণও নেই। কাজেই এই যে আমরা বলে ফেলি না– প্রিয়, সবচেয়ে প্রিয়, খুব প্রিয়, এই কথাগুলো আপেক্ষিক, খুবই আপেক্ষিক। যে লেখক আজকে আমার প্রিয়, কালকে হয়তো আরেকজন লেখক এসে ওই জায়গাটা নিজের করে নিতে পারে। তার মানে ভালোলাগার পৃথিবীতে আরো একজন সদস্য যুক্ত হল। আর কারো যুক্ততার ক্ষেত্রে অন্যের বিযুক্তি তো কোন শর্ত হতে পারে না, তাই না? আমার ভেতরে এ ব্যাপারে ফ্লেক্সিবিলিটি বেশ।

প্রশ্ন: আপনার লেখক জীবনে আপনাকে যদি আপনার লেখার জন্য কিংবা কথার জন্য কখনো নির্বাসিত হতে হয়, তখন আপনার অভিব্যক্তি কী হবে?

নাহিদা আশরাফী: তখনকার অবস্থাই আমার অভিব্যক্তি নির্ধারণ করবে। আগে থেকে বলা মুশকিল।

প্রশ্ন: লেখক হিসেবে তসলিমা নাসরিন যে নির্বাসিত হয়েছেন, বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

নাহিদা আশরাফী: যুগে যুগে অনেক লেখকই নির্বাসিত হয়েছেন। অনেককে নির্বাসিত করা হয়েছে, অনেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েছেন। লেলিন থেকে শুরু করে আমি এখনই বিশ্বসাহিত্যের দশজন লেখকের নাম আপনাকে বলতে পারবো যারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে নির্বাসিত হয়েছেন। ঘটনাটা হচ্ছে, আমাকেও যদি কখনো নির্বাসনে যেতে হয়– যাব। সেখানে বইপত্র তো থাকবে, নাকি! সমস্যা কী, আমি পড়ালেখা করবো। আগেও বলেছি বোধহয় আমি আশাবাদী মানুষ। অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য এ পৃথিবীতে এসেছি। এই সময়ের অনেকটা সময় আমরা ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিই, তারপর যতটুকু সময় থাকে, তাকে কাজে লাগানো উচিৎ।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ের আমাদের যে সাহিত্য তা কি আমাদের সমাজের দর্পণ হয়ে উঠতে পারছে?

নাহিদা আশরাফী: আমরা অনেকেই সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ ভাবি। দর্পণ ভাবা যেতেই পারে নানাবিধ কারণে। দেখুন, ইতিহাস তৈরি হয়। লেখকরা তা লিপিবদ্ধ করেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার মাধ্যমেই জানতে পারেন প্রাচীন ইতিহাস। চরকসংহিতা না লেখা হলে আয়ুর্বেদিক ব্যবস্থা নিয়ে যেমন জানা যেত না তেমনি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র লিখিত না হলে জানা যেত না তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবনাকে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল, বিজ্ঞান যে কোনো কিছুর লিখিত রুপটাকেই আমরা সমাজের দর্পণ মানতে পারি। আর যে কোনো কিছুর লিখিত রূপকে যদি সাহিত্য মানি তবে সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ বলেতেই পারি।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে যে সকল গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হচ্ছে এগুলো কতটুকু আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারছে বলে মনে করেন?

নাহিদা আশরাফী: বর্তমানের আলোড়ন তো লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বাতাসে বাতাসে। পাঠকের মনতো একটা দীঘির মতো, ওতে আলোড়ন সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু আলোড়নটা কতক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে সেটাই আসল বিষয়।

প্রশ্ন: অনেকে অভিযোগ করে থাকেন, ডিজিটালাইজেশনের কারণে এদেশে বইয়েরর পাঠক কমে যাচ্ছে। এটা কী সঠিক?

নাহিদা আশরাফী: খুবই ভুল। বর্তমানে হয়তো কিছুটা কম, আসলে আচমকাই ডিজিটালাইজেশনের একটা চকমকে পাথর আমাদের মগজে এসে লেগেছে তো– এই আর কি। আলট্রা মর্ডানিজম ও ডিজিটাইলেজেশনের মাঝখানে পড়ে আমরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। যখন জলধি করি, আমাকে অজস্রজন বলেছিল তুমি জলধি ওয়েব ম্যাগাজিন হিসেবে করো। আমি কিন্তু সেটা করিনি। এর কারণটা হচ্ছে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এখনো একটা বই হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দ পৃথিবী জয়ের আনন্দের মতো।

প্রশ্ন: আপনার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ “জাদুর ট্রাংক এবং বিবর্ণ বিষাদেরা”-গল্পগ্রন্থটি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

নাহিদা আশরাফী: এ বিষয়ে আমার এখন আর কিছু বলার নেই। এটা নিয়ে এখন তো কথা বলবেন গ্রন্থটির পাঠকেরা।

প্রশ্ন: কথাসাহিত্য নিয়ে আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কী? আপনার কী উপন্যাস লেখার চিন্তা আছে?

নাহিদা আশরাফী: কথাসাহিত্য নিয়ে আমার পরবর্তী পরিকল্পনা উপন্যাস নিয়ে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পড়বো, ২০২৪ বা ২০২৫-এ যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে হয়তো উপন্যাসে হাত দেবো। যতটা সম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে উপন্যাস লিখতে চাই। উপন্যাস লেখার জন্য যথেষ্ট পড়াশুনা আমার এখনো নেই বলেই আমি মনে করি, এজন্যই লিখছি না।

প্রশ্ন: কথাসাহিত্যের সাথে জীবনের সম্পর্ক কী?

নাহিদা আশরাফী: কথাসাহিত্যের সাথে জীবনের সম্পর্ক তো প্রচুর। পুরো জীবনটাই একটা কথাসাহিত্য। কথাটা কেন বলছি একটু সংক্ষেপে বলি, আমার একটি গল্প আছে, হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা– স্রেফ বাজার করতে গিয়ে গল্পটা আমি আবিষ্কার করেছি। জীবনের প্রতি স্তরে স্তরে কত গল্প লুকিয়ে আছে তা জানতে, বুঝতেই এক জীবন কেটে যায়।

প্রশ্ন: এই যে বললেন স্রেফ বাজার করতে গিয়ে আপনার মধ্যে গল্প চলে আসলো– তাহলে কী গল্পগুলো আপনার মাঝে হঠাৎ করেই আসে?

নাহিদা আশরাফী: হ্যাঁ, তা অনেকটা বলা যায়। আমাদের চারপাশে অসংখ্য চরিত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একজন লেখকের যা প্রয়োজন তা হল, পর্যবেক্ষণের অন্তর্দৃষ্টি। চেনা জগতেই লুকিয়ে থাকে গল্প বা উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ ও চরিত্র। তার সাথে কিছু রহস্যময়তা, কিছু চমৎকারিত্ব, কিছু দৃশ্যময় আবহের সমন্বয় ঘটানো, এই তো। বলা যায় একটা পারফেক্ট ব্যালান্স অফ প্রেসেন্টেশান।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে দেখা যায় শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম সাহিত্যের বই দেখলে নাক সিটকায়, আবার তারাই একাডেমিক বইগুলো গলাধঃকরণ করে থাকে, তরুণ প্রজন্মের কথাসাহিত্য বা সাহিত্য পড়তে না চাওয়ার প্রবণতাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

নাহিদা আশরাফী: এই পড়তে না চাওয়ার প্রবণতাকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত নতুন প্রজন্ম পড়তে চাইছে না নাকি আমরা তাদের অর্থাৎ আমাদের নতুন পাঠকদের তাদের সময় ও পাঠোপযোগী বই তুলে দিতে পারছি না। দ্বিতীয়ত শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম বলছেন, আবার তাদের সাহিত্যবিমুখী মনোভাবের কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে তারা শিক্ষিত হল কী করে? বলুন কুশিক্ষিত। আর এদের সংখ্যা আমি নগণ্য বলেই মনে করি। আবার দেখুন পুঁজিবাদ এমন একটা যুদ্ধে আমাদের ঠেলে দিয়েছে, যেটা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করছে। যার ছাপ আমাদের সন্তানদের মানে নতুন প্রজন্মের উপরেও পড়ছে। এতকিছুর পরেও ওরা পড়ছে, সাহিত্যকে লালন করছে। তাই বলবো খন্ডাংশের বিবেচনা কখনো সামগ্রিক বিবেচনা নয়। পড়বার পথ উন্মুক্ত হয়েছে যত, নতুন প্রজন্ম সাহিত্যের প্রতি ততই দায়বদ্ধ হয়েছে। আমি আশাবাদী।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu