এন্টিইটামের যুদ্ধের পর প্রচুর হতাহত সংখ্যা ইউনিয়নকে ভাবিত করে।এদিকে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রচুর দাস স্বাধীনতা এবং সুরক্ষার জন্য ইউনিয়নের ক্যাম্পে চলে আসতে থাকে। যুদ্ধের প্রাথমিককালে লিংকন দাসদের মুক্তির ব্যাপারে অতটা আগ্রহী ছিলেন না। কেননা তিনি মনে করতেন, এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে যে দাসরাজ্যগুলি ইউনিয়নে রয়ে গেছে– ম্যারিল্যান্ড, ডেলাওয়ার, মিসৌরি এবং কেন্টাকি— তারাও আলাদা হয়ে যাবে। এছাড়া তখনকার মার্কিন সংবিধান দাসত্বকে ব্যক্তি সম্পত্তি হিসেবে নানাভাবে সুরক্ষা দিয়ে রেখে দিয়েছিল। তবে আগস্ট, ১৮৬১ সালে কংগ্রেস ‘First Confiscation Act’ পাস করে, যার ফলে ইউনিয়নের সেনারা বিদ্রোহীদের সম্পত্তি জব্দ করতে পারবে। ফলে ইউনিয়নের সেনারা কনফেডারেসিদের দাসও জব্দ করতে পারবে, কেননা তারাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির আওতাভুক্ত। এই আইনের ফলে অনেক দাস মুক্ত হয় এবং ইউনিয়ন সেনাদলে যোগ দেয়। এদেরকে বলা হতো ‘Contrabands’, এই দাসেরা দক্ষিণীদের ফার্মে কাজ করত, ফলে দক্ষিণীরা ব্যাপক হারে যুদ্ধে যোগ দিতে পেরেছিল। কিন্তু ইউনিয়নের এই কৌশলের কারণে কনফেডারেসির অবস্থান দুর্বল হতে থাকে।
এপ্রিল, ১৮৬২ সালে কংগ্রেস ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া থেকে দাস প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। তিন মাস পর কংগ্রেস ‘Second Confiscation Act’ আইন পাস করে, যার মাধ্যমে বলা হয় যে— কনফেডারেসির কোনো নাগরিক অথবা সেনা সদস্য ৬০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে তাদের দাস আপনা আপনি মুক্ত হয়ে যাবে। দুইদিন পর কংগ্রেস কনফেডারেসি অঞ্চলে দাসত্ব নিষিদ্ধ করে। এদিকে লিংকন ১ জানুয়ারি, ১৮৬৩ সালে ‘The Emancipation Proclamation’ জারি করেন, যার মাধ্যমে ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে নেই এমন সব অঞ্চলে দাসদের মুক্তি ঘোষণা করা হয়। যুদ্ধের প্রাথমিককালে মনে করা হয়েছিল যে এই যুদ্ধ কেবল ইউনিয়নকে বাঁচানোর জন্য, তবে লিংকনের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধ দাসপ্রথা থাকবে কি থাকবে না সেটির নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘোষণা আরেক দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কালো আফ্রিকান আমেরিকানরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধের শেষ অবস্থায় এদের সংখ্যা ছিল ১,৮০,০০০, যা কিনা মোট সেনাসদস্যের ১০ ভাগ। এছাড়াও নৌবাহিনীতে ছিল আরও ২০,০০০ জন আফ্রিকান আমেরিকান সেনা। এরা ইউনিয়নের যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনাকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল।
চ্যান্সেলরভিলের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এপ্রিল ৩০ থেকে মে ৬, ১৮৬৩ সালে। এই যুদ্ধকে কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট ই লির সবচেয়ে বড় বিজয় বলে মনে করা হয়। এই যুদ্ধে কনফেডারেট সেনার তুলনায় দুইগুণ ইউনিয়ন সেনা অংশগ্রহণ করেছিল। রবার্ট লি চাতুর্যের পরিচয় দিয়ে নিজের সেনাদের দুই ভাগে ভাগ করে দেন। আকস্মিক এই কৌশলে ইউনিয়নের সেনারা হতবিহবল হয়ে পড়ে এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়।কনফেডারেসিকে এই যুদ্ধের জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল, কেননা কনফেডারেসির বিখ্যাত জেনারেল থমাস ‘স্টনওয়াল’ জ্যাকসন মারাত্মকভাবে আহত হন।
১ থেকে ৩ জুলাই, ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে মনে করা হয়। চ্যান্সেলরভিলের বড় বিজয়ের পর কনফেডারেটরা ভার্জিনিয়া থেকে পেনসিলভানিয়াতে আসতে থাকে। অগ্রসরমান সেনারা গেটিসবার্গে ইউনিয়ন আর্মির মুখোমুখি হয়। ইউনিয়ন আর্মির সাথে তিনদিন ব্যাপি চলা এই যুদ্ধে কনফেডারেসির ব্যাপক পরাজয় ঘটে। কনফেডারেসি ২৮০০০ সেনা হারায়, যা ছিল তাদের মোট সেনার তিন ভাগের এক ভাগ। তবে রবার্ট ই লি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কনফেডারেসির সেনাদল পিছু হটে ভার্জিনিয়ায় চলে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধের ফলে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কনফেডারেসির চূড়ান্ত পরাজয় কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই যুদ্ধের পর গেটিসবার্গে এসে আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন,
“Government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth.”
১৮৬৪ সালে ইউনিয়ন জেনারেল উইলিয়াম টি শেরম্যান কনফেডারেটদের মুখোমুখি হন জর্জিয়াতে। শেরম্যানের লক্ষ্য ছিল টেনেসির কনফেডারেট আর্মিদের হটিয়ে দেওয়া, আটলান্টা দখল এবং কনফেডারেটদের রসদের জোগান বন্ধ করা। সেপ্টেম্বরে আটলান্টার কমান্ডার শেরম্যানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এতে করে উত্তরবাসীরা যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে আরও আশাবাদী হন এবং প্রেসিডেন্ট লিংকনের পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম হয়।
কনফেডারেট কমান্ডার লি তাদের রাজধানী রিচমন্ড ত্যাগ করেন। তার লক্ষ্য ছিল নর্থ ক্যারলাইনার সেনাদের সাথে পুনর্মিলন এবং তারপর লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এপ্রিলের ৯ তারিখ সকালে কনফেডারেট সেনারা এপম্যাটক্স কোর্টহাউসে ইউনিয়নের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। লি বুঝতে পারেন যে, আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই। সেই দিনই, কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট লি তার সেনাদলসহ ইউনিয়ন জেনারেল উলিসেস এস গ্রান্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে দীর্ঘ চার বছর ধরে চলা রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
যুদ্ধের প্রথম দিকের অবস্থা অনুযায়ী মনে হচ্ছিল যে কনফেডারেসি হয়ত যুদ্ধে জয়লাভ করবে। বেশিরভাগ খন্ডযুদ্ধগুলোতে কনফেডারেসির জয় হয়েছিল চমৎকার নেতৃত্বের কারণে। তবুও শেষ পর্যায়ে এসে কনফেডারেসিকে ইউনিয়নের কাছে হার মানতে হয়। তার কিছু কারণ হল—
প্রথমত, গেটিসবার্গ যুদ্ধে পরাজয়। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন যে যদি কনফেডারেসিরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারত তবে তারা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত। কিন্তু এই যুদ্ধে তারা হেরে যায়। অনেকে মনে করেন, রবার্ট লি সঠিকভাবে তার সেনাদল পরিচালনা করতে পারেনি। তাই গেটিসবার্গে কনফেডারেসির পরাজয় ঘটে।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের রসদ কনফেডারেসির কাছে ইউনিয়নের তুলনায় অনেক কম ছিল। ইউনিয়নের তুলনায় কনফেডারেসির লোকবল কম এবং অর্থনীতি দুর্বল ছিল, যা যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারক হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, কনফেডারেসির বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে মার্শাল আইন, যুদ্ধ করসহ নানা ব্যাপারে রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধ যুদ্ধে তাদের পরাজয়ে ভূমিকা রাখে।
চতুর্থত, তখনকার সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হতে দাস প্রথার উচ্ছেদ ঘটে। এমন সময়ে দাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে কনফেডারেসির যুদ্ধকে ইউরোপীয়রা সমর্থন করেনি।
পঞ্চমত, অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন দক্ষিণের যুদ্ধ জয় করার মনোবলের ঘাটতি ছিল। তারা যদি সত্যিকার অর্থে বিজয় চাইত, তবে অনেক কঠিক মুহূর্তে পিছিয়ে যেত না।
সবশেষে, দুই পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দক্ষতায় ফারাক ছিল। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, কনফেডারেট প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিস ভাল নেতা ছিলেন না। তাকে তার অধস্তন কর্মকর্তা এবং সামরিক জেনারেলদের ব্যবস্থাপনায় বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
যদিও যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউনিয়নকে বেশ কিছু খন্ড যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছিল, তারপরও ইউনিয়ন বিজয়ের শেষ হাসি হাসে। এর পিছনের কারণ গুলো হল—
প্রথমত, উত্তরের বিশাল লোকবল এবং শক্তিশালী অর্থনীতি।
দ্বিতীয়ত ,আব্রাহাম লিংকনের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।
তৃতীয়ত, ইউনিয়নের শক্তিশালী নৌবাহিনী, যা কনফেডারেসির অর্থনীতিকে অবরোধের মাধ্যমে দুর্বল করে ফেলেছিল।
চতুর্থত, দক্ষিণ থেকে প্রচুর দাস উত্তরে পালিয়ে আসে। তারা ইউনিয়ন আর্মিতে যোগদান করে। ফলে ইউনিয়নের সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
পঞ্চমত, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন কনফেডারেসিকে সমর্থন করেনি। ফলে ইউনিয়ন লাভবান হয়।
উত্তরের চূড়ান্ত জয়লাভে অনেক কিছুই ভূমিকা রেখেছিল। শক্তিশালী নৌবাহিনী, সংখ্যা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য। তবে ইতিহাসবিদগণ তার উপরের রাখেন প্রেসিডেন্ট লিংকনের রাষ্ট্রনায়কসুলভ ভূমিকাকে। ঐতিহাসিক দিক দিয়েও যুদ্ধটি অনেক নতুনের জন্ম দিয়েছিল, যা বিশ্ব এর আগে দেখেনি। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, এটি পুরনো প্রচলনের শেষ যুদ্ধ। আবার অনেকে মনে করেন, এর মাধ্যমেই বিশ্ব আধুনিক যুদ্ধকালে উপনীত হয়েছে। তাই বলা যায়, এটি এমন একটি যুদ্ধ ছিল যা এক যুগ থেকে নতুন যুগ এর সূচনা করেছিল। এই যুদ্ধে বেশ কিছু আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এই যুদ্ধে লৌহবর্মভূষিত জাহাজ প্রথমবারের মতোন ব্যবহার করা হয়েছিল, প্রথমবারের মতো টেলিগ্রাম এবং রেলপথ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, প্রথমবার মেশিনগান ব্যবহার করা হয়েছিল এবং যুদ্ধের ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ ছিল। ভূমি এবং পানিতে মাইনের ব্যবহার, প্রথমবার সাবমেরিনের ব্যবহার, আহত সেনাদের নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মেডিকেল সেবা দেওয়া, যুদ্ধ ছবি ইত্যাদি আমেরিকান গৃহযুদ্ধকে করেছিল অনেক প্রথমের জন্মদাতা।
যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল। চারবছরব্যাপী এই যুদ্ধে ইউনিয়নের পক্ষে ১৫,৫৬,০০০ সেনা এবং কনফেডারেশনের পক্ষে ৮,০০,০০০ লক্ষ সেনা অংশগ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে ইউনিয়নের ৩,৬০,০০০ জন এবং কনফেডারেসির ২,৬০,০০০ জন সেনা নিহত হয়েছিল। তবে এই সংখ্যাগুলোর কোনোটাই একেবারে সুনিশ্চিত নয়। তবে ধারণা করা হয়, তখনকার জনমিতি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাত্ত অনুযায়ী আনুমানিক ৭,৫২,০০০ থেকে ৮,৫১,০০০ জন মারা গিয়েছিল। যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছিল তা ১৮৬০ সালে আমেরিকার জনসংখ্যা অনুযায়ী মোট জন সংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ। এছাড়াও প্রচুর হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ধ্বংসও ঘটেছিল।
গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির সাথে সাথেই আলাদা হওয়া কনফেডারেসির রাজ্যগুলো পুনরায় আমেরিকার সাথে যোগ দেয়। এর মাধ্যমে আমেরিকা থেকে দাসপ্রথা চিরতরে বিদায় নেয়। এটি ছিল এই যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। দাসপ্রথা ছিল মধ্যযুগীয় এবং বর্ণবাদী একটি প্রথা। তাই এই যুদ্ধ আমেরিকার সমাজ সংস্কারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখনও আমেরিকান সমাজে বর্ণবাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে অবশ্যই, প্রগতি তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলবে। প্রেসিডেন্ট লিংকনকে প্রাণ হারাতে হয় যুদ্ধের পরপরই। এপ্রিল ১৪, ১৮৬৫ সালে জন উইলকেস, একজন কনফেডারেট সহানুভূতিশীল, প্রেসিডেন্ট লিংকনকে গুলি করেন। পরদিন সকালে তিনি মারা যান। যুদ্ধ জয় এবং দাসপ্রথা বিলোপে লিংকনের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। সবশেষে এ কথা বলা যায়, আমেরিকান গৃহযুদ্ধকে সবাই মনে রাখবে বর্ণবাদ এবং অসমতার বিরুদ্ধে নেওয়া বড় পদক্ষেপ হিসেবে, তার পাশাপাশি বর্তমান সময়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে এই যুদ্ধের ইতিহাস সকলকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।