সেই সময়: সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাস


পলাশ মজুমদারের বই পর্যালোচনা

সেই সময়: সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাস


সাম্প্রতিককালের উভয় বাংলার সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক প্রবাদপ্রতিম কথাশিল্পী। কথাসাহিত্য ও ইতিহাসের অপূর্ব সংমিশ্রণ এবং শিল্পনৈপুণ্যের অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ ও কালজয়ী কিছু উপন্যাস। ‘সেই সময়’ তাঁর এমন একটি শিল্পসৃষ্টি। এই উপন্যাসের মূল নায়ক সময়, একটি বিশেষ সময়—যে সময়ের প্রেক্ষাপটে ঘটনা ও চরিত্রগুলো চিত্রিত।

উপন্যাসের ভূমিকাতেই বলা আছে, “একটি বিশেষ সময়ই এই উপন্যাসের মূখ্য চরিত্র। নাটকের শুরুতে যেমন দেওয়া থাকে পাত্রপাত্রীদের নাম ও পরিচয়, তেমনভাবে যদি গোড়াতেই দেয়া থাকত এই বিপুল বর্ণাঢ্য উপন্যাসের চরিত্রাবলীর নাম, সত্যিই বিস্ময়কর মনে হত সেই তালিকা। মাইকেল, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, হেয়ার সাহেব, দেবেন ঠাকুর—কে নেই! সমস্ত ঊনবিংশ শতাব্দীই এই উপন্যাসে যেন নানান চরিত্র হয়ে চোখের সামনে জীবন্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহু পরিশ্রমে, ধূলিমলিন পৃষ্ঠা ঘেঁটে প্রায় গবেষকের মতোই হাজির করেছেন সেই সময়কে। শুধু যেটুকু তফাৎ তা হল, গবেষকের রচনার মধ্যে প্রাণ থাকে না, তিনি সেই প্রাণটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।”

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি (১৮৪০-১৮৭০) সময়কালই এই উপন্যাসের উপজীব্য। ওই সময়কালে ইংরেজশাসিত পরাধীন অখণ্ড বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে যে-সমস্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী ঘটেছে, সে-সবের আলোকেই সুনীল ‘সেই সময়’ রচনা করেছেন। উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক বলেছেন, “আমার কাহিনীর পটভূমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দ। এবং এই কাহিনীর মূল নায়কের নাম সময়। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে ১৮২৫ থেকে ১৮৪৫ খ্রীস্টাব্দ সময়কে বঙ্গের নবযুগ বলেছেন। এই নবযুগেরই পরবর্তীতে নাম হয় ‘বেঙ্গল রেনেশাঁস’। এই রেনেশাঁসের ধারণাটিকেই এই গ্রন্থে নাড়াচাড়া করতে চেয়েছি।”

১৯৮৩ সালে বঙ্কিম-সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই খণ্ডে সমাপ্ত সুবিশাল ও বর্ণাঢ্য ‘সেই সময়’ উপন্যাসটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক মর্মস্পর্শী ও অবিনশ্বর সাহিত্য-কীর্তি। কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই সুদীর্ঘ উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে একজন বিদগ্ধ গবেষক ও পাকা ঐতিহাসিকের কাজ করতে চেয়েছেন, সেজন্য তাঁকে যেমন অনেক সময় (প্রায় আড়াই বছরেরও অধিক কাল) ব্যয় করতে হয়েছে, তেমনি খাটতেও হয়েছে প্রচুর। বইয়ের শেষাংশে তিনি সে-সমস্ত বইয়ের একটি তালিকাও প্রদান করেছেন যাদের সাহায্য তাঁকে অবধারিতভাবে গ্রহণ করতে হয়েছে। ইতিহাসের নির্যাস গ্রহণ করতে গিয়ে তাঁকে প্রজ্ঞার গহীন সরোবরে অবগাহন করতে হয়েছে বারবার।

ইতিহাসের উপাদান গ্রহণ করলেও তিনি পুরোপুরি ইতিহাস-নির্ভর না হয়ে ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজের কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে ভিন্ন ধারার সাহিত্য-সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছেন। কারণ তা না হলে এটি নিছক ইতিহাস বা গবেষণালব্ধ বই হতো, কোনোভাবেই মহৎ সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্থান পেত না। এখানেই সুনীলের পটুত্ব ও পারঙ্গমতা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শৈল্পিক ও সাবলীল উপস্থাপনা। বাংলা সাহিত্যের অপরাপর কথাসাহিত্যিক থেকে আলাদা হয়ে সুনীল একটি নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন, যা তাঁকে ব্যতিক্রমধর্মী সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

উত্তর কলকাতার বিশাল বিশাল অট্টালিকা ও প্রাসাদবিশিষ্ট জোড়াসাঁকো অঞ্চলটিকে তখন অভিজাত বাঙালিদের, বিশেষত জমিদারদের এলাকা বলে বিবেচনা করা হতো। ঠাকুরবাড়ি ও সিংহবাড়ি পাশাপাশি অবস্থিত দুই বিখ্যাত জমিদারের আবাসস্থল, যাদের জমিদারি ছড়িয়ে আছে সারা বাংলায় ও বাংলার আশেপাশের প্রদেশে। ঐতিহ্যবাহী ঠাকুরবাড়ির সন্তান রবীন্দ্রনাথের পিতামহ ও পিতা যথাক্রমে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন কারণে ঐ-সময়কালের প্রধান আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপন্যাসটিতে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেলেও সুনীল তাঁদের মধ্য থেকে প্রধান চরিত্র নির্বাচন করেননি; বরং সিংহবাড়ির রামকমল সিংহ ও সেই ধারাবাহিকতায় তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র নবীনকুমার সিংহকেই গ্রহণ করেছেন প্রধান চরিত্র হিসেবে।

‘নবীনকুমার সিংহ’ এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হলেও সুনীল তাঁকে অভিহিত করেছেন সেই সময়ের প্রতীক বলে। সময়কে রক্তে-মাংসে জীবিত করা ও উপন্যাসটিতে প্রাণ সৃষ্টি করার জন্য তিনি গ্রহণ করেছেন এই প্রতীক চরিত্র। নবীনকুমার চরিত্রটি এক অকালমৃত অসাধারণ ঐতিহাসিক যুবকের আদলে চিত্রিত। যাঁকে অবলম্বন করে নবীনকুমারকে গড়া হয়েছে তাঁর কয়েকটি কীর্তিচিহ্ন ছাড়া আর কিছু সুনীল নিজেও জানতেন না। কীর্তিচিহ্নগুলো চরিত্রটিকে আমাদের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কীর্তিমান পুরুষ ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’, যাঁর ছদ্মনাম ‘হুতোমপ্যাঁচা’ তাঁর সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। কীর্তিচিহ্নগুলোর মধ্যে ‘হুতোমপ্যাঁচার নকশা’ ও ‘মহাভারতের বঙ্গানুবাদ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তাছাড়া সুনীল ‘সেই সময় দ্বিতীয় খণ্ড’ কালীপ্রসন্ন সিংহকে উৎসর্গ করেন যা বিষয়টিকে আরো সুনিশ্চিত করে। তবে লেখক এই দুই চরিত্রকে এক করে না দেখে নবীনকুমারকে সেই সময়ের প্রতীক বলে অভিহিত করার পক্ষপাতী। এখানে সুনীলের সরল স্বীকারোক্তি, ‘নবীনকুমারের চরিত্রে যে আমি স্বকল্পিত বহু উপাদান সংযোজন করেছি, সেজন্য অনেকের সঙ্গে মতভেদ হতে পারে। হওয়াই স্বাভাবিক। সেই সময় সম্পর্কে যদি আমি আমার নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা না দিতে চাইব, তা হলে আর আমি এত বড় একটি গ্রন্থ রচনা করলাম কেন?’


দুই.


তৎকালের প্রথা অনুযায়ী জমিদার বাবু রামকমল সিংহ বাঈজী-রক্ষিতা কিংবা উপপত্নীর সঙ্গে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন এবং তখনকার সময়ে তা-ই স্বাভাবিক ছিল। অথচ তাঁর গৃহে অসামান্য রূপবতী স্ত্রী বিম্ববতী। জানবাজারের তাঁর এক বাড়িতে রক্ষিতা কমলাসুন্দরীর আলিঙ্গনে আদি-রসে মজে থাকার সময় হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবু রামকমল সিংহ। জানাজানি হওয়ার ভয়ে তাঁরই অন্তরঙ্গ সুহৃদ বিধুশেখর মুখুজ্যেকে ডেকে পাঠায় কমলাসুন্দরী। বিধুশেখরের কোলে মৃত্যুবরণ করার সময় রামকমল তাঁর জোড়াসাঁকোর সিংহসদনে রেখে যান দত্তক পুত্র গঙ্গানারায়ণ সিংহ, সাধ্বী স্ত্রী বিম্ববতী এবং নাবালক পঞ্চমবর্ষীয় পুত্র নবীনকুমারকে। মৃত্যু-মুহূর্তেও নবীনকে নিজের ঔরসজাত সন্তান বলেই জানতেন রামকমল, কারণ বিধুশেখর তাঁর মাথা স্পর্শ করে শপথ করে বলেছিল—নবীনকুমার তাঁরই সন্তান।

রামকমলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পরামর্শদাতা বিধুশেখরই মূলত তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন করার সময় গঙ্গানারায়ণকে যৎসামান্য সম্পত্তি দেয়া হয়। সিংহভাগই বিম্ববতী ও নবীনকুমারের নামে যা রামকমল জীবদ্দশায় করে গেছেন বলে বিধুশেখর জানান। বিম্ববতীর অনুরোধে মার হয়ে সম্পত্তি দেখাশোনার ভার গঙ্গানারায়ণ নিলেও বিধুশেখর ব্যাপারটাকে ভালো নজরে দেখেননি। তিনি চান গঙ্গানারায়ণকে সম্পূর্ণ টুকরো টুকরো করে ভেঙে নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত করে দিতে, আর চান নবীনকুমারকে জীবনে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করে যেতে।

সিংহপরিবারের বিশাল ঘটনাবহুল জীবনপ্রবাহের ছবি অনুপুঙ্খময় আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই উপন্যাসে। কিন্তু শুধু পাপ আর কেচ্ছার কাহিনি শোনাতে তিনি লেখনী ধারণ করেননি। বস্তুত সিংহ পরিবারের নাটকীয় ও চমকপ্রদ সে-সকল কাহিনি সেই বিশেষ সময়ের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত যখন কলকাতার বাবু সমাজ সুরা, নারী ও বুলবুলি-বিলাসে মগ্ন, যখন নব্য শিক্ষিত যুবকরা প্রাণপণে ইংরেজ অনুকরণে মত্ত, গ্রাম নিঃস্ব করে প্রজা শোষণের অর্থে চলছে সংস্কৃতি চর্চা, সমাজ ও ধর্ম সংস্কার, তরুণ বিদ্যাসাগর রাত্রি জেগে রেড়ির তেলের আলোয় রচনা করছেন বাংলা গদ্য ভাষা, জেগে উঠছে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি।


তিন.


উপন্যাসের শুরু নবীনকুমার সিংহের জন্ম-ঘটনা দিয়ে। মাত্র সাত মাস দশদিন গর্ভবাসের পর যখন শিশুটির জন্ম হয়, তখন পিতা বাবু রামকমল সিংহ উড়িষ্যায় মহাল পরিদর্শনে কৃষ্ণকায় বাঈজী কমলাসুন্দরীর আলিঙ্গনে মহানদীর বুকে বজরার ওপর বসে সূর্যাস্তের শোভা দেখছেন। নিঃসন্তান রামকমলের বিশ্বাস ছিল যে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা তাঁর নেই, তাই বিম্ববতীর সন্তান হতে পারে—এ ছিল তাঁর ধারণার অতীত। তবু অকস্মাৎ তাঁর গোমস্তা দিবাকর যখন বার্তা নিয়ে হাজির হয়, তখন তাঁর মধ্যে অজানা শঙ্কা কাজ করে স্ত্রী বিম্ববতীকে নিয়ে। তিনদিন পর কলকাতায় ফিরে যখন মুমূর্ষু অবস্থায় স্ত্রী ও নবজাত পুত্রকে দেখেন, তখন শিশুটির প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্য অনুভব করলেন, বোধ করলেন না প্রথম পিতৃত্ব অর্জনের কোনো রকম সুখানুভূতি। তিনি নিজেও তাতে বেশ অবাক হন।

সুন্দরী স্ত্রীকে তিনি মনে-প্রাণে ভালোবাসলেও কালো মেয়েদের মধ্য থেকেই উপপত্নী নির্বাচন করা ছিল তাঁর শখ। পরবর্তীতে নবীনকুমারের পাঁচ বছর বয়সে যখন রক্ষিতার গৃহে রামকমল সিংহের মৃত্যু হয়, মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে তিনি বন্ধু বিধুশেখরের কাছে জানতে চান—আসলে নবীনকুমার কার সন্তান, তাঁর না বিধুশেখরের। কারণ তিনি যত নারীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন কেউ তাঁকে সন্তান উপহার দিতে পারেনি। বিম্ববতী ও বিধুশেখরের এই গোপন কাহিনি জীবনের শেষ দিনও রামকমল জানতে পারেননি। মনে সন্দেহ থাকলেও সাধ্বী স্ত্রী ও বন্ধুর প্রতি মৃত্যুকালেও ছিল তাঁর অবিচল বিশ্বাস।

তিন মাস বয়স থেকে নবীনকুমার সব আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। যেমন তিন মাস বয়সে হামাগুড়ি দেয়া, পাঁচ মাস বয়সে কথা বলতে পারা। নবীনকুমারের পাঁচ বছর বয়সের সময় সরস্বতী পুজোর দিনে সিংহসদনে বেশ ধুমধাম করে নবীনকুমারের হাতেখড়ি হয়। পণ্ডিত দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার মস্তক স্পর্শ করে সংস্কৃত মন্ত্র পড়ে আশীর্বাদ করলেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোনো মন্ত্র উচ্চারণ না করেই নবীনকুমারকে কাছে ডেকে কোলে নিয়ে বললেন, তোমার মুক্তার মতো হস্তাক্ষর হোক! বিদ্যাসাগর শ্লেটের ওপর পেন্সিল দিয়ে ‘ক’ লিখে বলতেই নবীনকুমার সঙ্গে সঙ্গে বলল, ক! এবং না দেখেও ক লিখে ফেলে। তারপর বিদ্যাসাগর ইংরেজি এ ও বি লিখে মুছে দিয়ে লিখতে বলল এবং সে তাও লিখে ফেলে। দু’জন গুরু স্তম্ভিত হয়ে বললেন, এ-তো দেখি দৃষ্টি-শ্রুতিধর। নবীনকুমারের আরো কিছু কীর্তি দেখে বিদ্যাসাগর সত্যিই অবাক হলেন; বুঝতে পারলেন—এ শিশু কালে আপন কীর্তিতে কীর্তিমান হবে।

আট বছর বয়সে নবীনকুমার আশ্চর্য স্মৃতিশক্তির পরিচয় দেয়—মহাভারতের কঠিন কঠিন শ্লোক কণ্ঠস্থ করে। তাঁর মেধার বিবিধ প্রকাশ দেখে সবাই বিস্মিত। সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজের বাছাই করা তিনজন ছাত্র নবীনকুমারের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে তাঁকে সংস্কৃত, ইংরেজি ও গণিত শিক্ষা দিতে থাকে। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ্য করে এক ওস্তাদকে কণ্ঠসঙ্গীতের তালিম দেয়ার জন্য বাড়িতে নিযুক্ত করা হয়। ভিখারি-বৈরাগীদের গান শুনলেই নবীনকুমার ঠিকঠিক তা শিখে নেয়, যে-সব গানের কথার অর্থ তাঁর একেবারেই বোঝার কথা নয়, সেগুলিও সে বেশ ভাব দিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গায়।

দ্বাদশ বছর বয়সে নবীনকুমার হয়ে ওঠে এক অনিন্দ্যকান্তি বালক, মুখমণ্ডলে প্রতিভার জ্যোতি, চক্ষু দুটি অত্যুজ্জ্বল, এ বালক যে অন্য সবার থেকে আলাদা তা তাঁর মুখের পানে একবার তাকালেই বোঝা যায়। একই সঙ্গে নবীনকুমারের মধ্যে অনেক নিষ্ঠুরতাও পরিলক্ষিত হয়। কর্তব্যচ্যুতি ঘটলে সে দাস-দাসীদের কটু ভাষায় গালিগালাজ করে; প্রায় তাদের মানুষ বলে গণ্য করে না। স্নানের জলের উত্তাপ কম বা বেশি হলে সে বয়স্ক ভৃত্যকে চড় মারে। জুতা পরার সময় সে নবাবপুত্রদের মতো আরাম কেদারায় পা ছড়িয়ে বসে ভৃত্যের নাম ধরে ডাকে, তৎক্ষণাৎ সে ভৃত্যটি এসে পায়ে জুতা পরিয়ে দেয়। সংস্কৃত পণ্ডিতদের সে গুরু বলে মান্য করে না, প্রায়ই দুষ্টমির ছলে পণ্ডিতদের শিখা ধরে টানাটানি করে। এমনকি এক পণ্ডিতের টিকি পর্যন্ত কেটে নেয়, কারণ ব্রাহ্মণটি তাঁকে দান করা গরু কসাইয়ের কাছে বিক্রি করেছিল। প্রতিভা ও কাণ্ডকীর্তি দেখে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গঙ্গানারায়ণ তার প্রতিভাবান বন্ধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে নবীনকুমারের মিল খুঁজে পায়।

তের বছর বয়সে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাগবাজারের মেয়ে কৃষ্ণভামিনীর সঙ্গে নবীনকুমারের বিয়ে দেন অভিভাবক বিধুশেখর ও তাঁর মা বিম্ববতী। বিয়ের অনুষ্ঠান এত আড়ম্বরপূর্ণ হয়েছিল যে ওই সময়কার কলকাতা শহরের মানুষ এমন জৌলুস আর কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে দেখেনি। বিধুশেখর ও বিম্ববতী একেবারে সকলকে টেক্কা মেরে গেলেন। বালিকা স্ত্রীকে সে খেলার সাথী হিসেবে গ্রহণ করে এবং বিয়ে-বিষয়কে মনে করে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়-উৎসব। গঙ্গানারায়ণ ছোট ভাইয়ের এই বাল্যবিবাহে আপত্তি তুললেও বিধুশেখরের সিদ্ধান্তের কাছে মাথা নোয়াতে হয়। বিধুশেখর নবীনকুমারের কলেজে পড়ার বায়নাকে ধুলিসাৎ করার জন্য বিয়ের চালটা চালে এবং এ চালের কাছে নবীনের কলেজে পড়ার বাসনা বিসর্জিত হয়।

পঞ্চদশবর্ষীয় তরুণ নবীনকুমারের জীবন-যাপন প্রণালী হয়ে ওঠে আরো ব্যতিক্রমধর্মী, আরো হেয়ালিপূর্ণ। সেকালের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অন্যতম বসন্তকালীন বিনোদন আয়োজন বুলবুলির লড়াই দেখতে এসে হাতের হীরক অঙ্গুরি বিক্রি করে খাঁচাশুদ্ধ সব পাখি কিনে সে বুলবুলি পাখিগুলিকে অবমুক্ত করে দেয়। এমনকি টাকা শেষ হয়ে গেলে সে পাখি-বিক্রেতাদের সিংহবাড়িতে এসে টাকা নিতে বলে। বুলবুলির লড়াই দেখতে আসা লোকজন লড়াই দেখা বাদ দিয়ে বুলবুলি-মুক্তি উপভোগ করতে থাকে।

আরো একটি মহান ইচ্ছে তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। হিন্দু কলেজের পাঠ শেষ করার আগেই সে কলেজ ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে স্থাপন করে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ নামে একটি জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র। সেখানে বিশিষ্ট জ্ঞানী, গুণী ও চিন্তাবিদরা এসে দেশ, কাল, সমাজ ও সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর রচয়িতা প্যারীচাঁদ মিত্র ছাড়াও রাধানাথ সিকদার, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, হরিশ মুখার্জী, কৃষ্ণদাস পালের মতো প্রকৃত উৎসাহী যুবকদের সঙ্গে ইংরেজ পণ্ডিত ও শিক্ষকরাও এই সভায় যোগদান করেন। কলেজী শিক্ষকদের বাঁধা-ধরা লেকচারের বদলে এসব জ্ঞানগর্ভ ও শিক্ষাপ্রদ আলোচনাতেই তাঁর বেশি উৎসাহ। এরই মধ্যে প্রথম স্ত্রী কৃষ্ণাভামিনীর মৃত্যুর দেড় বছর পর নবীনকুমার দ্বিতীয়বার দার-পরিগ্রহ করে। প্রথম স্ত্রীকে সে খেলার সাথী হিসেবে নিলেও দ্বিতীয় স্ত্রী সরোজনীকে সে আর ওইভাবে নিতে পারেনি। বরং তখন সে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ নিয়েই ভীষণ মশগুল হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে এই সভার সদস্যদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা নিয়েও সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইংরেজি নাটকের অনুকরণে মঞ্চ তৈরি করে ‘বেণীসংহার’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার পর চারদিকে তাঁর নামে জয়ধ্বনি বাজতে থাকে। ক্রমান্বয়ে অন্য ধনীরাও মঞ্চ নাটকের দিকে ঝুঁকলে সে এ-ব্যাপারে সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমন হেয়ালি নবীনকুমার।

বন্ধু হরিশ মুখুজ্যে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ নামক দেশপ্রেম-উদ্দীপনামূলক ইংরেজি পত্রিকার মাধ্যমে চারদিকে সাড়া ফেললে নবীনকুমার হরিশের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। ধনীর দুলাল হওয়াতে জীবন-সংগ্রামী হরিশ তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে ইয়ার্কি করলে সে হরিশের প্রতি আরো ঝুঁকতে থাকে। কারণ হরিশের মতো তাঁর মুখের ওপর কেউ ওভাবে তাঁকে কিছু বলতে পারে না। প্রতিভাবান হরিশের মদ ও নারীতে আসক্তি নবীনের ভালো না লাগলেও হরিশ তাঁকে চুম্বকের মত টানে এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় হিন্দু পেট্রিয়টের অফিসে গিয়ে হরিশের সাথে আলাপ করার জন্য বসে থাকে। একদিন হরিশের কথার বাণে বিদ্ধ হয়ে নবীন মদ খাওয়া শুরু করে, এমনকি হরিশের সঙ্গে মুলুকচাঁদের আখড়ায় বারবণিতাদের নাচ দেখতে যায়। মুলুকচাঁদের আখড়া থেকে চাটুকার রাইমোহন নবীনকে এক রাতে তাঁর পিতার রক্ষিতা কমলাসুন্দরীর জানবাজারের বাড়িতে নিয়ে এলে তার পর দিন নবীনকুমারের আত্মোপলব্ধি ঘটে।

সে ওই অন্ধকার পথ থেকে ফিরে আসার বাসনায় গুরু বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়ে পাপমুক্ত হতে চায়। বিদ্যাসাগর তাঁকে প্রথমে বকাঝকা করলেও নবীনকুমারের ‘মহাভারত’ বঙ্গানুবাদ করার প্রতিজ্ঞা বিদ্যাসাগরকে অষ্টাদশবর্ষীয় যুবকটির প্রতি সহানুভূতিশীল করে। যদিও বিধবা বিবাহের জন্য এক হাজার করে টাকা দেয়ার কথা থাকলেও নবীনকুমারের তা পরে মনেও ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত সে বিদ্যাসাগর কর্তৃক নিযুক্ত পণ্ডিতদের সহযোগিতায় ১৩ খণ্ডের মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করতে সমর্থ হয় এবং তা মানুষের মধ্যে বিনা পয়সায় বিলি করে। গীতা ও রামায়ণ একইভাবে অনুবাদের কথা থাকলেও সে এই বিষয়ে পরে আর উৎসাহ পায়নি।

হরিশ মুখুজ্যের মৃত্যুর পর তাঁর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে নবীনকুমার এগিয়ে আসে এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় তা চলতে থাকে। তাছাড়া দেশপ্রেমিক ও জনদরদী বন্ধু হরিশের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য সে ‘হরিশ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ গঠন করে বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজের পদক্ষেপ নেয়। ‘পরিদর্শক’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা অর্থাভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে নবীনকুমার সে পত্রিকার সত্ব কিনে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং একে দৈনিক বাংলা কাগজে রূপান্তর করে। পাঠকের অভাবে পত্রিকাটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে সে বাধ্য হয় এবং এজন্য দীর্ঘদিন এ পরাজয়ের গ্লানি তাঁকে দহন করতে থাকে। একটি উর্দু পত্রিকা বন্ধ হওয়াও তাঁর অর্থানুকূল্যে রক্ষা পায় ।

মানুষের বিপদে-আপদে সে এমনভাবে অর্থ দান করতে থাকে যে অনেক ভণ্ড এ সুযোগে টাকা হাতিয়ে নিতে আসে। বিধাব-বিবাহের নাম করে অনেকে এমনভাবে টাকা নিতে থাকে যা বিদ্যাসাগরের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। তখন বিদ্যাসাগর তাঁকে যাচাই না করে টাকা দিতে নিষেধ করে। একবার রাইমোহন কৃষ্ণনগরের এক বিধবার বিবাহের কথা বলে বেশ কিছু টাকা চায়, বিধুশেখরের গুপ্তচর তাঁর কাছে এ-খবর পৌঁছায় যে এক পতিতার বিয়ের নাম করে রাইমোহন এই টাকা নিয়ে যায়। এজন্য বিধুশেখর রাইমোহনকে ডেকে পাঁচবার নাকে খৎ দেয়ায় এবং প্রতিজ্ঞা করায় যে নবীনকে এভাবে আর প্রতারিত করবে না।

প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে একবার কলকাতায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হলে যত মানুষ সহযোগিতা নিতে আসে সবাইকে একশত টাকা করে দেয়ার জন্য সে গঙ্গাকে বলে দেয়। আসলে টাকা জিনিসটার প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না, তাই দু’হাতে টাকা বিলি করতো। তাঁর জমিদারির সকল কৃষককে সে এক বাক্যে খাজনা মওকুফ করে দেয়। অন্যরা যতই বলে টাকা আসবে কোথা থেকে সে ব্যাপারে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্যও সে অকাতরে টাকা দান করে। ভৃত্য দুলালচন্দ্রের ছেলের নামে সে তাদের বাগবাজারের বাড়িটি লিখে দেয়। এভাবে দান-খয়রাত ও বিলি-বণ্টন করতে করতে তাদের জমিদারি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়।

বারবণিতা হীরে বুলবুলের ছেলে চন্দ্রনাথ ওঝা তাঁকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। এই ছেলেটি কলকাতা শহরে জিন-ভূত তাড়ানো, ভণ্ড সন্ন্যাসী নির্ণয় ও বিভিন্ন ধরনের অলৌকিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। ছেলেটি তাঁকে যতই প্রত্যাখ্যান করে সে ততই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। চন্দ্রনাথের আস্তানায় একদিন সে এক মেয়েকে দেখে যার চেহারা অবিকল তাঁর মা বিম্ববতীর মতো। মেয়েটিকে নবীনকুমার তাঁর সঙ্গে যেতে বললে সে প্রত্যাখান করে এবং তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারকারী চন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকতে চায়। অপমানিত হয়ে ফেরত আসার পরদিন সকালে আবার গিয়ে দেখে সে বাড়িটি পুরোপুরি অগ্নিদগ্ধ।

তারপর সে মেয়েটিকে খোঁজার জন্য শহরের সকল বারবণিতার গৃহে সশরীরে গিয়ে সন্ধান করে। এরমধ্যে দুর্নাম রটে যে শহরের এমন কোনো অবিদ্যা নেই যাকে সে ভোগ করেনি। অথচ কোনো পতিতাকে সে স্পর্শ করেও দেখেনি। শুধু মেয়েটির মধ্যে মাতৃরূপ দর্শন করেছে বলে সে মেয়েটিকে সর্বত্র খুঁজেছে। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া।

সে নিজেও জানত না কেন মায়ের চেহারার মেয়েটিকে সে খোঁজ করছে এবং পেলেই বা কী করবে? তবুও মেয়েটিকে না পেয়ে সে তাঁর তীর্থগামী মা বিম্ববতীকে দর্শনের জন্য হরিদ্বারের উদ্দেশে রওনা হয়। পথিমধ্যে মায়ের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর নদীয়া জেলায় নদীর পাশে একটি বাড়ি কিনে মায়ের শ্রাদ্ধব্রত পালন করে ও প্রায় তিন হাজার কাঙালিকে ভোজন করায়। সেখান থেকে তাঁদের জমিদারির নায়েব ভূজঙ্গধর ভট্টাচার্য তাকে ইব্রাহিমপুর নিয়ে আসে। নবীনকুমার দলবল নিয়ে এসে পড়ে ধানকুড়ি গ্রামে। এই গ্রামেরই ছেলে দুলালচন্দ্র তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী, অথচ তাঁরা কেউ তা জানে না।

ঘুরতে ঘুরতে বহু বছর আগে পোড়ানো একটি বাড়ির সামনে আসতেই এক পাগলের মুখোমুখি পড়ে সে। সবার নিষেধ সত্ত্বেও সে ওই পাগলের কাছে গেলে পাগলটি ঝাপটে পড়ে তাঁর বুকের ওপর; কামড় বসায় বুকে। পিরানের অংশসহ এক টুকরো মাংসপিণ্ড তুলে ফেলে।

দুলালচন্দ্র মনিবের প্রতি এমন আচরণের জন্য পাগলটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং তখনও সে জানে না যে এই পাগলটিই তার পিতা ত্রিলোচন দাস, যে একদিন খাজনা দিতে না পারায় জমিদারের লোকেরা এই বাড়িটি পুড়ে ফেলাতে জমিদারের কাছে বিচারের জন্য স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসেছিল। তারপর সবাইকে হারিয়ে পাগল হয়ে বহুবছর পর গ্রামে এসে ওই পোড়া বাড়ির মাটি খেয়ে বেঁচে আছে।

ত্রিলোচন দাসের কামড় খেয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে গ্রাম্য কবিরাজ দ্বারা ব্যান্ডেজ করে নবীনকুমারকে তখনই কলকাতায় আনা হয়। কলকাতার ডাক্তারের সেবা-শুশ্রƒষায় সে বেঁচে উঠলেও কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বালিগঞ্জে গেলে সেখানে চন্দ্রনাথের সাগরেদ সুলতানের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এবং সুলতানের সহযোগিতায় বাঁশের সাঁকো পার হয়ে ঘরে উঠতেই চন্দ্রনাথ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তার মায়ের মতো সেই মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি বের হয়ে আসে। তখন চন্দ্রনাথ তার পূর্বেকার বাড়িটি পোড়ানোর জন্য নবীনকে দোষারোপ করতেই সে রাগে পেছন ফিরলে চন্দ্রনাথ তাকে দাঁড়াতে বলে এবং মেয়েটিকে নিয়ে যেতে প্রস্তাব করে।

ওই সময় নবীনকুমার ঢলে পড়তেই দুলাল তাকে ধরে ফেলে এবং বুকের সেই ক্ষতস্থান থেকে তৎক্ষণাৎ রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ডাক্তারদের সব প্রচেষ্টাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে শেষ পর্যন্ত বাইশ বছর বয়সী নবীনকুমার সবাইকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করে।


চার.


নবীনকুমারের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গঙ্গানারায়ণ ও বিধুশেখর মুখুজ্যের অকাল-বিধবা মেয়ে বিন্দুবাসিনীর মধ্যকার প্রেম-প্রণয়-বিরহ উপন্যাসটির প্রথম অংশ জুড়ে ছিল। তারা দু’জন একই সঙ্গে শৈশব-কৈশোর পেরিয়েছে এবং এরই মধ্যে বিবাহের পর বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে বিন্দু পুনরায় ফিরে আসে। সনাতনপন্থী ও নীতিবাগীশ বিধুশেখর বিন্দুর ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে। জ্ঞানের প্রতি প্রবল আসক্তি থাকা সত্বেও বিন্দুর পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়ায় গঙ্গা পিতৃবন্ধু ও অভিভাবক বিধুশেখরের ওপর মারাত্নক ক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু সে কিছুই করতে পারে না, উপরন্তু অল্প বয়সে লীলাবতীর সঙ্গে গঙ্গার বিয়ে তিনি আয়োজন করে ফেলেন।

বিয়ের পর গঙ্গা বুঝতে পারে যে, সে আসলে বিন্দুর প্রতি আসক্ত। তাই বিন্দুর ঠাকুর ঘরে, যেখানে জনার্দনের মূর্তির পায়ের তলে তাকে সমর্পণ করা হয়, বার বার যাওয়া শুরু করে যা বিধুশেখরের চোখে একদিন ধরা পড়ে যায়। এমন অনাচার থেকে বিন্দুকে বাঁচানোর জন্য গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা সত্ত্বেও বিধুশেখর বিন্দুকে কাশীতে পাঠিয়ে দেন। তারপর গঙ্গা নদীয়ায় জমিদারি দেখার নাম করে স্ত্রীকে রেখে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যায়।

ঘুরতে ঘুরতে সে একসময় বিন্দুর খোঁজে কাশীতে এসে হাজির হয়। সেখানে গঙ্গা যা দেখে তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বিন্দুবাসিনী একজন বারবণিতা হয়ে পতিত পুরুষের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। বিন্দুকে এমন পাপের পথ থেকে রক্ষা করার জন্য গঙ্গা বিশাল ঝুঁকি নিয়ে ফেলে, বিন্দুকে নিয়ে মা গঙ্গার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্রোতের তোড়ে বিন্দু হারিয়ে গেলে গঙ্গা আর বিন্দুর খোঁজ পায়নি। গঙ্গার বুকে ঝাঁপ দেয়ার সময় বিন্দু বলে, ‘গঙ্গা, পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তবে সেখানে যেন তোকে পাই’।

উপন্যাসটির দ্বিতীয় খণ্ডে আমরা অন্যরকম গঙ্গানারায়ণকে দেখতে পাই। দীর্ঘ পাঁচ বছর সে হিমালয়ের বিভিন্ন তীর্থস্থানে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে তাদের জমিদারি পরগণা ইব্রাহিমপুরে ফিরে আসে। কারণ সেখানে সে জালালুদ্দিন শেখকে কথা দিয়েছিল নীলকর সাহেব কর্তৃক অপহৃত তার স্ত্রী হানিফা বিবিকে সে ফেরত এনে দিবে, তারপরই সে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিল। নীলকরদের বিরুদ্ধে একরকম লড়াই করে তাদের নাস্তানাবুদ করে গ্রামের মানুষের কাছে যখন সে কিংবদন্তী, তখন সে ধরা পড়ে জেলে যায়। জেল থেকে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নবীনকুমার তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনে এবং বিষয়-সম্পত্তির কাজে আটকে ফেলে।

এক সময় বন্ধু-বান্ধবসহ সকলের অনুরোধে সে কুসুমকুমারী নাম্নী বাগবাজারের রায় বাড়ির বিধবা মেয়েকে বিয়ে করে। মায়ের অবর্তমানে বিয়ে করায় গঙ্গার মধ্যে একটা অপরাধবোধ সব সময় ছিল। তবে কুসুমকুমারীর জ্ঞানস্পৃহা ও সংগীত-মনস্কতা গঙ্গানারায়ণকে মা ও বিন্দুর কথা ভুলিয়ে দেয়। বিন্দু তার কাছে ‘কালিদাসের মেঘদূত’ শুনতে চেয়েছিল, এখন তা কুসুমকে শুনাতে গিয়ে বিন্দুর কথাই মনে পড়ে গঙ্গার। নবীনকুমার কর্তৃক বাংলায় অনূদিত ‘মহাভারত’ কুসুম বারবার পড়ে, তবু তার আশ মেটে না। নবীনকুমারের মৃত্যুর পূর্বে বিদ্যাসাগর দেখতে এলে কুসুমকুমারী গঙ্গাকে দিয়ে বিদ্যাসাগরকে প্রণাম করার অনুমতি প্রার্থনা করে। প্রণাম গ্রহণ করার পর বিদ্যাসাগর তাঁর প্রবর্তিত বিধবা বিবাহের সফল এই জুটিকে দেখে পরম আনন্দিত হয়।


পাঁচ.


উপন্যাসের প্রারম্ভিক পর্যায়ে পুরনো কিছু গাল-গল্প করতে গিয়ে সুনীল কলকাতার যুগলসেতুর ঠাকুরদের পূর্বপুরুষের কাহিনি এবং কলকাতা নগরী পত্তনের সঙ্গে তাঁদের ভূমিকা খুবই সচেতনভাবে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। ঠাকুরদের আদি পদবী ছিল কুশারী, কুশ গ্রামের নামানুসারে তাঁদের এমন পদবী। তাঁদের এক বংশলতিকা ঘটনাক্রমে পির সংসর্গে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁদের নাম হয়ে যায় পিরালির বামুন। এই পিরালির বামুনরা খুলনার পিঠাভোগ গ্রাম ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় চলে আসে এবং ব্রাহ্মণ হওয়াতে স্থানীয় লোকেরা তাঁদের ‘ঠাকুর’ বলে ডাকা শুরু করে।

তখন ইংরেজ কর্তৃক নতুন শহরকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন কাজের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। লবণ ও অন্যান্য ব্যবসার মাধ্যমে কলকাতা শহরে ঠাকুরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ভীষণরকমভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এই বংশের সবচেয়ে সূর্যসন্তান প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর আরো বিভিন্ন ব্যবসায়ে জড়িয়ে সেই সম্পত্তিকে বহুগুণ বাড়িয়েছিল। এমনকি ইংল্যান্ডের রানির আমন্ত্রণে তিনি ব্রিটেন পরিদর্শনে গিয়ে ফরাসিদেশও ভ্রমণ করেন যা ভারতীয় ইংরেজদের চোখেও তাঁকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। অথচ তাঁর এমন সম্পদ-লিপ্সা ও বিলাস-ব্যসনকে জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সুনজরে দেখতেন না যা তাঁকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তাই সব ছেড়ে ইংল্যান্ডেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান এবং সেখানেই দ্বারকানাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

পিতার মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ পুরোপুরি ঈশ্বর ও আধ্যাত্নিকতার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। অথচ যুবাবয়সে তিনি হিন্দুধর্মের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত ছিলেন এবং এক সরস্বতী পূজায় প্রায় লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করেন। উপনিষদের শ্লোক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনতিকাল পড়েই পিতৃবন্ধু রাজা রামমোহন রায়ের মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন দেবেন্দ্রনাথ এবং আধ্যাত্মিকতা ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের পথ বেঁচে নেন। ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজ হাতে নেন যা সে-সেময়কার হিন্দু যুবকদের খ্রিষ্টান হওয়া থেকে রক্ষা করেন।

নব্য-প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্ম দেবেন্দ্রনাথের পুত্রসম কেশব সেনের মতো যুবকদের প্রবল উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও তাদের মধ্যকার বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ফাটল সৃষ্টি করে। গোঁড়া হিন্দুরা ব্রাহ্মধর্ম প্রচারকে হিন্দুধর্ম নাশের ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন, কারণ ব্রাহ্মরা দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করেন না, বরং নিরাকার ব্রহ্মের আরাধনা করেন। দেবেন্দ্রনাথ ওই সমাজের সংস্কারে যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তা যথার্থভাবে চিত্রিত করে লেখক প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।

দেবেন্দ্রনাথের মেজ পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম আইসিএস হয়ে ঠাকুর বাড়ি ও বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেন। ১৮৬১ সালে দেবেন্দ্রনাথের চতুর্দশ সন্তান রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলে নাম রাখার অনুষ্ঠানে তার প্রতিবেশী নবীনকুমার সিংহের আমন্ত্রিত হওয়ার খবর আমরা এই উপন্যাসে জানতে পাই। নবীনকুমার দেবেন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র ও ব্রাহ্মদের আলোচনায় উপস্থিত থাকলেও ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেয়ার কথা কখনও মনে স্থান দেননি।


ছয়.


মহামতি বিদ্যাসাগর উপন্যাসটির বিশাল অংশ জুড়ে আছেন। ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগরের জীবনী ও আদর্শ তুলে ধরাও যেন সুনীলের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক সতীদাহপ্রথা রহিত হওয়ার পর হিন্দু ব্রাহ্মণদের একাধিক বিবাহের কুফলস্বরূপ সমাজে বহু বিধবা সৃষ্ট হওয়ায় তা বিদ্যাসাগরকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তাই শাস্ত্র ঘেঁটে ঘেঁটে ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন যা আঘাত করে তৎকালীন হিন্দুসমাজের মর্মমূলে।

কট্টরপন্থী হিন্দুরা বিদ্যাসাগরকে হেনস্থা করার জন্য বিভিন্নভাবে উঠে-পড়ে লাগে। তবু বিদ্যাসাগর ক্ষান্ত হননি, নিজ উদ্যোগে ও অর্থব্যয়ে তিনি বেশ কিছু বিধবার বিবাহের আয়োজন করেছিলেন। তাঁর এই মহান উদ্যোগে আকৃষ্ট হয়ে তরুণ নবীনকুমার প্রত্যেক বিবাহে এক হাজার টাকা দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। অনেকের সঙ্গে মেলামেশা করলেও বিদ্যাসাগরকে নবীনকুমার সমসময় আদর্শস্থানীয় মনে করতেন।

বিদ্যাসাগর নবীনকুমারকে মাঝেমধ্যে কৃতকর্মের জন্য ভর্ৎসনা করলেও ভীষণ স্নেহ করতেন। প্রচণ্ড বিশ্বাস থেকে নবীনকুমারের কাঁধে মহাভারতের বঙ্গানুবাদের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেন এবং সে-ও এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সঙ্গে। নবীনকুমার বিধাব-বিবাহকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিধবা কুসুমকুমারীকে বিয়ে করতে চাইলে বিদ্যাসাগর একাধিক বিয়েকে গর্হিত বলায় তিনি ওই পথ থেকে সরে আসেন। বহুবিবাহ রোধে গ্রহণ করেন বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ। তাছাড়া নবীনকুমারের প্রত্যেকটি সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে বিদ্যাসাগর কেবল উৎসাহ যোগাননি, তা তত্ত্বাবধানও করেছিলেন পরম মমতায়। এমনকি নবীনকুমারের মুমূর্ষু অবস্থায়ও তাঁকে দেখার জন্য নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও ছুটে যান। আর এভাবেই বিদ্যাসাগর ও নবীনকুমার পুরো উপন্যাস জুড়ে গুরু-শিষ্য রূপে বিরাজমান।


সাত.


জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত ও জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান মধুসূদন দত্তের জীবনের ঘটনাবলী অসীম দরদ দিয়ে এঁকেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। গঙ্গানারায়ণের বন্ধু মধু হিন্দু কলেজে পড়ার সময় থেকে অবাক করা সব কাণ্ড ঘটিয়েছে। গৌরদাস বসাক, রাজনারায়ণ বসু, বেণী, মধু ও গঙ্গা হিন্দু কলেজের প্রথম দিকের ছাত্র এবং এরা সবাই মহান ইংরেজ ও ভারত-দরদী হেয়ার সাহেবের শিষ্য। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগী মধুসূদন বিলেত-ফরাসি দেশে পাড়ি দেয়া এবং মিল্টন-শেক্সপিয়ারদের সমান কবি হওয়ার বাসনায় মা-বাবার প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও বাংলা ও হিন্দু ধর্মকে পদদলিত করে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন। দীক্ষা নেয়ার পেছনে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না, ছিল বিলেত যাওয়ার ও ইংরেজ কবিদের সমকক্ষ হওয়ার প্রবল ইচ্ছা। বাংলা ভাষাকে চাঁড়াল-চণ্ডালের ভাষা হিসেবে অভিহিত করে সাহিত্যের জন্য ভাষাটিকে অযোগ্য বিবেচনা করতেন মধুসূদন।

দীর্ঘ আটবছর পর ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় ফিরে এসে দেখেন মা-বাবা কেউ আর জীবিত নেই। চরম অর্থকষ্টের মুহূর্তে বন্ধু গৌরদাস বসাকের অনুরোধে ৫০০ টাকা দক্ষিণার বিনিময়ে ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকের রচয়িতা রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে মাইকেল রামনারায়ণের বাংলা লেখায় খুব হতাশ হন। পাইকপাড়ার রাজাদের জন্য বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সময় তিনি ভ্রুকুঞ্চিত করে বলেন যে এর চেয়ে হাজারগুণ ভালো নাটক তিনি লিখতে পারেন।

অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো করে তিনি লিখে ফেলেন প্রথম সার্থক বাংলা নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’, তারপর ‘পদ্মাবতী’। নাটকগুলো মঞ্চস্থ হওয়ার পর চারদিকে সকলে ধন্য ধন্য করতে থাকে। নাটকের সঙ্গে সঙ্গে প্রহসন লেখার অনুরোধ আসে। তখন লিখলেন—‘একেই কি বলে সভ্যতা?’,‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। প্রহসনগুলোও সুধীসমাজে যথেষ্ট সাধুবাদ পায়। এরপর মধুসূদন হাত দিলেন কাব্যে, লিখলেন রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, তারপর ‘তিলোত্তমাসম্ভব’। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এই কাব্যগ্রন্থগুলো সারা দেশে সাড়া ফেলে দেয়। আবির্ভাব ঘটে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার এই মধুকবির হাত ধরে।

নবীনকুমারের ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ থেকে তাঁকে সংবর্ধনার আমন্ত্রণ জানালে তিনি প্রথমে প্রত্যাখান করলেও পরে বন্ধুদের অনুরোধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সেখানে বাংলায় বক্তৃতা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। যদিও পরে মঞ্চে উঠে বাংলায় কয়েক লাইন বলে নেমে যান এবং তাতেই মুগ্ধ হন শ্রোতারা।

গঙ্গানারায়ণ নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিছুদিন জেল খাটেন। জেল থেকে ফিরে আসার পর মধুসহ সব বন্ধুরা মিলে যখন গল্প করছেন, তখন এক আগন্তুকের আগমনে তাঁদের আড্ডার ছন্দপতন হয়। আগন্তুকের নাম দীনবন্ধু মিত্র, পেশায় ডাকবিভাগের সরকারি চাকুরে, কর্মস্থল পূর্ববঙ্গের ঢাকা।

বাংলা নাটকের সার্থক নাট্যকার মধুসূদনের কাছে তাঁর আর্জি ছিল—নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটা নাটক বা প্রহসন লেখা। মধুসূদনের যেহেতু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তাই তিনি এ-বিষয়ে দীনবন্ধুকেই লিখতে বললেন এবং বইটির ইংরেজি অনুবাদ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। দীনবন্ধু ‘নীলদর্পণ’ নাম দিয়ে লেখকের নামবিহীন বইটি প্রকাশ করলে সাড়া পড়ে না। কিন্তু মাইকেলের ইংরেজি অনুবাদে নাটকটির কপি পাদ্রী লঙ সাহেব কর্তৃক প্রচারিত হলে ইংরেজ মহলে বইটি ব্যাপক আলোড়ন তুলে।

ইংরেজ সরকার বইটির রচয়িতা, অনুবাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। মহান মানুষ ও আইরিশ পাদ্রী লঙ সাহেব এর সমস্ত দায় নেন নিজের কাঁধে। পরে আদালতে তাঁর একমাসের জেল ও সহস্র মুদ্রা জরিমানা করলে নবীনকুমার সিংহ তৎক্ষণাৎ এক হাজার টাকা আদালতে রেখে সরে পড়েন। এজন্য কলকাতা শহরে নবীনকুমারের নামে প্রশংসার বন্যা বয়ে যায়।

বাংলায় একটানা চার বছর লেখালেখি করার পর যখন খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সমস্ত সম্পত্তি পেয়ে রীতিমত ধনী হয়ে যান, তখন মধুর ভেতরে পুরনো বাসনা জেগে ওঠে। তিনি বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়বেন ও ইংরেজিতে কাব্য রচনা করবেন। বিলেতে ও ফ্রান্সে থাকাকালীন চরম আর্থিক অনটনে পড়লে একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কেউ তাঁর দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেননি; বরং যাদের বিশ্বাস করেছিলেন তারাই তাঁকে বেশি ঠকিয়েছে। ফলে তাঁকে আবার কলকাতায় ফিরে আসতে হয় এবং পড়তে হয় আবার চরম আর্থিক কষ্টে। এবার বিদ্যাসাগর আর সহযোগিতা করতে পারেননি, কারণ বিলেতে তাঁর জন্য যে টাকা পাঠাতেন তা-ও ধার করা। কিন্তু তা পরিশোধ করেননি মধুসূদন।


আট.


‘রাইমোহন ঘোষাল’ উপন্যাসটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। এই চরিত্রটি সুনীল অত্যন্ত দরদ দিয়ে এঁকেছেন। সেই সময়ের ভদ্রসমাজের ভদ্রলোকদের চরিত্রের নগ্নরূপটি আঁকতে গিয়ে তিনি এ-চরিত্রটিকে কৌশলে ব্যবহার করেছেন। রাইমোহন ওই সমাজের নষ্টামিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মধুর গন্ধ পেলে মাছি যেমন খবর পেয়ে যায়, রাইমোহনও টাকার আভাস পেলে সেখানে মুহূর্তে উপস্থিত।

স্বর্ণকার গোপী স্যাকরার কাছ থেকে নিজের পাওনা আদায়ের জন্য আমরা তাকে যেমন বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে দেখি, আবার রামকমল সিংহ, হীরে বুলবুল, কমলা সুন্দরী, হরিশ মুখুজ্যে, এমনকি নবীনকুমারের বিদ্যোৎসাহিনী সভায়ও তাকে আনাগোনা করতে দেখি। অন্যদিকে মানবতাবোধ, সংগীতপ্রিয়তাও তার মধ্যে দেখা যায়।

হীরে বুলবুলের পিতৃপরিচয়হীন শিশু চন্দ্রনাথকে নিজ সন্তান বলে পরিচয় দিয়ে শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে ভদ্রসমাজে প্রতিষ্ঠিত করতেও তাকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেখা যায়। তবে একটা রাগ সে মনে মনে দীর্ঘদিন পুষে রেখেছিল এবং তা রামকমল সিংহের উপপত্নী কমলা সুন্দরীর প্রতি, কারণ সে কখনও রাইমোহনকে আসকারা দেয়নি। তাই হরিশ মুখুজ্যের সঙ্গে নবীনকুমার যখন মুলুকচাঁদের আখড়ায় সুরাপান ও বাঈজীদের নাচ দেখতে যেত, সেখান থেকে ফুঁসলিয়ে তাঁর বাবার রক্ষিতা কমলাসুন্দরীর বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং এ-খবরটি বিধুশেখরের কানে পর্যন্ত পৌঁছায়।


নয়.


উপন্যাসটির সবচেয়ে রহস্যময় এবং প্রভাব বিস্তারকারী চরিত্র বিধুশেখর মুখুজ্যে। তিনি শুধু বাবু রামকমল সিংহের বন্ধু নন, পথ-প্রদর্শকও। পেশায় আইনজীবী হলেও তিনি কখনো ঘোর সংসারী, কখনও কট্টর ব্রাহ্মণ, কখনও স্নেহশীল পিতা, বন্ধুবৎসল, পরোপকারী। আবার তাঁর মধ্যে বিপরীত চরিত্রও লক্ষণীয়। বন্ধু-পত্নীর সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক কেউ না জানলেও বন্ধু ঠিক জানতেন। তাই মৃত্যু-মুহূর্তে পুত্র নবীনকুমার তাঁর সন্তান কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রামকমল সিংহ বিধুশেখরকে বারবার প্রশ্ন করেন। তখন তিনি রামকমলের মাথা ছুঁয়ে মিথ্যে বলেন; জানান, নবীন রামকমলেরই সন্তান।

নীতির প্রশ্নে অটল বিধুশেখর যখন গঙ্গানারায়ণকে তাঁর বিধবা কন্যা বিন্দুবাসিনীর প্রতি আসক্ত হতে দেখেন, তখন তিনি কিছু নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমত, গঙ্গাকে রামকমল সিংহের বিষয়-সম্পত্তি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেন। দ্বিতীয়ত, বিন্দুকে কাশীতে পাঠিয়ে ব্যাভিচারের পথে ঠেলে দেন যা গঙ্গাকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এদিকে গঙ্গাকে দিয়ে মা-কালীর কাছে শপথ করিয়ে নিয়েছেন যে, সে যেন কখনও বিন্দুর সামনে না যায় তবেই তিনি বিন্দুকে কোনো শাস্তি দিবেন না। নবীনকুমারের সব আবদার রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা ও মুখাগ্নি করার অনুমতি প্রদান নবীনের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসাই প্রকাশ করে।

বিম্ববতী পরবর্তীতে বিধুশেখরকে আর প্রশ্রয় দেননি, বরং তাঁকে স্পর্শ করলে তিনি আত্মঘাতিনী হবেন বলে বিধুশেখরকে হুমকি দেন; এমনকি তীর্থে চলে গিয়ে সেই পাপ মোচনের কথাও জানান। এটা বিধুশেখরের স্ববিরোধী আচরণ বলে প্রতিভাত হয়। বিম্ববতীর হরিদ্বারে চলে যাওয়াকে বিধুশেখর প্রথমে সহজভাবে নিতে না পারলেও পরে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সম্মতি দেন এবং তখন থেকে বিধুশেখরের শরীর ভেঙে পড়তে থাকে, এমনকি মনও।

বহু বছর পর গঙ্গানারায়ণ ফিরে এলে বিধুশেখর গঙ্গাকে ক্ষমা করেননি এবং নিরুদ্দেশ থাকার সময় গঙ্গার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। অথচ নবীনকুমারের প্রতি তাঁর ভালোবাসা দিনে দিনে আরও গভীর হতে থাকে। নিজ স্ত্রীর মৃত্যু, বিম্ববতীর প্রস্থান ও মৃত্যুর খবর, নিজ কন্যাদের মৃত্যু বিধুশেখরকে এতটুকু বিচলিত করেনি, যতটুকু করেছে নবীনের মৃত্যু। নবীনের অকালমৃত্যুতে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েন ও শোকের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ করেন যা বিধুশেখরের মত কঠিন হৃদয়ের মানুষের কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত। এমনকি যে নবীনকুমারের তাঁর মুখাগ্নি করার কথা ছিল, সে নবীনের মুখাগ্নি করার জন্য তিনি শ্মশানঘাটে পর্যন্ত যান।


দশ.


দুলালচন্দ্রের পিতা ত্রিলোচন দাস জোড়াসাঁকোর সিংহদের জমিদারি পরগণা নদীয়ার ইব্রাহিমপুরের লোক। খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় জমিদারের লোকজন তাঁর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিলে স্ত্রী থাকোমণি এবং দুই শিশু পুত্র-কন্যাকে নিয়ে জমিদারের সঙ্গে সাক্ষাতের আশায় সে কলকাতায় আসে। বিচারের প্রত্যাশায়। ঘটনাচক্রে কলকাতার রাস্তায় স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে সে পাগল হয়ে যায়, অন্যদিকে স্ত্রী থাকোমণি দুই শিশুকে নিয়ে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। এরমধ্যে মেয়েটি কলেরায় মৃত্যুবরণ করলে মৃত মেয়েকে কোলে নিয়ে সে যখন গঙ্গার ঘাটে বসে কাঁদছিল তখন তার প্রতি নজর পড়ে মালিকের স্ত্রী গঙ্গায় পূণ্যস্নানরতা বিম্ববতীর।

বিম্ববতীর অনুগ্রহে পুত্রসহ তার আশ্রয় জুটে সিংহবাড়িতে, অথচ এই জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যেই একদিন রাতের অন্ধকারে সে স্বামীর হাত ধরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে দুলালচন্দ্রকে নবীনকুমার বানিয়ে ফেলে তাঁর খেলার সঙ্গী। সমস্ত উপন্যাস জুড়ে আমরা নবীনকুমারের সঙ্গে দুলালের সরব উপস্থিতি দেখতে পাই। এভাবে থাকোমণি ও দুলালচন্দ্র হয়ে ওঠে উপন্যাসটির অন্যতম চরিত্র। এবং এই দুটি চরিত্রের হাত ধরে আমরা পূর্ণচোখে দেখতে পাই সিংহবাড়ির অন্দরমহল এবং অন্দরের লোকজনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার ছবি। এভাবে সেই সময়ের প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপন প্রণালীকে উপস্থাপন করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

অন্দরের তথা দাসীমহলের সর্দারনী দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মহিলা সোহাগবালা, সিংহবাড়ির গোমস্তা-মহলের সর্দার দিবাকরের স্ত্রী। সোহাগবালা সূক্ষ্ম কৌশলে দাসীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। দিবাকর বহির্মহলে আর সোহাগবালা অন্দরমহলে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছে, গ্রামের বাড়িতে গড়েছে বিশাল অট্টালিকা, মন্দির ও পুকুর।

বিধুশেখর গুপ্তচর মারফত সব খবর রাখলেও দিবাকরের মত বিশ্বস্ত চাকরকে ঘাটাতে চাইতেন না। সোহাগবালাকে দিয়ে দিবাকর সব দাসীকে, এমনকি থাকোমণিকেও নিজের শয্যাসঙ্গিনী বানাতে সক্ষম হয়। সোহাগবালার মৃত্যুর পর অবধারিতভাবে দাসীমহলের কর্তৃত্ব এসে পড়ে থাকোমণির ওপর, কারণ সে যে নবীনকুমারের নিত্যসঙ্গী দুলালচন্দ্রের মা। সোহাগবালা যেমন স্বামী দিবাকরের সিংহবাড়ির ওপর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে অন্দরের দাসী-বাদীর ওপর ছড়ি ঘোরাতে সিদ্ধহস্ত ছিল, তেমন করে থাকোমণিও পুত্র দুলালের দোহাই দিয়ে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসে সব।

মূলত ‘সেই সময়’ উপন্যাসটিতে প্রধান কোনো চরিত্র নেই, এমনকি প্রধান কোনো ঘটনাও নেই। নবীনকুমার সিংহ ও সিংহবাড়িকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি আবর্তিত হলেও বিধুশেখর মুখুজ্যে, বিম্ববতী, গঙ্গানারায়ণ, বিন্দুবাসিনী, কুসুমকুমারী, সরোজিনী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হরিশ মুখুজ্যে, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল দলের সদস্যবৃন্দ, রাইমোহন ঘোষাল, নবীনকুমারের ভৃত্য দুলাল, দুলালের মা থাকোমণি ও বাবা ত্রিলোচন দাস, কমলাসুন্দরী, হীরে বুলবুল ও তার পুত্র চন্দ্রনাথ, সিংহবাড়ির গোমস্তা দিবাকর ও তার স্ত্রী সোহাগবালা সবাই নিজ নিজ চরিত্রগুণে অনন্য হয়ে উঠেছে। এটাই চরিত্রাংকনে সুনীলের নৈপুণ্য। তবে সব ছাপিয়ে ‘সময়’-ই এই উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি বিশেষ সময়কে ধারণ করতে গিয়ে নির্মাণ করেছেন সুবিন্যস্ত ও সুবিশাল ক্যানভাসের এই বর্ণিল উপন্যাস।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

কবে

অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চুতুর্দিক, আজো বেঁচে আছি মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক। দুলে ওঠে দিন; শপথমুখর কিষাণ শ্রমিকপাড়া,

গল্প

লোকটা

লোকটা চলে যাবার পর আমার মনে হলো পাখিটার নাম মোঃ ইদ্রিস আলি। আদি নিবাস ভরতপুর। পোস্ট পারখিদিরপুর, থানা আটঘরিয়া। এক সময়

গল্প

সৎকার

বাংলাদেশের ছোট্ট একটি জেলা মাগুরা। নবগঙ্গা বিধৌত অসম্ভব সুন্দর জেলা। মাগুরা জেলার ছোট্ট একটি সবুজে ঘেরা ছায়া ঢাকা গ্রাম বাগডাঙা।

চারিদিকে প্রকৃতির

চারিদিকে প্রকৃতির ক্ষমতা নিজের মতো ছড়ায়ে রয়েছে। সূর্য আর সূর্যের বনিতা তপতী— মনে হয় ইহাদের প্রেম মনে ক’রে নিতে গেলে,