অনন্য আজাদের ‘চাঁদ মাংস ও জিঘাংসার প্রেত’ : কাব্যগ্রন্থ রিভিউ

স্নেহের নয়ন,

এটা তোমার ইমেল মনে হয়। খুঁজে পেলাম অনেক কষ্টে। তুমি কবিতা পড়তে চেয়েছিলে। বইটার কিছু কবিতা পেলাম আমার ফাইলে। তাই এগুলোই পিডিএফ করে পাঠালাম। শুধু তোমার পড়ার জন্যেই। বাকিগুলো আমার কাছে নেই। পাঠালাম। পড়ে মতামত দিও সময় পেলে। শুভকামনা নিরন্তর।

অনন্য আজাদ ( পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
০২.০২.২১


অনন্য আজাদের ‘চাঁদ মাংস ও জিঘাংসার প্রেত’


‘চাঁদ মাংস ও জিঘাংসার প্রেত’ (প্রথম প্রকাশ বইমেলা ২০১৯) বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সংযোজন, কবিতাগুলো আমাদের ভেতর বিস্ময় উদ্রেক করে, চেতনাকে করে ঋদ্ধ : যদিও আধুনিক শব্দচয়ন, আধুনিক জগত সেখানে শেষ রাত্রির নিভন্ত তারাটির মতো নিভু নিভু, তবু সেসব কবিতার ভেতর আছে আধুনিক মন ও মননের তীব্র ও বিপন্ন অনুরণন, প্রতিফলন। আবহমান বাংলার পৌরানিক উপাখ্যানের সাথে কবির একাত্মতা, ভাষা প্রয়োগে মধ্যযুগীয় আবহ, বাংলা সাহিত্যের স্বর্গীয় দ্বীপ জীবনানন্দের ছায়া কাব্যগ্রন্থটিকে পৌঁছে দ্যায় ভিন্ন এক দ্যোতনায়, গড়ে তোলে মৌলিক ও স্বতন্ত্র আঙ্গিক। অনন্য আজাদের কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা বেছে নিতে চাচ্ছি, কবিতাটির নাম ‘শাশ্বত’, কবিতাটি পাঠের ফলে আমরা নিমেষেই উপলব্ধি করবো, না, তিনি সাধারণ কোনো পদ্যকার নন, তিনি একজন প্রকৃত কবি, তাকে শাশ্বত শিল্প জগতে ‘কবিদের কবি’ বললেও অত্যূক্তি হবে না।

‘দেখি জন্ম, ভূতজন্ম, প্রেতজন্ম, লক্ষ–লক্ষ কোটি–কোটি ভ্রুণজন্ম
ঊনত্রিশ বর্ষ গর্ভের আঁধার হয়ে প্রণয়কালীন সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে আছে
দেখি মৃত্যু, দেখি জীবনের কঙ্কাল–করোটি অস্থি ও মজ্জাহীন
শিরায় শিরায়, রক্তে রক্তে উল্লাস হয়ে আছে, আর শ্মশান থেকে
কবর থেকে, বিস্তীর্ণ সরিষার ক্ষেত থেকে আমাদের ভূতগ্রস্ত ছিন্নমস্তা,
আমাদের আরাধ্য শব্দব্রহ্ম, আমাদের হারানো কবচকুণ্ডল হাহাকার করে ওঠে।
দেখি সত্য ভ্রুক্ষেপহীন, দেখি মিথ্যা জিঘাংসাপ্রবণ
একশত শতাব্দীর হাড়–মাংস নিয়ে, ধড়মূণ্ড নিয়ে অট্টহাস্য করে

দেখি পাপ, পাপের গায়ে পুণ্যের আলপনা শাশ্বত হয়ে আছে
দেখি বৃশ্চিক রাশিতে নাচে প্রেত, যজ্ঞীর অগ্নি, পুরুষকার
বাঁশি বাজে মরণবাঁশি, পাগল বাঁশি, শ্যাম ও শ্যামার প্রেম নিঃস্ব হয়ে আছে
পশ্যন্তী, মধ্যমা, বৈখরী, কোন বাকে লিখবো তোমাকে মৃত্যু—বলে দাও।’

পড়াশোনা না করে কবিতা লেখা অসম্ভব, বড় জোর পদ্য লেখা যেতে পারে। সংবাদপত্রের ক্ষণায়ু আবর্জনার চেয়েও স্বল্প সেসব পদ্যের জীবন চক্র। অনন্য আজাদ প্রচুর পড়েছেন। কবিতার স্তবকে স্তবকে ছড়িয়ে আছে অধ্যয়নের দ্যুতি, সৌরভ। তার লেখা কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে। এসব কবিতায় বারবার চোখ বুলোতে চাই। তিনি একজন প্রকৃত শিল্পী। সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ একটি কাব্যগ্রন্থ। নিঃসঙ্গ জীবনে কবিতা ছিল যার একান্ত ধ্যান, সৃষ্টির অনিবার্য ধ্বংসের ব্যাপারে ছিল তার স্থির বিশ্বাস, মৃত্যুর মতো ধ্রুব সত্যের সৌন্দর্য নিয়ে লিখে ফেলেন—

‘একদিন কথাও তো ফুরিয়ে যাবে
একটি সম্পূর্ণ জীবন উড়িয়ে নেবে হাওয়া
অস্থি ও মজ্জার ভেতর দুলে উঠবে অলৌকিক লণ্ঠনের শিখা।

এতদিন যে একা একা দ্বীপরাজ্য গড়েছি এখানে
ধ্বংস, ধ্বংস হয়ে যাবে।’

জন্ম, মৃত্যু, প্রেম ও জীবন সম্বন্ধে ভারতীয় দর্শনের মিথস্ক্রিয়া, জন্ম—জন্মান্তর, মায়াময় জগত, ভারতীয় মানসে দেব দেবীর অনিবার্য উপস্থিতি, নক্ষত্র, বাংলার গ্রামীণ পারিপার্শ্বিকতা, ব্যক্তিগত মৌলিক একান্ত কিছু অনুভব, দেহাতীত প্রেম, সামগ্রিক ভাবে পাঠকের চেতনায় ও হৃদয়ে একীভূত হয়ে সঞ্চার করে নির্মল রস।

‘কত জন্ম পার হলে, কত শ্মশান পেরিয়ে এলে
দেহের তিমিরে ডুবে যায় দেহাতীত প্রেম।’

গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের ঘটনার কথা সর্বজনবিদিত; ভাগ্য ও উদ্যমের দ্বন্দে বিপর্যস্ত অনিবার্য পরিণতি ঘটে ইডিপাসের জীবনে। সেই ঘটনাটির বিচ্ছুরণ অসাধারণ ও অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে একটি কবিতার আলাদা দুটি স্তবকে—

‘কোনো ফেরেশতার সাথে দেখা হয়নি আজও
তবু আবছা বিশ্বাসের আলোয় ভ্রমজন্মের ঠিকুজি খুঁজছে জ্যোতিষী
আমি তাকে ব্যর্থ হতে প্ররোচনা দিই।’


‘আমাদের সবারই হাতের তালুতে ধরা থাকে
সেরকম এক পূর্বপরিচয়হীন রুমাল,
যাতে জীবনের সুঘ্রাণ অথবা মৃত্যুর সুস্বাদ লেগে থাকে।’

গাছের পাতা স্থলনের দৃশ্যে যে একাগ্রতা ও সুক্ষ্ম দৃষ্টির প্রয়োজন, অথবা বিশ্বভ্রমণ শেষে ঘরের বাইরে শিশির ফোঁটা না দেখার মধ্যে যে কৌতুক ও আনন্দ আমরা পাই, একইরকম সৌন্দর্য ও সুক্ষ্ম অনুভূতি লাভ করি নিম্নোক্ত লাইন দুটিতে—

‘দূরে কোথাও একটা কাঁচপোকা মরে গেল এইমাত্র
আমি তাঁর শেষ নিঃশ্বাসটুকুও স্পষ্ট শুনতে পেলাম।’

কাব্যগ্রন্থের ছন্দের দিকটিও বেশ আকর্ষণীয়, মনোরম ও সুখময়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যঞ্জনায় কাব্যগ্রন্থটি সমৃদ্ধ ও অলংকৃত। কোথাও অন্ত্যমিল নেই (দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) অন্ত্যমিল দেয়ার প্রবণতা থেকে কবি সম্পূর্ণ মুক্ত। অনেকটাই স্বাধীনতা তিনি নিয়ে নিয়েছেন লেখার আগেই, কি করতে যাচ্ছেন ভেবে নিয়েছেন, অবচেতন মনে জমে ওঠা ভারতীয় সংস্কৃতি, রক্তে বাংলার প্রতি টান ও ভালোবাসা, চোখে ও মগজে বিশ্ব সাহিত্য পাঠের অনুপম স্মৃতিচিহ্ন, ক্ষুধা এবং কবিতার প্রতি প্রেম ও মোহ : গদ্যের মতো স্বাধীনতা যেমন তিনি নিয়েছেন, আবার নিরলস অধ্যবসায় ও চর্চার ফলে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রাও কোথাও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়নি, ফলে তিনি শৈল্পিক কিছু কবিতা উপহার দিয়েছেন আমাদের। কোনো কোনো কবিতায় ক্বচিৎ জীবনানন্দ ও আল মাহমুদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যা খুবই স্বাভাবিক এবং পরিমিত মাত্রায়। তবে কাব্যগ্রন্থটির মৌলিকত্ব নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার: বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কবিতাগুলো মূলত নিরীক্ষাধর্মী।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

লেনা দেনা

শুনতে শুনতে চাচীর সামনে ভেসে উঠলো সেই মেয়েটার মুখ ৷ আর কিছু লেনদেনের ভাষা ৷ কতগুলো অব্যক্ত সত্য ৷

মহিলা

এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো; এইখানে এসে প’ড়ে- থেমে গেলে- একটি নারীকে কোথাও

গল্প

গন্ধ শিশি

একচালা টিনের একটাই ঘর, চিকোন বারান্দা, বারান্দার এক মাথায় উনুনে ঘুটে ঠেলে ঠেলে রান্না করছে কুদ্দুসের বউ কপালি খাতুন।