জীবন্মুক্ত বাতিঘর এবং পাঠ-রৌদ্র-ছায়া


রাতুল হরিৎ-এর বই আলোচনা

জীবন্মুক্ত বাতিঘর এবং পাঠ-রৌদ্র-ছায়া


কল্পনা আটকে যায় বাস্তবে আর বাস্তব তৈরি করে স্বপ্নের মোহ। গোপনে বপন করা ইতিহাসের ভার বয়ে বয়ে গল্প এগোয়। বিজ্ঞাপিত বাংলাদেশের আড়ালে যে সত্যিকারের বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের অন্তরে যে আনন্দ-বেদনা, হাস্য-পরিহাস, দুঃখ-দ্রোহ আর হাহাকারের বয়ান, সেই বয়ান বুনে গল্প নির্মাণ করেন সিদ্দিক বকর। গল্পের আল ধরে কে যায়, আমি না তুমি, আমরা না তোমরা অথবা নানা নাম এবং সর্বনামের মিছিলে কার জীবনের প্রবাহ-প্রতিচ্ছবি দেখি! সিদ্দিক বকরের কলমের কারসাজি মূলতঃ মুখোশে মোড়া মানুষের মূলমুখ উন্মোচন অথবা স্বাপ্নিক মানুষের ধাবমানতা, থমকে যাওয়া এবং সংগ্রামশীল কেন্দ্রগামীতায় সত্যের সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠা করা। পাঠকভেদে পাঠের ভিন্নতা থাকে। এক গল্প ভিন্ন অর্থে, ভিন্ন মনে, ভিন্নভাবে বিরাজ করে।

বর্তমানের অতীতপ্রীতি এবং ভবিষ্যৎবাদীতা চিরকালীন। বন্ধ্যা সময়ও বসে থাকে না, ঝুঁকে বসে নানা সৃষ্টি-অনাসৃষ্টিতে। তখন নানা আচার-অনচারের উৎপাতে আমাদের স্বপ্ন হারিয়ে যায় অস্বস্তির অমাবস্যায়। বন্ধ্যার সন্তান মিথ্যাবস্তু আবার প্রাণহীন স্মৃতিবন্ধনাও অনিবার্য। এমন গ্রহণ-বর্জনেই মানুষের বেঁচে থাকা। সিদ্দিক বকরের গল্পে এই বাস্তবতার মূর্ততা দেখি, দেখি বিমূর্তায়নের মুগ্ধ মূর্ছনাও। তাহলে তার গল্পে পাঠকের প্রত্যাশা নিবৃত্তি হয় কীভাবে? গল্প মানে চিলতে চিলতে ঘটনার সমন্বয়। প্রত্যেক মহৎ লেখক তার গল্পে জীবনের সামগ্রিকতা ধরবার চেষ্টা করেন। সিদ্দিক বকরের এমন নির্মিৎসা স্পষ্টতা পায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথায়। তিনি বলেন, “যে লেখক মানুষকে যত সাহসের সাথে তার টোটালিটিতে ধরবেন তিনিইতো পাঠককে ততবেশী ইন্সপায়ার করবেন।”

অন্তঃসার শূন্যতার হতাশা যদ্দুর জয়াশা তার থেকে বেশি। শূন্যতার যত দৌর্বল্য তার থেকে বেশি প্রাবল্য। শূন্যতায় কবরের নিস্তব্ধতা আছে আবার শূন্যতার শক্তিতে অগ্নিগিরির আগ্নেয় জাগরণও আছে। এই আলো-অন্ধকারের ঝাপটা-ঝাপটি বুকে এগিয়ে চলা গল্পগুলো অবশ্যই বিশেষ মনোযোগ দাবী করে। তাঁর গল্পসমূহের পটভূমি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও তার চারপাশ।

না উজান, না ভাটি এমন মধ্যবর্তী অঞ্চলে দুইপ্রান্ত মানুষের সহাবস্থান। দুঃখ-দারিদ্র্য বনাম প্রাচুর্য এই দুইয়ের চিরকালীন সংঘাতে সাম্যাবস্থার স্বপ্ন-সংগ্রাম, উজান-ভাটির ভাঙ্গাগড়াতে যে জীবনযাত্রা তার প্রকাশভঙ্গীতে ধরা দেয় স্বতস্ফূর্ত আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার আর এই কথাকর্মীর মাটিলগ্নতা।

গল্পসমূহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে আছে মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধকালীন, যুদ্ধপূর্ব এবং পরবর্তী সমাজ বাস্তবতা উঠে এসেছে নানা গল্পে। দৃশ্যমান যাপিত জীবনের ভেতরেও যন্ত্রণার অদৃশ্য গভীরতম বহমানতা আছে। দৃশ্যের অন্তরে আছে অদৃশ্যের বসবাস। সাংসারিক টানাপোড়েনে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাত অতঃপর নানা অমীমাংসা, নানা অস্থিরতা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বয়ানে গল্পগুলো সিঁড়ি ভাঙ্গে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনের বাহিরে যে হাহাকার ভেতরে তা আরও তীব্রতায় বহমান। এই ভেতর বাহিরের মিথস্ক্রিয়ায় একটা খাপছাড়া প্রকাশভঙ্গি এবং জটিল শিল্পবোধ-বিন্যাসে প্রকাশ হয় মূলত আত্মজাগরণ ও গভীর আত্মানুসন্ধান। গল্পের স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের দ্যোতনা বিশেষ তাৎপর্যে বিশেষায়িত হয়। আবার এই ভরসাবাদী তোলপাড়েও খেলা করে ভাঙ্গন, নির্মম বিচ্ছিন্নতা, আত্মপীড়ন আর চোখ ঝাপসা করা এক নৈরাশ্যের নির্দিশা। “জীবনন্মুক্ত বাতিঘর” এর সকল গল্পই ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে প্রতিফলিত।

জীবনন্মুক্ত বাতিঘর:

গল্পের নাম ‘জীবনন্মুক্ত বাতিঘর’। কাহিনীর ভেতর থেকে অসাধারণভাবেই নামটা জেগে উঠেছে অথবা নামটাই ধারণ করে পুরো গল্প-প্রবাহ। গল্পের নাম এবং নামের গল্প একাকার। জীবন এবং যাপনের স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনার মোহ ত্যাগ করে যে কেউ অন্য অনেকের স্বপ্নবার্তা ফেরি করে, মৃত্যুর মুখোমুখি জীবনের জয় গায় সে-ই জীবন্মুক্ত; অনিবার্য অনুপ্রেরণা। এভাবেই ‘জীবন্মুক্ত বাতিঘর’।

ভিন্ন অর্থের ভিন্ন শব্দ মিলে একটা আওয়াজ হলে সেখানেই বেজে উঠে অর্থের গুঞ্জন, শিল্পের দ্যোতনা। যাঁরা সত্যকে সুন্দর জেনে জীবনকে ভালোবেসে জীবন দখল এবং বিলিয়ে দিতে গিয়ে হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বরে তাঁরা যখন বিজলীর উজ্জ্বলতায় উঁকি মারেন গল্পে তখন আমার, আমাদের, অনেকেরই ভালো লাগে। ‘জীবন্মুক্ত বাতিঘর’ তেমন একটা গল্প। সিদ্দিক বকর গল্প বলার নিজস্ব শৈলি তৈরির চেষ্টায় যত্নবান সেটা বুঝা যায়।

মিঞা মুহাম্মদ দরবেশদের মন-মগজে স্থাপিত নির্যাতনের ঘাঁটি আর মসজিদের ইমামের আছে গরুর গলায় ছুরি চালাবার প্রকৌশল। প্রাণী হত্যা মহাপাপ- এমন বুদ্ধের বাণী ইমাম সাহেব মানবে কেন? ইমামের রয়েছে আসমানী নির্দেশ আর ঈমানী জোশের অমৃত- রক্ত দেখে কাঁপবে কেন মুসলিমের অন্তর…। ঈশপ উপলব্ধি করে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর যন্ত্রণা। ঈশপের জীবন মৃত্যুতে থেমে যায় না; অধিকার বঞ্চিত মানুষের স্বপ্নে প্রস্ফুটিত হয়ে স্থানীয় ঈশপ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক। আর আন্তর্জাতিক মিঞা মুহাম্মদ দরবেশ নর্দমার কীট হয় ভেসে যেতে থাকে দুর্গন্ধময় ভাগাড়ে।

গল্পের ঈশপ এবং তার সময়টাকে বড় চেনা চেনা লাগে। হ্যাঁ, ১৯৭২ থেকে ৭৫-এর কালপর্বে এইসব ব্যবহারিক আখ্যান রচিত হয়। আজকের বাস্তবতা তার থেকে আরও অনেক ভয়াবহ।

ঈশপের সংবেদনশীল চোখ টলোমলো আবছায়ায় ভেসে ওঠে মিঞা মুহাম্মদ দরবেশ আর ইমামের চকচকে ধারালো ছুরি। ঈশপের চোখে স্থির হয় কোরবানির গরুর চোখ– “চোখে যত আলো ছিল তত আলোরা কাছাকাছি একটু দূরে পড়ে মাতম করে হায় হোসেন হায় হোসেন।… আমি বুঝতে পারি আমাকেও এখন একইভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমাকে যত রকমের অসহনীয় নির্যাতন আছে সবই করা হবে। তাই আমাকে উপুড় করে শোয়ানো হয়েছে। উপুড় হওয়ামাত্র শরীরের পতনের শব্দে দরজার শতধা নির্যাতনসহা কাঠ একটু চমকে ওঠে। ঘুমবিলাস কুকুর অলস চোখে তাকায় যেন। কাঠে আমার শরীর স্থাপন হলে কোনো এক বিন্দুতে এক হয়ে যাই আমরা, ভার বিনিময়ের সোপান তৈয়ার হয়। … আমি আরো নিবিড় নিমগ্ন হই, নিবিষ্ট হই। আমার দেহগৃহ থেকে আমার আত্মাকে আলগা করার মগ্নতায় প্রার্থিত হই। আমার হৃদয়ের স্পন্দন কাঠের মাঝে স্পন্দিত হয়। আমি শুনতে পাই কাঠ আমাকে বলে আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি তোমাদের বাড়ির সামনের আঙিনার জামগাছ। আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। তোমার এই হাত-পা-শরীর, শরীরের ঘ্রাণ, তোমার প্রাণ প্রাণস্পন্দন সবই আমার অতি চেনা। তোমার মনে পড়ে কি, তোমার কোমল কচি হাত পায়ে বুক সিনা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার গতর বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠতে কত? ডালে ডালে বাদরিয়েছ- ফল খেয়েছ। আমাকে এক খুনি কাঠুরে আমার গোড়া করাত দিয়ে কেটে আমার শিকড় হাত-পা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মাটি-মা থেকে আমার নাড়ি আলগা করে। তুমি খুব বিমূঢ় হয়েছিলে, মেলায় হারানোর উদ্বেগের ঢেউ বয়ছিল তোমার মাঝে। তোমার চোখের কোনায় জল এসে ছলছল করেছিল। জানো, ওরা আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে পাতা পুড়িয়ে, ডাল পুড়িয়ে, আমার শরীর চিরে চিরে তক্তা বানিয়ে হাতুড়ি-বাটাল-রানদা দিয়ে একটু একটু করে কত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে নির্যাতন করে আমাকে দিয়ে কাঠ বানাল, আমি সবকিছুকে বরণ করে নিয়েছি অবলীলায়। দুঃখের গর্ভে সুখশিশু লালন হয়। তুমি আমার মাঝে মিশে যাও। লবণ যেভাবে মেশে জলে। আমি কাঠের মাঝে নিজেকে প্রতিস্থাপন করলাম। আমার সুখাত্মা মিশে যায় জামগাছের আত্মার সাথে। আমার দেহ কাঠ হয়ে যায়।”

ঈশপরা নিজের মুক্তি চেয়েছিল সকলের মুক্তির মধ্যে। তারা জানতো– একটা সামগ্রিক সংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ না করে নিজের মুক্তি কখনো ন্যায্য করা যায় না। এই ঈশপদের ভাবনা দেখি পৃথিবীব্যাপী। আশি নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বুন্টু উপজাতির উচ্চারণেও ঈশপ জেগে উঠে– ‘উবুন্টু’ (ubuntu) মানে I am because we are. আমি আছি, কারণ আমরা সবাই আছি তাই। বাকীরা যদি দুঃখে থাকে, তাহলে আমি একা সুখী হবো কীভাবে?

ভেল ঘুম, খোয়াব ও তীক্ষ্ণ ফলার বর্শা: ঘুমের স্বপ্ন কাট কাট। ঘটনার কোন পরম্পরা থাকে না। মনে হয় নির্ভয় আবার ভয়াবহতা বিরাজ করে। ঘুম ভাঙ্গে কিন্তু ঘোর কাটে না। নানা কল্পনা তাড়া করে। ভেল ঘুমের ভেল্কিতে অস্পষ্ট স্মৃতি তীক্ষ্ণ ফলার বর্শাতে আটকে থাকে। স্পষ্ট হয় না। মনস্তাত্ত্বিক তোলপাড়ে রক্ত টগবগ করে। ধীরে ধীরে খোয়াবের আবছায়া সরতে ধাকে।

বউয়ের কথার ঝাঁজে বুঝা যায়, বলহরি– একদিন দুনিয়াটা বদলে ফেলার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলো এবং আছে। অনেক দৈন্যদশা যাপন করে সুন্দর সমাজের স্বপ্নে বিভোর বলহরি অতঃপর কাঙ্ক্ষিত সমাজ বানাতে পারেনি। অক্ষমতার এই ক্রোধ-জ্বালার দহনে দগ্ধ বলহরি তড়পায়। বউয়ের হাড়কাটা কথার ফোড়নে উদাম হয়ে যায় বলহরির অতীত বর্তমান। অগণন বলহরি বয়ে যায় একলা বলহরির মননে। বলহরির প্রতি তার বউয়ের বাক্যবাণে উঠে আসে তাদের চলমান দৈন্যদশা, সময় এবং সমাজের চরম অবক্ষয়ের চিত্র। বউয়ের তিক্ত কথায় বলহরি বোবা হয়ে থাকে। বউ বলে– “কী আছে তোমার কও দেহি? দেখবানে বউ যখন অন্যের বাড়িত কাম করবো, রানবো, বাড়বো তহন কৈ থাহে মান-সম্মান! কী করছো, কী করছো সারাডা জীবন? ই…স্ দুন্যাইডা উদ্ধার কইর ্যা সব ফল্ডাইয়্যা লাইবো। বালডা ছিঁইড়্যা আডি বাইন্ধ্যা অহন মন্ত সাইজ্যে। আর গ্যাছলা তো গ্যাছলা ফাল্ডাইয়্যা ফরে ক্ষ্যান্ত দিতা। ফারছিলা না, জীবনটাতো দিতে পারতা। এহন খুব মজা লাগে। ছোড ছোড পুলাপাইন চোক্ষের সামনে দিয়া হাডে, মদ খায়, গাইঞ্জা খায়, ডাইল খায়, বাপের আগে বাল ফালায় সব। রাস্তা দিয়া হাঁডা যায় না, টিটকারী মারে- মন্তর বউ যায়…”

বউয়ের এই ছোট্ট ধীরা কথার ব্যাপ্তি অনেক। সামন্য এই কথার রেখায় উঠে আসে অসামান্য জীবনবোধ– বাস্তবতা, সমকাল, ইতিহাস এবং দর্শন সবই।

জোনাকপোকার মিছিল:

জোনাকপোকার মিছিল এই নামের মত্ততা-ই গল্পের মূল উপজীব্য। নামে যদ্দুর টানে মনে তদ্দুর আলোড়ন মূলতঃ ভারসাম্যের-ই ভাবব্যঞ্জনা।

অগ্নিগর্ভ সময়ের উত্তাপে জ্বলা গল্পের নিশাচর বিষু আর ঝোপঝাড়ে জ্বলা নিশাচর জোনাকপোকায় বিরাট মিল। এই দুই প্রজাতিকে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সক্রিয় সৈনিক মনে হয়।

জোনাক পোকার দেহে লুসিফেরিন নামের যে রাসায়নিক পদার্থ তার সংগে অক্সিজেনের ক্রিয়া হলেই তাপবিহীন উজ্জ্বল ঠাণ্ডা আলো জ্বলে ওঠে। এই জ্বলে উঠার প্রক্রিয়াকে বায়োলুমিনেন্স বলে। এই আলো জোনাকির প্রজনন ত্বরান্বিত করে এবং নারী জোনাকিদের প্রলুব্ধ করে। সংশয়াকুল ভাঙ্গনের সংঘাত অতঃপর জাগরণের ঝলমলানিতে যুবকটি বায়োলুমিনেন্সের আরেক সংস্করণ হয়ে ওঠে।

জয়-পরাজয়ের চিহ্ন আঁকা মানুষ আরও বিস্তৃত বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এমন কেউ নেই যার হাসি-আনন্দ নেই, জ্বালা-যন্ত্রণা, দুঃখ-দ্রোহ নেই, সরব-নীরবের কোলাহল নেই। আত্মদহন আর ক্ষরণ মিলিয়ে নির্মিত হয় সামগ্রিক জীবনের অবয়ব। পুতুপুতু প্রেম-ভালোবাসার মতো ঘৃণা বা হিংসা-বিদ্বেষও কম শক্তিশালী নয়। গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ-সংশ্লষণের বিস্তৃতি ছোটছোট ডট-ডিজিটে ধরে ফেলার এক বিশেষ পারঙ্গমতা লক্ষ্য করার মতো। মানুষ যে প্রতিনিয়ত হয়ে উঠবার ব্যাপার– এমন নিষ্ঠার গৌরবে তার চরিত্রগুলো ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। বীজ মরে যাবার পরেই নতুন করে অঙ্কুরোদ্গম হয়। মৃত্যুর গহীন অরণ্যে যেমন জীবনের প্রণোদনা আছে, তেমন ঘুমগভীরে জাগরণের অপার শক্তিও সঞ্চয়ন হয়। এমন জাগ্রত নিদ্রিত মানুষের বাস্তবিক রূপ-অপরূপে-ই সমাজের শরীর সৃষ্টি হয়। অতঃপর নামগোত্রহীন যুবকটি আরও অগণন যুবকের দুঃখ-বীরত্বের মিথস্ক্রিয়ায় জোনাকপোকার মিছিল হয়ে যায়।

এক চিলতে গল্পাংশ– “একটা ঘরের সামনে যেতেই নিজের ঘর নিজের বাড়ি বলে বিভ্রম লাগে। ওই ঘরে কি আমার মা শুয়ে আছে? মা…!

বাবা আইছস তুই? বাবারে, আমি যে তর জন্য মরতে পারি না, ঠিকমতো খাইতে পারি না, কত কষ্ট রে বাবা! তুইনি মইরে গেছছ হেই কষ্ট, ক্যামনে বাছছ হেই কষ্ট, আমার কষ্টের কিনারা নাই।

মা, আমি আইছি, আর যাব না মা। তোমার আর কষ্ট হবে না। আয় বাবা, আমার বুকে আয়। যেভাবে তরে আমি পেটে রাখছিলাম হেইভাবে তরে আমি বুকে রাহুম, আর যাবি না তো বাবা! তরে ছাড়া আমি ক্যামনে বাঁচি! দেশ তো স্বাধীন হইলো হেই কবে, এহন আর কী যুদ্ধ করচ বাবা! তুমি বুঝবা না মা, অহনের যুদ্ধই সবার থেকে বড় যুদ্ধ।” মা পুতের চিরায়ত বন্ধন আর সাম্যবোধ-বাদের দ্বান্দ্বিক চেতনা, মাতৃত্বের ওম আর মুক্তির ডাক সমান্তরাল রেখায় এগিয়ে যায়। ভাঙ্গনের ক্ষরণ আর গড়ে তোলার সাহসে বিষু জোনাকপোকা অথবা ডট হয়ে যোগ দেয় নতুন দলে। লুকিয়ে থাকবার বিপর্যস্ত সময়ে বিষুরা ঈগলের মতো লড়াই করে, ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে উড়ে উড়ে উঠে যায় মেঘের ওপরে।

মঙ্গলযাত্রা:

মঙ্গলযাত্রা– এক চিলতে মনোভূমে অনেকগুলো গল্পদানা। বাংলার সহজিয়া শৈশব কৈশোরের দুধভাতে আচানক পাকিস্তানি জন্তু-জানোয়ারদের উৎপাত। যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা। স্বাধীন তবে শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ কখনও ছিলো কি? এই স্বাধীনতার অন্তরে দগদগে ঘাঁ যা এখনো শুকায়নি। এই যন্ত্রণাদগ্ধ ঘাঁ ছড়িয়ে আছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে। এই গল্পের বয়ানে আছে স্বাধীনতার ভেতরের হাহাকার। জল আপন মনে জমিন গিলে খায় মূলতঃ মায়ের জন্মদান প্রক্রিয়ার মতো একদেহে আরেক প্রাণের অস্তিত্ব। বিনাশমুগ্ধ বেদনায় সন্তান প্রসব যেমন জলও তেমন জমিন জন্ম দিয়ে যায়। এক চিরকালীন অন্তর্গত সম্পর্কের মধ্যেই জল জমিনের বসবাস। সিদ্দিক বকরের চূড়ান্ত অনুভবে- যুদ্ধের আগে ও পরে জীবন সংগ্রামতো চলতেই থাকে। আমরা সহজ মানুষ সহজ জীবনের গল্পটা সহজিয়া ভঙ্গিতেই চাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গল্প বলার ধরণ-ধারণ মূল গল্পের বহমানতা আটকে দেয়। কখনো কখনো গল্পের দৃশ্যগুলো শুধু লেখকের মানসপটে যা পাঠকের কল্পনায় নোঙ্গর করতে ইতস্তত করে। তারপরেও পাঠকের অভিজ্ঞতার পুঁজি আর গল্পের স্বনির্ভরতায় গল্প এবং তার পাঠক ঝাঁপটা-ঝাপটি করে অল্প সময়ে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। বুড়ি আয়তন, ছায়াতন আর ছেনুর মায়েদের মন-প্রাণ এবং স্মৃতিতে দগদগে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ইতিহাস জিওল মাছের মতো তড়পায়, আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ কি আসন্ন…!

প্রাণ:

গল্পটা পড়লেই মনে হবে গান– খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…ফকির লালনের আত্ম-জিজ্ঞাসা-অন্বেষা, ধ্যানমগ্ন আধ্যাত্মিক সাধু-সন্তের গাম্ভীর্য। গল্পে দুইজনের পারস্পরিক কথা বিনিময়ের মধ্যে ভেসে আসে আমাদের লোকায়ত মহাকাব্যিক সুর-সংগীত- ফান্দে ফড়িয়া বগা কান্দেরে…। পাখির দুঃখ-দুর্দশার সংগে মানুষের সম্পর্ক তখনও এক পৌরাণিক পরিভ্রমণে ব্যাপ্ত। কিন্তু ছোট্ট বন্য পাখির সংসার তছনছের ভেতরে বাঙ্গালি জাতি-গোষ্ঠীর হাহাকার শোনা যায়। গল্প-কথা– “… দেখি একদল জলপাই রঙের পশু আমার মেয়ের হাত ও চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি উঠতেই ওদের কাছে যা যা থাকে তা দিয়ে মাথায় আঘাত করে। আমি আর কিছু বলতে পারি না। …আমি দৌঁড়ে ওদের ক্যাম্পে গেলাম, খোঁজ করলাম- ওরা পরিষ্কার অস্বীকার করলো যে এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি। গত রাতে এমন কাউকে ধরে নিয়ে আসা হয়নি।…” প্রচলিত এই রাষ্ট্রীয় বয়ানের সংগে জনগণ বিশেষভাবে পরিচিত। এই গল্পের ভেতরের গল্পটা শেকড়গাড়ে বাঙ্গালি মননে যদিও তার বিস্তার বিশ্বব্যাপী। ভীষণ বিব্রতকর সময়ের প্রতিবিম্ব বুকে নিয়ে গল্পটা ঘুমায় আবার জ্বালা-যন্ত্রণার দহন নিয়ে জাগে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে।

আগুন জ্বলা জল:

“ধানের মাঝে গুরদই, এক কাঠা ধানের নয় কাঠা খই।” এমন অনেক প্রবাদ-প্রবচনের প্রচলন থেকে কৃষিনির্ভর সমাজের অবয়বটা বুঝা যায়। এই অবয়বের নানা রঙরূপ আছে। লোকমুখে আছে পরামানিক কুমকুমির প্রেমাখ্যান। এরই মধ্যে বাজের মতো এক যুদ্ধ এসে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিলো তাদের মুখের সূর্যটা। পরামানিক যুদ্ধে যায়। অন্তরের আগুন চেপে রেখে বাইরের আগুন নেভাতে যায়। আর চরম সামজিক অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে অতি সতর্কে সন্তরণ করে কুমকুমি। ওরা পড়ে যায় আগুন দিয়ে আগুন নেভানোর খেলায়। এই খেলায় হারিয়ে যায় পরামানিক। অতঃপর আসে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। এই দিনে বাঙ্গালি জাতিকে বিকলাঙ্গ করে দেবার জন্য পাকিস্তানিরা আমাদের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালিদের হত্যা করে। সারি সারি নিহত বুদ্ধিজীবীর সংগে কুমকুমিও যোগ হয়। গল্পভাষ্য এমন- “গাবগাছের ডালে কুমকুমি এক ভাঙা ডাল। ইটরঙা শাড়িটা আরো লাল দেখায়। শাড়ির আঁচলের একটা মাথা গলাগলি হয়ে থাকা নতমুখী পদযুগল ছাড়িয়ে ফণা তুলে ঈষৎ নড়ে মৃদুবৎ বাতাসে। লাল শাড়ির কুমকুমির ফোঁটার চতুর্দিকে গাবগাছের সবুজ প্রাণ পত্ পত্ করে কাঁপে এবং ওড়ে।” সবুজ প্রকৃতির মধ্যিখানে লাল সূর্য কুমকুমির নামেইতো আজকের বাংলাদেশ। জটিল ভাষা প্রয়োগে লেখক হয়তোবা অস্পষ্ট উপলব্ধি স্পষ্ট করবার চেষ্টা করেন। লেখক যা-ই করেন গল্পের ঘোরে ঘোরলাগা ভাষা বুঝবার দায় পাঠককেই নিতে হয়। কুমকুমি আত্মহত্যা করে নাকি হত্যা করা হয়? এই রহস্য ভেদ করে কুমকুমির বড় ভাই আবেল মুন্সী। কুমকুমির নামে সমাজে কানাঘুষা হয়, এই নালিশ শুনে আবেল মুন্সীর যে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া লেখক তা অনুবাদ করেন এভাবে- “আবেল মুন্সীর দুইডা পা আচমকা মাটিতে পুঁতে যায়। খালে পানি দেখে ছাগল যেভাবে সারা শরীরের ভর এবং জোর সামনের দুই পায়ে ভর করে জান জোরে মাটিতে পোঁতে; দড়ি টেনে, ধাক্কাটাক্কা কোনো কিছুতেই একচুল নড়ানো যায় না, আবেল মুন্সী ঠিক এমনি করে আচমকা দুই পা মাটিতে পুঁতে দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক একেবারে মাথা ও কানের পাশ দিয়ে মর্টার শেল যায় প্রচণ্ড গতি ও শব্দে। দুই-দুইটা যুদ্ধবিমান মাথার এক্কেবারে কাছ দিয়ে চক্কর মারে- অনেকগুলো সার রেইনট্রি গাছের গুঁড়ি একসাথে ভাঙার কড়কড় শব্দে এক বজ্র এসে পড়ে যেন তার ওপর। আবেল মুন্সী পুড়ে এবং এই বজ্রের সবটুকু আগুন আত্মায় নিয়ে বজ্র হয়ে আসমানে উড়ে মেঘে মেঘে, বজ্রপাতের ক্রোধে পাকতে থাকে।” পাকিস্তান এবং তার দোসরদের এই বর্বর ক্রোধ বাঙ্গালি জাতি-গোষ্ঠীর সকল বুদ্ধিজীবী হত্যা করে মেধাশূন্য এক মূর্খ জাতি-গোষ্ঠী বানাবার নীল-নকশা করে। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সেই নীল-নকশারই সাক্ষ্য বহন করে। পাকিস্তানি বর্বরদের বাঙ্গালি প্রেতাত্মারা এখনও দেশ বিনাশের গুরুদায়িত্ব পালন করছে। কুমকুমির গর্ভে মুক্তির যে চেতনা তা ভূমিষ্ঠ হবার আগেই তারা তাকে হত্যা করেছে, আরও করবে, বাংলাদেশকে মুর্খদের স্বর্গরাজ্য বানাবে। এই মুর্খদের বিরুদ্ধে কুমকমির আত্মশক্তির জাগরণ আমাদেরকে আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করে।

আকন মেন্দির পাতা:

বিমূর্ত প্রচ্ছদের মতো গল্পটা। প্রথম পাঠে শূন্য মনে হবে অতঃপর অনেক গল্পের রূপরেখ ইশারা স্পষ্ট হবে। সবুজ মেন্দিপাতায় দমন-পীড়ন হলে জাগে লাল আগুনের মুখ আর বাঘের গর্জন। বাংলাদেশের অন্তর্জগৎ মন্থন করে কিশোর বলাই একাকার হয় ঘৃণা-ভয়-বিস্ময়ে আর স্পর্ধার দুর্দম বাসনায়। পাকিস্তানের “মিলিটারি বাহিনীটা কেমন!” বলাই তা পরখ করে বলে- “বাপরে শালারা সব একেকটা শুয়োরকা বাচ্চা।” একাত্তরের আগুনের ভেতর চরম মানবিক বিপর্যয়ে মানুষ মানুষের ভয়ে দৌড়ায়… কেন? যুদ্ধ হলো কিন্তু মুক্তি এলো না আজও। আজও জাতির পতাকা খামছে ধরেছে সেই পুরনো শকূনরাই। তাই যুদ্ধের কথা-ই মনে পড়ে। বিধ্বস্তের ব্যথা জর্জরিত বাংলাদেশে বিষনাশী আকন মেন্দির পাতা হয়ে মুক্তির বার্তা নিয়ে কেউ আসুক। মনের ভেতর জাগিয়ে তুলুক আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ।

সাপ:

সময়ের সঙ্কট এবং সম্ভাবনার চিহ্ন নিয়েই চরিত্রগুলো ধাবিত হয় সামনের দিকে। গদ্যের সারল্যে কাব্য প্রবাহ যোগ হলে অর্থের বৈচিত্র্য তৈরি হয়। কিন্তু সমস্ত বৈচিত্র্যে ব্যক্তির গল্প, গল্পের উপাদান কিছুই ব্যক্তিতে থাকে না সবই সমাজের অধীন। মানুষের ইতিহাস, সমকাল এবং ভবিষ্যতযাত্রায় নির্দিষ্ট হয় সমাজের অবয়ব। সামান্য ওয়ার্ড সভাপতি চানপুরার ফোনেও থানার ওসি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এই চানপুরাদের কপালেই আজ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। “এহনের এই পাওয়ারতো দেহি বাইরা মাসের ব্যাঙের লাহান। ট্যাঙ-টুঙে বাইরা-বাইরি লাগে। তফাৎ একটু আছে…ব্যাঙ মুতে ট্যাঙে- এই ব্যাঙ মুতে মুহে। ওয়াড সভাপতি তাইলেতো অহন বড় নেতাঐ। আগে কিন্তু এগুলি ঠিক এভাবে চখে পড়তো না, এহন যেভাবে এক্কেরে নাহে-মুহে ওরাবেরা করে।”

ফাইভ স্টার হোটেলের দামি কাস্টমাররা যত বস্তাপচা সস্তা কথা বলে, শুনলে- এদের মুখে খাড়ায়া মুইত্তে দিবার ইচ্ছা হয়। আর ফুটপাতে চা-স্টলের সস্তা কাস্টমাররাও অনেক দামি কথা বলেন। তাদের কথা বাণী হয়ে যায়। এদের টোটকা কথায় ধর্মনীতি, রাজনীতি, দর্শণ ও সমাজ রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ চেহারা দেখা যায়। চা-স্টলের এক প্রৌঢ় বক্তা বলেন–

“ধর্মনিরপেক্ষ না আমার বাল, পারবে ছেলেকে হিন্দুর ঘরে বিয়ে দিতে?”

“চানপুরার কথা আর কি কইবা, রাজনীতিতো এহন এরাই করবো, তাই না?

– চানপুরারে দেখলে মনে অয় হের জানি কত ক্ষমতা… যতটুকু আছে ততটুকুতো ঐ আমরার বাপ-দাদারা খরম পড়তো না, ঐ খরমের বৈলার মত। হে তো আসলে ঐ খরমের বৈলা। ক্ষমতা যে থাহে না বেশি দিন এই জিনিসটা এরা ভাবতে পারে না ক্ষমতার মোহে।

– চাচাজি, ভাবে টিহৈ, না অইলে বৈদেশ-বিভুঁইয়ে বাড়ি করে ক্যান? খমতা গেলে বৈদেশ যায়া তাকবো, ডর কী?

– আরে ভাতিজা ঠিকই কইছো, মাগার আজরাইলরে আটকাইবো ক্যামনে? হের তো আর বিদেশ যাইতে ভিসা টিকেট প্লেইন লাগে না। কথায় আছে না, আল্লার মাইর দুন্ন্যার বাইর। ছানপুরার বসেরা তো আর হিটলার মুসোলিনি না, হেরাঐ থাকতে পারে নাই। এগুলান অইলো একেকটা বিষাক্ত সাপ, দেশটা এই সাপে ভইরা আছে, নিরাপদে চলাফেরা করবা, তারও কোনো ব্যবস্থা নাই।”

বাজারের লেংটা পাগল অতি সামান্য একজন এক ফোটা শিশির। এক ফোটা শিশির যেমন অতিকায় সূর্যকে বুকে ধরে আবার সূর্যের তেজস্ক্রিয়াতেই হারিয়ে যায়। তেমন করে বাংলাদেশের পূর্ণরূপ অতি সামান্য পাগলের কল্বে খেলা করে কীভাবে?

এই পাগলকে একদিন হঠাৎ বেজান দৌড়ে এক কাপড়ের দোকানে ঢুকতে দেখা যায়। “ঢুকেই অতি ত্রস্ত হাতে একটা লুঙ্গি নিয়ে তাড়াতাড়ি করে এর ভিতর ঢুকে যায়- লুঙ্গিটা এক প্যাঁচ দিয়ে পরে দোকানের বারান্দায় চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। খুবই অল্পস্বল্প সময়ের ভিতরই লুঙ্গি খুলে ফলে দেয় এবং নির্বিকার মৃদু এলোপায়ে আনমন দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকে-…” গন্তব্যহীন হাঁটে আর গুনগুন করে–

“আমার পাগলা ঘোড়ারে
তুমি কইর মানুষ কৈ লৈয়া যাও…”

পাগলের এমন আচরণের রহস্য কী? এই জিজ্ঞাসা নিবৃত্তির আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হলে লোকজনের উদ্দেশে এই পাগল একটা ছোট্ট উত্তর দেয়–

“বাজারে একজন মানুষ আসছিল…”

পাগলের ছোট্ট এই উত্তরে খানখান হয়ে যায় চানপুরাদের সকল দম্ভ। এই পাগলের সামনে এরা অমানুষ। এইসব অমানুষদের সামনে উলঙ্গ হয়ে ঘুরলেই কি যায় আসে? জলের ছোট্ট মাছ চানপুরা ডাঙ্গার মানুষ হয়ে সমাজ-রাষ্ট্রে বিচরণ করার কী কারণ, কীইবা মাহাত্ম? শুনেছি, চানপুরাকে অনেক বড় মাছও ভয় পায়। ক্ষুদ্র চানপুরা বৃহৎ মীনকে ভাগিয়ে ক্লান্ত করে অতঃপর আক্রমণ করে, ধারালো কাঁটার আঘাতে রক্তাক্ত মস্ত মৎস্যের
রক্ত পান করেই চানপুরা বাঁচে। উলঙ্গ বাংলাদেশ আর দিগম্বর পাগলে কোন বিরোধ নেই। একলা এই পাগল আর পাগলরাই পারে প্রতিদিন রক্তচোষাদের বাল দেখাতে।

গল্প বলবার সহজাত তাড়নায়, দায় এবং দায়িত্বের সমন্বয়ে এই কথাকার কথার শিল্প বা শিল্পের কথা তৈরি করেন। তার গল্পসমূহে পাঠকের শিল্পবাঞ্ছা পূরণের নিরন্তর চেষ্টা দেখি। স্বতন্ত্র ভাষাবৈশিষ্ট্যে তিনি গল্পের বিস্তার ঘটান। প্রতিনিয়ত বাস্তবতার নিরিখে গল্পব্যক্তিকে যৌথ জীবনায়নে যুক্ত করাটাই হয়তোবা সিদ্দিক বকরের দর্শন।

কথাকার গল্পের বক্তব্য ভাষার প্রতীকায়নে আড়াল করে পাঠককে মূলতঃ সক্রিয় অনুসন্ধানে ব্যস্ত করে রাখেন। গল্পের ভেতরের গল্পে পাঠককে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করবার জন্য সিদ্দিক বকর প্রতিনিয়ত ইঙ্গিতময় ভাষার আশ্রয়ে যান। গল্পগুলো তীর ছুঁড়ার মতো- পেছনে টেনে- অতীত ইতিহাস পাঠ করে, বর্তমানের ব্যাখ্যা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়। ইতিহাসের পাঠ যত দীপ্রগভীর, বর্তমান তত স্বচ্ছ-স্নিগ্ধ হয়ে দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দেখা যায় ঋদ্ধ ভবিষ্যত । এমন চিন্তাচর্চা হলে গল্পের ব্যক্তি, ব্যক্তির সমাজ এবং রাষ্ট্রের গূঢ় রহস্য উন্মোচন সম্ভব।

সিদ্দিক বকরের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জীবন্মুক্ত বাতিঘর।’ তার লেখার স্বকীয় শৈলীতে উঠে আসে সময় এবং সমাজের বহমান জীবনধারা। বাংলা সাহিত্যে অবক্ষয়রোধী কিংবা প্রতিবাদী শিল্পভাষ্য তৈরিতে কথাশিল্পী সিদ্দিক বকর বিশেষ ভূমিকা রাখবেন এই আমাদের প্রত্যাশা।

গল্পগ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ‘বেহুলা বাংলা’ থেকে।

বইটি কিনতে ক্লিক করুন – জীবন্মুক্ত বাতিঘর

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

আগ্নেয়গিরি

কখনো হঠাৎ মনে হয়ঃ আমি এক আগ্নেয় পাহাড়। শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা। এক

গল্প

প্যাঁচ

ড্রেসিং টেবিলের আয়নার উপরে কোণায় এক টুকরো সমান ভাঙা। মারুফা খয়েরি রঙের টাঙাইল শাড়ি পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসে

কবিতা পাঠপ্রতিক্রিয়া

মুজিব মেহদী, মাসুদার রহমান ও রিগ্যান এসকান্দারের কবিতা পাঠপ্রতিক্রিয়া

কথাসাহিত্যিক ও কবি আনিফ রুবেদ বর্তমান সময়ের একজন একনিষ্ঠ সাহিত্যসাধক। দর্পণ ঈদ সংখ্যায় যখন ‘কবিতা পাঠপ্রতিক্রিয়া’ বিভাগ চালু করার চিন্তা

তোমাকে

মাঠের ভিড়ে গাছের ফাঁকে দিনের রৌদ্র অই: কুলবধুর বহিরাশ্রয়িতার মতন অনেক উড়ে হিজল গাছে জামের বনে হলুদ পাখির মতো রূপসাগরের