অবরোধ বাসিনী: সেযুগ-এযুগ


জেসিকা আক্তার জেসির বই পর্যালোচনা

অবরোধ বাসিনী: সেযুগ-এযুগ


গ্রন্থ: অবরোধবাসিনী
লেখিকা: বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
প্রকাশকাল: ১৯৩১

অবরোধ বাসিনী পড়ে আমার মোটেও মনে হয়নি আজ থেকে ৯০ বছর আগে প্রকাশিত কোনো বই পড়ছি। এই কয়েক বছরে হয়তো অবরোধ বাসিনীদের অবরোধ হয়ে থাকার প্রেক্ষাপট বদলে গেছে কিন্তু তাদের জীবন ঠিক একই রকমভাবে মাটির মতোন করেই বয়ে চলছে। আমি “অবরোধ বাসিনী” পড়তে পড়তে রোকেয়া সাখাওয়াত সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছি ঠিক কোন যুগে থেকে তিনি নারী মুক্তির জন্যে বাজিয়েছেন মুক্তির বাঁশি।

অবরোধ বাসিনীর সাথে আমি আধুনিক সমাজকে নিয়ে একটি সরলরেখা টানবো। সেই রেখার শরীর থেকে চিৎকার করে উঠবে একজন নুসরাত কিংবা অপ্রকাশিত হাজারো নাম যাদের নামের একটাই মাত্র পরিচয় তারা নারী কিংবা তারা আমাদের সমাজের অবরোধ বাসিনী। চলুন সামান্য আলোচনা করা যাক।

১. প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের বা আদি অবরোধ বাসিনী

২.আধুনিক অবরোধ বাসিনী

১. প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগের বা আদি অবরোধ বাসিনীদেরকে বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনীদের মতোন ভাবা যায়। সে সময় ভারতর্বষে নারীদের অবস্থা এমন ছিলো যে, মনে হতো তারা একটা পাপের নাম আর তা ঢেকে রাখতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা রকম চেষ্টা। সেকালে এমন ছিলো যে, ঘরে যদি চোর আসতো তবে চিৎকার না করে কোমর থেকে চাবির গোছা খুলে দিতে রাজি ছিলো; কিন্তু তবুও যেন তাদের চেহেরা চোরে না দেখে। কিংবা ঘরে আগুন লেগেছে সমস্ত গহনা বাক্সে নিয়ে বসে ছিলো, গহনা বাঁচলো কিন্তু আগুন থেকে মহিলা বাঁচলো না; কারণ চিৎকার করে বাঁচাও বলে পরপুরুষকে গলার স্বর শোনানোর থেকে আগুন পুড়ে ছাই হয়ে মেঘ রং হয়ে আকাশে মিশে যাওয়া ঢের বেশি ভালো।যাতায়াত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যেন ছিল আরও করুণ দশা। গঙ্গা ঘাটে জৈনিক মহিলা স্নান করবে। বেয়ারা তাকে পালকি করে নিয়ে এসে ঘাটে পালকিসহ তাকে স্নান করিয়ে নিয়ে গেলো। ট্রেনের মধ্যে মহিলার বর কোনো দরকারে নামলো এক স্টেশনে তার মধ্যেই অন্য লোক এসে সিট না পেয়ে সেই খালি জায়গায় বসল এই জন্যে মহিলা সিটের নীচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। এদিকে মাইকে, পুলিশ মিলে মহিলাকে খোঁজাখুঁজি। চিৎকিসার ক্ষেত্রে ছিল আরও করুণ দশা। আর বিয়ের ক্ষেত্রে ছিলো অদ্ভুত নিয়ম। দেখা গেলো মহিলা হারিয়ে গেছে কিন্তু স্বামীর নাম মুখে আনছে না, নাম জিগ্যেস করলে আকাশ এবং হাতের ব্যাগ দেখিয়ে দিচ্ছে, পরে স্বামী স্বয়ং এসে লোকদের বুঝিয়ে বলে– তার নাম আফতাব বেগ বলেই তার বউ আকাশ এবং হাতের ব্যাগ দেখাচ্ছে। কি এক করুণ দশা!

বিয়ের আগে চার/পাঁচ মাসের জন্যে একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হতো। সবসময় চোখ বুজে থাকতে হতো, দেখা যেত বিয়ের আগেই সে অন্ধ হয়ে বসে থাকতো। কিংবা পাত্রী তার নামই জানলো না, বিয়ের মধ্যে সে তার নাম জানলো। সভ্রান্ত পরিবারের এক মেয়েকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কবুল বলার সময় তাকে কিল, চিমটি মেরে মুখ দিয়ে জোর করে হু শব্দ উচ্চারণ করা হতো। কেউ বিয়েতে রাজি নয় কিল কিংবা চিমটি খেয়ে উঁহু বললে, সেই উঁহুকে হু ধরে নিয়ে সংসার করতে পাঠিয়ে দিতো। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে ছোট বালিকাদের রান্না ঘরে কিংবা ছাদে বন্দী করে রাখত।

২. আধুনিক অবরোধ বাসিনী হয়তো দৃশপট বদলে গেছে কিন্তু আধুনিক যুগেও এমন হাজারো অবরোধ বাসিনী আছে। শিক্ষা, আধুনিকতা এবঙ চিকিৎসার ব্যবস্থা পাওয়ার পরেও আমি দেখি আমার মা/কাকিরা বাংলা পড়তে জানে না। সংসার থেকে সামান্য অবকাশ যাপনের সুযোগ তাদের নেই। স্বামীর সেবা করে, তার মার খেয়ে এবং স্বামীর পরকীয়া আছে জেনেও সন্তান এবং সংসারের জন্যে দাঁতে কামড় দিয়ে পড়ে থাকে। নিকটস্থ আত্মীয় স্বজনরাই আধুনিক মেয়েদের উপর প্রথম যৌন নির্যাতন করে। পরিবারের কাছে বেশিরভাগ সময় নির্যাতিত বালিকা ভয়ে কিছু বলে না, যদিও বলে– পরিবার থেকে চুপ করে থাকতে বলে। বলা হয় লোকজন জানতে পারলে মানসম্মান যাবে। হয়তো শহরে অনেক মেয়ে আজ সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বিনোদন কেন্দ্রে যেতে পারে কিন্তু আমাদের গ্রামের আধুনিক অবরোধ বাসিনীরা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে পিকনিকে যেতে হলেও মা-বাবার সাথে আত্মীয় স্বজনদের রাজি করিয়ে তবে যেতে হয় কিংবা যাওয়া হয় না।আর যাতায়াতের ক্ষেত্রেও বাস কন্ট্রাক্টদের হাতের স্পর্শ এবং পাশের সীটে দাদার বয়সী কোন লোককে লিঙ্গ চেপে বসে থাকতে দেখা যায়। এই হলো আমাদের আধুনিক অবরোধ বাসিনীদের অবস্থা।

অবশেষে অবরোধ বাসিনী থেকে এই দুটি কথা বলতে হয়–

“কেন আসিলাম হায়! এই পোড়া সংসারে
কেন জন্ম লভিলাম পর্দা-নশীন ঘরে!”

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

জোর – জীম হামযাহ

ইলেক্ট্রিসিটিহীন প্রায় জঙ্গলের মতো প্রত্যন্ত এ তল্লাটে সন্ধ্যার পর থেকে নেমে আসে অঘোষিত কারফিউ। পুরো লোকালয় তখন চলে যায় হিংস্র

গল্প

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্প: আ ক্লিন ওয়েল-লাইটেট প্লেস

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্প: আ ক্লিন ওয়েল-লাইটেট প্লেস অনুবাদ: শামীম আহমেদ রাতের অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। গাছের পাতায় তৈরি বৈদ্যুতিক আলোর

প্রলয়োল্লাস

তোরা সব জয়ধ্বনি কর! তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐনূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি কর!! আস্‌ল এবার অনাগত

গল্প

সিংহের নৈশভোজ

সাত পাহাড় নামে আফ্রিকায় একটি জায়গা ছিলো। জায়গাটি প্রাণীরা খুব পছন্দ করতো। সেখানে সুপেয় পানি আর সবুজ ঘাসের প্রাচুর্য। থাকলেই