কৃষ্ণকান্তের উইল: সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা উপন্যাস


আলোচ্য বই: কৃষ্ণকান্তের উইল (উপন্যাসগ্রন্থ)

লেখক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


কমলাকান্তের উইল নিঃসন্দেহে চমৎকার একটি সৃষ্টি। এক টুকরো সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের রূপ, রস এবং প্রেম-কামনা, বিরহ-বেদনা-বিচ্ছেদ এবং শেষে সংসার জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসী জীবন বেঁচে নেওয়ার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তির চেষ্টা; কিন্তু মানুষের জীবনে কি কখনও আত্মতৃপ্তি বলে কিছু আসে? আসে না বলেই মানুষ সুখকে ছেড়ে দুঃখের সন্ধান করে আবার দুঃখকে ছেড়ে সুখের সন্ধান করে, তবে শেষে ফলাফল শূন্য।

মূলত কৃষ্ণকান্ত রায় এবং রামকান্ত রায় দুই ভাই, রামকান্তের মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগ হওয়া নিয়ে কাহিনির সূত্রপাত। কৃষ্ণকান্ত তার ভাইয়ের ছেলে গোবিন্দলালকে ঠকাতে চায়নি বলে সম্পত্তিকে দুই ভাগ করে এক ভাগ গোবিন্দলালকে দিয়ে দেয়, কিন্তু তার ছেলে হরিলাল তা মেনে নেয় না এবং সে চক্রান্ত করে রোহিণীর সাহায্যে আসল উইলের সাথে নকল উইল বদলে দেয়। কে জানতো বিধবা রোহিণী গোবিন্দলালের প্রেমে মজিবে! যাই হোক কৃষ্ণকান্তের উইল পড়ে যা বোধগম্য হয় তা হলো..

রূপ;

পুরুষ চিরকাল নারীর সৌন্দর্যের পূজারী। যে নারীর রূপ আছে সে নারী আপন সৌন্দর্যের বলে সবকিছু ছিনিয়া নিতে জানে। যেমন করে বিধবা রোহিণী আপন সৌন্দর্যের বলে গোবিন্দলালকে অনেকটা মোহগ্রস্ত করে নেয়। আর অপর দিকে গোবিন্দলালের স্ত্রী কৃষ্ণকামিনী অর্থাৎ ভ্রমর আপনার হৃদয়ের কোলম ভালোবাসা দিয়ে কিছুতেই গোবিন্দলালকে আটকে রাখতে পারলো না!

প্রেম;

যখন কোনো মানুষ প্রেমে পড়ে তখন সে সকল লজ্জা ভুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। মানুষ যতোই চায় ভালোবাসার মানুষের কাছে ভালোবাসার কথা গোপন রাখবে, ভিতরে ভিতরে ততোটাই বুদবুদ তৈরি হয়ে ফুটতে থাকে। আর এভাবে একদিন ফুটতে ফুটতে আগ্নেয়গিরি হয়ে একদিন সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। রোহিণীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে কিন্তু শরীর তো মরে যায়নি, ভালোবাসা তারে যতোটা কাতর করতো, শরীরের অসুখ আরও বেশি কাতর করতো আর তাইতো সে তার বিষের ছোবল সমস্ত সংসারে ছিটিয়ে দিয়েছে।

বিরহ;

বঙ্কিম বলেছেন “যাহাকে ভালোবাস, তাহাকে নয়নের আড় করিও না। যদি, প্রেমবন্ধনে দৃঢ় রাখিবে, তবে সূতা ছোট করো।বাঞ্ছিতাকে চোখে চোখে রাখিও।”

আমাদের ভ্রমর গোবিন্দলালকে চোখে চোখে রাখিনি বলেই হয়তো গোবিন্দলাল ঘরের ফুলের মধু রেখে বিষকে সুরা ভেবে পান করতে গিয়েছিল। আর এদিকে বিরহিনী ভ্রমর বুকের মধ্যে দুঃখ জমা রেখে ব্যাকুল হয়ে থাকতো যে কবে তার গুরু, প্রেম, দেবতা এসে বলবে ভ্রমর এসব কানকথা মিথ্যা আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।

সত্য;

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “সত্য যে বড় কঠিন,সত্যরে ভালোবাসিলাম”

আসলেই সত্য কঠিন তার চেয়ে বরং মিথ্যা সহজ। কর্তব্য কিংবা পিতৃত্বের অহঙ্কারের খাতিরে ভ্রমণের বাবা যখন গৌবিন্দলালকে লোক লাগিয়ে খোঁজে বের করে প্রমাণ করে যে, রোহিণী আদৌ গৌবিন্দলালকে ভালোবাসে নাই। তখন গৌবিন্দলাল উন্মাদ হয়ে যায় এবং রোহিণীকে খুন করে। আর এদিকে কৃষ্ণকান্ত মরে যাওয়ার আগে নতুন উইল করে ভ্রমরকে গোবিন্দলালের ভাগের সম্পত্তি দিয়ে যাওয়ায় সে আর ভ্রমরের কাছে ফিরে আসে না। নির্দোষ ভ্রমর কেনো শাস্তি পেল? কেনো এমন হলো… এসব ভেবে ভেবে দীর্ঘ ছয় বছর স্বামীর অপেক্ষায় থেকে থেকে একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

পুরুষ;

পুরুষ মানুষ সবসময় ভ্রমে থাকেন। আদৌ তার কি চাই সে কখনও বুঝতে পারে না। যেমন গোবিন্দলালের যখন ভ্রমর ছিলো তখন মনে হতো রোহিণী চাই আর যখন রোহিণীকে নিয়ে দূরে স্বামী/স্ত্রীর মতো থাকা শুরু করলো তখন মনে হলো– ভ্রমর চাই। শেষে যখন দুজনকেই হারাল তখন মনে হলো দুজনকেই চাই। অতঃপর ভ্রমর সব সম্পত্তি গোবিন্দলালকে দান করে দিয়েছিল, কিন্তু গোবিন্দলালের এসব প্রয়োজন ছিলো না। সে বিবাগী হলো, সন্ন্যাসী হলো তবুও যখন একবার ফিরল। শেষে ভ্রমরের নামে তৈরি করা মন্দিরে ভ্রমরের মৃত্যুর ১২ বছর পর এসে মন্দির দর্শন করে সমস্ত সম্পত্তি শচীকান্তের হাতে তুলে দিয়ে আবারও হারিয়ে গেলো; তাকে আর কোনোদিন হরিদ্রাগ্রামে দেখা গেলো না।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

জেব্রাক্রসিং

সাজ্জাদ সাঈফের তিনটি কবিতা কিছুদিন কিছুদিন আমি শ্রাবণে ছিলাম ধীর কিছুদিন আমি অঘ্রাণে অস্থির; কিছু কথা বলে দূরেই কেঁদেছিলাম কিছুটা

চকলেট

কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে। বেরোনোর সময় আবার কে? দরজা খুলতেই পরীর মতো এক মেয়ে, বুকের কাছে একটা টেডি বিয়ার ধরে

রিভিউ – রহিমা আক্তার মৌ

জানি না কয়জন এমন নিয়ম মেনে আইডিতে ফ্রেন্ডের সংখ্যা বাড়ায়। যে যাই করুক আমি নিয়ম মেনেই এড করি। সেই প্রথম থেকেই