বাংলা ভ্রমণগদ্য কত বছরের সীমানা পেরিয়েছে কে জানে! হয়ত অনেক আগে এতদ্বিষয়ে কোনো পরিব্রাজক লিখেছিলেন তার পৃথিবী দর্শনের কথা। চর্যাপদে স্পষ্ট করে কোনো ভ্রমণবিষয়ক চিত্র পাওয়া না গেলেও পরবর্তীতে মঙ্গলকাব্যগুলোতে প্রচুর ভ্রমণকাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে নীলাচলে পরিভ্রমণের কথা পাঠক মাত্রই কম বেশি জানেন। আর এসব কারণে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণকাহিনির ইতিহাসও কম দীর্ঘ নয়। বর্তমান বাংলাদেশে ভ্রমণ সাহিত্য নিয়ে প্রচুর লেখা হচ্ছে। আর সেই লেখাগুলো অভিনবত্বে ভরপুর। আমেরিকার পরিব্রাজক জন মিওর বলেছেন, “মানুষ ভ্রমণে গেলে যা চায় তার চেয়ে বেশি পায়।” তবে সেই ভ্রমণকারির চারপাশকে দেখতে হয় অনুসন্ধিৎসুর চোখ দিয়ে। “সুদূরের অদূর দুয়ার” বইটির নাম শুনলেই মনে হয় সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে দূর ভূগোলের অপার সৌন্দর্যভূমির উন্মুক্ত দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো অনুসন্ধানী অনেকগুলো চোখ। ভ্রমণসাহিত্য বিষয়ক বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ফারুক মঈনউদ্দীন পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলের অতি তুচ্ছ বিষয়কেও গুরুত্বের সাথে তুলে এনেছেন বইটিতে। লেখকের সৌন্দর্যবোধ, গীতিময়তা, নৈসর্গিক চেতনা এবং গভীর রসবোধ বইটিকে একটি বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। লেখক ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব নিয়ে বইটিতে একাধিক ভূগোলের আলাপ করেছেন। মিয়ানমারের প্যাগোডা, স্থাপত্যশিল্প, লোকসংস্কৃতি, গ্রামীণজীবন ইত্যাদি এত চমৎকারভাবে উঠে এসেছে যা একটি ভিন্ন ভূগোলকে নিজ জনপদের সাথে কল্পনায় মিলিয়ে আলাদা করা যায়। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া এবং হংকংয়ের অতীত এবং সমকালীন রাজনীতিসহ প্রায় অন্যান্য বিষয় উঠে এসেছে এখানে। যারা বর্ণিত স্থানসমূহ ভ্রমণ করেছেন তারা অধ্যায়গুলি পড়ে হয়ত ভেবে বসবেন, এইসব স্পটে আমি গিয়েছি সত্য কিন্তু বর্ণিত স্থানটি আমার অচেনা। এর কারণ ফারুক মঈনউদ্দীন যে স্থানটির বর্ণনা করছেন সেখানকার অতীত ইতিহাস টেনে এনে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও উক্ত স্থানটির তুলনামূলক আলোচনা করেছেন অন্য একটি দেশে দেখা সমপর্যায়ের আরেকটি স্থানের সাথে। অধ্যায়গুলিতে বর্ণিত লোককাহিনি, রূপকথা আর কল্পনার বহু রংয়ের মিশ্রণে একটি আলাদা রসের সৃষ্টি হয়েছে যা বইটি থেকে পাঠকের একটি উপরি পওনা বলে বিবেচনা করা যায়। সিটি আনন্দ আলো পুরস্কারপ্রাপ্ত বইটিতে মোট বারোটি অধ্যায়ে মিয়ানমার, শ্রীলংকা, হংকং এবং অস্ট্রেলিয়াসহ চারটি দেশের ভ্রমণবৃত্তান্ত রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণখনি থেকে শুরু করে ঘরের কাছের রেঙ্গুন কিংবা শ্রীলংকার ভ্রমণ কেন্দ্রগুলোর ছবি লেখক তাঁর জাদুকরী ভাষায় তুলে ধরেছেন একজন চিত্রকরের মতন। বইটি প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন, পৃষ্ঠা সংখ্যা-১৬৫, মূল্য: ৩০০ টাকা এবং নান্দনিক প্রচ্ছদটি করেছেন ধ্রুব এষ।
বলে রাখা ভালো, লেখক ফারুক মঈনউদ্দীন একজন ব্যাংকার। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের সুবাদে বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে সেসব দেশের দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরেছেন আর জানার চেষ্টা করেছেন সংশ্লিষ্ট স্থানটির ইতিহাস। লেখকের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, তিনি কর্মসূত্রে পাঁচ বছর মুম্বাই অবস্থানকালে সেখানকার সৌন্দর্যবোধে আকৃষ্ট হয়ে ভ্রমণবিষয়ক একটা ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন। সেই লেখাগুলো নিয়ে ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় “মোহিনী মোম্বাই” নামে একটি বই। বিষয়টা ঠিক যেন এমন, নোবেল বিজয়ী লেখক জন স্টাইনবেক একবার আমেরিকা ভ্রমণে গিয়ে প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে পথে পথে নানাবিধ মানুষের আচরণের শৈল্পিক বর্ণনা লিখে তাক লাগিয়ে দেন। অথচ তিনি জানতেন না তিনি কি লিখবেন! লেখক ফারুক মঈনউদ্দীনের সেই মুম্বাই অবস্থানকালের লেখাগুলোই হয়ত তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে পরবর্তীতে ভ্রমণকাহিনি লেখায়।
আমাদের প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার সম্পর্কে বরাবরই একটি রহস্যময় ধারণা মনে গেঁথে থাকে। এটা হয়ত মিয়ানমারের ইন্টারনাল পলেসির কারণে। হয়ত তারা নিজ দেশের কালচার এবং সমাজ ব্যবস্থা জানাতে চায় না বিশ্ববাসীকে। আর সে কারণেই মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র হলেও মনে হয় দেশটি হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো উঁচু পর্বতমালার আড়ালের কোনো রহস্যময় ভূমি। বইটির প্রথম অধ্যায়টির নাম “বার্মা মুলুক মান্দালয়ে”। মান্দালয় মূলত মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। রেঙ্গুন শহর থেকে উত্তরে ইরাবতী নদীর পূর্বতীরের চমৎকার একটা নগর। মান্দালেয় এয়ারপোর্টে নামার পর বার্মিজ সুন্দরী তরুণী ভ্রমণগাইড জিমের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে কাহিনির শুরু। জিম চতুর, উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন, সদা হাস্যোজ্জ্বল কৌতুকপ্রিয় একটি মেয়ে। মাঝেমধ্যে মিয়ানমারের সমাজব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে উন্মোচন করে সেখানকার সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত দাঙ্গা এবং সম্পদ কুক্ষিগত করা পুঁজিবাদীদের কথা। মডার্ন ক্যাপিটালিজমের কারণে স্থানীয় বড় বড় ব্যবসা যে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি, তারাই এই পুঁজিবাদের হর্তাকর্তা। জিমের নিজ দেশের অসঙ্গতিগুলোর ওপর স্পষ্টোচ্চারণ এবং তার অঘাত জ্ঞানের ওপর লেখক এবং সহচরদের শ্রদ্ধাবোধ জাগে।
মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী মান্দালয় শহরে ঢোকার পথে মফস্বল শহরের বিশেষ সৌন্দর্য, হিল রিসোর্ট, বহুতল হোটেল এবং ইরাবতী নদীর অপার সৌন্দর্যের কথা ছবির মতো বর্ণিত হয়েছে এই অধ্যায়ে। সেইসঙ্গে মান্দালয়ের অতীত ইতিহাস, বাংলাদেশি এবং ভারতীয়দের শতবছর আগে রেঙ্গুন যাত্রা, ইরাবতী নদীর ভৌগলিক ইতিবৃত্ত, রয়েল প্যালেস এবং রাজা মিন্ডনের ইতিহাস প্রসঙ্গতই আলোচিত হয়েছে কাহিনিটিতে। এছাড়াও মান্দালয়ের অর্ধনিমজ্জিত জলাভূমি, দিগন্তের কাছে মালার মতো সাজানো পাহাড়সারি, সোনালী প্যাগোডার চূঁড়া এবং অগণিত বৌদ্ধ মঠ ও মন্দিরের কথা বলা হয়েছে বর্ণনার ভেতর। প্রত্যেকটি বর্ণনা একেকটা ছবির মতন। পাঠমুহূর্তে পাঠকের চোখের সামনে স্থানগুলোর চিত্র জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম “মাঠের সোনালী শহর বাগান”। এই কাহিনির প্রধান চরিত্র ভ্রমণ গাইড মিনমিন। আর এই মিনমিনকে ঘিরেই কাহিনি গড়ায় মিয়ানমারের সোনালী পথে পথে। ইরাবতী নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত মিয়ানমারের আরেকটি প্রাচীন নগরী “বাগান”। এখানে লেখকের ঈদুল আজহার দিন মান্দালয় থেকে বাগান যাত্রাপথের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সাথে বর্ণিত হয়েছে প্রাসঙ্গিক ইতিহাস। বাগান শহরের উপকণ্ঠে ঢুকে পড়ার পর দূরের পাহাড়ের সৌন্দর্যের সাথে পাল্লা দিচ্ছে তালবাগান। ছিটানো টুকরো মেঘের প্রকাণ্ড আকাশটার দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তালবাগানের সারি মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছবির মতো গ্রামের কথা। পথে পথে হাজার হাজার প্যাগোডা, পলেস্তারা খসা পুরনো দালান, দূরের দৃষ্টিসীমায় সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়ি, পথের ধারে ভ্রাম্যমান চায়ের দোকান যেন সবকিছুই প্রকৃতির ঢেলে সাজানো পৃথিবীর স্বর্গের দুয়ার। ১০৪৪ সালে সেখানকার সিংহাসন আরোহণকারী রাজা অনরাথার বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার এবং এর সংস্কারের ইতিহাস ভৌগলিক বিবরণের সাথে বিশেষ বোনাস। পাঠক ইতিহাসের মতো নিরস বিষটিকেও এখানে গল্পচ্ছলে পাঠান্তে অন্যরকম সুখরসে সিঞ্জিত হন।
বইটির তৃতীয় অধ্যায়ের নাম– “রঙ্গিলা রেঙ্গুন”। এই কাহিনিটিরও কেন্দ্রে অবস্থান করে ভ্রমণগাইড জিম। প্রথম গল্পটির অনেকটা পুনরাবৃত্তি হয় এখানে। জিন নির্ভয়ে তার দেশের সৈরশাসন, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং পূঁজিবাদী সম্প্রদায়ের নির্মমতার ভয়াবহ চিত্রের বর্ণনা দেয় লেখক এবং তার সঙ্গীদের কাছে। অপ্রাসঙ্গিক আলাপচারিতায় উঠে আসে মিয়ানমারের সাবেক সেনা শাসক জেনারেল নে উইনের কথা। জেনারেল নে উইন এক জ্যোতিষীর কাছে জানতে পারে নয় সংখ্যাটি তার কাছে বিশেষভাবে শুভ। সেকারণে তিনি ১৯৮৭ সালে ১০০ কিয়াতকে ৯০ এবং ১০ কিয়াতকে ৯ কিয়াতের নোট হিসেবে বাজারে চালু করে। অধ্যায়টির মাঝামাঝি পর্যায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী উ নু এর সেনাবাহিনী গঠন করা রেভ্যুলেশনের ইতিহাস আলোচনা করেন। এছাড়া সাবেক বার্মার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তুলনামূলক ইতিহাস তো আছেই। রেঙ্গুন শহরের হিরা চুনি পান্নার জন্য বিখ্যাত বাজার, পেইনটিংস, হস্ত এবং কারুশিল্প, চট্টল ধর্মদূত বৌদ্ধ বিহার, গন্ধ কুটির, চট্টল বৌদ্ধ সমিতি, একতলা বাংলো ইত্যাদির বর্ণনা পাঠকের মনে অন্যরকম প্রশান্তি আনে। ২৬ বছরের সেনা শাসনের অবসানের পর রেঙ্গুনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় মোটামুটি তার একটা প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় এই কাহিনির ভেতর। এছাড়া সোনার পাতে মোড়ানো পৃথিবীর প্রাচীনতম বৌদ্ধ স্তুপে গৌতম বুদ্ধের কেশদাম দেখার ঘটনা, শোয়েডাগন প্যাগোডায় বৌদ্ধের মূর্তি গোসল করানোর দৃশ্যও পাঠকের মন থেকে সহজে মুছে যাবার নয়।
ভারতবর্ষের শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের সমাধিস্থলের আবিস্কারের কাহিনি পাওয়া যায় অধ্যায়টির শেষের দিকে। একটা অচেনা ভূগোলের সাথে কয়েক’শ বছর আগের ইতিহাস সত্যিই পাঠকের কাছে একটা ঘোর তৈয়ার করে। লেখকের মুন্সীয়ানায় অদৃশ্য স্থানটি ইতিহাসের সংমিশ্রণে হয়ে ওঠে জীবন্ত।
বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হংকং ১৯৯৭ সাল থেকে চীনা শাসনের অধীন। ঠিক অধীন বলা যায় না বরং হংকং গণচীনের দুটি প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি। অন্যটি ম্যকাও। ২৬০টির বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত হংকং অর্থনৈকিভাবে খুব শক্তিশালী। “হংকংয়ের গ্রামে তিন হাউ পরব” নামক ভ্রমণকাহিনি শুরু হয় শিম সা শুই স্টেশন থেকে। এখানে ভ্রমণগাইড ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানেও লেখক আশ্রয় নিয়েছেন ইতিহাসের ওপর। একাদশ শতাব্দিতে একদল অভিবাসী গ্রামগুলোতে এসে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে চারপাশে দেয়াল তুলে দেয়। মাও সেতুংয়ের সময়ে বিপ্লবের ইঙ্গিত বহন করা ঘটনার পাশাপাশি হংকংয়ের ছিনতাই করে নেয়া ঐতিহাসিক ফটকের লোহার দরজা ফিরিয়ে আনার ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। শহর থেকে অনতিদূরের গ্রামগুলির নিরাভরণ চিত্র বৈষম্যের ইশারা বহন করে। লেখক গ্রামের এক সাধারণ লোকের কাছে জানায় সে একজন ট্রাভেল রাইটার। এতে পরদেশি মানুষের প্রতি লোকটির মুগ্ধতা, অতিথিপরায়ণতা ইত্যাদি লেখককে বেশ উৎসাহিত করে। আর সে জানতে পারে একটু আগে জনস্রোতের মচ্ছবটা ছিল সমুদ্রদেবীর তুষ্টির জন্য। হংকংয়ের ঝুপড়িঘরে থাকা হাজার হাজার গরিব মানুষ, সেখানকার গ্রামের ছবি ইতিহাসের পুরনো হংকংয়ের পরিচয় বহন করে। এছাড়া রেল স্টেশন, সাধারণ মানুষের জীবনছবি হংকং ভ্রমণের বিশেষ দলিল।
হংকংয়ের গ্রাম নিয়ে আরেকটি অধ্যায় “হংকংয়ের গ্রামের ইচ্ছাপূরণ বৃক্ষ” সেখানকার শহরতলীর মানুষের কুসংস্কার, তুকতাক আর অদৃশ্য বিশ্বাসের আখ্যান। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কড়া শাসনেও এক শ্রেণির মানুষকে এসব অন্ধ বিশ্বাস থেকে ফেরানো অসম্ভব। যেমনটি উদাহরণ দেওয়া যায় লাম সুয়েন স্থানের তিন হাউ মন্দির। এখানে মন্দির চত্তরের কাছে সদ্য সাবালক একটা চীনা বটগাছকে মানুষ ঈশ্বরতুল্য পূজা করে। প্রচলিত মিথ আর স্থানীয়দের গাছটির অলৌকিকতার প্রতি অদৃশ্য বিশ্বাস তাদের অন্ধ বানিয়েছে। প্রথমে বছরের পর বছর তারা কর্পূর গাছে আগরবাতি মোমবাতি জ্বালিয়ে ইচ্ছাপূরণের কথা বলত। গাছটি আগরবাতির আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর সেখানে রোপণ করা হয় চীনা বটগাছ। আর এখন সেখানকার মানুষ বট গাছটির মগডালে ছোট সাইজের কমলা ছুঁড়ে ইচ্ছে পূরণের বাসনা জানায়। এই কাহিনিটিতে ভাষার বিশেষ মাধুর্য বেশ লক্ষণীয়। কেতাবি বয়ানের গদ্যে দেশি কিছু নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করে লেখক পাঠককে আলাদা রোমাঞ্চ জুগিয়েছেন। যেমন, মাগনা খাওয়া, খয়রাত চাওয়া এবং আজদাহা ইত্যাদি।
পরবর্তী ভ্রমণকাহিনির গন্তব্য বিখ্যাত মেলর্বোনের উপশহর বালারাতের স্বর্নখনি সেভরন হিল। এই অধ্যায়টির নাম “ভিক্টোরিয়ার স্বর্ণ খনির সন্ধানে”। এখানকার স্বর্ণখনির কথা বলতে গিয়ে লেখক তুলে এনেছেন ১৮৪৮ সালের আমেরিকার সোনা তোলার কাহিনি। কিছুটা রূপকথার মতো করে প্রায় দেড় শতকের আগের ইতিহাস দিয়ে শুরু করা কাহিনিটি অন্য আখ্যান থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র। এছাড়া সোভিয়াত ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা, এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সোনা উত্তোলনের ইতিহাস তো থাকছেই। খনির সুরঙ্গের ভেতর অভাবনীয় দৃশ্য শেষে মেলবোর্ণের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের অসাধারণ বর্ণনা আছে এই গল্পে। স্বর্নখনিতে খটখটানি কোদাল আর সাবলের শব্দ, হাজার মানুষের ব্যস্ত গুঞ্জন, অগনিত তাবু, মাথার উপর পতপত করে পতাকা ওড়া দোকান আর সোনার খনি খন্দকদের অভিনব পোশাক ইত্যাদি যেন চূড়ান্ত এক অভিনব দৃশ্য।
স্বর্ণখনির রক্তঝরা বিদ্রোহ ভ্রমণবৃত্তান্ত সেই সেভরন হিলকে নিয়েই। সন্ধ্যার পর সেভরন হিলে ভিন্নধর্মী নাটক মঞ্চস্থ হয়ে থাকে। লেখক সেদিন সেখানে দেখতে পায় স্বর্ণশিকারিদের নিয়ে মঞ্চস্থ একটি তথ্যচিত্র। ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখা হয় এভাবে, সোনা তোলার লোভে আকুল মানুষগুলো পিপীলিকার মতো যখন অস্ট্রেলিয়ায় জড়ো হয় বাংলার নীলকরদের মতো সেই খনি শ্রমিকদের ওপর করের বোঝা চাপে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ করে। আর তখন চারদিকে দেখা দেয় বিদ্রোহ, গুলি আর হত্যা। মানুষ জীবনের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। আন্দোলনকারীরা তৈরি করে ইউরেকা পতাকা। এই ঘটনায় খনিশ্রমিকদের অনেক ন্যায্য দাবি কর্তৃপক্ষ মেনে নিতে বাধ্য হয়। একদল শ্রমিকের শ্রমের অধিকার আদায়ের লড়াই অত্র গল্পে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এর পরবর্তী অধ্যায়ের নাম একটু অন্যরকম কাব্যিক। “গ্রেট ওশেন ড্রাইভের বারো শিষ্য” নামক গল্পটিও অস্ট্রেলিয়ার ছোট্ট শহর বালারাতের। পাঠক এই অধ্যায়টি পড়ে ডুবে যায় বালারাতের যুদ্ধ পরবর্তী মূর্তমান গোলকধাঁধায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের বিনির্মাণ এবং ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস পাঠককে আত্মবিশ্বাসী হতে শেখায়। গ্রেট ওশেন মূলত একটা সড়ক। যা দীর্ঘ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সর্পিল গতিতে এগিয়ে গেছে শত শত মাইল দূরে। এই পথে যেতে যেতে কথক এই সড়ক নির্মাণের ইতিহাস বর্ণনা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ষাট হাজার সৈন্য মৃত্যুর পর হাজার হাজর সৈন্য আহত হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসে। তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে বিপাকে পড়ে কর্তৃপক্ষ। এঁদের কিছু অংশের লোকজন নিয়ে কাজ শুরু হয় জঙ্গলের বুক চিড়ে দীর্ঘ পথের সর্পিল সড়ক নির্মাণ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই শ্রমিকরা নিরালস কাজ করতে করতে শেষ করে এই সমুদ্র প্রতিবেশি দীর্ঘ সড়ক। পথিমধ্যে কাজ থামিয়ে দেওয়া বড় বড় পাথর ভাঙতে হয়েছিল বিস্ফোরক দিয়ে। আর তাতে হতাহতও হয়েছিল অসংখ্য শ্রমিক। এই দীর্ঘ সড়কের ভ্রমণ সময়কালে বিভিন্নস্থানে যাত্রাবিরতির ফাঁকে একাধিক দর্শনীয় স্থানের বর্ণনা পাঠককে মুগ্ধ করে। যিশুর বারো শিষ্য দেখতে গিয়ে এক প্রকার বুভুক্ষু রাক্ষুসে মাছির কবলে পড়তে হয় ভ্রমণপিপাসুদের। লেখক ও তার সহচরদেরও পড়তে হয়েছিল। এবড়োথেবড়ো পায়ে চলা পথে রোদজ্বলা বিকেলে হেঁটে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রতীরবর্তী সেই বারো শিষ্যর স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এখানে লক অর্ড জাহাজের প্রাসঙ্গিক গল্পটি ইতিহাসের আরেকটি বিষয়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।
”সিডনিতে একদিন” অধ্যায়টি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসিদের থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ গল্প। একদিকে যেমন সিডনির নৈসর্গিক সৌর্ন্দয আর ঠিক অন্যদিকে প্রচলিত মিথ আর স্থানীয়দের মুখের লোককথা নিয়ে দারুণ আলাপ। তিনকন্যাকে নিয়ে সেখানকার দুটি স্থানীয় লোককাহিনি বর্ণিত হয়েছে গল্পটিতে। বহুবছর আগের যাদুবিদ্যার প্রচলন আর এসবের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ইত্যাটির প্রতিফলন হয় দুটি শাখাগল্পে। তিন কন্যার সম্ভ্রম রক্ষার্থে পিতা তার কন্যাদের জাদুবলে পাথর বানিয়ে রেখে যায় কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় না। ঐন্দ্রজালিক নিজেকে বাঁচাতে যাদুবলে পাখি হয়ে যায় আর সে হারিয়ে ফেলে তার জাদুকরি হাড়। শতাব্দী পরিবর্তন হতে থাকে তবুও মানুষের প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস সমাজে ডালপালা বিস্তার করে। সিডনির সেই আদিবাসি পাড়ায় নাকি আজও শোনা যায়, সেই নিয়তির কাছে পরাস্থ পাখিটির আর্তচিৎকার!
”সিংহল সমুদ্রে তিমিদর্শন” অধ্যায়টির শুরুতে একটি বিশেষ টোটকার কথা বলা হয়। অর্থাৎ জাহাজের ডান এবং বামপাশটিকে নাবিকদের পরিভাষায় বলা হয় স্টারবোর্ড এবং পোর্টসাইড। এটি কেন বলা হয় তা যারা জানেন না, তাদের মনে রাখার সুবিধার্থে লেখক এখানে একটি কৌশলের কথা উল্লেখ করেন আর লেখকের ভাষায় সেটি মনে রাখার টোটকা। এই অধ্যায়টির ভ্রমণগাইড ”রয়”। কিন্তু রয়ের কাছে জানা যায় সে ভারতীয় অরুন্ধুতি রায় কিংবা সত্যজিৎ রায়কে চেনে না। চেনার কথাও না হয়ত ওর জন্য। এখানে ভ্রমণের গন্তব্য কলম্বো থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে গল পর্যন্ত প্রায় আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। ভারত মহাসাগরে জাহাজ ভ্রমনের অনন্য অভিজ্ঞতার বর্ণনা দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে পাঠককে নিয়ে যায় সুদূর গন্তব্যে। নারকেল গাছের মাথায় লেগে থাকা কড়কড়ে রোদ, শত শত মাছ ধরার বোটে রঙিন পতাকা, খাড়ির পাড় ঘেষা অনুচ্চ পাহাড়সারি ইত্যাদি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ভাতর সাগরের স্বচ্ছ জলের সাথে। কিন্তু গভীর সমুদ্রে জাহাজ প্রবেশ করতেই দেখা যায় সমুদ্রের চিরাচারিত আসল চেহারা। প্রচণ্ড ঢেউয়ের দুলুনিতে তিমি দেখার স্বাধ মিটে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। লেখক তবুও হাল ছাড়ে না। শেষে নৌকার তলার মতো তিমির পিঠ আর পাখনাওয়ালা লেজ দেখে মনে প্রশান্তি নিয়ে ফিরে আসে মিরিসা বন্দরে। এছাড়াও বড়শির ছিপ ফেলে মাছ ধরা, ষোড়শ শতাব্দিতে তৈরি গলের সুরঙ্গ ইত্যাদি দেখার পাক্কা বর্ণনা এই অধ্যায়ের বেশ আকর্ষণীয় বিষয়।
“হাতিদের অনাথালয়” অধ্যায়টি কিছুটা হাস্যরসাত্মক। তিমি দর্শনের অধ্যায়ের সাথে একটি সম্পর্ক বজায় রেখে এই অধ্যায়টির শুরু। আর শুরুতেই লেখক ইঙ্গিত দেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা একটি গল্পের প্রতি। মানুষের বাচ্চাদের মতো শ্রীলঙ্কায় হাতিদের একটি অনাথালয় আছে। সেখানে হস্তি সাবকদের বালতি বালতি দুধ পান করানো হয়। ঘুরতে আসা ট্যুরিস্টরা মোটা অঙ্কের পয়সা মিটিয়ে সেই দৃশ্য দেখে। ইউরোপের লোকেরা কখনো নিরাপত্তার বেড়া ডিঙিয়ে হাতির সাবকদের নিজ হাতে দুধ পান করায়। কেউ কেউ হাতিদের প্রজনন কেন্দ্রও দেখতে যায়। প্রসঙ্গত লেখক এখানে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি গল্পাংশের উদ্বৃতি দিয়ে অধ্যায়টি শেষ করেন।
বইটির শেষ অধ্যায়ের শিরোনাম-মাদু গঙ্গার দারুচিনি দ্বীপের ভিতর। অনির্ধারিত তিমি দর্শনের অভিজ্ঞতা সুখকর না হওয়ায় ম্যানগ্রোভের সৌন্দর্যমণ্ডিত মাদু গঙ্গা তীরে চলে যায় লেখক। একদিকে ভারত মহাসাগর আর অন্যদিকে মাদু নদীর কোলের ভেতর ৬৪ টি দ্বীপের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালির অপরূপ সৌন্দর্যের অসাধারণ কাব্যিক বর্ণনা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় শ্রীলংকার সেই জনপদে। মাদু নদীর শান্ত জলরাশি, আউটবোর্ড ইঞ্জিনের পলকা জলজান আর পড়ন্ত বিকেলের কোলাহল ভেঙে যাওয়া নীরাবতা মাদু নদীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যতা। দীর্ঘাঙ্গ নারকেলবিথীর নুয়ে পড়া ভঙ্গিমায় থির হয়ে থাকা হৃদয় জুড়ানো সৌন্দর্য পাঠককে আকুল করে। বাংলাদেশের মফস্বল শহরের মতো নোয়ানো বেইলি ব্রীজ আর তার নিচ দিয়ে মাথা নুইয়ে হাওড়ের জলে ঢোকা যেন পরিচিত প্রতিচ্ছবি। হাওড়ের বাঁশের ফাঁদ আর চিংড়ি মাছকে ঘোরগ্রস্থ করার আলোর ছোট ছোট লণ্ঠনের বর্ণনা হাকালুকি বা পশ্চিমের চলন বিলকে কল্পনায় নিয়ে আসে। চলন্ত ডিঙি নৌকায় টংয়ের দোকান আর হলুদ রঙের ডাব সাজানো বাংলাদেশের পিরোজপুরের পেয়ারা হাটের দৃশ্য চোখে ভাসে। অবশ্য লেখক সেকথা বলেছেনও এখানে। সবশেষে দেখা মেলে সেই কাঙ্ক্ষিত দারুচিনি দ্বীপের। কবি জীবনানন্দ দাশ হয়তবা এই দ্বীপের কথাই বলেছিলেন বনলতা সেন কবিতায়, কে জানে!
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে ফুট ম্যাসাজ দেখা যায় সেখানে শ্রীলঙ্কার মাদু গঙ্গার চৌবাচ্চায় মেলে ফিস ম্যাসাজ। ভ্রমণক্লান্ত পথিক সোনালী মাছের চৌবাচ্চায় পা ডুবিয়ে বসে আর মাছগুলি ঠোকর দিয়ে ময়লাগুলো খেয়ে নেয়। একপ্রকার হাস্যরস আর বিনোদনে ভরপুর এই অংশটা। এখানে উল্লেখিত সিংহলি কবি রাজ করুণার সুন্দর কবিতাটি এত মমতা দিয়ে কে অনুবাদ করেছেন তা পাঠকের খুব জানতে ইচ্ছা করে।
লেখক ফারুক মঈনউদ্দীনের অন্তদৃষ্টি প্রখরতার শুধু তারিফ করেই শেষ করা যায় না সেই দৃষ্টিগ্রাহ্য বস্তুটি নিয়ে লেখার দক্ষতা যে কোনো পাঠককে টেনে নিয়ে যায় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ভাষার ক্ষেত্রে তিনি যে কারুকার্য দেখিয়েছেন, তা পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন। একজন প্রকৃত লেখকই শুধু জানেন, কোন বিষয়টি উপস্থাপন করতে কোন ভাষার প্রয়োগ প্রয়োজন। লেখক ভ্রমণকাহিনি বলতে গিয়ে যুতসই ভাষা ব্যবহার করেছেন আর পাঠক স্বাদে, গন্ধে টের পেয়েছে বর্ণিত বস্তুর অন্তর্নিহিত মাদকতা। লেখক আমাদের বন্ধ চোখের জন্য খুলে দিয়েছেন সুদূরের অদূর দুয়ার।