মানিকরতন শর্মা
জন্ম : ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ, পিতা: মনোরঞ্জন শর্মা, মাতা: শ্রীমতি পুষ্প শর্মা। পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার জগৎপুর গ্রামে।গল্পগ্রন্থ : কালোমেঘের আছর (২০১৭), জলঘর (২০২১) প্রবন্ধ: অদ্বৈত অন্বেষণ (২০১৯) উপন্যাস : অদ্বৈত (২০২১) সম্পাদনা : স্বরূপ-অরূপ প্রাণতোষ চৌধুরী (২০২১)
মানিকরতন শর্মা

গল্পগ্রন্থ পর্যালোচনাঃ মাসউদুল হকের ‘সত্য যখন মিথ্যাকে আলিঙ্গন করে’

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বিষয় নির্বাচন লেখকের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার চেয়ে অধিক গুরুত্ববহ করে সেই বিষয়টিকে কাহিনি বির্নিমানে সার্থক করে তোলা। এই কাজটি সকল লেখকের দ্বারা সুসম্পন্ন হয় না। কারণ সবাই তো আর সিদ্ধহস্ত লেখক নয়। কখনো কখনো ছোট্ট বিষয়ও লেখকের মুন্সিয়ানার মাধ্যমে কাহিনি নির্মাণ হয়। পাঠকও সেই কাহিনির পথ ধরে এগুতে থাকে। তারপর তারপর কি আছে! এমন একটি কৌতুহলী মন কাহিনির বাঁকে বাঁকে হেঁটে যায়।

কথাশিল্পী মাসউদুল হকের ‘সত্য যখন মিথ্যাকে আলিঙ্গন করে’ গল্পগ্রন্থটিতে মোট পাঁচটি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম গল্প ‘সত্য যখন মিথ্যাকে আলিঙ্গন করে’। এই গল্পটির মূল রসদ হচ্ছে– একটি ফাঁরি রাস্তা, সাদা রঙের দুটো মাইক্রোবাস, একটি সরু গলি, গলির পাশে মসজিদ, এবং দুটো গাড়ির ভেতর কিছু অস্ত্রধারী লোক।  মূলত এই অস্ত্রধারী মানুষগুলোর আচরণ এবং দুই মাইক্রোবাসের মুভমেন্ট নিয়েই গল্পের কাহিনি বিন্যাস এগুতে থাকে। দুটো সাদা মাইক্রোবাসের মধ্যে কে আসল আর কে নকল পুলিশ এই একটি বিষয় উপজীব্য হিসেবে গল্পকার গল্পের শরীরে প্রাণ দিতে চেয়েছেন।

দুটো গাড়ি মুখোমুখি। কোনো উচ্চবাচ্য নেই। হর্ণ নেই। সরু রাস্তায় মুখোমুখি হয়ে একে অপরকে দোষারোপের সাতকাহনও স্বরগোলের মাধ্যমে মেলে ধরছে না। একটা সুনসান নিরবতা। অনেকক্ষণ হল গাড়ি দুটো মুখোমুখি অবস্থান করছে। কিন্তু রাস্তার পাশে মসজিদের ইমাম, মুসল্লিসহ রুটির কারিগর হেমায়েত, স্বপন এই চরিত্রগুলোর মাধ্যমে গল্পকে প্রাণ দানের প্রয়াস পেয়েছেন গল্পকার মাসউদুল হক।

“ইতোমধ্যে ফজরের নামাজে আগত মুসল্লিরা ইমাম সাহেব এবং মোয়াজ্জিনকে নিবিড়ভাবে জানার বাইরে তাকাতে দেখে, তারাও জানালায় মাথা রাখে। যাদের চোখে চশমা আছে তারা চশমাটি আরেকবার নাড়া দেয়। যারা ঘুম থেকে উঠেছে কিন্তু চোখে এখনও ঘুম ঝুলে আছে তারা চোখ দুটি আরেকবার কচলে নেয়। আনসারের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডজুটেন্ট আলি আজগর দৃশ্যটি খানিক সময় পর্যবেক্ষন শেষে আস্তে করে জানায়, “এক গাড়িতে আসল পুলিশ; আরেক গাড়িতে ভূয়া।” (পৃ.১২)

মুসল্লিরা দুটো মাইক্রোবাসের মুখোমুখি অবস্থান দেখে একে অপরের মাঝে কেবল কৌতুহলী কথপোকথন চলতে থাকে। আবার পাছে নামাজের সময় বহে যায়। এই বিষয়টিও ওঠে এসেছে গল্পে লেখকের সূক্ষ্মদৃষ্টির দ্বারা। বলেছেন– “ভাই, রাখেন এইসব। আগে নামাজ পইড়া লই। দ্বীনের কাম বাদ দিয়া আসল-নকল পুলিশ খুঁজবার লাগছেন। হাশরের ময়দানে যদি বলেন, আসল-নকল পুলিশ খুঁজতে গিয়া নামাজ কাজা করছি; মাফ পাইবেন?” (পৃ.১২)

একসময় দুটো মাইক্রোবাস থেকে দু’জন অস্ত্রধারী লোক নামে। তাদের চুলের কাটিং, দু’জনের হাতেই একই মডেলের রাইফেল, দুজন পুলিশের কোমরেই হাতকড়া, এত্তোসব বিষয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নান রুটির কারিগর স্বপনের সাথে ওস্তাদ হেমায়েতের অভিজ্ঞতার আলোকে কথা এগিয়ে যায়। কিন্তু তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার উজার করে দিয়েও নির্ণয় করতে পারছে না কোন মাইক্রোবাসের পুলিশগুলো আসল আবার যে সকল কারণে বলা যাবে ওরা নকল পুলিশ সেই বিষয়টিও শক্তভিত্তির উপর দাঁড় করাতে পারছে না হেমায়েত। সুতরাং হেমায়েতের অভিজ্ঞতাও এখানে খুব বেশী কাজে লাগছে না, এই পর্যায়ে আমরা দেখি– “রুটি বেলতে বেলতে কারিগর স্বপন বলে,“ওস্তাদ, আমারতো মনে হয় দুইজনই নকল। কেউর শইলে পুষাক নাই। কি কন?” (পৃ.১৩)

আমাদের দেশে আগে খাকি পোশাক ছিল পুলিশের। সেই খাকি পোশাক পরা লোক দেখলেই ছোটরা পুলিশ আইছে, পুলিশ আইছে, বলে দৌঁড়ে পালাত। বড়রা বুক ধরপর ভয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সেই চিরচেনা খাকি পোশাক পুলিশ আর নেই। খাকি এখন স্মৃতির গহ্বরে। এখন এসেছে বহুমাত্রিক পোশাক। মেট্রোপলিটনের এক ধরনের পুলিশের পোশাক; বিভাগীয় রেঞ্জের আরেক ধরনের পোশাক, আবার শিল্প পুলিশের আরেক ধরনের, সর্বপোরি সাদা পোশাকেরও পুলিশ রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার এত্তোসব পোশাকি পুলিশ রয়েছে যে, এতে করে হেমায়েত ও স্বপনের কথপোকথনে সেই সব বিবরণ গল্পে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন মাসউদুল হক। “হেমায়েত রুটির কারিগর স্বপনের কথায় মুচকি মুচকি হাসে। ‘বেকুব, পুলিশের দুই ধরনের পোশাক আছে। এরা যেইডা পরছে এইটাও পোশাক। তবে এইটারে বলে সাদা পোশাক।” (পৃ. ১৩)

একসময় দুটো মাইক্রোবাসের আসল-নকল পুলিশগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে আসে। ফলে ড্রাইভারদ্বয়ও নিজেদের মাইক্রোবাস সামনে পেছনে নিয়ে স্ব স্ব গন্তব্যে চলে যায়। এই বিষয়টা পুলিশের সোর্স এনায়েত পর্যবেক্ষণ করে খবরটা থানার কর্তব্যরত পুলিশের কাছে পৌঁছে দেয়। এনায়েতের খবরের পাশাপাশি আরো একটি গুজব খবরও চাউর হয়ে  ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গিরের কাছে পৌছে। “ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গিরকে বিভ্রান্ত মনে হয়। সে ইনফরমেশন পেয়েছিল, দুই দল ভূয়া ডিবি পুলিশ এ মহল্লায় মুখোমুখি হয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। গুলিতে একটি বালক ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে কিন্তু বাস্তবে দেখে কিছুই হয় নি। আর জনগণ যেহেতু উভয় পুলিশ দলকেই ‘আসল ডিবি পুলিশ’ বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে সেহেতু তার আর এ বিষয় নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কোন মানে হয় না। তবু নিজেই ইমেজ রক্ষার্থে জানতে চায়, “ডিবি পুলিশ কোন দিকে গেছে?” পৃ. ১৯

গল্পটি লেখ মাসউদুল হক আসল-নকল পুলিশ পুলিশ খেলায় পত্রিকার উপর নির্ভর করে সমাপ্তি টানেন। গল্পটি পড়তে গিয়ে পাঠক হিসেবে কিছু কিছু জায়গায় দৃষ্টি থেমে গেছে, যেমন-১৩ পৃষ্ঠার প্রথম থেকে তৃতীয় দু’লাইন নিয়ে একটি দীর্ঘ বাক্য উপস্থাপিত হয়েছে যেখানে ২৩টি শব্দ রয়েছে। দীর্ঘবাক্য এখন আধুনিক গল্পকারগণ সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলেন। তারপর কিছু শব্দ প্রয়োগ হয়েছে যা প্রবন্ধের ভাষা হিসেবে মনে হয়েছে। যেমন- ১ম পৃষ্ঠার ১ম প্যারার শেষ বাক্যে ‘সময়ক্ষেপণ’ ‘সমাপ্তকরণে’ দ্বিতীয় প্যারার প্রথম লাইনে ‘মহাসমারোহে’। তবে একটি ক্ষুদ্র বিষয়কে মাসউদুল হক পাঠককে গল্পে নিবন্ধিত করতে চমৎকার সার্থকতা দেখিয়েছেন।

বেনিফিট অফ ডাউট:

মেসে বসে তিন বন্ধুর তাস খেলা। খেলার অন্তরালে ধেয়ে আসে হার-জিতের ক্ষোভের ঝড়। এই ঝড়; এই খেলা। জীবনকে কখন যে তল্পিতল্পা তছনছ করে দেয় তা কেউ জানে না। তাসের এক একটা হরতন, রুইতন, টেক্কা জীবনকে কেবলই উলট-পালট করে দেয়। লোভ-আসক্তি বিষয়গুলো যদি আমরা পজেটিভ চিন্তায় কিংবা প্রগ্রেসিভ কাজে ব্যবহার করি তবেই ভালো। ঠিক একই বিষয় যদি কুকাজে, কুচিন্তায় লাগানো হয় তবেই বিপদ শুধুই কি বিপদ! মহা বিপদও। মাসউদুল হকের ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ গল্পে তিন বন্ধুর বেলায় সেটাই ঘটেছে।

জুয়ার আসর কখনোই সাধুর আসর হয় নয়। যারা খেলাতে ‘জুয়া’ বসিয়ে দেয় সেখানে অবশ্যই বিষধর সাপও থাকে। কারো না কারো পরাজিতের মনে সেই বিষধর সাপের ফনাও ফোঁসে ওঠে। “বেশ ক’দিন তাস খেলার পর আমরা আবিষ্কার করলাম, আনিজ তার খেলায় আমাদের তিনজনের তুলনায় একটু কমই হারে। তাস খেলে জেতা টাকায় আনিস নতুন নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে আমাদের সামনে দিয়ে যখন হাঁটতো তখন আমাদের খুব কষ্ট হতো। পরাজয়ের বেদনা বেশ আয়োজন করে বুকের ভেতর ঘুরপাক খেত। আনিস খেলেই জয়ী হতো কিন্তু তারপরও আমরা কেন যেন তাতে ছিনতাই ছিনতাই গন্ধ পেতাম।” পৃ.২১

বয়সের ফ্রেমে মানুষের রাগ-দ্বেষের বহির্প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়। শিশুর বেলায় একরকম; টিন এজের বেলায় সেটা অনেকটা ধারালো হয়; আবার তরুণ বয়সে সেটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আমাদের সমাজব্যবস্থাপনায় মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথা সংবাদপত্রে তার অনেক লোকহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেখতে পাই। এই সব ঘটনা আমাদেরকে অত্যন্ত মর্মাহত করে। এই ধরনের ঘটনা সমাজ, রাষ্ট্র তথা পরিবারে যথেষ্ট পরিমানে কোথাও না কোথাও প্রভাব ফেলে। আমরা এই সকল অপ্রস্তুতকৃত ঘটনাকে কোনো মতেই এড়িয়ে যেতে পারি না। গীতার (২/৬২,৬৩)  একটি কথা আছে-‘বিষয় চিন্তা করিতে করিতে মানুষের তাহাতে আসক্তি জন্মে, আসক্তি হইতে কামনা জন্মে, সেই কামনা কোন কারণে প্রতিহত বা বাধাপ্রাপ্ত হইলে প্রতিরোধকের প্রতি ক্রোধ জন্মে, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ ঘটে।” এই সূত্র ধরেই মানুষ কখনো কখনো পতনের শেষ সিঁড়িতে পৌঁছে যায়।

“সেজন্য আজ যখন আনিসকে আমরা তাস চুরি করতে দেখলাম তখন আমি আর কাসেদ নিজেরদ ঠিক রাখতে পারিনি। গত মাস দুয়েকের পরাজয়ের বেদনা ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছিল।” পৃ.২১

“কিন্তু আনিস যেন কি করে আমার গোপন উদ্দেশ্য বুঝে যায়। সে কনুই দিয়ে আমার পেটে আঘাত করতেই আমি আরও ক্রোধান্বিত হয়ে যাই। আমি আনিসকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দেয়ালের দিকে ধাক্কা দিই। আর তখনই প্রাথমিক আঘাত সামলে ওঠে আনিসের বুক বরাবর একটা প্রচণ্ড লাথি কষে কাসেদ। সেই লাথির আঘাতে আনিসের মাথা সজোরে আঘাত করে কংক্রিটের কঠিন দেয়ালে। আঘাতের শব্দ শুনে যে কেউ ভাবতে পারে একটা বড় নারকেল প্রচণ্ড জোরে কেউ ছুঁড়ে মেরেছে বাড়ির দেয়ালে। তাতে চারতলা বাড়ির পুরোটা যেন কেঁপে ওঠে। পিনপতন নীরবতার মধ্যে আনিসের দেহটা ধপ করে মেরুদণ্ডহীন মাংসের দলার মতো ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়।” পৃ.২১

দন্ডবিধির ২৯৯ ধারায় খুনের দায়ের কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। সেসকল ব্যতিক্রমের মাঝে আকস্মিক উত্তেজনাবশত কাউকে মেরে ফেলা একটি অন্যতম। যদিও ৩৪ ধারা যুক্ত হয়ে ঘটনাটি ঘটেছে অনিচ্ছাবশত। এক্ষেত্রে হয়তো আনিসের মৃত্যু কাসেদের অপরাধের বিষয়টি আদালত নির্ধারণ করবে। কিন্তু জীবন নাশের এই ধরণের ঘটনা বরং খেলাকে কেন্দ্র করে সমাজে এটাই প্রথম নয়; এমন ঘটনা অহরহ ঘটনা ঘটেছে বা আমরা সমাজ দর্পণ মিডিয়াতে দেখতে পাই।

গল্পে মাসউদুল হক ‘বিপুল’ চরিত্রটি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। একটা পর্যায়ে বিপুল প্রতিবাদী হয়। খুনের ঘটনায় থানায় গিয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি প্রদানে প্রস্তাব দেয়। না হয় সে নিজেই পুলিশকে সব বলে দিবে বলে হুমকিও দেয়। কিন্তু বিপুলের মোটিভ আঁচ করতে পেরে– “কাসেদ বলল, এক খুনের যা শাস্তি দশ খুনেরও তাই। তুই যেহেতু এই খুনের একমাত্র সাক্ষী সেহেতু তোকে আমাদের নিয়মানুযায়ী মাইরা ফেলানো উচিৎ। কিন্তু আমরা আর রক্ত নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। তুই যদি বুদ্ধিমান হস তবে আমাদের সাহায্য কর।” পৃ.২৩

গল্পটা এভাবে ক্লাইমেক্সের মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে। কিন্তু মানুষ তো! কখন কিভাবে মন চরিত্র বদলিয়ে ফেলে তা কেউ জানে না। তাই তো বলে ‘মানুষের মন এক বিচিত্র’। প্রকৃতির ছন্দে বদলিয়ে যায় তার রঙ ও রূপ। গল্পের শেষ পর্যায়ে বেনিফিট অব ডাউট পেতেই হয়তো কাসেদ আইনের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছে।

দক্ষিণী ভাল্লুক:

গল্পটি মফস্বল শহরের মিনি চিড়িয়াখানার দুই ভাল্লুক-টিটু ও মিঠুকে কেন্দ্র করে। দুই ভাল্লুক মফস্বল শহরের অন্যতম বিনোদনের বিষয়। ছেলে-বুড়ো-শিশুরা ভাল্লুককে দেখে মনে আনন্দ পায়। তাদের অঙ্গভঙ্গি ও আচরণগত দিক দেখে দর্শকরা বার বার ছুটে আসে। কিন্তু অনেকের মাঝে একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল এই দুটো ভাল্লুক একটা পুরুষ ও অন্যটি স্ত্রী জাতীয় হবে।

কিন্তু একদিন সাংবাদিকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বেড়িয়ে আসে আসল রহস্য– “তাছাড়া আমরা এতদিন মনে করতাম যেহেতু অন্যান্য প্রাণীর মতো ভাল্লুকও জোড়বদ্ধভাবে অবস্থান করছে সেহেতু তাদের মধ্যে একটি মর্দ এবং একটি মাদি। এবং নির্দিষ্ট সময় পর আমরা খাঁচায় নতুন ভাল্লুক শাবক দেখতে পাব! কিন্তু টিটু এবং মিঠু যে সহোদর এবং সমলিঙ্গের-এ খবর জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে জানার পর আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়; কেন এতদিনেও টিটু এবং মিঠু বাচ্চা উৎপাদন করতে পারেনি। যদি প্ল্যাকার্ডে ‘ভাল্লুক’র নীচে পণ্ডিতি করে বৈজ্ঞানিক নাম উল্লেখ না করে টিটু এবং মিঠু লেখা থাকত-তবে ভাল্লুকদ্বয় যে সমলিঙ্গের তা আমরা নাম দেখেই বুঝে নিতে পারতাম।” পৃ.৩২

প্যাচটা লেগেছে বৈজ্ঞানিক নাম নিয়ে। অতি সাধারণ দর্শকও বুঝতে পারে টিটু ও মিঠু কোন গোত্রের নাম। দুটোই যে পুরুষ তা বুঝতে অসুবিধা হতো না। স্মার্টফোনের মাধ্যমে ফেসবুকে ছবি আপলোড ছড়িয়ে পড়ে টিটু এবং মিঠুর ছবি। ভাইরাল হয়ে যায় অতিদ্রুত। দুঃখিনী থেকে কিভাবে ‘দক্ষিণী ভাল্লুক’ হয়ে যায় লেখক চমৎকারভাবে এখানে তুলে ধরেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কখন যে কোন আচরণ করে কেউ বুঝে উঠতে পারে  না। তাই তো দেখছি– “এ বিষয়টি এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, আমরা যারা দক্ষিণী ভাল্লুককে দুঃখিনী ভাল্লুক বানিয়েছিলাম তারাও বিশ্বাস করতে শুরু করি যে এটি একটি বিরল প্রজাতির দক্ষিণী ভাল্লুক। ফেসবুকের সুবাদে আমরা আরও জানতে পারি যে, এধরনের ভাল্লুক এশিয়ান ভাল্লুকদের চেয়ে আলাদা। এ প্রজাতীর পুরুষ ভাল্লুকদের উপযুক্ত নারী ভাল্লুক বাংলাদেশ তো দূরে থাক, সমগ্র পৃথিবীতেই বিরল। পৃথিবী থেকেই এরা আরও এক হাজার বছর হারিয়ে গেছে বলে ধারনা করা হয়ে থাকে।”পৃ.৩৬

সাংবাদিকের প্রতিবেদনের আলোকে শেষ পর্যন্ত “তারা ইব্রাহিম খলিলের নেতৃত্বে শহিদ মিনারে মিঠু ও টিটু’র জন্য উপযুক্ত সঙ্গীনী সরবরাহের দাবী জানিয়ে ‘আমরণ অনশন’ শুরু করে।”পৃ.৩৮ এই বিষয়টি লেখক মাসউদুল হক একটা অলস ইমুশন্যাল ও স্বার্থবাদী সমাজের চিত্র সার্থকভাবে উপস্থাপন করেছেন। গল্পটা পড়ে মনে হল আমাদের সমাজের কিছু মানুষ রয়েছে যারা অলস ও রুগ্ন মন্ত্রে দীক্ষিত। তাদের কোনো কাজ নেই। তাদের একমাত্র কাজ তিলকে কিভাবে তাল করা যায়। এই গল্পটি পড়তে গিয়ে চোখকে বেশ কষ্ট দিয়েছে, লেখক এই ক্ষেত্রে একটু সচেতন হতে পারতেন, যেমন– ৩৬ পৃষ্ঠায় কোথাও প্যারা নেই। এক্ষেত্রে ছোট ছোট প্যারা দিলে পাঠকের পড়ার সুবিধা হয়।

মিথ্যা ইতিহাসের ফেরিওয়ালা:

এই গল্পটি টোটাল পারিবারিক ইতিহাস নির্ভর গল্প। গল্পের বীজটা হচ্ছে– “মৃত্যুর কিছু দিন আগে আমাদের চার ভাইকে ডেকে এনে একটা মোটা রোল টানা খাতা দিয়ে বললেন, তোদের আমি কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। শুধু একটা ইতিহাস দিয়ে গেলাম। আমার ইচ্ছা আমার মৃত্যুর বছরখানেক পরে তোরা এটিকে পুস্তক আকারে প্রকাশ করবি।” পৃ.৪২

বর্ধিত হতে লাগল এই গল্পের ডালপালা। দলিল লেখক বাবার কাছ থেকে পাওয়া খাতাটি অর্থাৎ পাণ্ডুলিপিটি চার ভাইয়ের কাছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মতই মনে হতে লাগল। “স্বচ্ছল মেজ ভাই আবুল হাসেম, খাতাটি ধরতে ধরতে বিনয়ের সাথে বলেছিল, আব্বা আপনে মরণের পরে কেন? যদি কন তো এক মাসের মধ্যে ছাপাই দিয়াম। আপনেরে মঞ্চে নিয়া প্রকাশনা উৎসব করাম। ঢাকা থেইকা বড় বড় দুই চারজন লেহক নিয়া আসাম।” পৃ.৪৩

এই গল্পে মাসউদুল হক হলুদ বুদ্ধিজীবীর উপদেশের বিষয়টি তুলে ধরেছেন সচেতনভাবেই। “বুদ্ধিজীবী লেখক বললেন, একটি পরিবারের ইতিহাস নামটি মানুষের ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে দিবে। যেহেতু আপনারা কোন নবাব বা জমিদারের বংশধর নন সেহেতু আপনাদের নিয়ে সাধারণ জনগণের আগ্রহও নেই। মানুষ বংশানুক্রমিক নেতা লালন-পালনের মনোবৃত্তিতে বিশ্বাসী। এদেশের মানুষ যার দ্বারা নিগৃহীত হয় তার কথা স্মরণ করতে ভালোবাসে। মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইতিহাসও আপনাদের নেই। সুতরাং আপনাদের পরিবারকে বিখ্যাত করতে হলে একটা বড় এবং জনপ্রিয় বিষয়ের প্রেক্ষাপটের আড়ালে মার্কেটিং করতে হবে।” পৃ.৪৫

এই গল্পে লেখক-প্রকাশক-বিতরণ, প্রকাশনা উৎসব সর্বোপরি উদ্যোগতার বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। সমাজে মানহীন সস্তা বইয়ের একটি প্রামাণ্য চিত্রও পাঠক দেখতে পেল। মনগড়া মিথ্যা পারিবারিক গল্প কিভাবে মনের ভেতর কখন প্রভাব বিস্তার করে তা আমরা দেখতে পাই গল্পের এই অংশে– “আমাদের বাজারজাতকরণ কৌশলের সফল প্রয়োগের কারণে একটি মিথ্যা ইতিহাস বিভিন্ন লাইব্রেরি এবং শিক্ষিত দাবিদার লোকের ঘরে জায়গা করে নেয়। বইটির বিষয়বস্তু এবং সত্যতা নিয়ে আমাদের মনে বেশ অবিশ্বাস থাকার পরও বইটি বের হবার পর থেকে আমরা ভাবতে শুরু করি যে, আমরা দলিল লেখকের বংশধর নই। আমরা এক রাজপুত পরিবারের বংশধর।” পৃ.৪৭

একটি পারিবারিক মিথ্যা গল্প এইভাবেই স্থানীয় ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। একটা গ্রামের ইতিহাস হয়ে যায়। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হতে থাকে। একজন গবেষকের মাধ্যমে হাজীপুর গ্রামের ইতিহাস ইতিবৃত্ত সন ধরে প্রকৃত বিষয়টি যখন তুলে আনলেন তখনি দলিল লেখকের পারিবারিক গল্পটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সাধারণ পাঠকের কাছে প্রকাশ পায় দলিল লেখকের বইটি একটা নিছক মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। চার ভাইয়ের একজন তার জ্ঞান নেত্রে অনুধাবন করে বলে–“আমি তবু একটু মিন মিন করে বলি, অই গবেষকের গবেষণায় কিন্তু যুক্তি আছে, আমাদের বংশ এত বনেদি হলে আমরা অবশ্যই আগে জানতাম। মিথ্যা নিয়ে লড়াই করা ঠিক না।” পৃ.৪৮

গল্পকার মাসউদুল হক গল্পটিকে একজন প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান এর মাধ্যমে পারিবারিক গল্পটি সেই দলিল লেখকের চারিত্রিক পাঠ উন্মোচন করেছেন। তিনি বলছেন– “তোর বাপের লেহা বইডা পড়ছি। তোদের বাপ তোদের বড় করতে গিয়ে বহুত মিছা কতা লেকছে। মিছা ইতিহাসের ভার অনেক বেশি। তা বহনের দায় তোরাই নে। আমারে আর এর মধ্যে টানিস না।” পৃ.৫১

‘মিথ্যা ইতিহাসের ফেরিওয়ালা’ গল্পটি আমাদের চিরায়ত সমাজের একটি প্রতিবিম্ব। আজো মিথ্যার ইতিহাস যেমন লেখা হচ্ছে তেমনি তা প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার-লক্ষ লগ্নিও বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে সত্যটা একদিন না একদিন সময়ের বাতাবরণে উন্মোচিত হয়। এই গল্পের ৪২ পৃষ্ঠার শেষ লাইন আর ৪৩ পৃষ্ঠার প্রথম লাইন একই। এই ক্ষেত্রে প্রকাশক আরেকটু সচেতন হতে পারতেন।

রেশমা যখন সাবজেক্ট:

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টানাপড়েনের হাত ধরে এগিয়ে যায় গল্প ‘রেশমা যখন সাবজেক্ট’। চল্লিশোর্ধ্ব বয়স জড়ানো মানুষের মধ্যে যখন প্রেমঘন সম্পর্ক গড়ে ওঠে অপ্রত্যাশিতভাবে তখনি বিশ্বাস নামক সাবজেক্ট নাড়িয়ে দেয় সব কিছু। গল্পের নায়ক দেড় বছর হল শুক্লার সাথে সম্পর্ক গড়েছে। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা। ধ্বংসস্তুপ থেকে চৌদ্দদিনের মাথায় বের হয়ে আসে ‘রেশমা’। যাকে কেন্দ্র করে প্রেমময় দুটো সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরে। রানাপ্লাজা ধসে পড়েনি যেন দু’টো প্রাণের বিশ্বাস ধসে পড়েছে। তাই তো গল্পের কথক বলছে– “চৌদ্দ দিনের মাথায় রানাপ্লাজা থেকে রেশমা বের হয়ে আসার পর আমাদের দু’জনের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান আমাকে বিব্রত করে তুলছে।” পৃ. ৫৩

একটা বিল্ডিং হঠাৎ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হল। দিনের আলোর মত পরিষ্কার। মিডিয়া-সংবাদকর্র্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ ভিড় জমিয়েছে সেখানে। সুতরাং এত্তোসব মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিল্ডিং এর ধ্বংসস্তুপ থেকে কি করে একটা মেয়েকে চৌদ্দদিন পর উদ্ধার করে আনবে। প্রশ্নটা ছিল শুক্লার। এটা স্রেফ সাজানো; চৌদ্দদিন পর কোনো মানুষই ধ্বংসস্তুপ হতে জীবিত উদ্ধার হতে পারে না? গল্পের কথকের এই একটি জায়গায় তার আপত্তি। কিভাবে সাজানো নাটক হবে জন্ম-মৃত্যু স্রষ্টার হাতে। শত শত মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই নাটক মঞ্চস্থ করা কোনো মতেই সম্ভব নয়।  এই বিষয়টি কেন্দ্র করে গল্পটা সরকারের দুনীর্তিনামক অতি চেনা বিষয়ে যুক্ত হয়েছে। শুক্লার কথা হচ্ছে সরকার সব পারে। কিন্ত ‘রেশমা’ জীবিত এই বিষয়টি যখন অধিকাংশ মানুষ ধরে নিয়েছে, মিডিয়াতে যখন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নি তখন শুক্লা কেন বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নাটক ধরে নিচ্ছে। আসলে মানুষের বিশ্বাস বস্তুটা আপেক্ষিক। প্রত্যেক মানুষের মনের ঘরে বিশ্বাসের আলাদা সত্তা বাস করে। যাকে নিয়ে মানুষ তার জীবন দর্শন তৈরি করে। বিশ্বাসটা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় না, যুক্তিতর্ক, পরিবেশ পরিস্থিতি সবকিছু আমলে এনে বিশ্বাস একসময় সুদৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়।–“|তোমার ধারনা যদি সত্য হয় তবে হঠাৎ করেই সরকার তার কোন গোয়েন্দা সংস্থাকে এই দায়িত্ব দেয়নি। কমপক্ষে রানাপ্লাজা যেদিন ধ্বসে পড়লো সেদিনই বা তার এক দু’দিনের মধ্যে নাটকের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ধরা যাক এই পরিকল্পনার নাম ‘অপারেশন মুভ অ্যান্ড পিক বলেই আমি শুক্লার চোখে চোখ রাখি।”পৃ.৫৬

‘রেশমা’ বিষয়টি কথার ডালপালায় মেলতে মেলতে গামেন্টসে শিশুশ্রম, সেইভ দ্যা চিলড্রেন বা ইউনিসেফ, তথা গ্লোবালাইজড ইস্যুতে ঠেকেছে। লেখক গল্পের কথকের ভাবনার গভীরতা তথা বিশ্বাসে বিজ্ঞানমনস্কতা যুক্তির প্রৌঢ়ত্ব উপস্থাপন করতে চেয়েছেন– “শুক্লা বেশ বিরক্তির সাথে বলে, রেশমার ঘটনা সত্য না মিথ্যা তা নিয়ে আমাদের কি? এটা সত্য হলেও তুমি আমার কাছে যেমন আছ তেমন থাকবে। মিথ্যা হলেও যেমন আছ তেমনই থাকবে।” পৃ.৬২

সংসার বল, কিংবা বন্ধুত্ব এই সেক্টরে বিশ্বাসটা অত্যন্ত জরুরী। সন্দেহ প্রবন মন কখনোই প্রগতিকে ধারণ করে না। সন্দেহ জাল শাণিত যুক্তির মাধ্যমে ছেদন করতে হয়। আর সেই যুক্তিটা খোলামনে গ্রহণ করার মানসিকতাও লাগে। যদি সম্পর্কের মাঝে অহেতুক সন্দেহ প্রবন মন ঘুর ঘুর করে এবং যুক্তিটা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে তখনি সম্পর্কটা আলগা হয়ে যায়। সুদৃঢ়ভিত্তি আর থাকে না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কিংবা ব্যক্তি সম্পর্কে বিশ্বাসের মূলে প্রয়োজন মুক্তামনা ‘মন’। কিন্তু জীবনসঙ্গীর ক্ষেত্রে চাই চিন্তার গভীরতা। লেখক মাসউদুল হক ‘রেশমা যখন সাবজেক্ট’ গল্পে এই বিষয়টি অনবদ্য উপস্থাপন আমরা দেখতে পাই।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu