সায়াহ্ন ও পরের যামিনী 

তিন পর্বে ভেঙে ভেঙে কিয়ামতটা ধ্বংসযজ্ঞ চালালো। কিয়ামত– অর্থাৎ ঝড়টা। প্রথমে স্রেফ অতি প্রাচীন অশ্বত্থটাই উপড়ে গিয়েছিলো। লোকে বলতো– কাবিলের অশ্বত্থ। কিন্তু বুড়ির কাছে ওটা মড়া পোড়া। এর ব্যতীত একটুও কিছু নয়। এছাড়াও ঝড়টা বুড়ির কাছ থেকে আরো একটা জিনিস নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে– এটা দোজখের জোড়া পথ। পথের একটা বন্ধ করে গিয়েছে ঝড়টা। ঝড়ের শেষ তান্ডবের দিন– ঐটাই ছিল সবচেয়ে অমীমাংসিত,অস্পৃশ্য। একটি দানব-গোথিক শ্রেণীর-রাজী’দের ভগ্ন ছাদের একটি টিনের টুকরো– সোজা ছুঁড়ে দিয়েছিলো বুড়ির দিকে। তাতেই দোজখের একটি পথ কিলবিলে অন্ধকারে ছেয়ে যায়। করোগেটেড শিটের ঐ টুকরোয় রাজী’দের পরিবারের নিষ্পেষিত দিনের ধোঁয়া মাখা ছিল। পুরনো নয়,তবে বাসী। সিক্ত নয়– তবু আর্দ্র। গলে যাওয়া অক্ষিগোলক তাই আঁখিপটেই জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল। বুড়িকে কিছুই করতে হয়নি। সাত বছর পর (বুড়ির হিসাবে, অথচ ঝড় থামার সাত দিন পর)–ঘরটার বাইরে থেকে পুরুষ কন্ঠে হাঁক শোনা যায়–
“রাবেতার মা, ভেজা কাঠগুলো দাও দিখি। রোদ আসছে খুব।”

বুড়ি বিড়বিড় করে গালি দেয়। জরা, তাপ, প্রেম– এসব তো চোখের চাওয়া। একটি চোখ গেল– তো চাওয়া-পাওয়া আধেক কমলো (কিংবা আশাবাদীদের হিসেবে আধেক রইল)। রাবেতা কখনোই জন্মাতে পারেনি। তবু বুড়ির নাম ‘রাবেতার মা’ হয়ে গেছে। যেমন নার্সিসাস মরে গিয়ে মরেই গিয়েছিল। সে মোটেই ফোটেনি। লোকে তাকে কেবলই নার্গিসের নামে প্রাণদান করতে চায়। যৌবনে সে রাবেতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। যখন কাবুলিওয়ালা বলেছিল, “দুঃখ কোরোনা। আল্লাহ হয়তো তার তাকদিরে জন্মানোর পরশমণিটি দেননি। তবে পরের জনের নামও আমরা রাবেতাই রাখবো।” তখন, ঐ মুহূর্তেই, খুব আঁশটে গন্ধ এসে বুড়ির নাকে এসে ঢুকে গিয়েছিল।

ভ্রূণেরা মরে না। তারা জীবিতও নয়। জীবন থাকলে অস্ফুটে জীবনটা তুলে নিলে তাকে মৃত বলা যেতে পারে। ভ্রূণের অবস্থান প্রায় জীবন ও নির্জীবের সীমান্তের ঠিক মাঝখানে– জেলিফিশের মতো। বুড়ির মন খারাপ হয়না। তাকেও বহুবার মরতে হয়েছিল।

– কেউই নিজের পছন্দসই গন্ডিতে জন্মায়নি। আর যা পছন্দের– তা কখনোই আমাদের হয় না। এ অমোঘ সত্য টলানো যায় না।

বুড়ির আঁশটে গন্ধ নখের ডগা থেকে শুরু করে মধ্যচ্ছদা অবধি চলে গেছে। সে হাসলেও একই গন্ধ রি-রি করে। মেছো গন্ধ গেলাসের জলে সাঁতার কাটে। কাবুলিওয়ালার আমলে সে চুল রাখতে শুরু করেছিল। লম্বা, তেলতেলে-কালো জামের চামড়ার মতো চুল। আপেলরঙা গালে ফুরফুরে হাসি, গলায় হাড়ের গয়না। প্রায় স্বচ্ছ বর্ধিত আঙুলের ডগায় সুগন্ধী নিয়ে সে নাভিতে মাখতো। প্রত্যহ গোসলের পর তার গায়ে লেপ্টানো জাফরানী গন্ধ মিলতো। সেই দিনগুলোয় কেউই তাকে কখনো কুৎসিত দেখেনি। গুপ্তভাবে সে তিনজন খদ্দের রাখতো। সপ্তাহের তিনটি দিন তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। বলা হয়ে থাকে, মৃত্যু এমন একটি স্তর– যার পর আর কোনো কিছুই প্রভাব রাখতে পারে না।

কাবুলিওয়ালা বাঁকানো ক্ষুদ্র একটি ছোঁরা নিয়ে তাড়া করেছিল তাকে। সে নির্ভীক ও নিঃশব্দ দাম্ভিকতার সাথে উন্মুক্ত বুকে হাত রেখে বলেছিল– “মারো”, অথচ কাবুলিওয়ালা মরে গিয়েছিল। সেটিও রাবেতা (বা ৩ জন রাবেতাদের) মৃত্যুর পর। তার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন সে প্রত্যহ বাজারে যাওয়া শুরু করে। দিনে বা রাতে। তার গায়ের জাফরনীরা ধীরে খসে পড়তে শুরু করলো। যেমনটা হয় আর– কি। ভাঁজগুলো ঢাকতে সে হাতে ও মুখে নিয়মিত মেটে রঙ মাখতে লাগল। অনেক কিছুর সাথেই রাবেতাদের মায়ের শহরে লোকের আনাগোনা কমতে লাগল। সে সময়টি দ্রুতই গত হচ্ছিল যখন সে ভাবত তার কথায় কিন্নর সুর। তখন সে মেছো গন্ধটাকে পুঁজি করলো। সাগুফতা-মল থেকে বরফ দেওয়া মাছ সে ফেরি করত। দ্রুতই পসরা জমে উঠল।

তিন পর্বের ঝড়টি গত হয়েছে। সে সময় যারা পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করেছিল এবং যারা করেনি– উভয়েই পূর্বের পঙ্কিলতায় ডুবে গিয়েছে।

– অ্যাবরাকাডেবরা, আমি সৃষ্টি করি যখন আমি উচ্চারণ করি– কুন, ফা’আকুন। অবস্তুগত সৃষ্টির মধ্যে ভুল ও সঠিকের মাপকাঠিটি বড্ড জটিল। পৃথিবীর একপ্রান্তে তুমি যাকে ভালো– সুন্দর বলে বাহবা দিচ্ছ, অন্য কোথাও হয়তো সেটিকেই মানুষ দুয়ো দিচ্ছে (বা মৃত্যুদণ্ড; পৃথিবীর মানুষদের উপর বুড়ির খুব একটা বিশ্বাস ছিল না)।

পুরুষালী কন্ঠের অধিকারীটি তাতানো রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছে। বুড়ির পায়চারিতে ফিরে বসল। তার নাকের ওপরে একটা লাল পিঁপড়া। ক্রমাগত চক্কর কাটছে। সে রাজী’দের পারিবারিক ও অন্ত্যজ ছিদ্রটি নিয়ে ভাবছে। ওদের ঘরটা ছিল উষ্ণ। মজবুত মেঝের ওপর গোলাপি নরম পায়ের পাতারা হেঁটে যেত। বলা ভালো সর্পিল মসৃণ ভাবে ভেসে যেত। বাতাসে মাতৃত্ব ও মমতার প্রকট উপস্থিতি। সদ্যই কেউ মা হল। নানা বয়সীদের কোলাহলে জীবন্ত ও প্রকট হয়ে থাকে সংসার। মধ্যমণিটি, সবচেয়ে বয়েসী যে, তার সামনে বিরাট পাত্রে ঢালা হয় ঘন, কালচে টক মধু। সারা ঘর মধুর ঝাঁজালো গন্ধে গরম হয়ে ওঠে। তর্জনীর মাথায় করে চাখা হয় সেই মধু।

– “গতবারের চেয়ে ঘন, তিতকুটে।”

যথেষ্ট পবিত্রতা রক্ষা করে শিশুদেরকে চেটে খাওয়নো হয়। নেকটারগুলো বয়ামে করে সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে যে যার কাজে ফেরত যায়। ওদেরকে বলা যেত সবচেয়ে সুখী পরিবার। তাই সবাই ওদের ঘরটাকে পছন্দ করেছিল। ঝড়টাও। যে ছিদ্রটি ওদের ছিল তা কেউ বুজিয়ে দেয়ার কথা ভাবেনি কখনো। কিন্তু সকলে তা এড়িয়ে চলতো। ‘রাজী’–মরার আগে যথেষ্ট ফিসফিস আর কানাঘুষোর জন্ম দিয়েছিল।

– “ছেলেটা মেয়ে।”, “না, কিশোরটা কিশোরই।”, “উহু! পাপের ফল!”, “আসলে মেয়েটা ছেলেও না, মেয়েও না।”, “ব্যাপারটা বড় হলে বোঝা যাবে।”–
গুন্জন-গুজব যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার অনেক আগেই কেউ ওর নিথর দেহটা লটকে দিয়েছিল– লোকে যাকে বলতো কাবিলের অশ্বত্থ। বুড়ি একে আত্মহত্যা মানতে নারাজ। খুব যত্ন করে ম্যানিলা রোপে ঝুলছিল শক্ত হয়ে যাওয়া লিঙ্গহীন দেহটা। রাবেতার (বা রাবেতাদের) মা বা বুড়ি এইসব পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতো না। কে কার ঘরের খবর সবাইকে বলে বেড়ায়! লোকে বলে, যা লোকের বলতে ভালো লাগে। যেমন একটা কথা খুব চাউর ছিল। রাজী’র হরিণছানার মতো পদক্ষেপ। পাহাড়ি ঝরণার নিরেট পাথরের ধাপসমূহে ছানাটি লাফিয়ে যেত। যেন-বা ভাসছে। বুড়ির বিশ্বাস, ফুল-খেকো হলে ছানাটির পেটে নিশ্চয়ই অ্যাম্বার জন্মাচ্ছিলো। বড় লোভ হয় তার। আহা! বাইরে খুঁতওয়ালা সবটা খালি আমরা ঢাকতে চাই।

পাপের একটি পথ বন্ধ হওয়ার পর বুড়ি খুব কল্পনা করতে পারতো। সব কল্পনাই কালচে, ঝাঁঝালো মধু-কেন্দ্রিক পরিবারটির। রাতারাতি সে তাদের পরিবারের সবটা জেনে নিয়েছিল। যেমনটি বলা হয়ে থাকে, দেয়ালেরও কান আছে। দেয়াল যতটা শুনেছিল, টিনের টুকরো যতটা দেখেছিল, চোখকে আঘাত করার মাধ্যমে ওরা বুড়ির কাছে সব উগরে দিল। এভাবেই বুড়ি অনাহুত হয়েও গল্পগুলোর অংশ হয়ে যায়।

শেষমেশ মৃত্যু:
বুড়ি খুব ঘৃণা করতো বার্ধক্যপ্রাপ্তি-কে। কেমন গুইসাপের মতো হয়ে যাওয়া চামড়া। হিমালয় ঘেঁষা ঠাণ্ডা হিম হাওয়ার মতো শীতল রূক্ষ স্পর্শ। চোখের তলায় পানির পোটলা। ঘোলাটে চোখের গোলক নোংরা জলের ডোবার মতো। ছিঃ! সে আরো ঘৃণা করতো ঝুলে পড়া গাল। শূন্য পাটের থলের মতো ল্যাকপ্যাকে দাঁতহীন চোয়াল। ছিঃ ছিঃ! জীবনের কী অভিশাপ। বুড়ির মৃত্যু হয়েছিল তার তীব্র ঘৃণার কারণেই। তার নেতানো খুব নরম পেট, পাঁজরের উপর কোনোমতে লেপ্টে থাকা তেলতেলে চামড়া ধীরে ধীরে শক্ত কংক্রিট হয়ে যায়। সে অনিবার্য এক তীব্র আকর্ষণীয় ঘুমে ঢলে পড়ে। মাটি, মাটির টানে মাটিতেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে। অমোঘ নিদ্রাকর্ষণে তার সচেতন ভাবনা ও অচেতন ভাবনা উড়ে গিয়ে বায়ুমণ্ডলে মিলিয়ে যায়। এই দুইয়ে মিলিয়েই তো আত্মা। শেষ যতদূর সম্ভব সে আত্মাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মৃত্যুর গহ্বর মুখে দাড়িয়ে বুড়ি অভিব্যক্তির চলন্ত চিত্র হয়ে যায়। যেন প্রথমে অবাক হওয়ার অভিব্যক্তি, এরপর বুঝতে পারা, তারপর ঈষৎ রাগ, এরপর প্রতিরোধ করতে না পারার বদ্ধ উন্মাদনা, শেষ চেষ্টা, হার, অভিমান, এরপর মেনে নিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার– “তোমরা যা দিয়েছ তার জন্য, যা নিয়েছ তার জন্যেও।” সবশেষে অভিবাদন ও সমাপ্তি। পাপের পথটি লোকে খোলা অবস্থায় পেয়েছিল। দেহটি মাটি আঁকড়ে আছে। রাবেতার মা রাবেতাদের নিয়েই মরেছিল।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
ব্যক্তিত্ব

হিরু ওনদা: যুদ্ধ শেষের পরেও যে জাপানি যোদ্ধা ২৯ বছর যুদ্ধ করেছিলেন

ধরুন আপনার বন্ধুকে নিয়ে কোনো এলাকায় ঘুরতে গিয়েছেন। সে আপনাকে অপেক্ষা করতে বলে কোথাও চলে গেল। আপনি তার জন্য ঠিক

গল্প

স্বামী-স্ত্রী

রাত দশটায় মেনকা ঘরে এল। এ বাড়িতে সকাল সকাল খাওয়াদাওয়ার হাঙ্গামা চুকে যায়। ছোট ঘর, চওড়ার চেয়ে লম্বায় দুহাতের বেশি

স্মৃতির পাতা থেকে

স্মৃতির পাখিরা: ১৯৭১ [সম্পূর্ণ]

প্রথম অধ্যায় ১৯৭১  সালের জানুয়ারি মাস। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছি। সব্বাই খুশি। মাত্র তিন মাস স্কুলে