ক্যামেলিয়া ডে

০১.

পাশ্চাত্যে ঝড় তোলা  খুনের ঘটনার শুনানি চলছে ইংল্যান্ডের চেস্টার আদালতে। গত বুধবার আদালতে ছোট মেয়েটি সাক্ষ্য দিচ্ছে তার বড় বোন খুন হওয়ার।

সাক্ষীর বর্ণনা শুনে চোখ কপালে ওঠে আদালতের।

সেদিন আফসার এবং ফাইজা দম্পতির ছোট মেয়ে আরিবা এভাবেই সাক্ষ্য দিচ্ছিল আদালতেঃ

অইদিন আপু খুব হাসি-খুশি চেহারায় ফিরেছিল বাসায়।

ঢোকার পথেই মা আপুকে থামিয়ে দেয় আর বলে তুমি এসব কী কাপড় পরেছ ক্যামেলিয়া? তুমি বিখ্যাত পীর ফজলুল খানের নাত্নী। আর তুমি কিনা মিনি স্কার্ট পরেছ? তোমার লাল টপসের নীচে কালো অন্তর্বাস স্পষ্ট দেখা যায়। আর তোমার স্তনের নিপলগুলোও কেমন ফুটে রয়েছে। একটা সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে তুমি পতিতাদের মতো কাপড় পরছ? ছি!! তোমাকে আমি পেটে ধরেছি এটা ভাবতেও আমার ঘৃণা হয়! এরপর আপু মাকে বলে যে, বৃটেনে সবাই এরকম ড্রেস আপ করে। আমি একা করছি না। আমার অইসব জোব্বা-জাব্বা ভালো লাগে না। তোমার ইচ্ছে হয় তুমি পরো না! আমাকে কেন বল? আপুর একথা শুনে মা আপুর মুখে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই আপুর মুখটা কালোমেঘে ভরা আকাশের মতো থমথমে হয়ে যায়। মা আরেকটু কাছে গিয়ে আপুর ঠোঁটে দেখতে পায় চুম্বনের দাগ। মা চুলের মুঠি ধরে বলেন এতদূর!  যদি বাঁচাতে চাও সোজা পথে চল, ইসলামের পথে আস। নইলে..। এরপর আপুর ফোন নিয়ে মা ফোন চেক করেন। তারপর  মা দেখতে পান আপু মাইক নামের একজন ছেলের সাথে অনেকবার কথা বলেছে।

মা আপুকে জিজ্ঞেস করেন মাইক কে? আপু বলে আমার স্প্যানিশ বন্ধু। এরপর মা আপুকে বলে, তোমাকে আজ পারিবারিক আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। আমি ফোনে তোমার বাবাকে পুরোটা জানাচ্ছি। তখন মায়ের  ফর্সা মুখ কেমন লাল হয়ে উঠেছিল।

মায়ের চোখ থেকে আগুন বের হচ্ছিল। এরপর আপু দোতলায় চলে আসে। সেদিন আপুর ব্লাড ব্যংকের ক্যাম্পেইন আর কন্সার্ট ছিল। ওপরে এসে আপু আমাকে বলে, আয় তোকে কিছু দেখাই। আপুর বিভিন্ন দেশের কয়েন জমানোর হবি ছিল, সেগুলো দেখিয়েছিল, আপু ইংরেজি কবিতা লিখত সেই খাতা আমাকে হাতে দিয়ে বলেছিল এটা আমার কবিতার ডায়েরি। তারপর আপু কারো সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে কেঁদেছিল। আরিবা ডুকরে কেঁদে উঠে বলে সেদিন আপু বাসায় ফিরে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। খুদা লাগলেও আমাকে বলেছিল আরিবা ফ্রীজ থেকে একটা চকোলেট আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে দেবে আমাকে? আমার আপু অনেক মিষ্টি করে কথা বলত, আপুর চুলগুলো সোনালী রঙের ছিল, আর চোখগুলো ছিল খুব বড় আর গভীর। আমি চকলেট আর পানি আর এক টুকরো পনির এনে দিয়েছিলাম সেদিন আপুকে। আপু মুহূর্তেই হেসে আমার গালে একটা ছোট মিষ্টি চুমু দিয়ে বলেছিল আমার মিষ্টি বোনটা! এরপর আপু ঘুমাচ্ছিল।বাবা বাসায় ফেরে ভর সন্ধ্যার মুখে। এসেই বাবা এবং মা দুজনে কিছুক্ষণ শলা-পরামর্শ করে। এরপর আপুর ডাক পড়ে পারিবারিক সালিশ কেন্দ্রে। যেখানে বাবাই প্রধান বিচারক আর মা হচ্ছে তার সহযোগী। আরিবা একনাগাড়ে বলে যায় আবার কখনো কাঁদে। আরিবা বলে আপুকে ডেকে উঠায় আমার ভাই জুনায়েদ। আপু মুখ ধুয়ে গিয়ে বাবার সামনে বসে। তখনও আপুর পরনে ছিল থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর স্লিভলেস টি শার্ট। দেখেই বাবা মাকে বলে ওঠে খানকি হইছে তোর পেটে! তুই মেয়ে সামলাতে পারিস না ক্যান? মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে আমি তো অনেক চেষ্টা করি, তোমার মেয়ে না শুনলে আমি কী করব! বাবা আপুকে জিজ্ঞেস করেন ক্যামেলিয়া তুমি এসব জঘন্য আচার- আচরণ করছ কেন? আর  ইহুদীদের মতো কাপড় পরো কেন? আপু কোনো কথা না বলে চুপ করে ছিল। এরপর বাবা আবার জিজ্ঞেস করে কথা বলছ না কেন?

এসব জঘন্য কাজ করার জন্যই কী তুমি মুক্তাদীরকে বিয়ে করলে না? কত ভালো পরিবার ছিল। মুক্তাদীর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট  প্রকৌশলী ছিল। ওর বাবা মা দুজনেই ডাক্তার ছিল। তখন আপু বলে যে, এত শিক্ষিত মানুষ হয়েও উনারা কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর মুক্তাদীর তো হাঁটু অব্দি দাড়ি রেখেছে। আমি অই ধরনের পরিবারে কেন বিয়ে করব? আর আমি কোনো অন্যায় করছি না। আমি যে কপড় পরি  সেটা এখানের সবাই পরে। তোমরা না চাইলে আমি তোমাদের সাথে থাকব না। অমনি বাবা আপুকে কষে চড় মারে আর বলে কই যাবি তুই কুকুরী! কই যাবি বেশ্যা? তোকে জন্ম দিয়ে আমি যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্তও আমাকে করতে হবে!

 

০২.

মা- বাবা দুজনে দুজনের চোখে তাকিয়ে ইশারায় কী বলাবলি করে নেয়। মা মাথা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। তারপর মা বললো -অনেক হয়েছে, আর নয়। এখানেই খেলা শেষ করে দেয়া যাক! মার কথা শুনে বাবা তাকে বললেন একটা পলিথিন ব্যাগ আনার জন্য। মা তাই করেন। এরপর বাবা জোরে একটা ধাক্কা মেরে আপুকে ঘরের মেঝের ওপর ফেলে দেন।

বাবা তার দুই হাটু আপার দুই উরুর উপর তুলে দিয়ে তাকে অনড়ভাবে ধরে রাখেন। আর দুই হাত দিয়ে ধরে রাখেন আপার দুই বাহু। বাবার শক্তিশালী বিশাল শরীরের কাছে আপার কেবল মোচড়ামুচড়িই সার! পরে বাবা তাড়াতাড়ি পলিথিন ব্যাগটা আপার নাকে মুখে ‘সুন্দর করে’ চেপে ধরতে বলেন। মা তাই করে।

আমরা ওপরের রুমে গিয়ে তিনবোন  ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম । জুনায়েদ বলছিল একদম ঠিক আছে। অবাধ্যতাকারীর যথাযোগ্য শাস্তি। এরপর যা ঘটেছে তা আমি বলতে পারছি না কোনোভাবেই! তার কিছুক্ষণ পর দেখলাম বাবা একটা বড় কার্টন গাড়ির পেছনে উঠিয়ে চলে গেলেন।  এরপর বিচারক আরিবাকে জিজ্ঞেস করে, সাত বছর তোমরা চুপচাপ ছিলে। সাতবছর পরে কেন নিজের বাসায় ডাকাতি করলে? আরিবা বলে যখন ঘটনা ঘটে তখন আমার বয়স ছিল বারো বছর। খুব ছোট ছিলাম আমি। আর সেদিন বাবা বাইরে থেকে ফিরে এসে আমাদের সব ভাইবোনকে ডেকে বলেছিল যে, যদি এই কথা কাকপক্ষীও টের পায় তাহলে সবার পরিণতি একই হবে। আর জুনায়েদ বলেছিল, ভালো চাইলে আজকের ঘটনা একদম পুরোপুরি ভুলে যেতে। কিন্তু আমি আমার আপুকে প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। কখনো হাসতে দেখি, কখনো কাঁদতে দেখি, আবার কখনো দেখি আপু খুব আনমনে বসে আছে। এরপর চরম প্রতিশোধ স্পৃহা জন্মায় আমার ভেতর। বন্ধুদের নিয়ে পরিকল্পনা করি বাসায় ডাকাতি করার। ইচ্ছে করেছিল বাবা-মাকে খুন করে ফেলি। কিন্তু বন্ধুরা রাজি হয় না। তাই মা, ভাই আর আর বোনদের অস্ত্রের মুখে বেঁধে পঞ্চাশ হাজার  মার্কিন  ডলার নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কিন্তু পুলিশের কাছে ধরা খাই। আর পুলিশ তখন আমাকে সাইক্লোজিষ্টের কাছে নিয়ে যায়।

এরপর সাইক্লোজিষ্টের কাছেই সব কথা বলি প্রথমে।আর আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। তারপর  বিচারক আরিবাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বলেন এবং নার্সকে বলেন তার পরিচর্যা করতে।

 

০৩.

স্যালাইন এবং স্যুপ খেতে দেয়া হয় আরিবাকে। সিষ্টার খুব সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন যে- তুমি যা যা দেখেছ সবিস্তারে সুন্দর করে বিচারককে বল বেবী।

কারণ তাহলে ন্যায় বিচার হবে এবং তোমার আপুর আত্মা শান্তি পাবে।

এরপর আরিবা মানসিক শক্তি ফিরে পায়। অত:পর সেদিন চেষ্টার আদালতে সাক্ষীর বয়ানে সবিস্তারে বলে যাচ্ছিল খুনের ঘটনা  । খুনী তার বাবা-মা এবং ভাই। মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন আবেগপ্রবণ হয়ে না পড়ে সেজন্য কাঠগড়ার সামনে পর্দা ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

ব্রিটেনে একটা ‘সম্মানিত’ বাংলাদেশী পরিবারে লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের শুনানিতে আদালতে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আরিবার সাক্ষ্য। প্রত্যক্ষদর্শী আর কেউ নয়, খুন হওয়া মেয়েটির ছোট বোন। আর খুনি তার বাবা মা! মা-বাবা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যাটি আরিবা।

বাংলাদেশী  নোয়াখালীর পীর বংশদ্ভূত এই পরিবারটির বাস উত্তর পশ্চিম ইংল্যান্ডের চেশায়ারে। ৫০ বছর বয়স্ক আফসার  আহমেদ ও তার স্ত্রী ফাইজা আহমেদের (৪৭) চার কন্যা ও এক পুত্র নিয়ে সংসার। ছেলেমেয়েরা জন্মসূত্রে ব্রিটেনের নাগরিক। ক্যামেলিয়া স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলে কয়েকদিন পর তার স্কুলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় আফসার দম্পতির সঙ্গে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে তারা জানিয়ে দেন ক্যামেলিয়া  ‘নিঁখোজ’ হয়েছে।  তারা পুলিশের কাছে মেয়ের নিঁখোজ হওয়া নিয়ে একটা সাধারণ ডায়েরি করেন। ক্যামেলিয়ার স্কুলের পক্ষ থেকেও পুলিশের কাছে বিষয়টি অবহিত করা হয়। মাঠে নামে ব্রিটেনের পুলিশ ও গোয়েন্দারা। হন্যে হয়ে তারা ক্যামেলিয়ার ‘অপহরণকারীদের’ পিছু ছোটে।

পরের বছর আফসারদের আবাসস্থান থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে কাম্ব্রিয়ায় কেণ্ট নদীতে বন্যায় ভেসে আসা কার্টনে ভর্তি একটি লাশের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। তার সাথে থাকা ব্রেসলেট ও আংটি এনে পুলিশ আফসার দম্পতিকে দেখান। তারা সনাক্ত করেন এটা তাদের মেয়েরই লাশ। কিন্তু কেবল হাড়গোড় থেকে পুলিশ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। এক দফা ময়না তদন্ত  করা হয়।  কিন্তু কিছুই উদ্ধার করা গেল না। আরেক দফা ময়নাতদন্ত হয়। অভিমত দেয়া হয়, শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। লাশ থেকে দাঁত এনে ক্যামেলিয়ার ডেন্টিস্টকে দেখানো হয়। তিনি মনে করতে পারেন না। শেষে পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ টেস্ট করা হয়। ডিএনএ টেস্টে প্রমাণ হয় এটা আফসার দম্পতির ‘গুম’ হওয়া কন্যা ক্যামেলিয়া।

মা-বাবার চোখে অঢেল  অশ্রু। মেয়ের খুনিদের বের করে দিতে হবে, খুনের বিচার করতে হবে। পুলিশের উপর তারা চাপ দিতে থাকেন। জলজ্যান্ত আদরের মেয়েটা ‘গুম’ হয়ে গেল আর পুলিশ গোয়েন্দারা করছে কী! এভাবে কেটে যায় টানা সাত বছর। চরম লজ্জায় পড়ে যায় বাঘা বাঘা ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। কারণ দেশটিতে এভাবে দীর্ঘদিন খুনির লুকিয়ে থাকা কিংবা খুনের রহস্য উদঘাটন না হওয়া অনেকটা অবিশ্বাস্য। সব রাস্তাতেই চেষ্টা করে গোয়েন্দারা। কিন্তু কোনো ক্লু খুঁজে পায় না।

২০১০ সালের ২৫ আগস্ট আরিবা তার দুই বন্ধুকে নিয়ে তাদের নিজের বাড়িতেই ডাকাতি করে করে বসে! মুখে কালো মুখোশ পরিহিত আরিবা ও তার দুই সঙ্গী তাদের বাড়িতে ঢুকে তার মা, দুই বোন এবং ভাইকে অস্ত্রের মুখে বেঁধে তাদের মুখে টেপ লাগিয়ে দেন। ঘটনার সময় তার বাবা বাড়ি ছিলেন না। তারা ঘর থেকে প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার সমমূল্যের নগদ অর্থ এবং জুয়েলারি নিয়ে পালিয়ে যায়। কয়েকদিনের মধ্যেই পুলিশ আরিবাকে সন্দেহ করে তাকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে আরিবা ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। তার দুই সহযোগী লাপাত্তা হয়ে যায়। নিজের বাড়িতে ডাকাতি, এই অস্বাভাবিক ঘটনার কারণে আরিবাকে জিজ্ঞাসাবাদে মনোঃরোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেয়া হয়। একপর্যায়ে আরিবা সাত বছর ধরে যে কষ্ট লুকিয়ে রেখে বেড়ে উঠেছে তা প্রকাশ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কিভাবে তাদের কয়েক ভাই-বোনের সামনে মা-বাবা তাদের আপাকে হত্যা করেছিলেন সেই কাহিনী শোনায়। কিন্তু তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করা ঠিক হবে না, এমন মনে করে পুলিশ তার বাবা আফসার আহমেদ, মা ফাইজাসহ সব ভাই বোনের ফোনে আঁড়িপাতা শুরু করে। তাদের কথাবার্তা থেকে এই হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার স্পষ্ট আলামত পেয়ে ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় এই দম্পতিকে। সেই খুনের বিচার চলছিল চেস্টার আদালতে। সাক্ষ্য দিচ্ছে আরিবা।

আরিবা ১০ অক্টোবর ২০১০ সালে আদালতে সকাল দশটায় ঘটনার পুরো বর্ণনা দেন। এরপর বিচারক আদালতে পুলিশের প্রতিববেদন পড়ে শোনান-

“ঘটনার সময় ক্যামেলিয়া  ছিল ১৭ বছরের তরুণী। পড়তো এ লেভেলে। ছিল তুখোড় মেধাবী। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে বড় আইনজ্ঞ হবে। বাংলাদেশী বংশোদভুত হলেও সে ব্রিটেনের স্থানীয় মেয়েদের মতো স্বাধীনচেতা ছিল। কিন্তু তার মা বাবার চাওয়া ছিল মেয়ে রক্ষণশীল ঘরানার হোক। তার উপর চলতো মা বাবার গোয়েন্দাগিরি। ক্যামেলিয়া  স্কুল থেকে ফিরলে গোপনে তার স্কুলব্যাগ চেক করা হতো। মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেক করা হতো। ছেলেদের নাম্বারে কথা বলার প্রমাণ পেলে বকাঝঁকা করতেন তারা। ক্যামেলিয়া পছন্দ করত জিন্সের প্যান্ট, টি শার্টসহ ব্রিটেনের নতুন প্রজন্মের সব পছন্দের পোশাক। চুলে রং লাগাতো। কিন্তু তার মা বাবা এসব পছন্দ করতেন না। বকাঝকা করতেন। এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন, তাকে কৌশলে বাংলাদেশে নিয়ে সেখানে একটা ধর্মভিরু পরিবারের ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিবেন, তাতে সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই মোতাবেক তাকে বাংলাদেশের নোয়াখালী  নিয়ে যান। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আবার ব্রিটেনে ফিরে এসে পড়াশোনায় মনোযোগী হয় সে। সে ছিল স্কুলের প্রিয় মুখ। মেধাবী হবার কারণে শিক্ষকরা খুব স্নেহ করতেন। সব বিষয়ে একশ পার্সেন্টের কাছাকাছি নম্বর পেতো। সুন্দরী হবার কারণে বন্ধুরা তাকে ‘অ্যাঞ্জেল’ বা পরী বলে ডাকতো। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে অগণিত দাতব্য কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে সে। পড়াশোনার মাঝে পার্টটাইম চাকরি নিয়েছিল একটি টেলিমার্কেটিং কোম্পানিতে। সেই উপার্জনের অর্থের একটা অংশ দাতব্য কর্মসূচিতে খরচ করতো। লেটেস্ট ফ্যাশনের পোশাক এবং ডিজাইনার জুতা তার পছন্দ হলে কি হবে, সে রান্না-বান্না এবং ঘরকন্যার কাজেও ছিল সমান পটু। এতসব সত্ত্বেও ক্যামেলিয়ার মা-বাবা তার পাশ্চাত্য ঘরানার সাজসজ্জা ও চলাফেরা অপছন্দ করতেন। তারা মনে করতেন মেয়ের কারণে তাদের পরিবারের ‘সম্মানহানি’ হচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত মেয়েকে শাসন করা তাদের অন্য কাজগুলোর মতো রুটিন হয়ে গিয়েছিল। একপর্যায়ে তার জন্মদাত্রী মা-ই সিদ্ধান্ত নেন “খেলা শেষ করে’ দিতে!”

 

০৪.

বিচারক আবার আরিবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এজলাসে ডাকেন। সেদিনের ঘটনা পুরোটা বর্ণনা করতে বলে। আরিবা  আদালতে আরো জানায় আপু জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে দম নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পলিথিন ব্যাগের কারণে সেটা সম্ভব হয় না। সে সর্বশক্তি দিয়ে গোঙানি দেয়ার চেষ্টা করে। আর মা সর্বশক্তি দিয়ে পলিথিনের ব্যাগটা নাকে মুখে অনড়ভাবে চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। কষ্টে আপার চোখ দুটো যেন গর্ত থেকে বের হয়ে আসছিল। একদিকে প্রাণে বাঁচার সর্বোচ্চ চেষ্টা, আরেকদিকে নাকমুখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস বন্ধ করার জোর চেষ্টা। আমরা কয় ভাইবোন দর্শক। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। একপর্যায়ে দেখা গেল, আপা রণে ভঙ্গ দিয়েছে! আর দাপাদাপি করছে না।

-তারপর?

আপা নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা বন্ধ করে দিল। পা ছোড়াছুড়ি থামিয়ে দিল। বুঝলাম সব শেষ! মা মুখ থেকে পলিথিন ব্যাগটা সরিয়ে নিলেন। তারপর কোনো কারণ ছাড়াই আপার নিথর শরীরটার বুকের উপর বাবা কষে একটা লাথি দিলেন।  মা বললেন, বেশ্যামাগী অনেক জ্বালিয়েছে। আল্লাহ এরজন্য কোনো শাস্তি দেবে না আমাদের। ইহুদী  মারলে আবার শাস্তি কী? আমার পীরবংশীয় অভিজাত শ্বশুর বাড়ির সম্মান তো রক্ষা হল।

সেদিন বোনকে নির্মমভাবে হত্যা করতে দেখে আমি উপরের তলায় গিয়ে অন্য বোনদের সঙ্গে কান্নাকাটিতে অংশ নিই। কিছুক্ষণ পর আবার নিচে এসে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি-মা বাবা কি করছে। আমি দেখতে পাই – মা একটি কার্টনে স্কচটেপ লাগাচ্ছেন। আর ক্যামেলিয়ার লাশ কার্টনে ভরার উপযুক্ত করার জন্য বাবা আফসার আহমেদ তা কেটে খন্ড খন্ড করছেন!

প্রথমে বাবা আপুর সোনালি চুলগুলো কেটে ফেলে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আপুর সিল্কি সোনালী চুলগুলো র জন্য। ইচ্ছে করছিল যদি আপুর চুলগুলো রাখতে পারতাম! তারপর আপুর পিংক নেইলপালিশ পরা হাত,পাগুলি বাবা ছয় টুকরো করে। আপুকে বাবা মোট বিশ টুকরো করে বাবা তারপর কার্টনে ভরে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়।

বীভৎস  দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে আমি  আবার উপরে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ পেয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাবা কার্টনটা পাজাকোলা করে ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। এরপর গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হবার এবং প্রস্থানের শব্দ। কার্টনটা তার বাবা কোথায় ফেলে এসেছিলেন তা আমরা পরিবারের কেউ জানতাম না।

সে আরো বলে, তার মা বাবা অতটা ধর্মচর্চা না করলেও ক্যামেলিয়াকে  খুন করার পর থেকে তারা নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেন।

অন্যদিকে, এদিন পুলিশ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সরকারি উকিল  আদালতে জানায়, ২০০৩ সালে মেয়ে নিঁখোজ হওয়া সত্ত্বেও আফসার পুলিশে খবর দেননি। তাদের কল লিস্ট চেক করে দেখা গেছে, তারা মেয়ের মোবাইলে কল দেয়ারও চেষ্টা করেননি!  অথচ এর আগে একবার ক্যামেলিয়া রাগ করে তার বান্ধবীর বাসায় চলে গেলে তাকে খুঁজে বের করতে হেন কোনো চেষ্টা বাকি রাখেননি তারা। একারণে এই দম্পতিকে সন্দেহভাজন হিসেবে ২০০৪ সালে একবার গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে তারা চমৎকার অভিনয় করে পুলিশকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন যে তারা নির্দোষ। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

কিন্তু ডাকাতি মামলায় তাদের ছোট মেয়ে আরিবাকে গ্রেফতার করার পর আরিবাই জানিয়ে দেন ওই খুন তার মা বাবা করেছেন।  তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না হওয়ায় বাড়ির সবার ফোনে আঁড়ি পাতা হয়। ফোনে একদিন ফাইজা  স্বামীর কাছে জানতে চান, ‘তারা ধরা পড়বে না তো? শাস্তি হবে না তো?’ আফসার তার স্ত্রীকে অভয় নিয়ে বলেন, ‘চিন্তা করো না। আমাদের অপরাধ আদালতে প্রমাণ করার কোনো সুযোগই রাখিনি।’ আরেকদিন তিনি স্ত্রীকে বলেন, ‘ব্রিটেনে খুনের ঘটনা শতভাগ নিশ্চিত না করতে পারলে সাজা হয় না। তুমি যদি ৪০ জনকেও খুন কর, তুমিই যে খুন করেছো এটা শতভাগ প্রমাণ না করা পর্যন্ত কিছুই করতে পারবে না আদালত!’

বিচারক এরপর আফসার দম্পতিকে জিজ্ঞেস করে তারা কী মনে করেন- অবাধ্য মেয়েকে খুন করে তারা বেহেশতে যাবেন? মধ্যবয়স্ক এই নেকড়ে দম্পতি ভীতু, পাংশু,  অশ্রুসিক্ত মুখছবি নিয়ে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে।

 

০৫.

বিচারক সব শেষে রায় দেয়ার আগে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে, আজ জেসাস বা মোহাম্মদ এই চেয়ারে থাকলে কী রায় দিতেন আমি জানি না! কিন্তু কোরান বা বাইবেল মোহাম্মদ বা জেসাস কেউই তো একটা নিরস্ত্র পিঁপড়াকেও হত্যা করতে বলেনি। তারওপর নিজ সন্তান! আর ক্যামেলিয়ার মতো  এত সুন্দর, পবিত্র এবং সংবেদনশীল একজন কন্যা সন্তানকে কীভাবে একজন বাবা-মা খুন করতে পারে! তারপর নেকড়ে দম্পতিকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন- একুশ শতকের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা বিশ্বায়ন আবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জও বিশ্বায়ন। কেউ যদি অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক ভাবে পাশ্চাত্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চলে আসে, সংস্কৃতিগত ভাবেও সে অনেকটাই পাশ্চাত্যে বসবাস করবে। আর বিশ্বাস তো সংস্কৃতি থেকেই আহোরিত হয়। একুশ শতকের কোলে-পিঠে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম এটাই জানে। ধর্মের নামে দ্বিচারিতা তারা কেন নেবে? যারা নিজস্বতা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান, তারা কেন মাইগ্রেট কেন করেন? আপনি পাশ্চাত্যের খাবেন, পাশ্চাত্যের বাতাসে নি:শ্বাস নেবেন, আবার পাশ্চাত্যকেই ঘৃণা করবেন -এই আপনার সততা?

যাহোক আমি এই নেকড়ে দম্পতির জন্য যোগ্য কোনো শাস্তি খুঁজে পাচ্ছি না। মৃত্যু দন্ডের বিধান বৃটেনে নেই আর মৃত্যু কোনো শাস্তি হতে পারে না। মৃত্যু কেবল মুক্তি। এই  সন্তান হন্তারক কুমির দম্পতিকে আপাতত  এমন একটি ঘরে বন্দী রাখা হোক যে ঘরে ক্যামেলিয়ার বিভিন্ন বয়সের ছবি দিয়ে দেয়াল ভরে দেয়া হবে এবং প্রতিদিন তাদের ক্যামেলিয়ার  স্কুল এবং কলেজ এক্টিভিটির বিভিন্ন ভিডিও দেখানো হবে।  ক্যামেলিয়ার স্কুলে একটা বড় আকারের প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হোক আর ক্যামেলিয়ার মৃত্যু দিবসকে  ক্যামেলিয়া ডে হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করছি। সেদিন সবাই ধর্মের নামে মানুষ হত্যা না করার শপথ নেবে। এরপর বিচারক কোর্ট মুলতবি করে বলেন, রায় এরপরের কার্যদিবসে ঘোষণা করা হবে।

পৃথিবীর সমস্ত আদ্র হৃদয় ভাবছে এই খুনের কী বিচার হতে পারে? এর যথাযোগ্য শাস্তি আসলে কী!
নুরানি চেহারার নেকড়ে দম্পতির চোখের মনিতে গেঁথে যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

তবু মাফ করো না, মা

আশরাফ উল আলম শিকদার-এর তিনটি কবিতা তবু মাফ করো না, মা গলি শেষের দোতলা বাড়িটায় আমি থাকি, সস্ত্রীক আমার পরিবারের

ভ্রমণ ডায়েরি

সাগরের স্বর্গোদ্যান সাইপ্রাস

জাতিসংঘের কাজে নিয়োজিত থাকাকালে ২০১০ সালে আমার সাইপ্রাসে যাবার সৌভাগ্য হয়। একবার নয়, কয়েকবার। প্রত্যেকবারই কমপক্ষে সাতদিন অবস্থান। জাতিসংঘের গাড়ি

গল্প

একটা আষাঢ়ে গল্প

দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ। সেখানে কেবল তাসের সাহেব, তাসের বিবি টেক্কা এবং গোলামের বাস। দুরি তিরি হইতে নহলা দহলা

কবিতা

যে-কথা বলিতে চাই

যে-কথা বলিতে চাই,          বলা হয় নাই,              সে কেবল এই– চিরদিবসের