পোস্টমর্টেম

শীতের সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। চারদিকে গাঢ় কুয়াশা নেমেছে। মৃতদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামতেই চারদিক থেকে অসংখ্য প্রশ্ন আসতে থাকে– হাসপাতাল থেকে একটা লাশ নিয়ে আসতে এত সময় লাগে! মারা গেছে সেই গতরাতে। এখন তো লাশে পচন ধরার কথা! শীতকাল বলে রক্ষা।

কেউ বলে– আগেই বলছিলাম না ওদের দিয়ে এসব কাজ হবেনা! তোমরা শুনলেনা!

লকডাউনের মধ্যে হাজার বাধা ঠেলে একটা প্রাইভেট কার যোগাড় করেছি। গতরাতটা গাড়িতে নির্ঘুম কেটেছে। আর গাড়ি ছাড়ার পর থেকে চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে জল ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি। সাথে হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ বের করে আনতে নানান ঝক্কি-ঝামেলায় মনটা এমনিই বিগড়ে ছিল। তার উপর আবার অভিজিতের বাবার মৃত্যুতে গ্রামের উঠতি মোড়লদের এইসব বাঁকা-ত্যারা কথায় অবসাদে শরীর ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। কোন কথা না বলে ঘরে ঢোকে কমল। হয়তো দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকতে চেয়েছিল। তার ঘরের মধ্যে আমাকে দেখতে পাবে এমনটা বোধহয় আশা করেনি। তাই আমাকে দেখে তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। নিজে থেকেই বলতে শুরু করে–

শুনলে তো গাঁয়ের মানুষের কথা! এবার আমার কথা শোনো! –

দিনের আলো একটু করে ফুটে উঠলেও রাতের ঘোর তখনও কাটেনি। কুয়াশায় ভরে আছে সকালটা। শীতের সারাটারাত জার্নি করে আমরা দু’জনেই শ্রান্ত-ক্লান্ত। কিন্তু হাসপাতালে এসে নিজেদের ক্লান্তির কথা আর মনে থাকেনা। রিক্সা থেকে নেমে হন্যে হয়ে ডোমের রুমটা খুঁজতে থাকি।

সদর গেটের ঠিক সামনেই ছোট্ট একটা ঘুপ্সি ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলা দিতেই লোকটা বিছানা ছেড়ে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায়। একমাত্র জরাজীর্ণ চেয়ারটা টেনে বলে– বসেন স্যার। আমি আপনাগো জন্যেই অপেক্ষা করচি।

দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া নিকটাত্মীয়ের মৃতদেহ নিতে আসা শোকাহত, উদ্বিগ্ন চোখে হাসিটা বড্ড বেমানান লাগে। আর বসতে মন চাইলনা এই ভেবে– প্রতিদিন মর্গে অসংখ্য মৃতদেহের সাথে সময় কাটিয়ে এই চেয়ারে আলমগীর রোজ এসে বসে। বিড়িতে সুখটান দেয়।

বললাম, বসে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। মৃতদেহ নিয়ে আমাদের অনেক দূরের পথ যেতে হবে। শীতের বেলা তো এমনিতেই ছোট! আমরা যাতে দিনের আলো থাকতে মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটুকু করতে পারি আপনি সেই ব্যবস্থা করে দিন।

সব হবে। আপনি আমার সাথে আসেন– বলে বাইরে পা বাড়ায়। কয়েক পা হেঁটেই হাতটা বাড়িয়ে দেয়– দুই হাজার ট্যাকা দেন। লাশের পোসমডেম করতে হবে।

– আমরা তো পোস্টমর্টেম করাব না!

– তা ক্যামনে হবে! পুলিশ কেস যে! এর নিয়মই হইচে পোসমডেম।

– রাতের বেলা কোন্ মদ্যপ সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষটির গায়ে গাড়ি তুলে দিয়েছে আমরা তো জানিই না! তাই কারো নামে অভিযোগ করারও উপায় নেই। তাহলে পোস্টমর্টেম করিয়ে কি হবে?

– পোসমডেম না করালে কিন্তু ট্যাকা আরও বেশি লাগবে, চিন্তা কইরা দেহেন।

বিস্ময়ে আমার কথা হারিয়ে যায়– লোকটা বলে কি! মর্গে মৃতদেহ রেখে এ কী নিয়মের অত্যাচার! আমাদের দেশে তাহলে এত্ত নিয়ম-কানুন আছে! নাকি জীবিতদের জন্য আইনের তেমন কোন বালাই না থাকলেও মৃতের জন্য নিয়ম-কানুনের বাড়াবাড়ি আছে! কিন্তু আমরা তো তখন অসহায়! তাই সুর নরম করে বলি– দেখুন, এমনিতেই মৃত লোকটা মারা যাবার আগের মুহুর্তগুলোয় কষ্ট-যন্ত্রণার শেষ ছিলনা। এখন মরার পরও যদি শরীরটাকে কাটা-ছেঁড়া করা হয় তার স্বজনদের কাছে সেটা সহ্য হবে না। বিকল্প কি আছে সেটা বলুন।

– বিকল্প আচে। কিন্তু ঝামেলা বেশি হবে। আচ্ছা, পাঁচ হাজার ট্যাকা দেন আর আপনে এইখানে দাঁড়ান। আমি দেখচি কি করা যায়।

আমাদের দুঃসময় বিবেচনা করে টাকার পরিমাণ দুই থেকে একলাফে পাঁচে দাঁড়ায়! জানি, প্রতিবাদ করলে আমাদেরই দুর্ভোগ বাড়বে। এটাই এখন আমাদের কালচার হয়ে উঠেছে। ঠেকিয়ে যা কিছু কেড়ে নেওয়া যায়। অভিজ্ঞ লোকটার উপস্থিত দুর্বুদ্ধি দেখে বিস্ময়ও হার মানে! আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে টাকাটা তার হাতে দিয়ে দিই।

কিছুক্ষণ পরে আলমগীর হাসিমুখে একটা কাগজ হাতে বেড়িয়ে এসে বলে– স্যারে রাজি হইচে। এই কাগজটায় মৃতের ছেলের একটা সই লাগবে আর জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করতে হবে। সমেস্যা নাই, পাঁচশ’ ট্যাকা দিলে স্যারেই সব ঠিক করে দেবে।

– কি লিখতে হবে বলুন। আমি লিখে দিচ্ছি। স্যারের ঠিক করা লাগবেনা।

আলমগীরের দৃষ্টি খানিকটা রুক্ষ হয়ে ওঠে। নিরস গলায় বলে– আপনে এসব বোঝবেন না। স্যারেই করুক।

অগত্যা তার হাতে আবার পাঁচশ’ টাকা দিয়ে অভিকে ডেকে নিয়ে আসি। আমাদের নিয়ে আলমগীর এবার যে ঘরটায় ঢোকে সেটাকে ঘর না বলে মাল-গুদাম বলা ভাল। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বাক্স-প্যাটরা, কার্টন বক্স রাখা। তার মাঝে কোনমতে একটা চেয়ার পেতে একজন লোক বসা। মাথা নিচু করে একমনে কিছু লিখে চলছে। আমরা তিনজন মানুষ ঢুকলাম। কিন্তু তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই!

লোকটার ঔদাসীন্য দেখে যেমন বিস্ময় লাগে তেমনি সরকারি হাসপাতালের এই ঘরটাকে দেখে– এই আমাদের রোগমুক্তির ভরসাস্থল!

লোকটার লেখা শেষ হতেই কাগজটা আমাদের সামনে বাড়িয়ে ধরে বলে– এখানে সই করুন। অভিজিতের সই করা হলে আলমগীর দু’শো টাকা তার হাতে দিয়ে বলে– স্যার, পার্টি গরিব। এর বেশি কোনমতেই রাজি করাতে পারলাম না।

আমাদের পোশাক-আশাক দেখে আলমগীরের কথায় সে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ততক্ষণ আলমগীর অভিজিতের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে বলে– এরা অইল অবিচার মানুষ। যতই ট্যাকা দেবেন মন ভরবে না। আমরা ছোডখাড চাকরি করি, পাইলে আমরা দুই পয়সা খাই! তোগো তো সরকার এত দে, এরপরও খাওয়া লাগে?

অভিজিত কথার মানে না বুঝে আলমগীরের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে।

হাসপাতালের বাইরে এসে আলমগীর অনেকটা আদেশের সুরে বলে– একটা টেস্কি ডাকেন।

– কেন? রিক্শায় চলুন! আমরা দূরে তো কোথাও যাচ্ছিনা! ট্যাক্সির দরকার কি?

যদিও আমার মনেই খুঁতখুঁতানি ছিল– আমার আত্মীয়ের মত অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ এই লোকটার হাতে মর্গে ঢোকে-বের হয়। তার সাথে এক রিক্শায় যাওয়া……..। তবুও রিক্শায় যাবার প্রস্তাব করি।

কিন্তু আলমগীর আমাকে চম্কে দিয়ে বলে– এখন এই করোনার সময় দশজনের চলা রিশ্কায় আমি যাইতে পারমুনা। হয় টেস্কি করেন না হয় আপনে একলা যান।

এমন পরিস্থিতিতে জীবনে এই প্রথম। কোথায় যেতে হবে, কি করতে হবে কিছুই জানিনা। আলমগীরের দিকে চেয়ে দেখি তার মুখে পেশাদারী একটা কৃত্রিম কাঠিন্য মাখানো। অগত্যা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ি।

ছাব্বিশে মার্চের জাতীয় প্রোগ্রামে অংশ নিতে জেলা প্রশাসক সবেমাত্র বেড়িয়েছেন। আমাদের দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে পড়েন। আলমগীর ছুটে এসে আবেদনপত্রের কাগজটা তার সামনে ধরতেই আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন– মৃত ব্যক্তি আপনার কে হয়?

– আমার মামা। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

– আপনাদের কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই তো?

– না।

– আচ্ছা। আমি স্বাক্ষর করে দিচ্ছি। আপনি একটিবার থানায় যান। মৃতদেহের বর্ণনা, মারা যাবার কারণসহ কিছু তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব ওদের আছে।

সাক্ষর হয়ে গেলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন– কাউকে টাকা দিয়েছেন নাকি?

আড়চোখে আলমগীরের দিকে চেয়ে দেখি– সে বাইরে চেয়ে আছে। আমি কী করে বলবো যে সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটিকেই ইতিমধ্যে দুই দুইবার ঘুষ দিতে হয়েছে! আমি সসঙ্কোচে বলি– না।

– করো সাথে কোন প্রকার টাকা-পয়সার লেনদেন করবেন না। তেমন হলে আমাকে জানাবেন।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত ট্যাক্সির কাছে আসি। যদিও জেলা প্রশাসক একটি নিতান্ত সাধারণ কথা বলেছেন। আমি এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে ন্যূনতম প্রাপ্তিটাই আমি ভোগ করতে চাইছি। কিন্তু তাতেই নাভিশ্বাস উঠে গেছে। একজন মানুষ, কিছুক্ষণ আগেও যে কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে বেঁচে ছিল মারা যাবার পর তার মৃতদেহ জিম্মি করে কি নিষ্ঠুর আচরণ করে চলছে এই মানুষগুলো! কিন্তু আমি প্রতিবাদ করতে পারছিনা! তাহলে আমাকে পদে পদে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। জেলা প্রশাসক অন্ততঃ আমার কাছে কোন অন্যায় দাবী করেননি! এইটুকুতেই আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও খুশি হই।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামতেই চিন্তার জাল ছিন্ন হয়– সামনেই পুলিশ স্টেশন। আলমগীর নেমে বলে– গাড়ি বিদায় দিয়ে আমার সাথে আসেন। সে দ্রুত থানার ভিতর ঢুকে পড়ে।

আমি রিসেপ্শানে বসে এদিক সেদিক চোখ বোলাতে থাকি। আলমগীর আবার কোন্ ঘরে লুকালো!

দুই তরুণী পুলিশ রিসেপ্শানে বসা। একজন মাথা নিচু করে কি যেন লিখছে অন্যজন সেলফোনে কারো সাথে কথা বলছে। আমার উপস্থিতি তারা টের পেয়েছে বলে মনে হলনা। মনে মনে– আমি কি কাঁচ অথবা বাতাসের মত স্বচ্ছ হয়ে গেলাম! নইলে জলজ্যান্ত একজন মানুষ চোখের সামনে বসা থাকলে অন্ততঃ একবার দৃষ্টি বিনিময় তো হবার কথা! মিনিট বিশেক পরে কথা বলা শেষ করে কর্তব্যরত মহিলা পুলিশ আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে– কি জন্য এসেছেন?

আলমগীরের কথা বলতে সে অন্যমনস্কভাবে উঠে একবার ভিতরে যায়। কিছুক্ষণ পরে এসে বলে– আলমগীর তো চলে গেছে!

– সে কী! কোন্ পথে গেল! আমায় কিছু জানায়নি তো!

–এই ফোন নাম্বারটা রাখুন। ঘন্টাখানেক পর এই নাম্বারে একটা ফোন দিয়ে জেনে নিবেন উনি কখন যাবেন।

আবার আমি খুশি হই– এখানে কেউ টাকা চায়নি। মনেহয় আমার আত্মীয়ের মৃত্যুতে এরা আমার সাথে কিছুটা হলেও সমব্যথী।

যখন পুনরায় হাসপাতালে পৌঁছাই বেলা ততক্ষণে দুপুর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি– এগরোটা বাজে। মৃতদেহ নিয়ে যথাসময়ে পৌঁছানো যাবে বোধহয়।

ঘন্টাখানেক সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনায় আহত হবার পর থেকে যারা রোগীর সাথে কাল থেকে না খেয়ে আছে তাদের খাবার ব্যবস্থা করি। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করি। ততক্ষণে পুলিশ স্টেশন থেকে কেউ আসেনা। হাসপাতালের করিডোরে বিমর্ষ মনে পায়চারি করতে থাকি। হঠাৎ আলমগীর এসে হাজির– এখনও থানা থিক্যা কেউ আসেনাই?

– কই না তো!

– ফোন করেন। আজ শুক্কুরবার। একটু বাদে তো নামাজে যাবে! তখন কি আর আসপে?

অগত্যা থানা থেকে দেয়া নাম্বারে ফোন করি। ওপাশ থেকে ভারী গলায় কেউ বলে– আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। নামাজ পড়ে ফেরার পথে যাব।

ঘড়িতে তখন সোয়া বারোটা। হিসেব করে দেখলাম নামাজের পর তার আসতে অন্ততঃ দুটো পার হবে। তার মানে আমাদের যেতে রাত হয়ে যাবে। আলমগীরের দিকে চেয়ে হতাশ গলায় বলি– সে নামাজের পর আসবে।

আলমগীর পকেট থেকে সেল ফোন বের করে রিং করতে করতে বলে– কিভাবে কইতে হয় আপনারা তা জানেন না। ঠিকমত কইলে আবার আসপে না কেন?

ওপাশে রিসিভ করতেই আমার দিকে চোখ দিয়ে একটা ইঙ্গিত করে বলে– ছার, পার্টি অনেক দূরের। তাদের দেরি হইয়া যাবে। আপনে একটা কাজ করেন– একটা মোটর ছাইকেল নিয়া টান দেন। তেলের পয়সার ব্যবস্থা এরা করে দেবে।

ফোনটা বুক পকেটে রেখে একটা ক্ষয়ে যাওয়া ময়লা দাঁত বের করে কুৎসিত হাসি ছুঁড়ে দেয়। বলে– আর চিন্তা নাই। আপনেরা সব ব্যবস্থা করেন।

আজ মর্গে ঢুকেই মামার লাশের পাশে একটা বেওয়ারিশ বিকৃত লাশ দেখেছিলাম। মেঝেয় চিৎ করে হাত-পা ছড়িয়ে ফেলে রাখা। আলমগীরের মুখটা যেন হঠাৎ সেই লাশের মুখের মত ভয়ঙ্কর লাগে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দারোগা সাহেব হাজির। আমাকে দেখে একটা অমায়িক হাসি উপহার দিয়ে বলে– আপনাদের দুরাবস্থার কথা চিন্তা করে আগেই চলে এলাম।

আমার হাসি আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। নইলে এমন একটা মহানুভব কথায় একটু হেসে ফেলা উচিৎ ছিল! কিন্তু চেষ্টা করেও পারলামনা।

দারোগা সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মৃতদেহের বিবরণ লিখে রেখে আমাদের সাক্ষর নেয়। বিনয়ের সাথে বলে– আপনারা আবার কেসটেস করতে যাইয়েননা। তাহলে কিন্তু আমার বিপদ। পোস্টমর্টেম না করে লাশ রিলিজ দিচ্ছি এটা বেআইনি।

– কেন, আমাদের কাছে জেলা প্রশাসকের অনুমতি আছে তো!

– সময়কালে তারে পাবেন? তার আগেই তো খবর হইয়া যাবে! নেন তাড়াতাড়ি আমারে বিদায় দেন।

আলমগীর আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে বলে– ছারেরে পাঁচশ’ দেন আর আমারে পাঁচশ’।

ধৈর্য বোধহয় আর অবশিষ্ট ছিলনা। রেগে গিয়ে বলি– এক টাকাও দিতে পারবনা। আপনি পোস্টমর্টেম করুন। পোস্টমর্টেম ঠেকাতে গিয়ে বেলা বিকেল হয়ে এল! পকেট ফাঁকা হয়ে গেল! এখন পর্যন্ত মৃতদেহ নিতে পারলামনা। বাড়ি থেকে ফোনের পর ফোন আসছে!

দারোগা সাহেব আমার কন্ঠস্বর টের পেয়ে দ্রুতপায়ে কাছে এসে বলে– কি হয়েছে আলমগীর?

আলমগীর একটু হেসে বলে– ছার আপনারে তেলের পয়সা দিতে বলছিলাম। আর এই করোনার সময় লাশ দেখলে মানুষ সন্দেহ করে। তাই ভাবছিলাম লাশটা একটা ব্যাগে মুড়িয়ে গাড়িতে তুইল্যা দিই। তাতেই উনি রাগ করলেন।

রেগে গিয়ে ভুল করে ফেললাম বোধহয়। এটা তো এখনকার নিয়ম! আমার স্বজন মারা গেছে! তাই বলে এরা উপড়ি পাওনাটা ছেড়ে দেবে! পাঁচশ’ টাকার একটা নোট বের করে হাসপাতালের মর্গের সামনে লোকের দৃষ্টির মধ্যে দারোগার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। সে অবলীলায় নোটটা হাতে নিয়ে আমাকে বিদায় জানিয়ে ঘোঁৎ করে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দেয়।

আলমগীর সুর নরম করে তোষামোদী স্বরে বলে– আমরাও তো আপনার মত মানুষের অপেক্ষায় থাকি ছার! দুই পয়সা না দেলে খামু কি?

– তোমার বাপু খাই বড্ড বেশি! লাশ নিয়ে থাকতে থাকতে তুমি বোধহয় জীবিত মানুষের দুঃখ-কষ্ট এখন বুঝতে পারনা। বিরক্তির শেষ ধাপে পৌঁছে দু’শো টাকা তার হাতে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চড়ি।

এবার বলুন, আমি আর কি করতে পারতাম?

– তোমার কেন, এই দুঃসময়ে কারোরই বোধহয় কিছু করার নেই। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র এত নিষ্ঠুর মানসিকতা লালন-পালন করে যে মর্গে লাশ আটকে রেখেও নির্লজ্জভাবে সবাই ঘুষ খায়। কেউ নিয়মের ভয় দেখিয়ে সিংহের মত খায়, কেউ নিয়মের দোহাই দিয়ে শৃগালের মত চাতুরী করে খায়। আত্মীয়ের মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের হাতে থেকে রক্ষা করতে তুমি যে আদর্শহীনতার, যে আকাশচুম্বী লোভ-লালসার পোস্টমর্টেম করে দেখালে তাতে তো মরণের কথা ভাবতেও ভয় লাগছে! পাছে আমার শরীরটা নিয়েও লোভী জীবগুলো এমনি টানাহেঁচড়া করে! মরণটা যেন হাসপাতালে না গিয়ে স্বাভাবিকভাবে হয়! এখন চলো, এখানে আর বসে থাকার সময় নেই। ওরা মৃতদেহ সৎকারের জন্য ওই বোধহয় চলল!

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
বই

হ্যামলেট: ডেনমার্ক যুবরাজের ট্র্যাজেডি

কাম পশুস্তরের সেই আদিম খোলস, যা মানুষকে করে তাড়িত, বীতশ্রদ্ধ, বিক্ষুব্ধ, বিভ্রান্ত, দুর্নিবার। শরীরে প্রবাহিত রক্তে কামুক নগ্ন উল্লাসের উত্তপ্ত

কবিতা

বাড়ি

একদিন সেনগুপ্ত দিদি বলছিলেন, আমার ফ্ল্যাটের এই ব্যালকনিটা আমার খুব প্রিয় জায়গা। সকালে ঘুম থেকে উঠে এখানটায় এসে বসি, বুলবুলির

গল্প

সাতমার পালোয়ান

এক রাজার দেশে এক কুমার ছিল, তার নাম ছিল কানাই। কানাই কিছু একটা গড়িতে গেলেই তাহা বাঁকা হইয়া যাইত, কাজেই