হ্যামলেট: ডেনমার্ক যুবরাজের ট্র্যাজেডি

কাম পশুস্তরের সেই আদিম খোলস, যা মানুষকে করে তাড়িত, বীতশ্রদ্ধ, বিক্ষুব্ধ, বিভ্রান্ত, দুর্নিবার। শরীরে প্রবাহিত রক্তে কামুক নগ্ন উল্লাসের উত্তপ্ত সঞ্চারণ কখনো কখনো যৌক্তিক, বৌদ্ধিক, মন, মননশীলতাকেও হার মানায়। এ ব্যাপারে ইতিহাস, মিথ, উপকথা, ধর্মীয় উপাচার থেকে অজস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে। কিন্তু প্রসঙ্গ সেদিকে ধাবিত না করে, বরং সর্বজনবিদিত অনন্য অনবদ্য নাটক হ্যামলেটের দিকে করা যাক— যেখানে পরিলক্ষিত হয় দেশ, কাল, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতাকে অতিক্রম করার এক অদম্য শক্তি; যা দেখে মহান রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বিশ্বচিত্ত উদ্ভাসিয়া’। এর স্রষ্টাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার বললেও অত্যুক্তি হবে না, যদিও তার প্রাক জীবন সম্বন্ধে জানা যায় খুবই পরিমিত। তিনি হলেন নাট্য অঙ্গনের মহান সম্রাট, অনন্য অনুপম কাব্য প্রণেতা, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। বর্তমানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক সেই সফল পরিব্রাজক, অমর নাট্যকার রচিত এলিজাবেথিয় সময়ের জনপ্রিয় কালজয়ী ‘হ্যামলেট’ নাটকের দিকে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়, নাটকটি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বহন করে প্রাথমিক আলোচনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা।

Hamlet Book Cover

হ্যামলেটের পিতৃঘাতক, মায়ের সঙ্গে প্রণয় উল্লাসে মত্ত হ্যামলেটের পিতৃব্য অর্থাৎ চাচা ক্লডিয়াস। মূলত কামের স্বতঃস্ফূর্ত বিচ্ছুরণ ও ক্ষমতালিপ্সু মন হ্যামলেটের পিতৃহত্যার নেপথ্যে যুগিয়েছে রসদ।

হ্যামলেটের মৃত পিতা প্রেতাত্মা হয়ে এসে হ্যামলেটকে হে মহান যুবা বলে সম্বোধন করে বলে,

‘জেনে রাখো, যে-সাপের কামড়ে তোমার পিতা প্রাণ/ হারিয়েছে, বর্তমানে সেই কালনাগ পরেছে মাথায় তার আমারই মুকুট।’

তখন অবাক বিস্মিত হয়ে হ্যামলেট বলে,

‘হে আমার ভবিষ্যৎদ্রষ্টা আত্মা। আমার পিতৃব্য!’

পুনরায় প্রেতাত্মার জবাব শোনা যায়,

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই অত্যাচারী দুর্বৃত্ত কামুক, পশু তার/ কুবুদ্ধির মোহকরী ছলাকলা আর প্রতারক/ গুণপনা দিয়ে পুণ্যবতী রানীকে আমার/ করেছে শিকার তার কামনার। নির্বিঘ্ন প্রহরে সেই/ যখন ছিলাম মগ্ন ঘুমে, তোমার পিতৃব্য ঠিক/ চোরের মতন এসে ঘুমন্ত আমার কানে শিশি/ থেকে হেবোনার রস দিলো ঢেলে, যার বিষক্রিয়া/ এমন শত্রুতা করে মানুষের শোণিতের সঙ্গে/ যে নিমেষে কুষ্ঠ বিষ পারদের মতো অতি দ্রুত/ শরীরের অলিগলি জুড়ে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে। যদি শিরায় রক্তের টান অনুভব করো, তবে তুমি/ কখনো করো না সহ্য এই অনাচার/ আর ডেনমার্কের পবিত্র রাজশয্যাকে দিও না হতে/ অজাচার আর অবৈধ প্রেমের লীলাভূমি।’

হ্যামলেটের পিতার প্রেতাত্মা প্রতিশোধের অনল হ্যামলেটের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত করার ফলশ্রুতিতে, হ্যামলেট হয়ে ওঠে যৌক্তিক উন্মাদ, বিষাদাক্রান্ত প্রতিশোধপরায়ণ। এক বহিঃস্থ এবং পরবর্তীতে নিস্পৃহ অন্তর্দ্বন্দ্বে পর্যবসিত হয় হ্যামলেট। পিতার প্রেতাত্মার কথাবার্তা প্রমাণ করার জন্য নাটকের ভেতর নতুন নাটকীয়তার জন্ম দিয়ে ক্লডিয়াসের মানসিক অভিপ্রায়কে পর্যালোচনা করে সঠিক সত্যে উপনীত হয়। যদিও ওফেলিয়ার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ দৃষ্টিগোচর হয় নাটকের দৃশ্যের পরতে পরতে, কিন্তু এটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য যে, ওফেলিয়া ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটের প্রেয়সী, ধ্রুবতারা, কবিতা, স্বপ্ন, প্রেম এবং ভালোবাসা। মায়ের সঙ্গে সংলাপ বিনিময়ের কোনো এক পর্যায়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রিয়তমা ওফেলিয়ার বাবা পলোনিয়াসকে নিজের অজ্ঞাতসারে ছুরিকাঘাত করে হ্যামলেট এবং বাদানুবাদের কোনো এক পর্যায়ে হ্যামলেট রানীকে বলে,

‘তুমি ব্যাভিচারে/ স্বেদাক্ত পঙ্কিল বিছানায়, নষ্টামিতে টগবগে/ শুয়োরের কদর্য খোঁয়াড়ে মেতে থাকো সুমধুর/ প্রিয় সম্ভাষণে আর ক্লেদাক্ত সঙ্গমে।’

প্রত্যুত্তরে রানী বলেন,

‘বলিস না/ আর, তোর এই কথা শোণিত ছোরার মতো এসে/ বিঁধছে আমার কানে। প্রিয় হ্যামলেট, বলিস না/ কিছু আর, হে বাছা আমার।’

হ্যামলেট পিতার শোকে, মায়ের বিবাহের হঠকারী সিদ্ধান্তে পর্যুদস্ত হয়ে বলে,

‘খুনি আর দুরাচার/ ক্রীতদাস যোগ্যতায় যে তোমার প্রাক্তন স্বামীর/ দুই শতাংশও নয়; রাজা নামের কলঙ্ক এক/ সাক্ষাত পকেটমার, রাজ্য ও শাসনভার দুই-ই/ দামী মুকুটের মতো চুরি করে রেখেছে পকেটে।’

Hamlet at theater, Image Source: rsc.org.uk

পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে জীবনের এক নিষ্ঠুর, চরম, ধ্রুব সত্য মৃত্যুর তীব্রতর নগ্নতাকে চোখের সামনে মেলে ধরেন নাট্যকার— মৃত্যুর করাল ছোবল থেকে অব্যাহতি নেই কারোর। মৃত্যুর ছোঁয়ায় রূপ, সৌন্দর্য, খ্যাতি নিমেষেই মাটির সংস্পর্শে এসে কংকালসার দেহে রূপান্তরিত হয়ে ধুলোতে বিলীন হয়ে যায়। সমগ্র মহাবিশ্বে অনাদি অনন্ত সময়ের ভেতর ‘এক’ বলতে যে সময় লাগে, তার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য আমাদের বেঁচে থাকা। সমগ্র নাটকের মধ্যে এই দৃশ্যে ‘কবর খোড়ার গান’ আলাদা স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে পাঠকের চেতনায় এবং এই দৃশ্যটি জীবন ভাবনায় ঘটায় নতুন উন্মেষ। পলোনিয়াসের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে হ্যামলেটকে ডেনমার্ক থেকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে মৃত্যুর এক নীল নকশা আঁকেন ক্লডিয়াস। কিন্তু হ্যামলেট সুকৌশলে সে পথে পা না বাড়িয়ে ফিরে আসেন তার নিজ বাসভূমে এবং এক করুণ দৃশ্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন, পিতার মৃত্যুর শোক সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ওফেলিয়া, আর রানী বকছে বিলাপ,

‘আমার আশা ছিল তুমি হবে/ আমার হ্যামলেটের বধূ: মধুর কুমারী, ভেবে/ ছিলাম তোমার এই কবরের উপর ফুল না/ ছড়িয়ে তোমার আলোকিত বাসরের ফুলশয্যা/ সাজাবো সযত্নে আমি।’

ওফেলিয়ার ভ্রাতা লেয়ারটিসের প্রলাপ বিলাপ দেখে হঠাৎ হ্যামলেট আবেগাপ্লুত হয়ে বলে,

‘ওফেলিয়াকে ভালোবাসতাম আমি। চল্লিশ হাজার/ সহোদর তাদের সমস্ত ভালবাসা নিয়েও তো/ সমতুল্য হবে না আমার।’

লেয়ারটিসের ক্ষোভ ও ক্রোধ ক্রমশ বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়তে হ্যামলেটের সঙ্গে অসিক্রীড়ার আয়োজন করা হয়, কিন্তু পুনরায় নতুন ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে চলতে থাকে এক রক্তক্ষয়ী উন্মাদনা। অসিক্রীড়ার কোনো এক পর্যায়ে হ্যামলেট জিজ্ঞেস করে রানীকে, ‘কেমন আছেন রানী?’ রাজা বলেন, ‘রক্ত দেখে বেহুঁশ হচ্ছেন।’ প্রত্যুত্তরে রানী বলেন, না, না, ঐ সুরা ‘ও আমার প্রিয় হ্যামলেট, ঐ সুরা, ওতে বিষ, আমি বিষ পান করেছিরে।’ পানপাত্রে  ষড়যন্ত্রের নকশায় রানীর বিষপান, লেয়ারটিসের  তীক্ষ্ণ ও বিষাক্ত তরবারীর সাথে হ্যামলেটের রদবদলে তরবারীর আঘাতে লেয়ারতিস বলে,

‘এইতো এখানে, হ্যামলেট। তুমিও নিহত হতে/ যাচ্ছো হ্যামলেট, দুনিয়ার কোনো ভেষজবিদ্যার/ সাধ্য নেই তোমাকে বাঁচায়/ তোমার মাকেও বিষ দেয়া হয়েছে, আমি তো আর/ পারছি না। এই রাজা, এই রাজাই এজন্যে দায়ী।’

বিশ্বাসঘাতকতার এই পর্যায়ে হ্যামলেটের ছুরিকাঘাতে রাজার জীবনাবসান, লেয়ারতেস বলে,

‘সমুচিত/ শাস্তি হলো ওর, এ জহর সে নিজেই মিশিয়েছে/ আসুন আমরা পরস্পর ক্ষমা-বিনিময় করি হে মহান/ হ্যামলেট। আমার মৃত্যুর জন্যে এবং আমার জনকের/ মৃত্যুর দরুন তুমি দায়ী নও, যেমন আমিও/ নই দায়ী তোমার মৃত্যুর জন্যে।’

হ্যামলেটের মৃত্যুতে সমস্ত পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা হ্যামলেটের বন্ধু হোরেশিও বলেন,

‘একটি মহৎ প্রাণ দীর্ণ হলো। বিদায়, হে প্রিয় যুবরাজ/ উড়ন্ত দেবদূতের গান তোমাকে পাড়াক ঘুম।’

অনুবাদ সাহিত্যের অন্যতম একটি মাধ্যম। হুমায়ুন আজাদের দেয়া ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ উপাধিতে ভূষিত শামসুর রাহমানের ‘হ্যামলেট’ নাটকের অনুবাদ অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং সুখপাঠ্য, তবে আমার অজ্ঞাতে আরও ভালো কোনো অনুবাদ থেকে যেতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন সম্বন্ধে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কথা বললেও, আশা রাখি ইংরেজি ভাষা যে আমাদের উপমহাদেশের আশীর্বাদস্বরূপ, এ বিষয়ে কেউ বিন্দুমাত্র দ্বিরুক্তি করবেন না। কাজেই মূল ইংরেজি ভাষায় শেক্সপিয়ার নাটকের স্বাদ নেয়া কষ্টসাধ্য হলেও, অসাধ্য নয় এবং আমাদের চেষ্টা সেদিকে ধাবিত হওয়ার পেছনে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে হয় না, বরং আমাদের প্রয়োজন কিছুটা উদ্যম ও সাহস। পরিশেষে বলবো, ‘হ্যামলেট’ একটি রিভেঞ্জ ট্র্যাজেডি এবং নাটকের সংলাপের ভেতর থেকে অতিদূর তারকার মৃদু আলো এসে কখনো কখনো আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করে। দেশ, কাল, স্থানের ব্যবধান অতিক্রম করে মানস জগতে যোগসূত্র স্থাপন করে কালজয়ী এই নাটক এবং এখানেই শেক্সপিয়ারের মস্ত বড় জিৎ।

(সংলাপ ব্যবহারে শামসুর রাহমানের অনুবাদ অনুসৃত হয়েছে)

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

অবসরের গান

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে

কবিতা

কী চাহ আমার দেশ!

কী চাহ আমার দেশ! এটা রমনীকান্তের ভিটে বাড়ি। অবাঞ্ছিত ঘাসে ভরেছে উঠোন ঠাকুর ঘরে শাপ আর শামুক খেলা করে বড়

গল্প

বিসর্জন

– হ্যাঁ, এটাই। বামে নামিয়ে দিন। রিকশাটা থামার আগে তার থেকে যেনো লাফিয়ে নামলো অল্পবয়স্ক একটি মেয়ে। চোখে ঝড়ের কবলে

অনুবাদ

অর্ধেক দিনেই

অর্ধেক দিনেই লেখক: নাগিব মাহফুজ অনুবাদক: সৌমিত্র চৌধুরী  বাবার ডান হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। মাঝে মাঝে বাবার লম্বা পায়ের সাথে