পরিস্থিতি নাজুক: লাল পতাকা উড়ছে

মোরশেদ আলমের নাম আপনারা না শুনে থাকলে সেটা অপরাধের পর্যায়ে পড়বে না। কারণ মোরশেদ নামে বিখ্যাত ব্যক্তি, সিআইপি, ভিআইপি থাকলেও এই গল্পের সমনামের লোকটির অবস্থান কখনোই কারো চোখে বিশেষভাবে পড়েনি। ফলে মোরশেদ নামের অনেক শাখা থাকলেও আমাদের গল্পের নায়ক মোরশেদের কোথাও কোন শাখা দূরে থাক ঢালপালাও নেই। এমনকি তার অফিসের, মানে যেখানকার চাকর মোরশেদ, ভদ্রভাবে বললে, যেখানে চাকরি করে সে মাসশেষে মাইনে পায় সেখানেও তার বিশেষ কোন শান-শওকত নেই। দশজনের ভেতর সে থাকে গুটিয়ে, চুপচাপ। কথা বললে মোরশেদ বড়জোর পাশের ডেস্কের সাদেক ভাই শুনতে পাবে। গল্পটা মোরশেদের শব্দ-ক্ষমতা কি অফিস-ক্ষমতা নিয়ে নয়। পাঠকদের মধ্যে যারা আছেন বিবাহিত, যাদের ঘরে আছে স্ত্রী আর দুই সন্তান তাদের জন্যই গল্পটা। বয়সে যারা কম অথবা বয়সকে যারা লুকিয়ে চলে লোকচক্ষুর সামনে তাদের কাছে গল্পটা অশ্লীল তকমাও পেতে পারে। অবশ্য নানাবিধ হাবিজাবি মন্তব্য করতে চাইলে শেষতক পড়তে হবে, সময় নিয়ে বসতে হবে আর নিজের ভেতর বেখেয়ালে হলেও মোরশেদকে জাগাতে হবে; পারতপক্ষে তার সাথে হাঁটাতে হবে নিজেদের।

বিষ্যুদবারকে অফিসের কলিগেরা বলে বউবার, মোরশেদের কাছে আরো বেশি। গত আড়াই বছরে এই শাখার কোন কলিগ মোরশেদকে খুব বেশি শুক্রবার হারাধন উপজেলায় দেখেছে সেটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না। সারাদিন যত ব্যস্ততাই থাকুক, বিকেলে, বলতে গেলে আছরের নামাজ শেষে সে আর ডেস্কে বসে না। বসের চেয়ারের অদূরে গিয়ে বড় একটা সালাম টুকে বেরিয়ে পড়ে মোরশেদ। বস জানেন, মোরশেদকে কোন তরিকায় আজ আটকানো যাবে না। সালামের জবাব বস দিয়েছেন কি না সেটা শোনার সময় নেই তার। আল্লাহর বাকিটা দিন সে অফিসকে দেবে সত্য কিন্তু বিষ্যুদবার বিকেলের পর থেকে শনিবার সকাল তক সময় একান্তই বউ-বাচ্চার। এই ভেবে টপাটপ পেছনের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে যায় মোরশেদ। এর আগে পিয়ন কি অফিসের কেউ সহাস্যে মোরশেদকে হয়তো বলে, স্যার কি বের হবেন না? কটকটানি মার্কা এক হাসি দিয়ে মোরশেদ বলে, না গেলে কী হয়? পুরা সপ্তাহের ওভারডিউ পরে আছে তো! সময়মতো আদায় করতে না পারলে যোগ হবে আরোকিছু বাড়তি পাওনা, যাকে বলে জরিমানা; একেবারে উসুল করা তখন মুশকিল হয়ে যায় বটে। এই কথার পর আর কোন কথা থাকতে পারে না এটা মোরশেদের নিন্দুকও বলবে  কিন্তু একটা অফিসে নানাপদের কথা হাওয়ায় গোত্যা খায় এটা পাঠকমাত্রই জানেন। ঝটপট এহেন উত্তরে আরেক দফা হাসে অফিসের কলিগেরা, বাদ যায় না অফিসের চেয়ার-টেবিলও। প্রিয় পাঠক, আমরা অনুমান করি, এতক্ষণে মোরশেদ দ্রুতপায়ে চলে গেছেন বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি কিংবা বাস স্ট্যান্ডেই। সেখানে লোকের ভীড়। তার মতো দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ। দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের সে বলে, হাফ-মানুষ। ফুল-মানুষ হলে তো ভাই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না, বসে, আরামসে যেত প্রাইভেট কারে এসির হাওয়া গতরে লাগিয়ে। আমরা দেখি, দক্ষিণ দিকে বাসের আগা দেখা যায় মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে মোরশেদ। তার আবার বেশিক্ষণ অপেক্ষার অভ্যেস নেই বলে চেনামহলে সুনাম আছে। সুতারাং রাস্তার পূর্বপাড়ে, বাস যেখানে থামে তার বিপরীতে পানের দোকান বরাবর ঠেসে মোরশেদ। দোকানীকে মিষ্টি জর্দাসমেত পানের অর্ডার করে সে। মনে রসের হাওয়া দেখা দিলে পান খায় মোরশেদ। পান চিবুতে চিবুতে ভাবের দুনিয়ায় তার হাজিরা দেয়া বউ-বাচ্চা। তারা নিতে বলে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্তর। বউ তো বলেই বসে, পুরো হপ্তা পরিশ্রম করে কোথাও অযথা আড্ডা দেবার কাম নাই, আপনে সোজা বাড়িত চলে আসবে, কইলাম! হয়তো পানমুখে বাসের দিকে আগাবে সে; সেইতক আমাদের দেখে আসার দরকার আছে মোরশেদের ঘরবাড়ি, বংশতরিকার দৃশ্যমান জানাশোনা।

মোরশেদের বাবার নাম জনাব খলিলুর রহমান। পেশা তার বিচিত্র রঙের। তবে তার মনের উপর কেউ কোনদিন জোর খাটাতে পারেনি। হতে পারে, সে জন্যই সাংসারিক সুখ থাকলেও তার পকেটে যথেষ্ট মালপানি ছিল না কখনো। শ্যাম বর্ণের লম্বা-চওড়া এই ভদ্রলোককে দেখলে এলাকার দুষ্টু পোলাপাইন সিনেমার খলনায়ক খলিল সাহেব বলে টাহর করে। ফলে, মোরশেদের বাবা এই বৃদ্ধ বয়সে, হয়তো চায়ের নেশায় পাড়ার দোকানে গেছেন কিংবা সদাই করতে স্থানীয় বাজারে; আরেঠারে শুনতে পান, তাকে খলনায়কের নাম নিয়ে কিছুটা হেয় করার চেষ্টা করছে তারা। তাতেও তিনি নিরব থাকেন। মোরশেদের বাবা মানেন, জগতের কোন কিছুই তার মতো চলবে এমন বিধান নেই। তাছাড়া মানুষের সাথে মিল-মহব্বত যত বেশি থাকে ততই মঙ্গল। বাবার এমন নামের কারণে মোরশেদকেও কোথাও কোথাও হাসির পাত্র হতে হয়েছে। ওই অলক্ষুণে সময়ে, মোরশেদ তার মরহুম দাদাকে গালি দিয়েছে কয়েক দফা। তার মা হনুফা খাতুন। জগতের কোন দুঃখবোধ  তাকে স্পর্শ করে এমনটা বোঝা যায় না মায়ের চেহারা দেখে। মোরশেদের বাবা, হনুফা বেগমের বর জনাব খলিলুর রহমান যখন যা পায় তাই করে গোছের হাঁটুরে পেশাদার হওয়ায় ঘরের পাতিলে সবসময় যে ভালো কিছু চড়তো তা নয়। তবুও চার-চারটে সন্তানাদি নিয়ে হনুফা বেগম ওরফে মোরশেদের মা কখনো দীর্ঘশ্বাস ছাড়েনি। তবে ঘরেরই কেউ কেউ, এমনকি হনুফা বেগমের চার নম্বর সন্তান মাজেদা আক্তারও মাঝেমধ্যে বলে, মা’র মনে অনেক কষ্ট। কীরকম সেটা? কেউ জিগালে পরে মাজেদা বলে, মা চেয়েছিল আমি যেন ছেলে হই কিন্তু হলাম গিয়ে মেয়ে! ঘটনা সত্য কি না সেটা যাচাই করার সুযোগ থাকে না আমাদের। মোরশেদ ওরফে খলিল সাহেবের বিসমিল্লাহ-সন্তান মোরশেদ জানান, তাদের মা-বাবার বিয়ের দেড় বছরের মাথায় সে দুনিয়ায় আসার ম্যালা বিরতির পর দুনিয়ায় তশরিফ আনে তার ছোটবোন সাহেদা আক্তার। মাঝখানের প্রায় পৌনে এক যুগের ব্যবধানে সাহেদা সংসারে আসার আগের পুরো সময়টা ছিল মোরশেদের দখলে। তার ইচ্ছাই হনুফা-খলিলের ইচ্ছা। মোরশেদের মেধা আর পড়ালেখার আগ্রহ দেখে বড়মামা নিয়ে যায় তাকে নানারবাড়ি। বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকায় মোরশেদের সংসার সম্পর্কে ধারণা আরো কিছু পোক্ত হয়ে যায় বাকি দশজন তার বয়েসী ছেলেমেয়ে থেকে। এর ফাঁকে আমরা দেখি, ঘরে মোরশেদ না থাকলে তার তিন বোনের হৈ-হল্লায় জেগে আছে হনুফা-খলিলের সংসার। মোরশেদ জানে, তার বাবা অতটা সংসারি না হলেও পরিবার পরিকল্পনার কথা বেশ ভালোভাবেই জানতেন। অথচ পড়শিরাও জানে না যে কথা, তা জানে মোরশেদ। তার পরে আর হয়তো দুটো সন্তান আসতো তার মায়ের কোলে কিন্তু অনুমানকে মিথ্যে করে দিয়ে অতিরিক্ত সংখ্যার পেছনে দায়ী তার মায়ের আকাঙ্ক্ষার আরেকটা ছেলে সন্তান! খলিল সাহেব কোনদিন স্ত্রীর উপর কথা বলেননি; তার রাগ-বিরাগ তাই দেখা যায়নি কখনো এ-বিষয়ে। হনুফা বেগম নিরালায় বসলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, নিজের পেটের দোষ দেন; আল্লাহকেও অপরাধীর তালিকায় রাখেন আরেকটা ছেলে সন্তান না দেয়ার অভিযোগে।

এবার নজর দেয়া যাক মোরশেদের বিগত সময়ের বুকে। নানার বাড়ির অন্ন ধ্বংস করা শেষ হয় তার নবমে উঠার কালে। মাদ্রাসার কাছেই জায়গির থাকে আমাদের মোরশেদ। বলা ভালো, চেহারা যেমন হোক, তার ছিল কণ্ঠের বৈভব। ফলে জায়গিরের পাশাপাশি টিউশনি না বাড়িয়ে মোরশেদ মাদ্রাসালাগোয়া মসজিদে মুয়াজ্জিনের খেদমতে জড়িয়ে যায়। বেশ ভালোই লাগে। একদা যারা কি না নিচু ক্লাসের ছোটভাই হিসেবে পাত্তা দিতো না, তারাই তাজিম করতে শুরু করে তাকে। মাদ্রাসার হুজুরেরা আলাদা কদর করে মোরশেদকে।এলাকায় তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের আগে। খলিলুর রহমান এসবে ছিল বেশ বেখবর। তিনি জানতেন, পুরুষ মানুষ কিছু একটা করে টিকে থাকবে; তার আওলাদ এত নাহান্দা নয় যে, খড়কুটোও ধরতে পারবে না। আজান দিয়ে, তাবিজ-কবজের কপালে মোরশেদের হাতে আসে কিছু টাকা। বলা চলে, ছাত্রকালে এই টাকা অসামান্য। মাঝেমধ্যে তার মাথা আউলে যেত জামানো টাকা দেখে। বাড়ি গেলে মা হনুফা বেগমের হাতে গুজে দেয় কিছু টাকা। মার চোখ জ্বলজ্বল করতো পুত্রের উপার্জন হাতে নিয়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে অন্তরের দোয়ায় সিক্ত করতো ছেলেকে। বোনদের স্কুল খরচ, নাস্তা খরচ দিতেই তার আনন্দ। এই সুখ মোরশেদের বেশদিন সহ্য হয়নি। কেউবা আতঁকে উঠবেন; দেশে এরচে মজার পেশা আর কি আছে, এতে কিসের অশান্তি আবার! মোরশেদ কি তবে ঠিকমতো মসজিদের মাইকে আজান দেয়নি? দেয়নি ফ্লোরে ঠিক টাইমে ঝাড়ু? নাকি মোতয়াল্লির সুন্দরি কিশোরীর দিকে দিয়েছে বদনজর? নানা কিছিমের অনুমান অসম্ভব কিছু নয় বিশেষত এই বয়েসী ছেলেদের কাছে। কিন্তু আমরা তলিয়ে দেখি তার একেবারে উল্টো ঘটনা। পাঠক দেখবেন মোরশেদ তখন দাখিল সনদ হাতে পেয়েছে। গা-গতরেও অনেকটা সেয়ানা। মসজিদ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবার পথে শুনে,  চা দোকানের আড্ডায় এক বুড়ার চরম বিরক্তিকর খিস্তি, ওই খানকির পুত মানুষ না, তার ধাত্রীর মারে চুদি, তার আজান দেওনেয়লার মারে চুদি… আচমকা এমন গালি শুনে বেকুব বনে যায় মোরশেদ। না, সে আর ওই মুখে বাড়ি যায়নি। নিজের মসজিদের দিকে আসতে আসতে কেবলই ভেবেছে, নবাগত সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর সে-ও তো কম আজান দেয়নি অত্র এলাকায়! সন্তান হলে ডাক পড়ে তার, এলাকার মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে এটা তার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। আজান শেষে হয়তো কিছু টাকা তার পকেটে আসে কিন্তু আজকে যে গালি পড়লো সমস্ত আজান দেওনেয়লাদের গায়ে তাতে বেশ অপমানবোধ করে মোরশেদ। নিজের মাকে গালি দিয়ে কে তবে খেদমতের গোয়া মারবে? টুপিটা পকেটে ভরে আগপিচ না ভেবে নগদে মসজিদ কমিটির সভাপতির দোকানে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বের হয়ে আসে মোরশেদ। সেই যে গল্পের নায়ক মোরশেদ মাদ্রাসা ছাড়লো আর ও-মুখো হয়নি। দাখিলের পর আলিমের বদলে একাদশ শ্রেনিতে নাম লেখায় সে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কলেজে।

মোরশেদের কলেজ-লাইফ খুব দ্রুত কেটে যায় আর দশটা ওই বয়েসির মতো। মোরশেদ হাতড়ে দেখে, এবতেদায়ী কি দাখিলে তার যে পরিমাণ বন্ধু বা চেনাজানা মানুষ ছিল তা হয়নি কি হয়ে ওঠেনি এইচএসসি থেকে ডিগ্রির সময়ে। আজব সময় বটে। যাওয়া-আসা আর একটা সনদ জোগানোর ধান্ধায় দৃষ্টি দেয়া হয়নি অন্যদিকে। তারউপর ছিল টিউশন নামক টেবিল-ব্যবসার রুটিনে বাঁধা নিয়ম। পোশাকআশাক বদলের সাথে মোরশেদের আমূল বদল স্বয়ং গর্ভে ধরা মা হনুফা বেগমই মেলাতে পারে না যেন। কিন্তু মোরশেদ জানে, তার বুকের বেদনা। ক্লাসমেটদের সাথে মিশতে পারতো না সে। ভেতর থেকে কে যেন তাকে বলে, তুই হলি গিয়ে মাদ্রাসাপড়ুয়া, টুপি-পাঞ্জাবি পরা লোক; এখানে জিন্স-টিশার্ট কি শার্টের ভেতর তোকে মানায় না মনু। অথচ কোন ক্লাসমেটই তাকে কোনদিন হেলা করেছে এমনটা চোখে পড়েনি, পারতপক্ষে ফারাকের নাম-নিশানা দূরে থাক গন্ধই পায়নি সে। নিজের কাছে ছোট হতে হতে একদিন মোরশেদের ছাত্রজীবনই ছোট হয়ে আসে! ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে সে ঢুকে পড়ে মার্কেটিং কোম্পানীতে। এ-ঘাট ও-ঘাট করে মোরশেদ এখন সুবর্ণরেখা এনজিওর গর্বিত এক চাকুরে। বলা ভালো, সিনিয়র ক্রেডিট অফিসার। মোটর বাইকে চড়ে কিস্তি আদায় আর ঋণ বিতরণের যত টার্গেটই থাকুক বেতন তো কম দেয়া কোম্পানি, এই মনোবাসনায় এখানে পড়ে আছে মোরশেদ। কত অভিজ্ঞতা দিয়েছে তাকে এই এনজিওর চাকরি! কত মানুষের মুখ জেগে আছে তার হৃদয়ে; আহ, প্রিয়তমা স্ত্রির কাছে সপ্তাহের দেড়দিন থাকলে সাড়ে পাঁচদিন থাকে তো মাঠেঘাটে। কেউ ডাকে ভাই, কেউবা স্যার। মোরশেদের মনেহয়, জগতের সবচে কঠিন কাজ মানুষের পকেট থেকে টাকা বের করে আনা। এই কঠিন কাজের ভেতর আনন্দ খুঁজতে গিয়ে কখন ব্যক্তিগত আনন্দ বিদেয় হলো তা টের পায় না তার মতো কোন এনজিও কি ক্ষুদ্রঋণে কামলা দেয়া কর্মী। কত নিরবে চলে যায় আয়ু, বদলে যায় ঠিকানা ভাববার ফুরসতই মেলে না! পাহাড়-নদী-সমতল শেষে তার চাকরিস্থল আজ হারাধন উপজেলায়।

আমরা দেখি, মোরশেদ বাসস্ট্যান্ডে অনেক্ষণ অপেক্ষা করে। সাথে তার মতো যারা ছিল বাসে উঠার অধীর অপেক্ষায় তারা প্রায় কেউ-ই নেই আর। ঝড়গ্রস্থ পাহাড়ের মতো ঢুলতে থাকে মোরশেদ, মনেমনে। যেই সময়ে আমরা ছিলাম মোরশেদের জ্ঞাতি-কুষ্ঠির পরিচয় উদ্ধারে ব্যস্ত, তখন দেখি তার মোবাইলের টোনটা বেজে ওঠে তারস্বরে। স্বামী-স্ত্রীর কথা শোনার রাইট নেই আমাদের, হোক না তা গল্পে; ফলে আমরা বিরত থাকি তাদের কথা-উপভোগ থেকে।  কেউ হয়তো বলবেন, যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানের ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায় সেখানে মোরশেদ কোন ছার! আরে ব্রাদার, আমরা সেই কিছিমের পয়দা নয় বলে অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারি সেসব। ম্যাংগোপিপল হলেও ইজ্জত আছে আমাদের। বাস স্ট্যান্ডের পান-দোকানদার কিন্তু খেয়াল করে মোরশেদের মুখ হঠাৎ করেই গোমরা হয়ে যায় ফোনের কথা শেষে। যে পান ধীরে চিবিয়ে খেতে তার এত আনন্দ, সেটা মুহুর্তে ফেলে দেয় রাস্তার ধারে। কেউ কেউ বলে, বাসের হেল্পার ডাইরেক মোরশেদ স্যার বলে ডাকও দিয়েছিল। সেদিকে নজর নেই মোরশেদের। তার শারীরিক ভাষা কেন ঠাস করে মূক হয়ে গেল, কেন সে ইচ্ছে করে মিস করলো বাড়িগামী বাস সে ব্যাখ্যা নিরব রাস্তা জানে কি না সেটা জিগাবে কে? মোরশেদের তেমন লড়াছড়া নেই আগের মতো সেটা টের পাই আমরা। আরে, মোরশেদ অফিসের দিকে যাচ্ছে বোধহয়? খেয়াল করি, যুদ্ধশ্রান্ত সৈনিকের মতো ধীরে আগাচ্ছে এই গল্পের মা-বাপ মোরশেদ। পথে অনেকেই সালাম দেয়, হাত তোলে; সেদিকে বিশেষ খেয়াল দেয় না সে। হাঁটতে হাঁটতে সে ঢুকে পড়ে হেসেল নামের অত্র বাজারের বিখ্যাত ও জ্যামময় হোটেলে। বেয়ারাকে অর্ডার দেয় এক কাপ দুধ চায়ের। অথচ আমরা বটে, মোরশেদের কলিগ, ঘনিষ্ঠ জনেরা জানে, তার প্রিয় পানীয় আদা-তেজপাতা-লেবু সহযোগে রঙচা। কলিগদের মধ্যে বিবাহিত কেউ দুধচা খেলে মুখ ভেংচে মোরশেদ বলতো, বাড়ি গিয়ে খান মিয়া দুধচা, এখানে রঙচা খাবেন; রঙচায়ে আছে প্রাণের খনি। এই প্রথম নিজের নিয়ম ভাঙে সে। হোটেল বয় চা নিয়ে আসলে এক প্যাকেট চিকেন বিরিয়ানির অর্ডার করে সে। রুমমেটদের কেউ আজ বাসায় থাকবে না এটা মহাসত্য। ভাঙামনে চুলায় মোরশেদ আগুন জ্বালাবে না এটা আরো বড় সত্য। অগত্যা রেডিমেট বিরিয়ানি প্যাকেটই ভরসা। পার্সেল হাতে নিয়ে অফিসমুখো রাস্তা ধরে হাঁটে সে। অফিসের দুই বিল্ডিং পরে তার বাসা। বাজারের উপরেই সব। একবার ভাবে অফিসে ওঠবে। পেন্ডিং কিছু কাজ এগিয়ে নেবে। সেইমতো পা বাড়ায়। সিঁড়িতে ওঠার আগে সামনে পড়ে অফিসের পিয়ন ইউসুফ। তার আবার মুখের লাগাম নেই বলে বেশ সুনাম আছে। ইউসুফের যাবতীয় দোষ মাপ হয়ে যায় তার কাজে, কাজের অভিজ্ঞতায়। মোরশেদ স্যারকে দেখে ইউসুফ অন্ধকারে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। কিয়ো স্যার, বাড়ি যান নাই? মোরশেদ দেখে, মার্কেটের রঙিন লাইটগুলোর আলোয় চমৎকার দেখাচ্ছে সওদাপাতি। মাথা চুলকায় তবু সে এসবের ভেতর। একবার নিজের ছায়া দেখা যায় কি না পরখ করে। এত আলোর ভেতর মানুষরে ওজনই বুঝি বেশকম হয়ে যাবার দশা, সেখানে আবার ছায়া! ফট করে মুখ ফসকে মোরশেদ ইউসুফকে বলে বসে, আরে বইলেন না ইউসুফ, ঘরে লাল পতাকা উড়ছে, বাড়ি যাবো কেমনে? মুখ পাতলা ইউসুফও ভেবে পায় না একথার কোন জবাব আছে কি না। তার মুখের আগায় প্রায় চলেই আসে, একদিন না হয় ভাবী অসুস্থ্য হলো, হতেই পারে, তাই বলে বাড়ি যাবেন না? পুরুষ মানুষ এমনই, আগাগোড়া স্বার্থপর। তবে মুখে আসা কথা নিরবে গিলে ফেলে ইউসুফ। সে দেখে, মোরশেদ স্যারের চোখ একেবারে নিচের দিকে, যেনবা পরখ করছে বহু চেনা নজর না-পড়া পায়ের নখগুলোর দিকে।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

গুবরে ফড়িং শুধু উড়ে যায় আজ

গুবরে ফড়িং শুধু উড়ে যায় আজ এই সন্ধ্যার বাতাসে, খড়কুটা ঝড়ে শুধু শাইকের মুখ থেকে চুপে। আবার শালিখা, সেই খড়গুনো

গল্প

সাত ভাই চম্পা

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ১. এক রাজার সাত রাণী। দেমাকে বড়রাণীদের মাটিতে পা পড়ে না। ছোটরাণী খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোটরাণীকে

কবিতা

মৃত্যুমুখী পাখির সমাবেশ

ইমরান মাহফুজের দুটি কবিতা ‘মৃত্যুমুখী পাখির সমাবেশ’ ও ‘দুঃখবোধের সমাজ’ মৃত্যুমুখী পাখির সমাবেশ মা– দিন শেষে আমায় আর ডেকো না

বই

সেই সময়: সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাস

পলাশ মজুমদারের বই পর্যালোচনা সেই সময়: সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাস সাম্প্রতিককালের উভয় বাংলার সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক প্রবাদপ্রতিম কথাশিল্পী। কথাসাহিত্য ও