বিশ্বসাহিত্যে গল্পের ইতিহাস অনেক পুরোনো। সেই তুলনায় বাংলাসাহিত্যে শিল্পমানসম্পন্ন গল্পের সূচনা হয় আধুনিক যুগে। বাংলাসাহিত্যে ছোটগল্পের যাত্রা ঠিক ছোটগল্পের আঙ্গিকে হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসধর্মী কিছু লেখায় [যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), রাধারাণী (১৮৮৬)] ছোটগল্পের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। তারপর গল্পগোত্রের লেখা হিসেবে চিহ্নিত হয় পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতি’। ‘মধুমতি’ কথাদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১২৮০ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। তারপর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বর্নকুমারী দেবী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রমুখ কথাশিল্পীর হাতে ছোটগল্পের প্রাথমিক ভিত্তি নির্মিত হয়। মূলত রবীন্দ্রযুগেই বাংলা গল্প আলাদা পরিচয়ে শিল্পযাত্রা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথই প্রথম গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে একটি ভেদরেখা টানেন। এর ফলেই গল্প ও উপন্যাস আলাদা আঙ্গিক লাভ করে।
ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত, আত্মনির্মাণ, আত্মবিসর্জন, সামাজিক সংকট ও সামাজিক শাসনে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিনষ্টি এবং এর ফলে মানবাচরণের সামূহিক পরিবর্তন সমকালীন বাংলা গল্পের জগতকে করে তুলেছে বহুবর্ণিল। বাংলা গল্প ক্রমশ হয়ে উঠেছে জীবনঘনিষ্ঠ । জীবনের জটিলতা, মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব, প্রথাবিরোধী মনোভাব, ব্যক্তি ও সমাজের বিরুদ্ধ অবস্থানজনিত সংকট রবীন্দ্রযুগে শুরু হলেও রবীন্দ্রপরবর্তী গল্পেও এই সংকট এসেছে প্রবলভাবে। কথাসাহিত্যে গল্পের পাশাপাশি দাপটের সাথে এগিয়ে এসেছে উপন্যাস। প্রথম পর্যায়ের অনেক গল্পই ছিল উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। পরবর্তী সময়ে গল্প ও উপন্যাসের পার্থক্য স্পষ্ট হলে উপন্যাসের জনপ্রিয়তা হেতু অনেক গল্পকার উপন্যাস লিখতে শুরু করেন এবং উপন্যাস লিখেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাই অনেক গল্পকার পাঠকমহলে ঔপন্যাসিক হিসেবেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছেন। যাহোক, বাংলাসাহিত্যের আধুনিক আঙ্গিক হিসেবে ছোটগল্পের অগ্রযাত্রাও ঈর্ষনীয়। স্বল্পায়তন ও আখ্যানভাগ ব্যাপক-বিচিত্র না হওয়ার কারণে ছোটগল্প পাঠককে হয়রান করে তোলে না। উপন্যাসের কিছুটা স্বাদও লাভ করতে পারেন পাঠক। কারণ, গল্প ও উপন্যাসের একই নির্মাণশৈলী, একই ভাষাকাঠামো। পার্থক্য হলো একটি ক্ষুদ্রায়তন ও অপরটি বৃহদায়তনবিশিষ্ট। গল্প যেখানে পুত্তলিকা, উপন্যাস সেখানে প্রতিমা। যাহোক গল্পের স্বরূপ বা সংজ্ঞা নিয়ে আছে নানা মত। গল্পকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সাহিত্যবোদ্ধাগণ। রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা’র পরও ছোটগল্প নিয়ে নানা নিরীক্ষা হয়েছে। এসব নিরীক্ষা ছোটগল্পের শরীরে নতুন পালক যুক্ত করলেও ছোটগল্পের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রয়েছে। ফলে ছোটগল্প হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের একটি প্রধান আঙ্গিক।
রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্ম ব্যক্তিমানুষের কল্যাণে কাজ করে। মানুষও মানুষের কল্যাণে কাজ করে। এর অন্যথা হলে ব্যক্তিজীবনে নেমে আসে অশান্তি, অতৃপ্তি ও নানা সংকট। ব্যক্তিচিন্তায় যুক্ত হয় ক্ষোভ, হতাশা, দ্রোহ বা বিরুদ্ধবাদিতা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যক্তির এই নানামাত্রিক নেতিবাচক প্রবণতাকে নিরীক্ষা করেন একজন গল্পকার। চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতির বাঁকবদল ও অর্থনৈতিক স্তরবিন্যাসের প্রভাব নির্মোহভাবে নিরীক্ষা করলেই গল্পকার চলমান সময়ের বাস্তবতা খুঁজে পান। এই বাস্তবতা থেকে গল্পের প্লট নির্বাচন করেন একজন সময়সচেতন গল্পকার। পাঠকমাত্রই বর্তমান সময়ের ব্যক্তিসত্ত্বা। তাই বর্তমানকে পরিহার করে পাঠকের সাথে একাত্ম হওয়া কঠিন ব্যাপার। গল্পের ভাব, ভাষা, বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলী সমকালীন না হলে পাঠক গল্পপাঠে নিষ্ঠা অর্জন করতে পারেন না। অতৃপ্তিবোধ করেন বলে গল্পটাকে নিজের ভেতর নিতে পারেন না। তাই দ্বিতীয়বার পড়ার আগ্রহ জাগে না পাঠকমনে।
স্বল্পতম ব্যাপ্তির মধ্যে বৃহত্তম ভাবের সন্ধান করেন গল্পের পাঠক। গল্পকে সেই বৃহত্তম ভাবের অধিকারী করে তোলা গল্প লেখকের প্রধান কাজ। লেখকের দৃষ্টির সাথে পাঠকের দৃষ্টির মিল হওয়াটা জরুরি। পাঠকেরও একটি চিন্তার জগত আছে। গল্পের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুকে পাঠক তার সেই নিজস্ব চিন্তার জগতের সাথে মেলাতে চান। তাই গল্প যখন পাঠকের সেই চিন্তাকে আশ্রয় করে নির্মিত হয় তখনই গল্প পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। এখন প্রশ্ন হলো, পাঠকের হৃদয়স্পর্শী না হলে কী সেটা সার্থক গল্প হয় না? অনেক শিল্পসফল গল্প অনেক সময় পাঠকনন্দিত হয় না। গল্পের লেখক যদি শুধু পাঠককে নিয়ে ভাবেন তাহলে লেখক তাঁর ব্যক্তিচিন্তাকেও পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে লেখকের নিজস্ব দায়বদ্ধতার জায়গাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই একটি গল্পের শিল্পসফল নির্মিতির ক্ষেত্রে গল্পকারের ব্যক্তিচিন্তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। পাঠক কিছুটা গ্রহণ করবে, কিছুটা করবে না। ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা হেতু পাঠক প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন হবে। তবে একটি গল্পকে একটি শিল্পকর্ম করে গড়ে তোলার দায় গল্পলেখকের নিজের। গল্পলেখক ব্যক্তির নানামাত্রিক প্রবণতা, নানামাত্রিক সংকট, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তি ও সমষ্টির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, পরিবেশ-প্রতিবেশ ইত্যাদি নিরীক্ষা করে এবং এসব থেকে গল্পের উপাদান সংগ্রহ করে গল্প নির্মাণ করেন। গল্পে প্রাণপ্রতিষ্ঠার জন্য ভাষার লালিত্য ও বিষয়ের তীব্রতা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমকালীন ভাষা ও সমকালীন বিষয় গল্পকে করে তোলে প্রাণবন্ত।
ছোটগল্পের স্বভাবধর্মই হলো যাপিত জীবনের সংকট, সম্ভাবনা ও পরিণতিকে উন্মোচন করা। এই স্বভাবধর্মই ছোটগল্পকে ক্রমশ জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছে। অসঙ্গতি, সংকট, স্ববিরোধিতা ব্যক্তির স্বভাবধর্মকে বদলে দেয়। ফলে ব্যক্তিসম্পর্কের অবক্ষয় ঘটে। এই অবক্ষয় থেকেই একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে ব্যক্তিজীবনকে। প্রবলভাবে জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পমাধ্যম হিসেবে ছোটগল্পে ব্যক্তিজীবনের এই সংকটগুলোকে তুলে আনা জরুরি। এর ব্যত্যয় ঘটলে গল্প ঋদ্ধ পাঠকের প্রাণস্পর্শ করতে পারবে না। একজন প্রকৃত গল্পকারকে ব্যক্তিসংকটকে নিরীক্ষা করতে হয় নির্মোহভাবে; সমাজকে নিরীক্ষণ করতে হয় সামগ্রিকভাবে; চলমান সময়কে নিরীক্ষণ করতে হয় অতীত ও ভবিষ্যতের সাথে সেতুবন্ধন তৈরি করে। গল্পকার তাঁর নিরীক্ষিত বিষয়ের শিল্পিত প্রকাশ ঘটান গল্পে। তাই আধুনিক গল্পে রূপকথা বা ফ্যান্টাসির স্থান খুব অল্প। সামগ্রিক জীবন ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলির নির্মোহ নিরীক্ষা সমকালীন গল্পের প্রাণ। এই নিরীক্ষায় ঘাটতি থাকলে গল্প প্রাণবন্ত সর্বাঙ্গীন শিল্পসফল হয় না।
ছোটগল্পের প্রথম বাঁকবদল বা গতিপথের পরিবর্তন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ছোটগল্প ছিল প্রধানত চিত্তবিলাসী ও নান্দনিক। কল্পকাহিনি বা ফ্যান্টাসি ছিল তখনকার গল্পের মূল আকর্ষণ। গল্পের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুতে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন ঘটেনি বলে সে সময়ের গল্প ছিল একমুখি। চিত্তসুখ বা আনন্দ লাভ করাই ছিল তখনকার গল্পপাঠকদের মূললক্ষ্য। গল্পলেখকগণ পাঠকের সে চাহিদাই পূরণ করতেন। সমাজবাস্তবতা ও জীবনের জটিলতা তখনও অতটা স্পর্শ করেনি গল্পের শরীর। তবে সময় সবকিছু বদলে দেয়। বদলে যায় পাঠকের রুচি ও ভাবনার জগৎ। আর এই বদলে যাওয়াটাকেই গ্রহণ করেন একজন সময়সচেতন গল্পকার। সেটা করতে গিয়ে ধীরলয়ে পরিবর্তিত সমাজচিত্র তুলে ধরেন। নান্দনিকতার সাথে যুক্ত করেন সময়বাস্তবতা। এতে গল্প অর্জন করে নতুন শক্তি। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক প্রথাকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করার শক্তি অর্জন করে বাংলা ছোটগল্প। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) ও রুশ বিপ্লব (১৯১৭) বিশ্বের সাথে চিরায়ত ভারতীয় সমাজকেও প্রভাবিত করে। সমাজবদলের বৈশ্বিক ঢেউ ভারতীয় সমাজকেও নাড়িয়ে দেয়। বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন সংকট নিয়ে, ভিন্ন ভাব-ভাষা-বিষয়বস্তু নিয়ে বাংলা ছোটগল্প তার গতিপথ বদলায়। এই বদলে যাওয়া সমাজমানসের প্রতিনিধিত্ব করেন তিরিশ ও চল্লিশ দশকের একঝাঁক গল্পকার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ব্রিটিশবিরোধী এই রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে এক নতুন ধারার প্রতিবাদী সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে। বিপ্লবীচেতনায় সমৃদ্ধ এই মানবতাবাদী সাহিত্য ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জাতীয়মুক্তির কথা বলে। শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশোষণ, ব্যক্তিসংকট, সামাজিক ক্ষয়-অবক্ষয় ব্যক্তিচিন্তাকে করে তোলে বিক্ষুব্ধ। এই বিক্ষুব্ধ চেতনাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দেয় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ত্বরান্বিত করে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানামাত্রিক সংকট, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও টিকে থাকার সংগ্রামকে উপজীব্য করে নির্মিত হয় অনেক গল্প। মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, শোষণ-নির্যাতন, সামাজিক শোষণ, শিল্পায়নের প্রভাবে সামাজিক ভাঙন, যাপিত জীবনের বাঞ্চিত-অবাঞ্চিত পরিবর্তন, হতাশা-গ্লানি-অস্থিরতা ইত্যাদির চিত্রও উঠে আসে এই কালপর্বের গল্পে।
সাতচল্লিশের দেশভাগ ব্রিটিশভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি নির্মম ঘটনা। দেশভাগের ফলে দেশত্যাগ একটি মানবিক বিপর্যয়ের দলিল। সাতচল্লিশপরবর্তী এই দিখণ্ডিত বাংলার বিকলাঙ্গতা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও বিকল করে তোলে। বাংলাসাহিত্যের ইসলামিকরণ করার প্রচেষ্টা এপার বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশকে থমকে দেয়। সেই জাতীয় সংকট থেকে জন্ম নেয় এক ভিন্ন সমাজমানস। এপার বাংলা ও ওপার বাংলার ছোটগল্প এই সমাজমানস ও ব্যক্তিসংকটকে ধারণ করে আর একবার গতিপথ পরিবর্তন করে। এই দ্বিখণ্ডিত বাংলার উভয় অংশের অনেক মানুষ নিজবাসভূমে পরবাসী হয়ে যায়। কেউ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কেউ নিজ দেশেই দেশহীন হয়ে পড়ে। উভয় বাংলায় যারা দেশত্যাগের শিকার হয় তাদের মর্মবেদনা সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে অক্ষয়মূর্তি লাভ করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নীতি-আদর্শিক বিচ্যুতি, অস্তিত্বের সংকট ও রক্ষণশীল মনোভাব দেশভাগপরবর্তী গল্পে প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়। ভাষা আন্দোলন, শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান- এ সব রাজনৈতিক আন্দোলনে সমাজবদলের সুর ধ্বনিত হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- এই কালপর্বে ছোটগল্প নতুন সমাজনিরীক্ষার মুখোমুখি হয়। বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থা, স্বৈরশাসন, অর্থনৈতিক শোষণ, মানবিক মর্যাদার বিনষ্টি এ কালপর্বের সাহিত্যকে করে তোলে প্রতিবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ। আঙ্গিক সচেতনতা, নতুন ভাষাকাঠামো ও নিরীক্ষা প্রবণতা এ সময়ের গল্পকে ভিন্নমাত্রায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে।
একাত্তর পরবর্তী ছোটগল্প আর এক নতুন বাঁকে চলে আসে। এই বাঁকবদলের ফলে বাংলাদেশের ছোটগল্প যে গতিপথ লাভ করে সে পথেই চলছে সমকালীন ছোটগল্প। নতুন দেশ প্রাপ্তির স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নিয়ে শুরু হলেও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা যুগমানসকে পাল্টে দেয়। পাল্টে দেয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের চরিত্র। রাজনীতির নতুন বিন্যাসের ফলে সাহিত্যও ধারণ করে নতুন মেজাজ। নতুন নিরীক্ষায় সাহিত্য হয়ে ওঠে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ফলে নব্বইপরবর্তী সাহিত্য আবার গণমুখি হয়ে ওঠে। ব্যক্তিসংকট, ধর্মান্ধতা, যৌনচেতনা, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির মনোজাগতিক দহন ও নিঃসঙ্গতা এ সময়ের গল্পকে করে তোলে বিপুল বৈচিত্র্যের অধিকারী। কিন্তু এই বৈচিত্র্য কোন জাতীয় চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি। আসলে নব্বইপরবর্তী বাংলাদেশের ছোটগল্প কোন গতিপথ খুঁজে পায়নি। ধারণ করার মতো কোন জাতীয় চেতনা যুগমানসকে প্রভাবিত করতে পারেনি বলেই এ যুগের গল্প ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে গেছে। তাই আজও ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিপ্লবীচেতনায় সমৃদ্ধ গল্পগুলো পাঠককে টানে। আজও দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনায় সমৃদ্ধ গল্পগুলো পাঠককে আলোড়িত করে। আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ গল্পগুলো পাঠককে নাড়িয়ে দেয়। আজও কোন গল্পে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের গন্ধ থাকলে পাঠক নড়েচড়ে বসে। বিভিন্ন কালপর্বের গল্পের দিকে পাঠকের এই মনোযোগই সমকালীন গল্পের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সমকালীন গল্পকে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে।
সমকালীন গল্প কোন জাতীয় চেতনাকে ধারণ করতে পারছে না। কারণ এখন কোন জাতীয় চেতনায় বিক্ষুব্ধ হচ্ছে না মানুষ। মানুষ এখন বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিসংকট নিয়ে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী মনোভাব ব্যক্তিকে প্রবলভাবে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। ব্যক্তিচিন্তা বিশেষ বিশেষ গতিপথে চলছে। আবার সে গতিপথও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। চিন্তা-চেতনার ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে জাতীয় সংকট প্রয়োজন সে জাতীয় সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে না জাতি। জাতীয় সংকটের চেয়ে ব্যক্তিসংকটই এখন মানুষকে বেশি তাড়িত করছে। পুঁজিবাদের প্রভাব ও আনুকূল্য একটি শ্রেণিকে অতি বিত্তবান করে তুলছে। অন্যেরা পিছিয়ে পড়ছে ক্রমশ। ফলে এখন সংকট মানেই ব্যক্তিসংকট। জাতীয় সংকট বলে কিছু নেই। তাই জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ গল্প এখন নির্মিত হচ্ছে না। গল্পের লেখক এখন নিজেকেই নির্মাণ করতে পারছেন না। নিজের মানসিক নির্মাণটা সঠিকভাবে না হলে গল্প নির্মাণে পূর্ণতা আসে না। গল্পের অবকাঠামো নির্মাণ করা আর শিল্পমানসম্পন্ন গল্প লেখা এক কথা নয়। একটি ঘটনাকে কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে গল্পের অবকাঠামো নির্মিত হয়। কিন্তু গল্পটিকে শিল্পিত করার জন্য প্রয়োজন একটি টেনশন। এই টেনশন যখন চরিত্রগুলোকে পাঠকের সমান্তরালে দাঁড় করাবে তখন গল্প জীবন্ত হয়ে উঠবে পাঠকের সামনে। পাঠক তখন গল্পটি বার বার পড়বে।
গল্পের কাঠামো আর গল্প এক জিনিস নয়। কাঠামো নিষ্প্রাণ, কিন্তু গল্প প্রাণবন্ত। সমকালীন অনেক গল্প শুধু গল্পের কাঠামো। সেগুলো দ্বিতীয়বার পড়ার তাড়না অনুভব করে না পাঠক। গল্পের প্লট সমকালীন সংকট থেকে নির্বাচন করা হলেও সংকটটি সামগ্রিকভাবে প্রতিফলিত না হওয়ার কারণে গল্পে আবেগের পূর্ণতা আসে না। সংকটটিকে তখন জীবনের সাথে মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। গল্পের চরিত্রগুলো স্ব স্ব ভূমিকা পালন করলেই চরিত্র সার্থক হয় না। চরিত্রগুলোর মনোজাগতিক প্রবণতাগুলো উন্মোচিত হওয়া জরুরি। শুধু সংলাপ দিয়ে চরিত্রগুলো জীবন্ত করে তোলা যায় না। চরিত্রগুলোর যাপিত জীবনকে এমন একটি টেনশনের আওতায় আনা প্রয়োজন যার মাধ্যমে একটি চরিত্র অন্যান্য চরিত্রগুলোর সাথে অনিবার্যভাবে সম্পর্কিত হয়ে যায়। সমকালীন গল্পগুলোতে এই বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে আসছে না বলেই গল্প প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। যে গল্পটি পাঠক বার বার পড়ার তাড়না অনুভব করে না সে গল্পটি কালোত্তীর্ণ হতে পারে না। পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবে ব্যক্তি এখন এতোটাই বিচ্ছিন্ন যে কোন সামষ্টিক চেতনা তাকে আর তাড়িত করে না। সংকটগুলো এখন একান্তই নিজস্ব। তাই সংকট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি আর সমষ্টির কাছে যায় না। ফলে সামষ্টিক চেতনা বলতে এখন তেমন কিছুই নেই। সামষ্টিক চেতনা ছাড়া সাহিত্য কোন গতিপথ খুঁজে পায় না। সামাজিক পরিবর্তন ব্যক্তিচেতনাকে নানামূখি করে তুলেছে বলেই একটি বিশেষ গল্প বা একটি বিশেষ সমাজচিত্র সাধারণ পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারছে না। ফলে পাঠক গল্প পড়ছে প্রচুর। ভুলেও যাচ্ছে একইভাবে।
সমকালীন গল্পে সবকিছুই আছে। অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ, অতি সুন্দর থেকে অতি কুৎসিত- কোন বিষয়ই বাদ পড়ছে না। সকল কিছুই এখন গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। একজন লেখকের অনুসন্ধানের সীমা এখন ব্যক্তির মনোজগত থেকে মহাকাশ পর্যন্ত। এই বিশাল প্লট থেকে গল্পের লেখক অনুসন্ধান করেন একটি ঘটনা ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি বা চরিত্র। চরিত্রগুলো সমাজের এক একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। শ্রেণিবিভাজিত সমাজে কোন গল্পই তাই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। আবার একটি শ্রেণিতে স্বার্থের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা দেখা দেয় স্বাভাবিকভাবেই। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে অভিন্ন চিন্তার অনুসারী একটি পাঠকমণ্ডলি তৈরি না হলে শুধু গল্প কেন- কোন সাহিত্যকর্মই পাঠকের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে না। চিন্তার ভিন্নতাকে পরিহার করে পাঠককে অভিন্ন চিন্তার আওতায় আনার জন্য যে জাতীয় সংকট বা জাতীয় সংকটপ্রসূত জাতীয় চেতনার প্রয়োজন সেই জাতীয় চেতনার অভাবেই যে কালোত্তীর্ণ গল্প সৃষ্টি হচ্ছে না এ কথা অনেকাংশেই সত্য। এটা শুধু লেখক-পাঠকের সমস্যা নয়; এটা যুগমানসের সমস্যা।
লেখক বিক্ষুব্ধ হলেই তাঁর হৃদয়ে বুদবুদ সৃষ্টি হয়। প্রকাশ করার একটি ব্যাকুলতা পেয়ে বসে লেখককে। বিক্ষুব্ধ লেখক মানেই প্রকৃত লেখক। অন্যায়, অনিয়ম, অসঙ্গতি, শোষণ, নির্যাতন একজন প্রকৃত লেখককে বিক্ষুব্ধ করবেই। প্রথাগত লেখক কখনো বিক্ষুব্ধ হন না। তাঁরা কালস্রোতে গা ভাসিয়ে চলেন। প্রথাগত বিষয় নিয়ে নান্দনিক সাহিত্য নির্মাণ করেন। কিন্তু বর্তমানে সাহিত্য শুধু নান্দনিক মূল্য বহন করে না। মানবজীবনের তমসাবৃত দিকটিকে উন্মোচন করাও সাহিত্যের কাজ। ফলে লেখককে উভয় দিক সামলাতে হয়। যাপিত জীবনের কদর্য দিকগুলো সাধারণত প্রথাবিরোধী। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় এই প্রথাবিরোধী বিষয়গুলো নির্মোহভাবে সাহিত্যে তুলে আনা একজন লেখকের সামাজিক দায়িত্ব। তবে এই তুলে আনার কাজটি মার্জিত ও শিল্পিত হতে হবে। সমাজবাস্তবতার চিত্র যতই কদর্য হোক, সেটাকে শিল্পিত করেই উপস্থাপন করতে হবে সাহিত্যে। সমকালীন গল্পে সমাজবাস্তবতার চিত্র অতিশয় নগ্নভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতা যতটা প্রবল, গল্পকে শিল্পিত করার প্রবণতা ততটা প্রবল নয়। ফলে গল্প যতটা বক্তব্যধর্মী, ততটা হৃদয়গ্রাহী নয়।
ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধকে লালন করে। ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা মানুষের মনোজাগতিক দুরত্বকে বাড়িয়ে দেয়। চেতনার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না বলে লেখকরাও আজ পরস্পর বিচ্ছিন্ন। সম্মিলিতবোধের বিকাশ না হলে সাহিত্য বহুগামী হয়ে যায়। এই বহুগামিতা বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু কোন বোধের বিকাশ ঘটাতে পারে না বলে তা পাঠকমনে স্থায়ী আসন লাভে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার দায় শুধু লেখক-পাঠকের নয়। এর জন্য যুগমানসকেও দায়ী করা চলে। সমকালীন সমাজব্যবস্থা প্রধানত পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের কথা বলা হয় তা মূলত অবকাঠামোগত জাগতিক সমাজ। মনোজাগতিক চেতনাবাহী কোন সমাজ নয়। ফলে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি পুঁজিবাদের লেজুড় হয়ে টিকে থাকে। এই টিকে থাকা মানে চেতনাহীন হয়ে টিকে থাকা। এ কারণেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বাইরে যতটা সরব, ভেতরে ততটাই নীরব। উপাদানে-অবয়বে যতটা আকর্ষণীয়, ভেতরে ততটা প্রাণবন্ত নয়।
গল্পকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পাঠকের মানসিক প্রস্তুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানসিক প্রস্তুতি না থাকলে গল্পের ভেতরে ঢুকতে পারবেন না পাঠক। এখন প্রশ্ন হলো কে পাঠককে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবে? রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, ব্যক্তিসম্পর্কের নানামাত্রিক ঘাত-প্রতিঘাত ও সামূহিক সংকট একজন পাঠকের মানসগঠনে বা মানসিকভাবে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তির আর্থিক অবস্থানও তার আগ্রহের বিষয়টিকে নির্ধারণ করে। একজন সংকটাপন্ন ব্যক্তির আগ্রহের সাথে একজন স্বচ্ছল ও সংকটমুক্ত ব্যক্তির আগ্রহ কখনো মিলবে না। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ভিন্ন হলে ব্যক্তির মানসকাঠামোও ভিন্ন হয়ে যায়। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা ব্যক্তিচিন্তার প্রতিকূল হলে ব্যক্তি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ব্যক্তির আগ্রহ ও ব্যক্তিচিন্তার ভিন্নতা পাঠককে এতোটাই স্বতন্ত্র করে তুলেছে যে একটি গল্প সাধারণ আবেদন নিয়ে সাধারণ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন মানসকাঠামো কোন কালেই কোন সার্বিক চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি। একটি গল্প যে খণ্ডিত সমাজচিত্রকে তুলে ধরে কোন পাঠক সেই খণ্ডাংশের আওতায় পড়লেই কেবল গল্পটিকে হৃদয়ে ধারণ করবে। অন্যেরা শুধু পড়ে যাবে, কিন্তু মনে রাখবে না। বলা যায়, মনে রাখতে পারবে না। এ জন্য পাঠককে দায়ী করা চলে না। দায়ী করা চলে না লেখককেও। একই পরিমণ্ডলে অবস্থান করে ভিন্ন ভিন্ন চেতনা লালন করার ফলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। সমাধানের জন্য প্রয়োজন চেতনার ঐক্য। চেতনার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলেই গল্প সঠিক গতিপথ লাভ করবে।